রাব্বিআল্লাহ্--আল্লাহ্ই আমার একমাত্র রব্ব-সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক। রাব্বি আ’উযুবিকা মিন হামাযাতিশ শায়াতিন,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা দয়াময়, অসীম দাতা ও দয়ালু মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের জন্য, যিনি জগতসমূহের একমাত্র রব্ব। আমরা তাই সেই মহান রব্বের’ই শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করছি।
অগনিত দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর সর্বশেষ নাবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি।
যিনি নিজে অনাথ হয়েও সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য হয়েছেন রহমত-রাহমাতাল্লিল আ’লামীন। যিনি উম্মী হয়েও সমগ্র জগতবাসীর জন্য হয়েছেন শিক্ষক। যাঁর অনুসরণ মানেই মহান আল্লাহ পাকের অনুসরণ।
আল্লাহ পাকের অফুরন্ত শান্তি অবিরাম ধারায় বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সহচরগণের উপর।
আদম শুমারীর হিসেব-নিকেষ বলছে আমাদের এই দেশ-বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টদের দেশ অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম (১০০জনে প্রায় ৯০জন)।
আমাদের স্র্রষ্টা প্রদত্ত আকল বা জ্ঞান বলছে কোন দেশ যদি মুসলিম প্রধান দেশ হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই সে দেশে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং দ্বীন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের মুসলিম নামধারী শাসক আর শাসিতদের দ্বীনের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, মুসলিম দাবী করার পরও সমাজ বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সালাত কায়েম নেই, যাকাত আদায় হচ্ছে না আর সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পারিবারিক ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত মুসলিম আইনের আংশিক প্রয়োগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আইন-বিধান অনুপস্থিত। প্রকৃতপক্ষে নামধারী ৯০% মুসলিমের মধ্যে অধিকাংশই ব্যক্তিগত সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি ইবাদাতের বাইরেও ইসলাম যে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি চির আধুনিক যুক্তিগ্রাহ্য পরিপূর্ণ দ্বীন-জীবন ব্যবস্থা সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই রাখেন না। সুতরাং যারা দ্বীন পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের জন্য সর্বাত্মক দাওয়াতের বিকল্প নেই। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ, র্শিক, রুবুবিয়্যাহ্, উলুহিয়্যাহ্ সম্পর্কে চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে।
তাই অধিকাংশ মানুষের ঈমান ও চরিত্রের ইসলাহ্ (সংশোধন) ব্যতিরেখে বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বা চেষ্টা করাটা হবে পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত সালাত আদায়ের শামিল। এরূপ প্রচেষ্টা দ্বীন প্রতিষ্ঠায় মানুষের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করলেও বাস্তবে সংকট ডেকে আনা ব্যতীত ভিন্ন ফল দেয় না। উপরন্তু দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ জনগণ দিনকে দিন ইসলাম বিরোধী হয়ে পড়ে এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের সাথে সচেতন ভাবেই শত্র“তা প্রকাশের পাশাপাশি তাদের ঠেকাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে একাট্টা হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
আজকে আমাদের দেশের অধিকাংশ পন্ডিত (Scholar) ব্যক্তিবর্গ ইসলামকে শান্তির ধর্ম, কল্যাণের ধর্ম, Complete Code of Life প্রভৃতি বিশেষণে বক্তৃতা, বিবৃতিতে উপস্থাপন করে থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য বাস্তব কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। এ দেশে আল্লাহর একক সার্বভৌমত্ব এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার পেছনে এই সকল পন্ডিতদের আচরণও কম দায়ী নয়।
