একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিচার চলছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার কাজ এগিয়ে চলছে। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল শুরু থেকেই নানাভাবে এ বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা রাজনৈতিক বা আইনগতভাবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার মোকাবিলা করতে না পেরে এখন ইন্টারনেটকে আশ্রয় করে সাইবার জগতে অপপ্রচারে মেতে উঠেছে। মূলত জামায়াত-শিবিরের আজ্ঞাবহ বিভিন্ন সংগঠন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক, ইউটিউব, ব্লগ, টুইটারসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিরামহীন মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এমনকি ‘যুদ্ধাপরাধী’দের পক্ষে অসংখ্য বই ও বুকলেট ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা তাদের আজগুবি অপপ্রচারে তুলে ধরছেÑ ‘মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন নিজামী। ’ আর ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মুক্তিযুদ্ধের সময় নাবালক ছিলেন, বয়স সবে বারো কি তেরো বছর। সেই বয়সে লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্ষণ কাকে বলে, কিছুই তিনি বুঝতেন না।
’ শুধু তা-ই নয়, ‘আলবদর-আলশামসরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেনি, আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বহির্বিশ্বে জামায়াতকে বিতর্কিত করেছে’Ñ এ রকম সব ডাহা মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনলাইনে ‘যুদ্ধাপরাধী’ এবং তাদের সংগঠনের পক্ষে সাফাই গেয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছে জামায়াত-শিবির চক্র।
জামায়াত-শিবিরের এসব মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে সরকার বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো মহলেরই কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই কিংবা পাল্টা হিসেবে অনলাইনে সত্য তথ্য প্রচারের কোনো উদ্যোগও কারো নেই। কিছু ব্যক্তি ও ছোট সংগঠন ডিজিটাল অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কাজ করে গেলেও জামায়াত-শিবির চক্রের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের নানামুখী অপপ্রচারে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করছে জামায়াত। আন্তর্জাতিক ও ডিজিটাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ব জনমত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
দি ইকোনমিস্ট ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে। ওই চক্রটি সুপরিকল্পিতভাবে একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ সরকারের বিষয়টি মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা মনে করছে, বিচার এমনি এমনিই হবে। যেসব মন্ত্রী গলাবাজি করেন, তাঁরা যখন ক্ষমতায় থাকবেন না, ওই সময় তাঁরা রাস্তায় বের হতে পারবেন না।
ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াবেন। তখন তাঁরা বুঝবেন, আমরা কী বলতে চেয়েছিলাম। ’
জামায়াত-শিবির চক্রের মিথ্যাচার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। তারা নিজেরা বাঁচতে দেশে-বিদেশে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অনলাইনে মিথ্যাচার এরই অংশ।
তবে কোনো ষড়যন্ত্রই বিচার কাজ বন্ধ করতে পারবে না।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে জানান, ‘রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা জঙ্গি-মৌলবাদীরা এখন অপ্রচারের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইনকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রচারণা, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মিথ্যাচার, সর্বোপরি সরকারবিরোধী প্রচারণার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন দিক। বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চলছে এসব অপপ্রচার। জামায়াত-শিবির ও হিযবুত তাহ্রীরের আইটি বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এসব ব্লগ, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং ওয়েবসাইট।
ওরা অসংখ্য বই ছাপিয়ে সেগুলো আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। এর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না। আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে যতটুকু পারছি, করে যাচ্ছি। সরকারের উচিত এসব মিথ্যাচার বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। ’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার জানান, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার জাতীয় বিষয়, কোনো দলের নয়।
বিদেশে আমাদের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বহু মিথ্যা প্রচারণা চলছে। সেই তুলনায় আমাদের প্রচারণা কিছুই নয়। যদি কোনোভাবে আমরা এই বিচার বাকি সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারি, তাহলে সমগ্র জাতির ওপর সাংঘাতিক দুর্যোগ নেমে আসবে। ’
ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি ও প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘সরকার ডিজিটাল প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ করছে আর ডিজিটাল শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে আমাদের শুভাকাক্সক্ষীরা। আমাদের অধ্যাপক গোলাম আযম একজন ভাষাসৈনিক, তাঁকে অশ্লীল ভাষায় কেউ যদি গালি দেয়, তখন তো আমার লোকজন বসে থাকবে না।
