আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পার্বত্য ভূমিকমিশন আইন সংশোধন ও বাস্তবতা

আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে পার্বত্য ভূমিকমিশন আইন সংশোধন ও বাস্তবতা এই মুহূর্তে পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ১৩টি সংশোধনী নিয়েই পার্বত্যবাসী সবচেয়ে শঙ্কিত। গত ৩০ জুলাই ২০১২ বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেটে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকমিশন আইনের এ ১৩টি সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে। কথা রয়েছে, সংশোধনীসমূহ জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে তোলা হবে আইন হিসেবে অনুমোদনের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সচেতন মানুষদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তোলপার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে এটা রীতিমত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

তাদের আশঙ্কা এসব সংশোধনী পাস হলে পার্বত্যাঞ্চলে তাদের পক্ষে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সংশোধনীর আলোকে আইন প্রণীত হলে সেখানকার উজাতীয় নেতাদের দৌরাত্ম্যে ভূমিহীন হয়ে পড়বে বাঙালিরা। ফলে যারা গত ৩০-৩৫ বছর ধরে সেখানে জীবন-মরণ লড়াই করে বসবাস করছেন, গড়ে তুলেছেন একটা ছোট্ট স্বপ্নের আবাস তার সব কিছুই চলে যাবে উপজাতীয়দের হাতে। আর এই নিয়ে শুরু হবে নতুন করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। হয়তো বাধ্য হয়েই জীবন নিয়ে পালাতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে।

বিষয়টি যে শুধু পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠীকেই ভাবিয়ে তুলেছে তা নয়, বরং দেশের সচেতন প্রতিটি নাগরিককেই ভাবনায় ফেলেছে। কেননা এর সাথে শুধু পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ৮-৯ লাখ বাংলাভাষী মানুষের সমস্যা জড়িত নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় অখ-তা রক্ষার বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট। ভূমি কমিশন পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি সমস্যাটি নতুন কোন বিষয় নয়। এটিই এখানকার সব চেয়ে জটিল সমস্যা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ভূমিবিরোধ সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য একটি ল্যান্ড কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খ-ের ৪, ৫ ও ৬ ধারা মতে অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে ৩ জুন ১৯৯৯ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ল্যান্ড কমিশন গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে ২০০১ সালের ৫৩ নং আইন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১’ পাস করে। যা ১৭ জুলাই ২০০১ প্রেসিডেন্টের সম্মতি লাভের পর বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যার ৪০৭৩-৭৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এই আইনটিতেই পার্বত্য বাঙালিদের ভূমির অধিকার খর্ব করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু এতে সন্তু লারমার একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ কিছুটা কম থাকায় তিনি নাখোশ হন।

তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে ভূমি কমিশন আইন ২০০১-এর ব্যাপারে আপত্তি তোলে সংশোধনের দাবি জানায়। তারা তাদের দাবির পক্ষে সরকারের পাসকৃত আইনের ২০টি ধারার বিপরীতে আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে ১৯ দফা সুপারিশ প্রেরণ করে। পরবর্তী সময়ে সুপারিশ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩-এ। এসব সুপারিশের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সরকারের কাছে আঞ্চলিক পরিষদের গুরুত্বকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। যাই হোক, আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশ সমূহকে উদ্দেশ্য অনুসারে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি।

প্রথমত, এমন কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমির উপর থেকে পার্বত্য বাঙালিদের অধিকারকে খর্ব করে উপজাতীয়দের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট সুপারিশগুলো করা হয়েছে, যাতে ভূমিকমিশনের ওপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আঞ্চলিক পরিষদের তথা জেএসএসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে যেসব সংশোধনী গৃহীত হয়েছে তাতে জেএসএসের উভয়বিদ সিদ্ধান্তই হাসিল হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এসব সুপারিশের ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধি নিষেধের বিষয়টি উল্লেখ করে এতদিন আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এক যুগ পর হঠাৎ করে বিনা আপত্তিতে সকল স্পর্শকাতর সুপারিশ মেনে নিয়ে সরকার তার নৈতিক পরাজয় নিশ্চিত করেছে।