পৃথিবীব্যাপী ইসলাম বিরোধীদের নিকট এরা আবার মডারেট মুসলিম নামে পরিচিত। এই তথাকথিত মডারেট মুসলিমদের দ্বারা এনেসথেসিয়া কৃত জনগণের ঈমান যেন আর জাগতে চায় না। এই ঈমান জাগিয়ে তোলার জন্যই এত কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক লেখালেখি, সভা-সেমিনার, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে যাওয়া সহ বিভিন্ন ঘটনা। তবুও আমরা কেন জানি একেবারে ঘুমিয়ে গেছি। তথাকথিত আলিমদের অন্ধ আনুগত্যই যেন সব থামিয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থার উত্তরণে আজ আমাদের কুরআন ও হাদীস মাতৃভাষায় চর্চা না করার ফল হচ্ছে, কতিপয় ‘উলামায়ে ছু’দের উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সাধারণ বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষরা পড়ছে ও শুনছে এবং ঐ লেখা ও কথাকে মানদন্ড ধরছে। কেননা সে লেখা ও কথা প্রকাশিত এবং প্রচারিত হচ্ছে মানুষের পরিচিত কোন বিরাট প্রকাশনা সংস্থা ও মিডিয়ায় মাধ্যমে। দুঃখজনকভাবে যার শতভাগ শিকার ছিলাম আমি নিজেই। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এদের দ্বারা গড়া আমার মনন ছিন্ন করতে; বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে প্রকৃত সত্য’কে মজবুত করে আঁকড়ে ধরতে। এজন্য প্রায়শঃই হৃদয়ের গহীণে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, হয় নীরব রক্তক্ষরণ।
এজন্য মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অসহায়ও মনে হয়, আর ইবরাহীম খলিলুল্লাহ’র অসহায়ত্বের অবস্থাটি বার বার চোঁখের সামনে ভেসে উঠে। যখন তিনি সৃষ্টির মাঝে আপন সত্য রব্বকে খুঁজে ফিরে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তখন আমার দু’চোখ বেয়ে দর-বিগলিত ধারায় অশ্রু নেমে আসে, ইবরাহীম খলিলুল্লাহ’র ন্যায় আমি অধমও মহান মালিকের প্রতি সিজদায় পরে যাই, আরশ পানে দু’হাত তুলে নিজে সহ সকলের মুক্তির লক্ষ্যে প্রার্থণা করি- “হে মহান রব্ব! আপনি যদি আপনাকে চেনার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন না করেন, তবে তো আমরা আমৃত্যু মুশরিকদের অন্তর্ভূক্তই থেকে যাবো, আমাদের দু’নিয়া ও আখিরাত দুই-ই ধ্বংশ হয়ে যাবে। হে মহান রব্ব! অজ্ঞতার কারণে র্শিক করে আপনার সীমাহীন ক্রোধ উৎপন্ন করে গজবে পতিত হতে চাই না। সুতরাং আপনি আমাদেরকে সরল-সহজ পথ দেখান, সেই সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে আপনি হিদায়াত দান করেছেন।
তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি আপনার অভিসম্পাত ও গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। হে মহান রব্ব! একমাত্র আপনিই পারেন আমাদেরকে আপন নফ্সের তাড়নায় কৃত গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দিয়ে আমাদের অন্তরে হিদায়াতের নূর, ঈমানের নূর ঢেলে দিতে। আমাদেরকে আপনি দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে মুক্তি দিন। আপনার নিকট হতেই আমরা আগমন করেছি আর নিশ্চয় আপনারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ”
সমস্ত শুকরিয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্যই; যার নেয়ামত ও অনুগ্রহেই যাবতীয় ভাল কাজ সুসম্পন্ন হয়ে থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের বিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত নাবী ও রাসূলগণ (তাঁদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক) ব্যতীত পৃথিবীতে আর কেউ ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। ভুল আমারও হতে পারে। তাই ভূমিকার শেষে মহান মালিকের দরবারে প্রার্থণা: “হে আমার রব্ব! আমার এ সামান্য খিদমতটুকু কবুল করুন এবং এটিকে পরকালে নাজাতের অছিলা বানিয়ে দিন। যে মহা উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন আমরা যেন তা উপলব্ধি করে তদনুযায়ী আমল করতে পারি, খালেছ ভাবে আপনার দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্ব করতে পারি সে তাওফীক দিন। লেখনির ভাষায় ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার প্রদত্ত ইলমের কোন খিয়ানত আমি করিনি।
যদি নিজের অক্ষমতার কারণে কোন ত্র“টি-বিচ্যুতি করে থাকি সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আপনার সাহায্য চাই। সর্বোপরি আপনার দয়া চাই, আপনার পাকড়াও হতে পানাহ চাই। হে মহান রব্ব! আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েন না, যা আপনি আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। হে আমাদের রব্ব! যে বোঝা বহন করার সামর্থ আমাদের নেই, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েন না। আমাদের প্রতি কোমল হোন, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি করুণা করুন।
