আসেন দুর্নীতি করি। আর এই দুনিয়াটাকেই খুচাই! ইন্টারে পড়তাম। ফুরফুরে মেজাজ, তেজগাও কলেজের বখে যাওয়া জীবনে গা ভাসানো কৈশোর তখন। বন্ধু বান্ধবের আড্ডা, ছাত্রলীগের সিদ্ধার্থ, সোহেলের সাথে উঠা বসা, চা খাওয়া, ভাবই ছিলো আলাদা। সামনেই ছিলো ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ড, ৩ টাকা ভাড়া দিয়ে গাবতলী থেকে ফার্মগেট আবার মাঝে মাঝে ভাড়াও দিতে হতো না।
একদিন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাবো বলে গেটে অপেক্ষা করছিলাম, তখন ট্যাম্পু স্ট্যান্ডটা কলেজের গেটের সামনেই ছিলো। কিছু লোক ১২ বছরের একটা বাচ্চাকে কুকুরের মতো লাথী মারছে আর মুখে জঘন্যতম খিস্তি খেউড়। কিছুদূর দাড়িয়ে ড্রাইভার দেখছে, তার মুখ ভর্তি রক্ত। একজন ৫০ বছর বয়সোর্ধ্ব লোক ছেলেটার বুকে পা দিয়ে দাড়িয়ে আরেকজন মধ্যবয়স্ক তার পেটে লাথী মারছিলো একের পর। ছেলেটা ক্ষীন স্বরে বলছিলো "মা" "মা"; আমি দৌড়ে গিয়ে বুড়ো লোকটাকে ধাক্কা দিলাম।
হ্যাংলা ছিলাম, গায়ে তেমন শক্তি ছিলো না আমার। আমার ধাক্কা খেয়ে বুড়োটা তেমন লড়লো না। কিন্তু মুখের খিস্তিখেউড় বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বুড়োটা আর ঐ মধ্যবয়স্ক আমাদের সাদা শার্ট দেখে চলে গেলো।
আমি ছেলেটাকে উঠাবো, বন্ধু বান্ধব টানাটানি করে বললো,"পুলিশ কেস"। আমাকে হ্যাচকা টানে ওরা নিয়ে যায়। যাবার সময় শুনতে পেয়েছিলাম ৫ টাকার বদলে ১০ টাকার নোট নিয়েছিলো, ভাংতি দিতে খেয়াল ছিলো না। খামার বাড়িতে নামতে পারেনি বাকী ৫ টাকার নেবার জন্য এই ক্ষোভে স্ট্যান্ডে এই পিটানি। আমি জানি না এরকম নি্ম্ন শ্রেনীর মানুষ মার খেয়ে কোথায় চিকিৎসা নেয়, কিভাবে খুজতে হয় কারন আমি ঢাকায় নতুন।
দুদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরে পরে ভুলেও গিয়েছিলাম। ১২ বছরের একটা কিশোরকে এরকম ভাবে মারাটা ঠিক হয়েছিলো কি না মাত্র ৫ টা টাকার জন্য সেটার উত্তর খুজবার আর কোনো ইচ্ছা জাগেনি!
আমাদের সামনে পাহাড় সমান সমস্যা। প্রতিটা সরকারী অফিসে দুর্নীতি চলছে। সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকার স্কেলে চাকুরি করে কিভাবে একজন সেনা প্রধান বারীধারায় বিশাল এপার্টম্যান্ট বানায় জানি না।
৮০ হাজার কোটি টাকার মালিক ঠিক কারনে সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা মেরে খায়, তাও আবার বুক ফলিয়ে বলে আমি নির্দোষ সেটাও মাথায় আসে না।
ধরে নিলাম আমরা সবাই পচে গেছি, আসলেই কিন্তু আমরা পচে গেছি। তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে এই যে এতবড়ো চুরি এটা ধরলো কে? তার ধরার কি দরকার ছিলো? যে ধরেছে তার বেতন কতো?
যে চুরি করেছে তার চুরিটা আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে খুব বড় একটা চুরি না। কারন ব্যাংক নাকি ৪০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবার অনুমতি আছে। তার মানে দেখা যাচ্ছে স্বয়ং সরকার এই চুরিটাকে খুব বড় কিছু মনে করছে না।
বড় মনে না করতেই পারে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিদেশের প্রচারযন্ত্রে বলে আসে দেশে নাকি উন্নয়নের জোয়াড়ে ভাসছে, ১০ শতাংশ দারিদ্র্য নাকি তার আমলেই কমে গেছে সেখানে এই চার হাজার কোটি টাকাতো নস্যি।
আমি ভাবছি সবাই খারাপ হবার পরও তারপরও এমন একজন আছে সবজায়গায় যাদের কারনে আমরা জানতে পারি এরকম হলমার্ক স হ আরও বেশ কয়েকটি বড় চোরের কথা। আমাদের দেশে কেউ এক টাকা বেশী নিলে অথবা হাতের ৩০ টাকার ঘড়ি কোনো কিশোর ছিনিয়ে নিয়ে গেলে অথবা চুরি করলে তাকে খিস্তি খেউড়ের বন্যার সাথে সাথে পায়ের নীচে রেখে বুকের সব কটা হাড় ভেঙ্গে প্রমান করা হয় ওর দুর্বলতা কতখানি। অথচ আমাদের চোখের সামনে খাদ্যে ফর্মালিন মাখানো হয় সেগুলো আমাদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়।
অথবা দরবেশ বাবার মতো পুরো শেয়ার বাজার খুবলে খায় অথবা জয়ের মতো একজন পার্টি বাজ লোককে দেশে কম্পিউটার বিজ্ঞানী বা ডিজিটাল বাংলাদেশের জনক উপাধীতে ভূষিত করা হয় যেখানে সে সুদূর আমেরিকায় বসে একের পর এক বাড়ি কিনে আর বোনের শ্বশুড়ের নামে কোটি কোটি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ওগুলো ওড়ায়।
বলি ৪৫ হাজার টাকার বেতনপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ঠিক কতটাকা উপার্জন করলে তার ছেলে ওখানে কোনো চাকুরি বাকুরী না করে এতগুলো বাড়ি কিনতে পারে?