ভূমিকমিশন আইনের কিছু সংশোধনী প্রস্তাবের পর্যালোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সম্প্রতি গৃহীত ১৩টি সংশোধনীর মধ্যে ২নং প্রস্তাবে আছেÑ আইনের (২০০১ সালের ৫৩ নম্বর আইন) তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘পার্বত্য জেলাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য জনসংহতি সমিতির’-এর স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ প্রতিস্থাপিত হবে। এই প্রস্তাবটি একটি মামুলি বিষয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জেএসএস একটি সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য সামনে রেখেই যে এটি সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। জেএসএস আন্দোলন শুরু করেছিল স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার খায়েশ নিয়ে। তাদের এই আকাক্সক্ষা তারা কখনই পরিত্যাগ করেনি।

যা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্য, আচার-আচরণ থেকে প্রমাণিত। সরকারের সাথে চুক্তি করার সময় যেহেতু স্বাধীন দেশের দাবি তোলা অপ্রাসঙ্গিক ছিল, তাই তারা প্রথমে ফেডারেল রাষ্ট্র এবং পরে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতায় সরকার এ দাবি মেনে না নেয়ায় তারা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেই চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বলে তাদের মনের সুপ্ত আকাক্সক্ষার কথা ভুলে যায়নি। সে কারণে পার্বত্য চুক্তির শুরুতেই পার্বত্যাঞ্চলের পরিচয়কে তারা ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়।

আর এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো থেকে পার্বত্যাঞ্চলকে পৃথক করে ফেলা। যাতে ধীরে ধীরে এই স্বতন্ত্র পরিচয়টাকেই বড় করে তাদের পুরনো উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই এই বিষয়টির ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোকপাত করেছিলেন। কিন্তু সরকার তখন এর প্রতি দৃষ্টিপাত করেনি। বোঝা যায় সরকার এর ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন এবং এখনো উদাসীন আছেন।

যা ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীর দুই নং প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমেও প্রমাণিত। সরকার উদাসীন থাকলেও জেএসএস তাদের লক্ষ্যে যে অবিচল এখানে সেটাই স্পষ্ট। যার ফলে তারা ‘পার্বত্য জেলাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপনের দাবি আদায় করেছে। ‘জেলা’ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ তাই এই শব্দটি জেএসএস মানতে পারেনি। তাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে এই অঞ্চলের নতুন একটি পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা, তারা সেটি করতে পেরেছে।

আর আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বোঝেই হোক কিংবা না বোঝেই হোক এই প্রস্তাব গ্রহণ করে জেএসএসের খায়েশ পূরণে সহায়তা করছে। এই একটি সংশোধনীর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেই অপর ১২টি প্রস্তাবের উদ্দেশ্যও বোঝা সম্ভব। কেননা প্রতিটি প্রস্তাবই এসেছে জেএসএসের কাছ থেকে। আর তারা যে এসব প্রস্তাব তাদের মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখেই দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সংশোধনীর ৪ এবং ৫নং প্রস্তাব নি¤œরূপ- ৪।

৬ (১) (ক) ধারায় ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’-এর স্থলে ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া জায়গাজমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণসহ সমস্ত ভূমিসংক্রান্ত বিরোধের পাশাপাশি চুক্তির পরিপন্থী নয় এমন সকল বিষয়ে চুক্তির ধারা ঘ ৪ মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’ প্রতিস্থাপিত হবে। ৫। ৬ (১) (খ) ধারায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী’ শব্দাবলির স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী’ হবে। উপরের দুটি প্রস্তাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী’ বিরোধ মীমাংসা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি’ বলতে আসলে কি বোঝায় তার ব্যাখ্যা কি সরকারের কাছে আছে? আমরা আসলে জানি না, তা ছাড়া সরকারের কাছে এর ব্যাখ্যা থাকার কথাও না।

কারণ ৪নং প্রস্তাবেই অবৈধ বন্দোবস্ত জমির প্রসঙ্গ এসেছে। এর অর্থ হলো সরকার অবৈধভাবে কাউকে না কাউকে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে! বিষয়টি কি আসলে তাই? আমরা জানি রাষ্ট্রের আইনেই বৈধ কিংবা অবৈধতা নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখছি ভিন্ন বিষয়। সরকারের কর্মকা-কে অবৈধ বলে ঘোষণা করারও বিধান আছে! কিন্তু সেই বিধানটি আসলে কি, এর প্রয়োগকারীই বা কারা? আমরা আসলে বোঝতে পারছি না, এর মাধ্যমে সরকার পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বন্দোবস্ত দেয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা অন্য কারো হাতে ছেড়ে দিচ্ছে কি না। আর যদি তাই হয় তাহলে এর পরিণতি কি হতে পারে, সংশ্লিষ্টদের তা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রইল।