কারণ নিঃসন্দেহে আপনিই আমাদের উত্তম অভিভাবক, উত্তম সাহায্যকারী, ইয়া রাব্বাল আ’লামীন। ”
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক হচ্ছে, খাঁটি দাসত্বের সম্পর্ক। আর আমাদের সাথে মহান আল্লাহর সম্পর্ক হচ্ছে, পূর্ণ দয়া ও অনুগ্রহের সম্পর্ক। কারণ আমরা তাঁর দয়ায় অস্তিত্ব লাভ করেছি, তাঁর অনুক¤পায় এ নশ্বর পৃথিবীতে জীবনযাপন করছি এবং তাঁর রহমতেই আখেরাতে নাজাত পাবার আশা করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের তাঁর সৎ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করেন, খাঁটি ভাবে তাঁর দাসত্ব করার তাওফীক দেন।
কারণ তিনি এই মহা উদ্দেশ্যেই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই তো তিনি ¯পষ্ট ভাষায় ইরশাদ করেন-
“আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি যে, তারা সকলে কেবল আমার দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা করবে। আমি তাদের নিকট হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে। ” (সূরা যারিয়াত ৫১:৫৬-৫৭)
খাঁটি ভাবে আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য চাই শিরকমুক্ত ঈমান, পরিপূর্ণ তাওহীদ। এ লক্ষ্যে পরিপূর্ণ তাওহীদপন্থী ও র্শিক মুক্ত হওয়ার মানসে আলিমদের বিভিন্ন ওয়াজ-নসীহত, লেকচার ও বই-পুস্তক হতে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করি।
কারণ আলিমগণ হচ্ছেন নাবী-রাসূলগণের (আলাইহিস সালাম) ওয়ারিছ আর নাবী-রাসূলগণ সর্বপ্রথম যে বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন তা হলো তাওহীদ। আলিমগণের নিকট হতে লব্ধ জ্ঞানের আলোকে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো- তাওহীদ হচ্ছে কোন জিনিসকে এক ও একক বলে সাব্যস্ত করা। আর সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য একমাত্র আল্লাহ’ই হচ্ছেন এক ও একক। অর্থাৎ আল্লাহ পাক’কে তাঁর নাম, সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে এক ও একক জানা এবং মানার নামই তাওহীদ। তাওহীদ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার হক্ব যা বান্দাহর উপর ফরয।
তাওহীদ দ্বীনের সর্বশ্রেষ্ঠ বুনিয়াদ। সকল মূলনীতির মূল এবং আমলের ভিত্তি।
তাওহীদের বিপরীত সকল কর্মই র্শিক। র্শিক অর্থ অংশীবাদ, সংমিশ্রণ, মিলানো প্রভৃতি। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নাম, সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে গায়রুল্লাহকে অংশীদার সাব্যস্ত করার নামই র্শিক।
তাওহীদ আর শিরকের উপমা হচ্ছে: আলো আর অন্ধকার, দৃষ্টিহীন আর দৃষ্টিমান, পবিত্র আর অপবিত্র, রহমত আর লানত, জান্নাত আর জাহান্নাম। র্শিক এমন এক বিকলত্ব যার কথা বলার শক্তি পর্যন্ত রহিত। তাওহীদ হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত আর র্শিক হচ্ছে দু’নিয়ায় আযাব-গযব আর মৃত্যুর পর আখিরাতে চিরস্থায়ী জাহান্নামের বাহন। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত এক হাদীসে তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জান্নাত ও জাহান্নাম ওয়াজিবকারী বস্তু দু’টি কি কি? তিনি বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না বানিয়ে মৃত্যু বরণ করলো সে জান্নাতী। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বানিয়ে মৃত্যু বরণ করলো সে জাহান্নামী।
” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান অধ্যায়)
বিখ্যাত সাহাবী আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি, “আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে আদম সন্তান, তুমি দুনিয়া ভর্তি গুনাহ নিয়ে যদি আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো”। (তিরমিযী, হা/৩৪৬৩, সহীহ, মুসলিম)
এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
“স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো, ‘হে পুত্র! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই র্শিক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম’। ” (সূরা লুকমান ৩১:১৩)
