আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিতে এস,এম সুলতান।

প্রবাসী বিশ্ববরেন্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। এস এম সুলতানকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল অল্প কিছুদিন। ১০ই আগস্ট ১৯২৩ সালে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন শিল্পী, মৃত্যু বরন করেন ১৯৯৪ সালে। ১৯৮২ সালে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটী তাকে নির্বাচন করে “ Man of Asia” ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে আমরা স্বাধীন হলাম। বিধ্বস্ত, ধংশপ্রাপ্ত দেশে শুধু অভাব আর অভাব।

সবচে’ বড় অভাব খাদ্যের। দেশী বিদেশী ত্রান সংস্থা যা ত্রান দেয় তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনমতে দিন কাটছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর ১৯৭১ এ আমরা ছিলাম এস,এস,সি পরীক্ষার্থী । পালিয়েছিলাম ভারতে, ভারত থেকে ফিরে এসে শুনেছিলাম খান সেনারা নাকি এস,এস,সি পরীক্ষা নিয়েছিল এবং আমাদের ক্লাশের তরুন রাজাকার কাইয়ুম সে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ ও করেছিল। ১৯৭২ এ এস এস সি পরীক্ষায় পাশ করলাম।

অর্থাৎ আমি হলাম ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ১৯৭১ সালের এস,এস,সি পাশ। ভর্তি হলাম নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে । নড়াইল শহর যারা চেনেন না তাদেরকে নড়াইল শহর একটু চিনিয়ে দিই। নড়াইল শহরের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হল আগের মহকুমা এলাকা। নড়াইলের অপর এলাকা হল রুপগঞ্জ।

দুটো যায়গার মধ্যে দুরত্ব ২ কিলোমিটার মত । নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ রুপগঞ্জে। ১৮৮৬ সালে তদানীন্তন জমিদার নিজের বাড়ীর পাশে প্রতীষ্ঠা করেন এই কলেজ এবং ইংল্যান্ডের মহারানীর নাম অনুসারে নাম রাখেন ভিক্টোরিয়া কলেজ। এই জমিদারই শিল্পী সুলতানকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কোলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি হতে। যশোর -নড়াইল রাস্তা এবং চিত্রা নদী রুপগঞ্জ হয়ে চলে গিয়েছে নড়াইল মহকুমা শহরের ফেরী ঘাট পর্যন্ত।

যশোর নড়াইল সংযোগকারী রাস্তা থেকে রুপগঞ্জ বাজারের মধ্য দিয়ে কলেজের সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে শিল্পী সুলতানের গ্রাম মাছিমদিয়া হয়ে গোবরা গ্রাম পর্যন্ত। বাজার ছাড়লেই রাস্তার ডানদিকে পড়বে খাদ্য গুদাম এবং তার পর কলেজ আর বায়ে চিত্রা নদী। আরো একটু এগিয়ে গেলে কলেজের পর পড়বে বুড়ো বটগাছ, নিশিনাথ তলা। আমাদের সময় বাজারের মধ্য দিয়ে যাওয়া এই রাস্তাটি ছিল খোয়া বিছানো। গ্রাম থেকে তখন কলেজ যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ১১ নং বাস অর্থাৎ পায়ে হাটা।

১০ কিলোমিটার রাস্তা হেটে রুপগঞ্জ বাজারের মধ্য দিয়ে প্রথমদিন কলেজ করতে যাচ্ছি। মনে মনে কিছুটা উত্তেজিত আনন্দিত তো বটেই। রুপগঞ্জ বাজার পেরিয়ে খাদ্য গুদামের পাশের পোস্ট অফিসে উলটো দিকে ছিল দু তিনটে চা য়ের দোকান। চোখ পড়ল চা’য়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসা বেমানান পোশাক পরা এক ভদ্রলোকের উপর। গায়ে সেই গরমের দিনেও ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লা , মাথায় বাবরী চুল, হাতে বাশী , পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বসা ভদ্রলোক।

আশে পাশের পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ন নির্বিকার তিনি। তিনিই যে এস এম সুলতান বা আমাদের নড়াইলের লাল মিয়া তা চিনতে পারি নি তখন। অনেকদিন তাকে দেখেছি একই যায়গায় আপন মনে বসে আছেন। কোনদিন দেখেছি একা একা আপন মনে হেটে যাচ্ছেন। একই বেশভূষা।