সংশোধনীর ৬নং প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছেÑ ৬ (১) (গ) ধারায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইনবহির্ভূতভাবে কোনো বন্দোবস্ত দেয়া হয়ে থাকলে তা বাতিল এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হতে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহাল’-এর স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতিবহির্ভূতভাবে ফ্রিজল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হয়ে থাকলে তা বাতিল এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হতে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহাল’ প্রতিস্থাপিত হবে। ধারা ৬(১)(গ) এর শর্তাংশ ‘তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপধারা প্রযোজ্য হবে না’ শব্দাবলি বিলুপ্ত হবে। এই সংশোধন প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশ পার্বত্য চুক্তিতে ছিল। অর্থাৎ শান্তি চুক্তিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর সরকারের কর্তৃত্ব বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখানে তা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে।

কারণটা কি? শান্তি চুক্তিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর সরকারের কর্তৃত্ব বহাল রাখা সম্ভব হলেও আজ কেন তা বহাল রাখা সম্ভব হচ্ছে না? বর্তমানে এমনকি পরিবেশ তৈরি হলো, তার ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা দরকার। কেননা রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক শুধু সরকার নয়, মূল মালিক এই দেশের ১৬ কোটি জনগণ। অতএব তাদের সম্পদ অন্যকারো হাতে ছেড়ে দেয়ার ব্যাখ্যা জানার অধিকার দেশের জনগণের আছে। ৯নং প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ ৭(৫) ধারায় ‘চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১) বর্ণিত বিষয়াদিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে’-এর স্থলে ‘চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়াদিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে’-শব্দাবলি প্রতিস্থাপিত হবে। এ প্রস্তাবে কমিশনের চেয়ারম্যানের ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের স্বেচ্ছাচারিতার নিকট ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

কারণ চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে নিয়ে কমিশন। এর মধ্যে তিনজনই উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ। অপরজন সরকারি কর্মকর্তা। এই অবস্থায় অধিকাংশের মতামত কোন দিকে যাবে এটা কি সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভেবে দেখেছেন? এখানে ভাবনার প্রশ্নটা আসছে, কারণ উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এমন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। বরং তারা নানাভাবে সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব খর্ব করার পাঁয়তারা করছে।

ইতোমধ্যে তারা জাতিসংঘকে টেনে আনার চেষ্টা করেছে। এই অবস্থায় উপরের সংশোধনীটি গ্রহণ করে সরকার নিজের পায়ে আরো একটি কুড়াল মারছে না তো? ১১নং প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ ধারা ১০(৩)-এর পরে নতুন উপধারা ১০(৪) নি¤œবর্ণিতভাবে সন্নিবেশিত হবে: ‘(৪) কমিশন কর্তৃক আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে যে কোনো সময় ন্যায়বিচারের স্বার্থে আবেদনকারী তার আবেদন সংশোধন করতে পারবেন’ উপরের সংশোধনীর মর্মার্থ হলো, ইতিপূর্বে দেখা গেছে ভূমি কমিশনে উপজাতীয়রা যেসব আবেদন করেছে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক। তাই সেসব বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু ন্যায় বিচারের স্বার্থে বলা হলেও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের মূল উদ্দেশ্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি নয়, বরং কলেকৌশলে বাঙালিদের ভূমি হস্তগত করা। তাই কোন ভূমিকে নিজের বলে দাবি করার পর তা আইনগত কারণে বাতিল হয়ে গেলে সেই জমি নিয়ে নতুন করে তালবাহানা করে বাঙালিদের হেনস্থা করার সুযোগ থাকে না।