“আসলে তো নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা তাদেরই জন্য এবং সত্য-সরল পথে তারাই পরিচালিত যারা ঈমান এনেছে এবং যারা নিজেদের ঈমানকে জুলুম (র্শিক) এর সাথে মিশ্রিত করেনি। ” (সূরা আন’আম ৬:৮২)
সীমাবদ্ধ যোগ্যতা দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাওহীদ ও র্শিক সম্পর্কে এতোসব জ্ঞান আহরণ করার পরও পুলকিত হওয়ার পরিবর্তে আমার হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো যখন দেখলাম বর্তমানের এই বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়্যাতের সমাজে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় ও র্শিকের বিনাশে জাতির মানুষকে সাবধান-সতর্ক করার আন্দোলনে পথের দিশা দিতে পারতেন যে আলিম সমাজ তারা-ই ঐক্যবদ্ধ নন।
তারা নিজেরাই একাধিক গ্র“পে বিভক্ত হয়ে জাতিকে দিশেহারা করে তুলছেন। মহান রব্ব প্রদত্ত আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের আলোকে দেখতে পেলাম বর্তমান আলিম সমাজ পাঁচ গ্র“পে বিভক্ত:
প্রথম গ্রুপ: ঐ সমস্ত আলিম যারা তাওহীদ ও র্শিক বুঝেছেন। অতঃপর মানুষের জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব¡ অনুধাবন পূর্বক তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় এবং শিরক নির্মূলে সোচ্চার হয়েছেন। আর সামর্থানুযায়ী মানুষকে সাবধান-সতর্ক করছেন। শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সন্তুষ্টি এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুহাব্বাতই তাদেরকে এ কর্মে উদ্বুদ্ধ করেছে।
কারো সামনে অহংকার প্রকাশ কিংবা মানুষের সমাজে নিজ নাম-যশ-খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে নয়। তাদের দলীল হলো কুরআন এবং সহীহ সুন্নাহ। তাদের দাওয়াত সমাজের প্রচলিত অভ্যাস, ধ্যান-ধারণা, র্শিক, কুফর ও বিদআ’তের বিরুদ্ধে হওয়ার কারণে নাবী-রাসূলগণের ন্যায় তাদেরকেও সমাজ কর্তৃক বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ ও জুলুমের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তারা সকল প্রকার অপবাদ, জেল-জুলুম-নির্যাতন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সহ্য করে যাচ্ছেন; কিন্তু দাওয়াতী কাজ হতে বিরত হচ্ছেন না। তারা শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঐ কথার উপর আমল করে যাচ্ছেন যে কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
“আর লোকেরা যাই বলুক না কেন, আপনি সহ্য করুন এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে পরিহার করে চলুন।
” (সূরা মুয্যাম্মিল ৭৩:১০)
“আপনি মানুষকে আপনার রব্বের পথে আহ্বান করুন হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়। ” (সূরা নাহল ১৬:১২৫)
“যারা আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে থাকে, তারা শুধু তাঁকেই ভয় করে এবং এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। ” (সূরা আহযাব ৩৩:৩৯)
অপর এক আয়াত যেখানে লুকমান হাকীম তার ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন-
“হে আমার পুত্র! সালাত কায়েম কর, নেক কাজের প্রতি আদেশ দাও এবং মন্দকাজে নিষেধ কর এবং এই দাওয়াতে যে কষ্ট-মুছিবত হবে তার উপর ছবর কর। নিশ্চয় এটা খুবই সাহসিকতার কাজ।
” (সূরা লুকমান ৩১:১৭)
তারা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এ কথার উপরও আমল করে যাচ্ছেন:
“যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করবে নির্বোধদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য বা আলিমদের সামনে অহংকার প্রদর্শনের জন্য অথবা মানুষের আকর্ষণ নিজের দিকে নিবদ্ধ রাখার জন্য, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে। ” (ইবনু মাজাহ, হা/২৫৩, ছহীহ ইবনু মাজাহ্, ভূমিকা, অনুচ্ছেদ নং ২৩, হাদীছ/২০৭)।
অর্থাৎ আলিমদের এ গ্র“প তাওহীদের পক্ষে এবং র্শিক-কুফরের বিরুদ্ধে দাওয়াত দেয়ার ফলে বিরুদ্ধবাদী লোকদের নিকট হতে যে অন্যায় ও অর্থহীন আচরণ করা হয়, তা উপেক্ষা করে চলে এবং তাদের কোন অভদ্র আচরণের জবাব দেয় না। তবে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তাদের এ উপেক্ষা এবং নির্লিপ্ততা অবশ্যই কোন প্রকার ক্ষোভ, ক্রোধ এবং বিরক্তিসহ প্রকাশ করে না বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী উত্তম পন্থা অবলম্বন করে।
