আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আজাদ: তিন হুমায়ুনের মধ্যে প্রথম নক্ষত্র

আমি একা নই......আরও অনেকে আমার সাথে । বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তিনটি বিখ্যাত মেধাবী মুখ যারা অতুলনীয় মহিমায় নিজেদেরকে দেশের সম্পদে পরিণত করেছেন। বিরাট একটি মিল আছে তাদের মধ্যে, তিনজনের নামের প্রথম অংশ এক। তারা হলেন হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন ফরিদী ও হুমায়ূন আহমেদ। দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তিন হুমায়ুন খুব অল্প সময়ের পরিধিতে একে একে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তাদের অমর সব কীর্তি।

তিন হুমায়ুনের মধ্যে প্রথম আকাশের নক্ষত্র হন হুমায়ুন আজাদ। ভাল থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভাল থেকো/ ভাল থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভাল থেকো/ ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা/ ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা/ ভালো থেকো। - হুমায়ুন আজাদ। সাতটি কবিতার বই রচনা করেছেন হুমায়ুন আজাদ। অসম্ভব কাব্যিক সেই বইগুলো কবিতাপ্রেমীদের জন্য হতে পারে নিজের সংগ্রহে রাখার মতো দারুণ অনুসঙ্গ।

তার লেখনিতে প্রতিক্ষণ মা, মাটি, দেশ মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি প্রতিমুহূর্তে পরবর্তী প্রজন্মের দিকনির্দেশনা সরূপ স্বপ্ন বুনে গেছেন। হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য সাহিত্য কর্মের মধ্যে আছে ১৩টি উপন্যাস, ৮টি কিশোর সাহিত্য, ১৩টি কথা সাহিত্য, ১৮টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষা বিষয়ক গ্রন্থ সহ আরো কিছু প্রবন্ধের বই। হুমায়ুন আজাদের উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আছে - সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে, তোমাকে মিনতি করি কখনো তুমি বাংলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিওনা, আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে, আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্যে মারা যাব, আমাদের মা। তুমি জানো না, কোনদিন জানবে না, কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে।

তুমি শিশির দেখোনি, কুয়াশা দেখোনি, কচুরি ফুল দেখোনি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখোনি, পুকুরে দেখোনি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি, -না আমি জানতাম।

বিষয়টি অতীত হয়ে গেছে এই কারণে যে, এখন আমি জড়িয়ে আছি শহরে, আমার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিট, চোখে নিয়ন আলো, চারদিকে গোঁ গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস। কতো দিন আমি তোমার মতোই চাঁদ দেখিনি। শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখিনি দুধের সরের মতো, পদ্মার পাড়ে দেখিনি ধবধবে কাশফুলের সাদা মেঘ। কতদিন দেখিনি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো। কিন্তু যখন আমি হাঁটি, বিকেলে বেড়াই, বই পড়ি, ঘুমোতে যাই, গড়াই স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে তখন আমি একটি ফুলের গন্ধ পাই।

সে ফুল আমার গ্রাম, সে ফুল আমার গাঁ। আমার ছোটবেলার গ্রাম রাড়িখাল। উপরের উদ্ধৃত কথাগুলো সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের। কিশোর গল্প ‘ ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’ বইটিতে তিনি তার মেয়ে মৌলিকে উদ্দেশ্য করে তার ফেলে আসা স্বপ্নের মতো দিনগুলোর কথা লিখেছিলেন। কি সুন্দর সাবলীল প্রকাশভঙ্গি।

সাহিত্যের কোন শাখায় তার পদচারণা পড়েনি! তার হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে বাংলা সাহিত্য। মেয়েকে নিয়ে যেমন প্রাণোবন্ত দুরন্তপনার গল্প লিখেছেন, মাকে নিয়ে তেমনি লিখেছেন নিজের আত্মোপলব্ধি থেকে তুলে আনা এক বিষাদ কাব্য। মায়ের সেই রুপ যেন বাংলার ঘরে ঘরে এখনো চিরন্তন। “আমার মাকে আমরা তুমি বলতাম, বাবাকে আপনি। আমার মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে, কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতো না।

আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনদিন মনেই হয়নি। আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিল আমাদের সমান। আমাদের মা ছিল আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের। বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লাহর মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম। ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।

আমাদের মা ছিল অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো আমাদের মা ছিল বনফুলের পাপড়ি, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো, আমাদের মা ছিল ধানক্ষেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো। আমাদের মা ছিল দুধভাত- তিনবেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো। আমাদের মা ছিল ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম। আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিল কিনা আমরা জানি না। আমাদের মাকে কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।

আমি জানিনা মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না। চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না ” মৌলবাদের বিরুদ্ধে হুমায়ুন আজাদ এর লেখনি ছিল দুর্বার। ২০০৪ সালের বইমেলায় হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সাদ জমিন সাদ বাদ’ প্রকাশিত হয়। এরই জের ধরে মৌলবাদীরা হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে মসজিদে মসজিদে ফতোয়া দিতে শুরু করে। ঐ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি আততায়ীদের দ্বারা গুরুতর আহত হন।

মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সেইযাত্রা ফিরেও আসেন। তারপর ঐ বছরেই জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা করতে জার্মানের মিউনিখে যান। জার্মান যাওয়ার মাত্র পাঁচদিন পর ১২ আগস্ট তাকে নিজের ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এভাবেই বড় অবহেলায় শেষ হয়ে যায় হুমায়ুন আজাদের বর্ণিল জীবন অধ্যায়। তিন হুমায়ুনের মধ্যে তিনিই হন আকাশের প্রথম নক্ষত্র।

হুমায়ুন আজাদের প্রতি জানাই বিনম্য শ্রদ্ধাঞ্জলি। বেচে থাকুক হুমায়ুন আজাদ প্রতিটি বাঙালির মনে। তথ্যসুত্র: হুমায়ুন আজাদের লেখনী থেকে সংগৃহীত।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.