শুনেছি হলমার্কের এতবড় কেলেংকারী সহ আরও বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার কেলেংকারী যে ধরেছেন তাকে নাকি বদলী করে অজঁপাড়াগায়ে পাঠানো হয়েছে। দুদকের একটা নিয়ম আছে, সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় কোনো আর্থিক দুর্নীতি ধরলে উদ্ধারকৃত টাকার ১০ শতাংশ যে বা যাহারা সাহায্য করেছে তাদেরকে দেয়া হয়। অথচ তাকে বদলী করা হলো।
সেখানে হলমার্কের মালিককে ডেকে এনে মাত্র অর্ধেক টাকায় দফরফা করা হলো।
তার স্ত্রী যে গাড়িটা চালিয়ে আসলো দুদকে সেটাও অবৈধ, তার নাকি কোনো লাইসেন্স প্লেট নেই। দুর্নীতি কতটা ওপেন সিক্রেট হলে এমন হয়।
দেশের কোথায় এই দুর্নীতি নেই? যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে সকল মন্ত্রী আমলা দুর্নীতিগ্রস্হ। যেখানে জাতীর সামনে বড় কোনো আদর্শ পর্যন্ত কলুষিত সেখানে ভালো মানুষটাই কোথায়। প্রত্যেকটা সরকারী অফিসে জিজ্ঞেস করুন বলবে তাদের কোনো দুর্নীতি নেই।
কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আপনি কোনো ঘুষ ছাড়া করাতে পারবেন না। তার মানে ঐ অফিসারের বড় কর্তা থেকে শুরু করে দারোয়ানটা পর্যন্ত ঘুষ খায়। কে করবে এই ঘুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ?
আর যে সিস্টেমটা আছে ঘুষের বিরুদ্ধে কাজ করাবার সেই সিস্টেমটাকে আমরা দিনে দিনে ধ্বংস করেদিয়েছি। সেজন্যই দেখেন ওবায়দুল কাদের চড় মারতে সাহস পায় একজন টিকেট চেকাররের মতো চতুর্থ শ্রেনীর কর্মকর্তাকে।
তার মানে দুদককে কাজে না লাগিয়ে সে হাত তুললেন। দুদুকের উপর তার নিজের কতটা বিশ্বাস সেটা এই এক চপেটাঘাতের সস্তা নাটক দেখেই বোঝা যায়।
তারপরও আমরা এসব দুর্নীতির খবর পাই। চাল ডাল সংগ্রহ করা নিয়ে দুই কোটি টাকার ঘুষ আদায়, অথবা রেলের এত বড় বড় দুর্নীতি অথবা সোনালি জনতা অগ্রনী স হ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যেসব ব্যাংকের লভ্যাংশ থেকে সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন দেয়া হয়, আমজনতার টাকা জমা রাখে, রাস্ট্রচালনার টাকা যেখানে জমা হয়, সেই টাকা মেরে নেয় সরকারের সমর্থক শক্তিশালী কিছু কুমীর। আর তাদের পক্ষে সাফাই গায় অর্থমন্ত্রীর মতো লোক!
একটা সরকারী অফিসে আপনি তখনই জানবেন যে একজন সৎলোক আছে যখন আপনি দেখবেন ঘুষ ছাড়া যে কাজটা হচ্ছে না সে কাজটা একজন এসে বিনা পয়সায় করিয়ে দি্চ্ছে।
এমন লোক আমি কিছু পেয়েছিলাম। বিটিআরসি, সিভিল এভিয়েশন, কৃষি ব্যাংক, ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল, চুয়েটের অফিস, ওখানকার সোনালী ব্যাংক শাখা, খুলনা বিআইটির অফিস,ফার্মগেটের টিএন্ডটি অফিস ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো তো আজ থেকে ৬-৭ বছর আগের কথা, এখনও কি এগুলো ঠিক আছে?
তবু এতকিছুর পরও একটা ঘটনা গত তিনটা বছরে আমার খুব ভালো লেগেছে।
শাবিপ্রবি নাকি এবার গনিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সম্মান বয়ে এনেছে তাদেরকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পছন্দমতো বিষয়ে বিনা ভর্তি পরীক্ষায় এবং বিনা খরচেই পড়তে দেয়া হবে।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশ যতটুকু এগিয়েছে এর পিছনে রাজনীতিবিদ বা বড় বড় উপাধী সংশ্লিষ্ট নেতাদের কোনো অবদান নেই।
অবদান হলো সেসব মানুষ যারা ভালো কাজ করতে গিয়ে এবং সৎ থাকতে গিয়ে না খেয়ে মরে।
এমন দিনটি দেখতে খুব কষ্ট হবে যখন দেখবো আমাদের দেশে ভালো কোনো মানুষ জন্মাচ্ছে, যারা জন্মাচ্ছে সবাই শুয়োর হয়ে, আর আমরা সবাই এই শুয়োরগুলোকেই পদচুম্বন করছি!
একটা গল্প লিখেছিলাম এমন লোকদের নিয়ে, এখন মনে হয় এসব লোক মরে গেলেই তো ভালো হয় , তাহলে আমরা বুঝতে পারবো আসলে আমরা কি হারিয়েছি! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।