কলেজে আমাদের ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন নব কৃষ্ণ বিশ্বাস। স্যারের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম শিল্পির কথা। খান সেনারা শিল্পীর ছবি নস্ট করেছিল, লুট করে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকারেরা শিল্পির বাড়ী , তার আঁকা রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের ছবি দুটো নাকি রক্ষা পেয়েছিল এবং তা পাশের বাড়ীর কারো কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, এ সমস্ত গল্প শুনেছিলাম স্যারের কাছ থেকেই। আমার কলেজ জীবনের শেষদিকে ছবি দুটোকে টানান হয়েছিল কলেজের অফিস রুমে। জানিনা সে ছবি দুটো এখনো সেখানে আছে কিনা।

আমাদের কলেজের রসায়নের শিক্ষক মঈনুদ্দীণ স্যারের ছোট ভাই হানিফ আমাদের কলেজের ছাত্র ছিল এবং শিল্পির সাথে জানা পরিচয় ছিল তার । একদিন হানিফকে নিয়ে চা’য়ের দোকানের সামনে বসে থাকা শিল্পির মুখোমুখি হলাম। কথা খুব একটা বলতেন না তিনি। তবে সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন আমাদের সাথে । হয়ত অল্প বয়সের ছেলে ছোকড়াদের কাছে পেয়ে কিছুটা মজা পাচ্ছিলেন কথা বলতে।

শিল্পী ভালবাসতেন শিশুদের। তাই তো নিজের বাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিশু স্বর্গ। শিল্পী বলছিলেন তার দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতা। সে সব আজ আর আমার মনে নেই। এটুকু মনে আছে তিনি আমাদের বলেছিলেন তার বোস্টন সফরের অভিজ্ঞতা, আমেরিকার কোন কোন শিল্পী বোস্টনে তার ছবির প্রদর্শনীতে এসেছিলেন।

হানিফ ছিল কিছুটা অকাল পক্ক । ধুম করে শিল্পীকে প্রশ্ন করে বসেছিল “ চাচা আপনার ছবির মানুষগুলো সবাই মোটা মোটা কেন? শিল্পীর উত্তর ছিল “ দেখ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষজন অপুস্টিতে ভোগা রোগা সোগা। তা আমাকে কস্ট দেয়। তাই আমার ছবির কল্পনার মানুষগুলোকে স্বাস্থ্যবান হিসেবে উপস্থাপন করি, যেমনভাবে আমি কল্পনা করি আমাদের দেশের সবাই হবে স্বাস্থ্যবান” বিদায়ের সময় তিনি বলেছিলেন “ তোমরা সবাই এসো আমার বাড়িতে, আমি তোমাদের অনেক অনেক গল্প বলব। শিল্পির বাড়িতে আমি সে সময় যাই নি।

গতবছর দেশে গিয়ে গেছিলাম শিল্পীর বাড়িতে তার যাদুঘরে, দেখেছিলাম তার সে বজরাকে। শেষ করছি হানিফের মুখে শোনা শিল্পীর একটা ঘটনা দিয়ে। শিল্পী নড়াইল ছেড়ে নড়তে চাইতেন না। স্বয়ং বংগবন্ধুর অনুরোধে রাজী হয়েছিলেন ঢাকাতে তার ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করতে। যথারীতি সেবার ও শিল্পীর সঙ্গী হয়েছিল হানিফ।

আর্ট কলেজে তার প্রদর্শনী ছিল ১৫ দিনের। ১৪ তম দিনে একজন আমেরিকান তার দুটো ছবি কিনে নেয় সেই সময়ের ৬০ হাজার টাকা দিয়ে। টাকা হাতে পেয়ে শিল্পী লেগে গেলেন তার বহুদিনের শখ বাস্তবায়নে । সে সখ আর কিছুই না দুটো ফুলগাছের চারা লাগাবেন তার বাড়ীতে। দুই দিন ধরে ঢাকার সমস্ত নার্সারী চষে বেড়ালেন হানিফকে সাথে নিয়ে।

পেলেন না, তবে কাটাবনের এক দোকানী জানাল সিংগাপুর থেকে এনে দিতে পারবে সে ফুলগাছের চারা, কিন্তু সময় দিতে হবে ১০ দিন মত। সেই ১০ দিন তারা রইলেন ঢাকায়। ৫৬ হাজার টাকায় দুটো ফুলগাছের চারা কিনে এনে লাগিয়েছিলেন নড়াইলের বাড়ীতে। সে ফুলগাছ বেচেছিল কিনা বা এখনো বেচে আছে কিনা জানি না। শিল্পীর ফুলের চারা কেনা ঘটনা শুনে মনে হয়েছিল সেই প্রবাদ বাক্য “The distance between insanity and genius is measured only by success.” শিল্পী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তার শিল্পকর্মে তাই তো তার প্রতিভার নীচে চাপা পড়ে গেছে পাগলামী।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।