যখন সত্য এসে মিথ্যার সামনে দাঁড়ায় তখন মিথ্যা বিলুপ্ত হয়। কারণ মিথ্যা তাঁর প্রকৃতগত কারণেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। [ কুরআন ১৭:৮১ ] মূলত আধুনিক মুক্তমনা মুসলিম যাদের ধারনা ইসলাম একটি সেকেলে ব্যবস্থা আর দুনিয়ার ইতিহাসে তথা সভ্যতার উন্নয়নে ইসলামের কোন অবদান নেই তাদের জন্যই এ লেখাটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও লেখা দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যখন ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে ছিল তখন মুসলিম বিশ্ব ছিল তার সোনালী যুগে।
পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদরাও এককথায় স্বীকার করেন অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপে জ্ঞানের আলো জ্বালায় মুসলিমরাই। লন্ডন যখন মাত্র একটা গ্রাম ছিল তখন মুসলিম স্পেনের (তৎকালীন আল-আন্দালুস) রাজধানী কর্ডোবাতে প্রায় ২ মাইল জুড়ে আলোকসজ্জা ছিল। ইউরোপের শক্তিশালী বলতে ছিল এক রোমানরাই। তবে তাদের সংস্কৃতি ছিল অমানবিক ও জঘন্য।
যাই হোক আজ এমন একজন মুসলিম বিজ্ঞানীর কথা আলোচনা করব যিনি গণিতের রূপরেখাই চিরদিনের জন্য পালটে দেন।
তিনি হলেন ইতিহাসের পাতায় অনন্য স্থান পাওয়া আল খোয়ারিজমি।
আল খোয়ারিজমি
আল খোয়ারিজমি (Abū ʿAbdallāh Muḥammad ibn Mūsā al-Khwārizmī (৭৮০-৮৫০) মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তার পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মূসা আলখোয়ারিজমি।
জন্ম : সোভিয়েত রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়া (Amu Dariya - Oxus) নদীর একটি দ্বীপের নিকটে অবস্থিত খোয়ারিজম নামক শহরে।
এই শহরটি প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল যার তত্কালীন নাম ছিল উরগেঞ্চ (Urgench)। তার জন্ম তারিখ বা শৈশব ও কৈশোর সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
মৃত্যু : খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর (আনুমানিক ৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে) আল খোয়ারিজমির মৃত্যু হয়।
আল খোয়ারিজমি খলিফা আল মামুনের বায়তুল হিকমাহ (House of Wisdom) সংলগ্ন গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিকের চাকুরি করতেন।
খলিফা মামুনের মৃত্যুর পরও তিনি জীবিত ছিলেন এবং পরবর্তী খলিফা আল ওয়াতহিকের (Al Wathiq) শাসনকালের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রাখেন। তবে মূলত বীজগণিতের জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশী আলোচিত হন।
এজন্যই তাকে বীজগণিতের জনক বলা হয়।
আল খোয়ারিজমীর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছুই জানা যায়না; এমনকি তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন তা ও নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।
তার নাম থেকে অনুমান করা হয় যে তিনি সম্ভবত আব্বাসীয় শাসনামলে খোরাসান প্রদেশের খোয়ারিজমী (খিভা) হতে আগমন করেন। (বর্তমানে উজবেকিস্থান এর জরাজম প্রদেশ)
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল-তাবারী তার নাম দেন মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারিজমী আল কুতরুবুল্লী (আরবি: موسى الخوارزميّ المجوسيّ القطربّليّ). এই বিশেষণ আল-কুতরুবুল্লী এটাই নির্দেশ করে যে তিনি সম্ভবত বাগদাদ এর নিকটবর্তী ক্ষুদ্র শহর কুতরুবুল, হতে এসেছেন।
আল তাবারী কর্তৃক তার উপর আরোপিত আরেকটি বিশেষণ হল, "আল-মাজুশী," এটাই নির্দেশ করে যে তিনি হয়তোবা প্রাচীন জরথ্রুস্ট মতবাদের অনুসারী ছিলেন। এটা ইরানীয় বংশোদ্ভূতদের ক্ষেত্রে তৎকালীন সময় পর্যন্ত অসম্ভব ছিলনা, কিন্তু “এলজেবরা” গ্রন্থের মুখবন্ধ হতে দেখা যায় যে, আল-খারিজমী ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান, অর্থাৎ আল তাবারী বিশেষণ এটাই নির্দেশ করে যে হয়তোবা তাঁর পূর্বপুরুষ কিংবা তিনি সম্ভবত তাঁর কৈশোরে জরথ্রুস্ট মতবাদের অনুসারী ছিলেন।
ইবনে আল-নাদিম এর কিতাব “আল-ফিরহিস্ট” এ আমরা আল খারিজমীর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী খুঁজে পাই, যেখানে তাঁর লিখিত বই সমূহের একটি তালিকাও রয়েছে।