শুধু আমাদের লোক নয়, যারা মনে করছেন এগুলো অন্যায়, তারা নিজ উদ্যোগেই প্রতিবাদ করেন। সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যা ইচ্ছা তা-ই করছে। কিন্তু এর প্রতিবাদকারীরা কোথাও স্থান পাচ্ছেন না। রাস্তাঘাট, মাঠ, এমনকি প্রেসক্লাবেও প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এখন একটি স্থানই আছে, সেটা অনলাইন।
এটার মাধ্যমেই আমাদের প্রতিবাদ চলছে। ’
একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইন্টারনেটে কনটেন্ট তৈরিসহ আপলোডের ক্ষেত্রে দেশের নামিদামি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, এমনকি বুয়েটের শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মেধাবী ছাত্রদের কাজে লাগাচ্ছে শিবির। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ঠেকাতে বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে জনমত গঠন চলছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা যায়, ওই সাইটগুলোর বেশির ভাগই ‘মোটিভেশনাল’।
সেগুলোতে নিজের মতামত দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। এতে অংশ নেয় ‘পেইড ব্লগাররা’। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের জবাব অনলাইনে দিয়ে থাকে তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘স্টোরি অব বাংলাদেশ’ নামের একটি ব্লগ সাইটে মুক্তিযুদ্ধকালের ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। ই-বুক সেকশনের বইগুলোর প্রতিটিতেই ইতিহাসবিকৃতি রয়েছে।
এর মধ্যে একাত্তরের আত্মঘাতের ইতিহাস, আমি আলবদর বলছি (লেখক : কে এম আমিনুল হক), দুই পলাশী দুই মীরজাফর, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, ফেলে আসা দিনগুলো (লেখক : ইব্রাহিম হোসেন) উল্লেখযোগ্য। আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামক একটি ব্লগ সাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ লেখা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ‘সোনার বাংলা’ ব্লগে যুদ্ধাপরাধীদের সাফাই গেয়েছেন পুষ্পিতা ছদ্মনামের এক ব্লগার। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক তোলা হয়েছে।
ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবেও স্বাধীনতাবিরোধীরা তৎপর।
এখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বেশকিছু ভিডিও রয়েছে। একইভাবে ‘ফাইট এগেইনস্ট হাসিনা অ্যান্ড অল ইন্ডিয়ান এজেন্ট টু সেভ বাংলাদেশ’ নামের ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছে। তাতেও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে বিকৃত তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ব্লগার ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অমি রহমান পিয়াল জানান, অনলাইনে বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল লিখে সার্চ দিলে নিশ্চিতভাবেই প্রথম যে ১০০টি লেখা সামনে আসবে, তা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই বেশি। যদি কেউ উইকিপিডিয়া সার্চ দেন দেখবেন, আলবদর নামের যে সংগঠনটির নেতা হিসেবে নিজামীর বিচার হচ্ছে, সেই আলবদর সম্পর্কে লেখা আছেÑ এরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে স্বল্প সময়ের জন্য ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং দেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তিনি আরো উল্লেখ্য করেন, এসবের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো প্রতিরোধ নেই, প্রতিবাদ নেই। এসবের বিরুদ্ধে অনলাইনেই জবাব দিতে হবে; তরুণ প্রজন্ম এবং বহির্বিশ্বকে বোঝাতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম রাজনৈতিক নয় বরং জনতার দাবি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বজনদের দাবি, নির্যাতিতদের দাবি, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একাত্তর সালে আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে নানাভাবে প্রচারণা চালানো হয়। যেমনÑ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায়, তারা ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়।
’ (দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ আগস্ট, ১৯৭১)। ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-এ দৈনিক সংগ্রামে ‘মিনহাজের পিতার নিকট ছাত্রসংঘ প্রধানের তারবার্তা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক সংবাদে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘ভারতীয় এজেন্ট মতিউর রহমান’-এর (বীরশ্রেষ্ঠ) মোকাবিলায় মিনহাজের আত্মত্যাগে পাকিস্তানি ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গর্বিত। মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। পাকিস্তান টিকে থাকলেই কেবলমাত্র এখানকার মুসলমানরা টিকে থাকতে পারবে। ’ (দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগস্ট, ১৯৭১)।
সরকারিভাবে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কিভাবে জামায়াত-শিবিরের ওইসব মিথ্যাচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়া যায়, সে বিষয়ে শিগগির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে সচেতন মহল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।