সেকারণেই উপরের সংশোধনীটি নেয়া হয়েছে যাতে, যখনই কোন আবেদন বাতিল হয়ে যাবে বলে মনে হবে তখনই যেন তা আবার নতুন আবেদন করে বিষয়টি জিইয়ে রাখা যায় এবং শেষ পর্যন্ত কমিশনকে ব্যবহার করে জমিটি হস্তগত করা যায়। ১২নং প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ ধারা ১৩(২)-এর পরে নতুন উপধারা ১৩(৩) নি¤œবর্ণিতভাবে সন্নিবেশিত হবে: ‘১৩(৩) এই ধারার অধীন কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলায় উপজাতীয়দের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হবে’ ভূমিকমিশনের অধিকাংশ সদস্য উপজাতীয়, অন্যদিকে পার্বত্য বাঙালিদের পক্ষ থেকে কোন সদস্য সেখানে নেই। তার উপর কমিশনের সকল পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা, কর্মচারীও যদি উপজাতীয় হয় তাহলে সেই কমিশন থেকে পার্বত্য বাঙালিরা সুবিচার আশা করতে পারে এটা কি ভাবা যায়? যারা বিশ্বাস করে পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব বা সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নেই এবং সেখানে বসবাসের অধিকার বাঙালিদের নেই, সেই উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের কর্তৃত্বাধীন ভূমিকমিশন বাঙালিদের উপর সুবিচার করবে এটা কি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন? বাঙালিদের ভূমি এবং ভোটাধিকার হরণ পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যগণ জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে এই আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচিত হইবেন। ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ভোটার তালিকা প্রয়োজন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যাতে জটিলতা সৃষ্টি করা যায়, সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যই পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খ-ের ৯নং ধারার ৪নং উপ-ধারায় কোন ব্যক্তির ভোটার হওয়ার ব্যাপারে একটি বিতর্কিত এবং সংবিধান পরিপন্থী শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি তিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হন। ’ যা পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদ আইনসমূহ সংশোধন করে ১৭নং ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার অ-উপজাতীয়দের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়ে পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা বলিতে- যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণত বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে। ’ অর্থাৎ পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ভোটার হতে হলে বৈধ জমির মালিক হতে হবে। কিন্তু বাঙালিরা যাতে বৈধ জায়গা সম্পত্তির মালিক হতে না পারে সে জন্যও সকল পদক্ষেপ নিয়ে রাখা হয়েছে।

যেমন- খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিক্রয় বা অন্যান্যভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদকে অবহিত করে বা জেলা পরিষদের অনুমতি নেয়াকে শর্ত করে দেয়ায় বাঙালিদের ভূমির মালিক হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে গঠিত ল্যান্ড কমিশনকে অকার্যকর করে রাখার জন্য আঞ্চলিক পরিষদ ২৩ দফা অযৌক্তিক দাবি দিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে সন্তু লারমার ২৩ দফা দাবির মধ্যে ১৩টি সংশোধনী গ্রহণ করে সরকার এক অর্থে নৈতিক পরাজয় স্বীকার করেছে। যা কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

আসলে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের উদ্দেশ্য সরকারে নিকট যাই থাকুক উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এর উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমিহীন করা। কেননা পার্বত্য বাঙালিদের ভূমিহীন করতে পারলে সংবিধান পরিপন্থীভাবে (পার্বত্য জেলা পষিদ আইন বলে) তাদের ভোটাধিকার হরণ করা যাবে। আর সেটা সম্ভব হলে বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে ভূমির অধিকার, ভোটাধিকার হারিয়ে এক সময় হতাশ হতে বাধ্য হবে। আর মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব মানুষ হয়তো পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে যেতে শুরু করবে। ক্রমান্বয়ে বাঙালির সংখ্যা কমতে থাকলে তারা পার্বত্যাঞ্চলে জাতিসংঘের উপস্থিতিতে পূর্বতিমূরের মত স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটের আয়োজন করবে।

সে ভোটের ফলাফল কোন দিকে যাবে তা-তো আগেই থেকেই নির্ধারণ করা থাকছে। অতএব পরিণতিটা সহজেই অনুমেয়। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যত গালভরা যুক্তিই দেখাক না কেন, ভূমিকমিশন আইন সংশোধন, আদিবাসী স্বীকৃতি আদায়, জেলা পরিষদের মাধ্যমে পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রচেষ্টাসহ পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিটি পদেক্ষেপই নিচ্ছে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। ভূমিকমিশন আইন ২০০১-এর সংশোধনীর প্রতিটি প্রস্তাবই তাদের সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যই আনা হয়েছে। এখন সরকার যদি এসব বুঝতে অপারগ হয় তাহলে এর দায় শুধু তাদের ওপর বর্তাবে তা নয়, বরং এদেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককেই ভবিষ্যতের কাঠগড়ায় এর খেসারত দিতে হবে।

অতএব সময় থাকতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভাবতে হবে সরকারকে, ভাবতে হবে সচেতন দেশবাসীকেও।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।