আল-খারিজমী তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ ৮১৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ সময় কালের মধ্যে রচনা করেছেন। মুসলমানদের পারস্য বিজয় এর পরে বাগদাদ ব্যবসা-বাণিজ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে দূর-দূরান্ত এমনকি চীন ও ভারত উপমহাদেশ থেকেও প্রচুর ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী বাগদাদে পাড়ি জমান। অনুমান করা হয় যে আল-খারিজমীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি বাগদাদে খলিফা আল-মামুন এর লাইব্রেরিতে প্রধান লাইব্রেরীয়ান হিসাবে কর্মরত ছিলেন, এবং সেখানে তিনি বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা করতেন।
এখানে বসেই তিনি গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেক বৈজ্ঞানিক রচনা অনুবাদ করেন।
বীজগণিতে অবদানঃ
বীজগণিত হল ইসলামী সভ্যতায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। বীজগণিতকে তিনিই প্রথম গণিতশাস্ত্রের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলেন এবং এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারতীয়রাই প্রথম বীজগণিত নিয়ে গবেষণা করে এবং গ্রিকদের মধ্যে কেবল ডায়োফ্যান্টাস (Diophantus) ব্যতিত আর কাউকে বীজগণিত নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করতে দেখা যায়নি। ভারতীয়দের গাণিতিক উত্কর্ষের সময়টা অনেক প্রাচীন ছিল।
সুতরাং খোয়ারিজমির সময় বীজগণিতের অবস্থা ছিল ম্রিয়মান। এ সময় তিনি বীজগণিতের ভিত্তি স্থাপন করে আধুনিক গণিতের পথকে অনেকটাই কুসুমাস্তীর্ণ করে তোলেন।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিন্দু গণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। হিন্দুদের উদ্ভাবিত এই দশমিক পদ্ধতি খোয়ারিজমিই প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তার রচিত The Book of Addition and Subtraction According to the Hindu Calculation (যোগ-বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) তারই উদাহরণ।
আরবি ভাষায় তার রচিত গ্রন্থই সর্বপ্রথম ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতায় ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমেই তার গবেষণার বিকাশ ঘটে। অ্যালগরিদম (Algorithm) উত্পত্তিই এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ।
তার রচিত পুস্তক কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবলা হতে বীজগণিতের ইংরাজী নাম আলজেবরা (Algebra) উত্পত্তি লাভ করে।
Algorithm শব্দটি Alkhwarizmi নামের ল্যাটিন অপভ্রংশ algorismi হতে উত্পত্তি লাভ করেছে।
ভূগোলে অবদানঃ
তাঁর রচিত সুরত-আল-আরদ (The image of the Earth) গ্রন্থটি বিশ্বের প্রথম মানচিত্র হিসেবে বিবেচিত।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদানঃ
আল খোয়ারিজমি তাঁর ''জিজ আল সিন্দহিন্দ'' গ্রন্থের ৩৭টি অধ্যায়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাত্ত (বিভিন্ন কোণের sine value সহ) সন্নিবিষ্ট করেন। তাছাড়া সূর্য, চাঁদ ও সে আমল পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৫টি গ্রহের গতিবিধি বর্ণনা করেন। বইটির ল্যাটিন সংস্করণ অক্সফোর্ড ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের নামীদামী অনেক ভার্সিটিতে রাখা আছে।
পাটীগণিতে অবদানঃ
আল খোয়ারিজমির ''কিতাব আল জামঅয়াল ওয়াল তাফরিক বিল হিসাব আল হিন্দ'' (The Book of Addition and Subtraction According to the Hindu Calculation) বইয়ে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ও প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত পাটীগণিতের বিভিন্ন কৌশল এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
সেপ্টেম্বর ৬ ১৯৮৩ সালে আলখোয়ারিজমির ১২০০ তম(আনুমানিক) জন্মদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত একটি ডাকটিকিট
আল খোয়ারিজমির al-Kitab al-mukhtasar fi hisab al-jabr wa'l-muqabala বইয়ের একটি পৃষ্ঠা।
তথ্যসূত্রঃ Wikipedia
ইনশাল্লাহ আরও পোস্ট দিব। সবাই দোয়া করবেন।
( এখনও প্রথম পাতা ও মন্তব্যের সুবিধা পাইনি ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।