এই আলিমগণ দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে যখন কোন দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার কিংবা সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তখন তারা এসবকে ঈমানের পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করছেন।
এদের সম্পর্কেই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-
“আর নিশ্চয়ই আমরা ভয়-ভীতি, ক্ষুধা, জান ও মালের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করবো। তবে সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের। এবং যখনই তারা কোন বিপদে পতিত হয় তখন বলে: ‘আমরাতো আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহর দিকেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। ’ এরা সে সব ব্যক্তি, যাদের উপর রয়েছে তাদের রব্বের পক্ষ থেকে বিপুল অনুগ্রহ ও রহমত। এই ধরণের লোকরাই হিদায়াত প্রাপ্ত।
” (সূরা আল বাকারাহ ২:১৫৫-১৫৭)
দ্বিতীয় গ্রুপ: ঐ সমস্ত আলিম যারা ঈমান ও ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়াকে খুব বেশী গুরুত্ব দেন না। সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ তাওহীদে আছে না র্শিকে নিমজ্জিত আছে সেদিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের মধ্যে কেউবা ঘুরে ঘুরে মানুষকে ওজু, গোসল ও সালাতের তালিম দেন, আবার কেউবা ডাকেন জিহাদের দিকে, কেউবা ডাকেন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের দিকে। তাদের কর্মকান্ড দেখে মনেই হয় না যে কুরআনে এরূপ কোন আয়াত আছে:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেছে তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর এ ধরনের জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।
” (সূরা মায়িদাহ ৫:৭২)
“যদি তুমি র্শিক করো, তাহলে তোমার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত। ” (সূরা যুমার ৩৯:৬৫)
“কিন্তু যদি তারা কোন র্শিক করে, তাহলে তারা যত আমলই করুক না কেন তা ধ্বংস হয়ে যাবে। ” (সূরা আনআ’ম ৬:৮৮)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের কোন কাজ কবুল হওয়ার এবং তাঁর নিকট হতে বিশেষ সাহায্য পাওয়ার মূল শর্তই হচ্ছে পরিপূর্ণ তাওহীদ গ্রহণ করা অর্থাৎ বিশ্বাস বা কর্মে র্শিক মুক্ত থাকা।
তৃতীয় গ্রুপ: ঐ সমস্ত আলেম যারা মানুষের শত্র“তার ভয়ে অথবা তাদের চাকরী চলে যাওয়ার ভয়ে অথবা রুটি-রুজিতে আঘাত আসার ভয়ে অথবা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে কিংবা নিজেদের সামাজিক অবস্থান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে পরিপূর্ণ তাওহীদের দাওয়াত দেন না আর র্শিকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন আন্দোলন দুরে থাক স্পষ্ট করে কোন কথাই বলেন না। ফলে তারা দাওয়াত ও তাবলীগ করার সময় আল্লাহ তাদেরকে যে ইলম দান করেছেন তা ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখছেন।
তারা যদি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঐ বাণীসমূহের উপর আমল করতেন তবে তারা সহ তাদের অনুসারীদের জন্য কতোইনা কল্যাণকর হতো যেখানে ইরশাদ হয়েছে-
“নিশ্চয়ই যারা গোপন করে ঐ সমস্ত বিস্তারিত তথ্য এবং হিদায়াতের কথা যা আল্লাহ মানুষের জন্য তাঁর কিতাবের মধ্যে নাযিল করেছেন; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিশাপ এবং অন্যান্য অভিশাপকারীদেরও অভিশাপ। ” (সূরা বাকারা ২:১৫৯)
‘‘মূলতঃ আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে সমস্ত বিধান অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো যারা গোপন করে এবং সামান্য পার্থিব স্বার্থের বেদীমূলে সেগুলো বিসর্জন দেয় তারা আসলে আগুন দিয়ে নিজেদের পেট ভর্তি করছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথাই বলবেন না, তাদের পবিত্রতার ঘোষণাও দেবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ” [সূরা বাকারা ২:১৭৪]
“জানা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি ইলমকে গোপন রাখবে, আল্লাহ রাব্বুল ইয্যত কিয়ামত দিবসে তার মুখে আগুনের লাগাম পরাবেন। ” (মুসনাদে আহমদ-ইল্ম অধ্যায়, হা/৩৭, ছহীহ)
