আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার সাধের বাইসাইকেল

ভাবতে ভাবতেই একসময় হারিয়ে যেতে চায় ভাবনার জগতে সবেমাত্র সাইকেল চালানো শিখেছি। প্রতিরাতেই তাই সপ্ন দেখি বাবা আমার জন্য নতুন একটা সাইকেল কিনে দরজার সামনে রেখে দিয়েছে। এমনি এক ঘুম ভাঙা সকালে আমি কোন এক অজানা কারণে ঘরে বাবাকে খুঁজতে লাগলাম। মনে পড়ে দিনটি ছিল শুক্রবার। সাভাবিক ভাবেই বাবার বাসাই থাকার কথা।

বাবা বাসাই নাই দেখে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম “বাবা কোথায়?” আম্মাও আমার সাথে অনেকক্ষণ লুকোচুরি করার পর বলল “তোর বাবা সাইকেল কিনতে গেছে”। তারপর সারাদিন আমার এক কঠিন উত্তেজনায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, শুধুই ছটফট করা। কখন বাবা আসবে। বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকা, যখনই কোন একটা ট্রেনের শব্দ হয়, মনে হয় এই বুঝি বাবা এল সাইকেল নিয়ে। মফস্বলে থাকার কারণে বাবা গিয়েছিলেন জেলা শহরে সাইকেল কিনতে।

এভাবে সারাদিন অপেক্ষার পর অবশেষে বাবা ফিরল বিকেলে। তারপর আমার সেকি আনন্দ বাবার হাত থেকে সাইকেল নিয়ে সেই যে ছুট, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমার সাধের নতুন ফনিক্স সাইকেল। তখনও ঠিকমত চালাতে পারতাম না নিচে থেকে চালাতাম। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, সাইকেল মাড়িয়ে স্কুলে যেতে চাইতাম বাবা দিত না।

বাবার কথা, আরও ভাল করে শিখে তারপরেই সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাবে। আমার মাথায় তখন শুধুই দিনরাত ঘুরত সাইকেল আর সাইকেল। কবে ভাল করে শিখব, কবে স্কুলে নিয়ে যাব, কবে বন্ধুদের দেখাব আমার সাধের বাইসাইকেল। ক্লাস ফাইভে বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রথম সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া, প্রথম দিনই হাত-পা ছিলে রক্ত বের করা। এই ঘটনার পর বাবার অত্যধিক কড়া নির্দেশ, না, সাইকেল নিয়ে আর রাস্তা ঘাটে বের হওয়া নয়।

আমার মনে মনে খুব রাগ লাগত তখন, এ কেমন কথা, সাইকেল কিনে দিয়েছে অথচ সেটা নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারব না!! তারপর থেকে প্রতিদিন সকালে উঠতাম আর অপেক্ষা করতাম কখন বাবা অফিসে যাবে আর তারপরই শুরু হত সাইকেল নিয়ে আমার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। অবশেষে ক্লাস সিক্সে প্রথম সাইকেল নিয়ে স্কুলের দরজায় প্রবেশ। কিযে ভাল লাগত, আমিও একটি সাইকেলের গর্বিত মালিক ভেবে। স্কুলে গেলেই ক্লাসে বসে খালি অপেক্ষা করতাম কখন টিফিন হবে। আর টিফিন হওয়া মানেই সাইকেল নিয়ে আবার বাসাই যাওয়া, বাসাই খাওয়া-দাওয়া করে আবার স্কুলে ফেরা।

আবার বিকেলে ছুটির জন্য অপেক্ষা, আরেকটু সাইকেল চালানোর আসায়। কখনও বাজারে যাওয়া হয়ে উঠত না আমার, সাইকেল কেনার পর বাজারের যে কোন টুকটাক বাজারের ফরমায়েশ গুলো আমিই করতাম। মাঝে মাঝে বর্ষার দিনে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধুরা মিলে ছুটে যেতাম বন্যা দেখতে। একঝাক সাইকেলের মাঝে যখন আমার সাইকেলটিও ছুটে যেত কিযে ভাল লাগত। ইতোমধ্যে ভাইয়াও সাইকেল চালানো শিখে গেছে।

বলা ভাল আমার বড় ভাই আমার পরে সাইকেল চালানো শিখে। ভাইয়া তখন কলেজে পড়ে। কলেজ ছিল বাসা থেকে অনেক দূরে। তাই তখন থেকে বেশিরভাগ সময় ভাইয়াই সাইকেল নিয়ে যেত। আমার আর আগের মত সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাতায়াত থাকল না।

মনটা খুব খারাপ লাগত। মনে মনে খুব রাগও লাগত খালি ভাবতাম ইস একদিন যদি এমন এক দুর্ঘটনা ঘটত, জীবনের তরে সাইকেল নিয়ে কলেজে যাওয়ার শখ মিটে যেত। হঠাৎ একদিন ভাইয়া কলেজ থেকে ফিরতে দেরি করছে। দেরি নয় এ যেন ভিষম দেরি। ফিরতে ফিরতে ফিরল সন্ধ্যার পর কিন্তু সাইকেল ছাড়া।