চতুর্থ গ্রুপ: ঐ সমস্ত আলেম যারা তাওহীদ ও র্শিক সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী বলেছেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের বুজুর্গ ও উস্তাদদের কথাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে এবং কুরআন ও সুন্নাহর খেলাফ কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করে।
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবাধ্যতায় অন্য কারো আনুগত্য করবে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ফরমান-
“যেদিন তাদের মুখমন্ডলকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে আগুনে জ্বালানো হবে; সেদিন তারা বলবে: হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব্ব! আমরা আমাদের নেতা ও মুরুব্বীদের আনুগত্য করেছিলাম, তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে। হে আমাদের রব্ব! তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দিন এবং তাদের প্রতি মহা লাণত বর্ষণ করুন। ” (সূরা আহযাব ৩৩:৬৬-৬৮)
“তোমরা তারই অনুসরণ কর যা তোমাদের নিকট তোমাদের রব্বের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। তা বাদ দিয়ে ওলী-আওলিয়াদের অনুসরণ কর না।
তোমরা তো খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। ” (সূরা আরাফ ৭:৩)
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার আনুগত্য করো তখন তারা বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে যে রীতির ওপর পেয়েছি তার আনুগত্য করবো। শয়তান যদি তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনের দিকেও আহ্বান করতে থাকে তবুও কি তারা তারই আনুগত্য করবে ? (সূরা লুকমান ৩১:২১)
এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন-
“সৃষ্টিকর্তার সাথে অবাধ্যতার কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। ” (মুসনাদে আহমদ, ছহীহ)
পঞ্চম গ্রুপ: ঐ সমস্ত নামধারী আলিম যাদের অধিকাংশই তাওহীদ ও র্শিক সম্পর্কে নিজেরাই পরিপূর্ণ ধারণা রাখেন না। যদিওবা তাদের মাঝে কতিপয় আলিম এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা অর্জন করেছেন তথাপিও ব্যক্তি স্বার্থে সমাজ ও জাতির মানুষকে সাবধান-সতর্ক করার পরিবর্তে তাদের ঈমান ও ইসলামকে খানকাহ, দরগাহ, কবর ও মাজারে নিয়ে বন্দী করেছেন।
এই সকল আলিম নামধারী মুরিদচোষা পীর আর মিলাদজীবী হুজুরগণ জাতির মানুষের ঈমান ও আক্বীদাহ সংশোধণের পরিবর্তে নিজস্ব উদ্ভাবিত মনগড়া তরীকার মাধ্যমে কিছু নব উদ্ভাবিত আমল ধরিয়ে দিয়ে জান্নাত লাভের গ্যারান্টি দিচ্ছেন। জাতির মানুষ আল্লাহর বিধান কুরআন ও সুন্নাহর পরিবর্তে মানব রচিত আইন-বিধান গ্রহণ করে সুস্পষ্ট র্শিক ও কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাদের সকল আমল বরবাদ হয়ে, জান্নাত হারাম হয়ে জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে বসে আছে এদিকে তাদের নজর দেবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। এসকল নামধারী আলিমরা মানুষকে বেশী বেশী দান-খয়রাত, নযর-মানতের মাধ্যমে সকল প্রকার আসমানী-জমীনি বালা-মুসিবত থেকে বাঁচার পথ বাতলে দিচ্ছেন। আবার এই দান-খয়রাত, নযর-মানতের মাল দরিদ্র, অসহায়, মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার পরিবর্তে নিজেরা গ্রহণ করছেন এবং নিজেদের আরাম-আয়েশী ভোগের জীবনে ব্যয় করছেন। তারা আল্লাহর পাশাপাশি নবী, আউলিয়া ও মৃতদের নিকট সাহায্য চাওয়টাকে শুধু বৈধ নয়, সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক পূণ্যের কাজ মনে করেন।
এ গ্র“পের আলিমদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে, সমাজের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরোধীতা না করে সাধারণ মানুষদের ধর্মের প্রতি আবেগপ্রবণতাকে পুঁজি করে দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিল করা, সমাজে নিজেদের নাম, খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করা। অথচ কতইনা কল্যাণকর হতো যদি তারা র্শিক-কুফর, বিদআ’ত ত্যাগ করে তাওহীদকে প্রাধান্য দিতেন, দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী ভোগের জীবনকে প্রাধান্য না দিয়ে আখিরাতমুখী আল্লাহওয়ালা হয়ে যেতেন। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-
“যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানের সাথে সামান্যতম র্শিককেও মিশ্রিত করেনি তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং একমাত্র তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। ” (সূরা আনআ’ম ৬:৮২)
হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে:
“কিয়ামতে যাদের দ্বারা জাহান্নামকে প্রজ্জ্বলিত করা হবে তারা হল তিন ব্যক্তি। এদের মধ্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ আলিমের কথা উল্লেখ করেছেন যে নিজ ইল্ম দ্বারা মানুষের প্রশংসা ও তাদের গুণকীর্তন আশা করে ছিল (আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করেনি)...।
” (হাদীছটি বিস্তারিতভাবে জানার জন্য দেখুন ছহীহ মুসলিম-ইমারত অধ্যায়, হা/১৯০৫, তিরমিযী-ইলম অধ্যায়, হা/২৬৫৪)
দ্বিধাবিভক্ত এই আলিমদের কারণেই আমার মতো সাধারণ মানুষরা ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ ও র্শিক সম্পর্কে এক মহা বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তে পতিত হয়। আমরা লক্ষ্য করলাম আলিমদের বক্তব্যের বিষয়টি যদি সমাজের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যশীল বা বিপরীত হয়, তবে প্রতিরোধ বা বিরোধীতার সম্মুখীন হওয়া থেকে শুরু করে তাদের বেতন-ভাতা, দান-খয়রাত ও নজর-নিয়াজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যে ভীতিকর অবস্থাটি বর্তমানে খুবই বিরাজমান। এ অবস্থাকে এড়ানোর (ওভারকাম) জন্য সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, কুরআনের যে বক্তব্যগুলো সমাজের প্রচলিত ধারণার বিপরীত, সেগুলোকে লুকিয়ে ফেলা অথবা সে বক্তব্যকে এমনভাবে ঘুরিয়ে বলা, যাতে বিরোধিতা কম আসে বা সবার জন্য তা গ্রহণযোগ্য হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মানসিকতাই বর্তমান বিশ্বের মুসলিমদের দুরবস্থার একটি প্রধান কারণ। কুরআন দিয়ে মানুষকে সাবধান-সতর্ক করার ব্যাপারে এই ভীষণ ক্ষতিকর কর্মপদ্ধতি সমূলে উৎপাটন করার জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে মু’মিনদের বলছেন-
“এটা (আল-কুরআন) একটি কিতাব।
এটি আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে এ জন্য যে, এর বক্তব্য দ্বারা আপনি মানুষকে সতর্ক করবেন, ভয় দেখাবেন। তাই (কুরআনের বক্তব্য দিয়ে মানুষকে সতর্ক করার ব্যাপারে) আপনার অন্তরে যেন কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি ইত্যাদি না আসে। আর এটাই মু’মিনদের জন্য উপদেশ। ” (সূরা আরাফ ৭:২)
কুরআনের অন্য জায়গায় আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেন,
“অতএব আপনি উপদেশ দিয়ে যেতে থাকুন। আপনি তো শুধু মাত্র একজন উপদেশক।
আপনি এদের উপর বল প্রয়োগকারী নন। ” (সূরা গাশিয়াহ ৮৮:২১,২২)
“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের উপর তো আমি আপনাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি। ” (সূরা নিসা ৪:৮০)
অর্থাৎ পৃথিবীর সকল মানুষ কখনই কোনো একটি বিষয়ে একমত হবে না। তাই আপনি কুরআনের বক্তব্য সরাসরি মানুষের নিকট উপস্থাপন করবেন।
যারা তা গ্রহণ করবে না, তাদের তা গ্রহণ করতে বাধ্য করার জন্যে পুলিশের ন্যায় আচরণ করা আপনার কাজ নয়।
কুরআনের এই সকল বক্তব্য জানার পর আসুন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আমরা কথা বা লেখনীতে কুরআনের বক্তব্য লুকিয়ে নয়, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নয়, সরাসরি উপস্থাপন করব। আমরা মানুষকে সাবধান-সতর্ক করার সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি ইত্যাদির মধ্যে পড়ে কখনই কুরআনের বক্তব্যকে লুকাবো না বা ঘুরিয়ে বলবো না। কারণ কুরআন হচ্ছে হিদায়াত-সুস্পষ্ট পথ প্রদর্শক মুত্তাকীদর জন্য। আমরা কেবল ঐ আয়াতের উপর আমল করবো যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।
তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য করে, সে ব্যক্তি অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। ” (সূরা আহযাব ৩৩:৭০-৭১)
“আলিফ লাম মীম। এই সেই কিতাব (অর্থাৎ কুরআন) যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটি পথ প্রদর্শনকারী মুত্তাকীদর জন্য, যারা অদৃশ্য বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সালাত কায়েম করে।
আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে আর যে কিতাব (অর্থাৎ কুরআন) তাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং তাদের আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে আর আখিরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। এ ধরনের লোকেরা তাদের রব্বের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত আর তারাই যথার্থ সফলকাম। ” (সূরা বাকারা ২:১-৫)
আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেই ছাড়েন। তাঁর এ সিফাত বা গুণ পূর্বেও ছিল, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র তিনিই হচ্ছেন হুকুমদাতা।
তিনি ছাড়া সবাই তাঁর গোলাম/দাস ও হুকুমের তাঁবেদার। তাই তাঁর রাজত্ব ও হুকুমের বাইরে যাওয়ার অবকাশ কোন বান্দাহর নেই।
মূলতঃ আল্লাহর নিকট মানুষের সঠিক অবস্থান হচ্ছে, আল্লাহ আমাদের মহান মালিক আর আমরা তাঁর দাস ও প্রতিনিধি। সুতরাং দুনিয়ায় জীবনে মহান মালিক আল্লাহর খাঁটি দাস ও প্রতিনিধি হিসেবে দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্ব করতে হলে শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত ইবাদাতসমূহে নয়, আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও আল্লাহর হুকুম-বিধান প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। এই জরুরতকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে যারা দুনিয়ার বুকে আল্লাহ পাকের মনোনীত একমাত্র দ্বীন, হুকুম-বিধান সম্বলিত পরিপূর্ণ একমাত্র জীবন ব্যবস্থা ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে আল্লাহ’কেই একমাত্র রব্ব-সার্বভৌম মালিক, সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরঙ্কুশ কর্তা মেনে ঈমানের উপর দৃঢ়-অটল থাকবে এবং এ লক্ষ্য অর্জনে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে তারাই আল্লাহর দলভূক্ত এবং বিজয় তাদের হবেই হবে, এটাই আল্লাহ পাকের ওয়াদা।
কেননা আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- “আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো” (সূরা আলে ইমরান ৩:১৩৯)। “আর যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী” (সূরা মায়িদাহ ৫:৫৬)। আর আল্লাহর গোলাম হওয়া সত্যেও যারা আল্লাহর মনোনীত দ্বীন-ইসলাম গ্রহণ না করে মানব রচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তারা মূলতঃ আল্লাহর পরিবর্তে (সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে) মানুষকেই রব্ব মেনে নিয়েছে এবং নিজ নফসকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে, তারা-ই শয়তানের দল, পতন তাদের নিশ্চিত। এদের প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- “শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তর থেকে আল্লাহর স্মরণ ভূলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল।
সাবধান! শয়তানের দলভুক্ত লোকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত। ” (সূরা মুজাদালাহ ৫৮:১৯)।
শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণকারীরা আল্লাহর জমীনে মিথ্যা সার্বভৌমত্বের দাবীদার সেজে শুধু মহান রব্ব আল্লাহর ক্রোধই অর্জন করছে, এতে করে তাদের মাঝে ও জাহান্নামের মাঝে দূরত্ব ক্রমশঃ কমছে বৈ বাড়ছে না। সুতরাং যারা এখনও আল্লাহর জমীনে মিথ্যা সার্বভৌমত্বের দাবীদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করে, তাঁর-ই মনোনীত একমাত্র দ্বীন-জীবন ব্যবস্থা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেননি তারা সাধ্যানুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই মহৎ কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে জাহান্নাম থেকে ফিরে নিজেদের মূল বাড়ী, আসল বাড়ী জান্নাতে যাওয়ার পথ ধরবেন। নিজেদেরকে আর আবু জাহেল নয়, আবুল হাকাম হিসেবে আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করবেন এবং এ আয়াতের উপরে আমল করবেন-
“তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং এ ব্যাপারে পরস্পর দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।
” (সূরা শুরা ৪২:১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।