ভাইয়ার কিছু বলার আগেই বাবা বুঝে গেলেন ব্যাপারটা কি। বাবা বললেন, “সারাদিন মনে মনে ভাবলাম আজকে বোধহয় ও সাইকেলটা হারিয়ে ফেলেছে, হলও তাই”। খবর শুনে আম্মার মাথা ঘুরানো শুরু করে দিল। আমার মনটা এত খারাপ হল সাথে সাথে নিজের উপরও প্রচুর মেজাজ খারাপ হল, খালি মনে হতে লাগল আমি কেন খারাপ কিছু চাইতে গেলাম। কান্না চেপে রাখতে পারলাম না।

আর ভাইয়ার প্রতিও প্রচুর রাগ উঠতে লাগল, সাইকেলটার দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারল না!! ইস। সারারাত আম্মা আর ভাইয়ার খাওয়া দাওয়া বন্ধ। আম্মার তজবি তেলাওয়াত চলছে, আর সাথে বাবার শান্তনা, বিশেষ করে ভাইয়াকে। পাশের বাসার দাদু মাঝে মাঝেই বাসার দরজায় এসে আম্মাকে জিজ্ঞেস করছে, “মা, সাইকেলডার কুনো খুজ খবর পাইলা?? দুয়া ইঊনুছ পড়তে থাক পায়ে যাবা”। খুব সকালে বাবার কিছু ছাত্র বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে সাইকেলের বেল বাজাতে লাগল আমি দৌড়ে বের হয়ে দেখি আমার সাইকেল।

তাদের মধ্যে একজন আবার এক রোগা পটকা লোকের শার্টের কলার চেপে ধরে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম “উনি কে?”। তারা বলল-“এই ব্যাটায় তো বদমায়েশ চোর” তারা বাবাকে বলল “স্যার এইডারে কি আমরাই সাইজ করুম নাকি পুলিশে দিয়াইমু, শালা সারাডা রাইত বহুত ঘামাইছে। ” বাবা বলল- ওকে ছেড়ে দাও, সাথে কিছু টাকা দিয়া দাও। সাইকেলটা পাইছি আমার মনে এখন ওর প্রতি আর কোন রাগ নাই ওকে ছেড়ে দাও।

আর তোমরা এইখানে সকালের নাস্তা করে যাও। তারপর ভাইয়া এইচ এস সি পাশ করে ঢাকায় চলে গেল। তখন একান্তই আমিই সাইকেলের মালিক। ভাইয়াকে আমি বাবার চেয়েও বেশি ভয় পেতাম। তাই যতটুকু সময় পেতাম বাবার অনুপস্থিতিতে সেটাও ভাইয়ার শাসনের ভিতরেই থাকতে হত।

তাই আমি এখন বলতে গেলে মোটামুটি এক মুক্ত পাখি। আর এই সময় দশ্যি পনাও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যেতে লাগল। এভাবে আমার সাধের বাইসাইকেলের আরোহি হয়ে কাটিয়ে দিলাম ক্লাস এইট পর্যন্ত। যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন কৈশোর আর তারুণ্যের এক মিলিত হাওয়া লাগতে লাগল গায়ে। জীবনের প্রথম সিগারেটে ফুঁ দেয়া, প্রথম প্রেমের বহিঃপ্রকাশ... মনে পড়ে কত মুরুব্বির কাছ থেকে সিগারেট ফুঁকানোর সময় ধরা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে আমার সাধের বাইসাইকেল।

মনে পড়ে মিলির রিকশার পিছন পিছন ওর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া। তারপর ওর বোনের ঝাড়ি শুনে সাইকেল নিয়ে দৌড়ের উপর থাকা। বৃষ্টির দিনে জ্যোতিদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টঙের দোকানের চা খাওয়া। তারপর জ্যোতির ভাইয়ের চেহারা দেখা মাত্র মুকিত আর আমি আবার ছুটে চলা। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম।

আমারই মফস্বলের কলেজ। এলাকার বাইরের কলেজে যাওয়া হল না। হইতবা আমার সাইকেলই আমাকে যেতে দিল না। কলেজে প্রতিনিয়ত যাতায়াত ছিল সাইকেলে। প্রতিদিন সকাল সাতটায় বের হতাম সাধের বাইসাইকেল হাতে।

তারপর তিনটা টিউশনির পাঠ চুকিয়ে, কলেজের পাঠ চুকিয়ে বাড়ি ফেরা হত কাঠফাটা দুপুরে। কিন্তু শরীরে কখনো কোন ক্লান্তি ছুতে দেয়নি আমার সাধের বাইসাইকেলটি। টিউশনিতে পড়তে গিয়ে মনের অজান্তেই মনের গভীরে অবনীর জন্য জায়গা তৈরী করা। প্রতিনিয়ত কোন এক ছুতোয় ওর বাড়ি যাওয়া। এ সবই হত আমার সাধের বাইসাইকেলের কারণে।

একদা একদিনের কাহিনী। প্রত্যেকদিনের মত সেদিনও সবকিছুর পাঠ চুকিয়ে বাড়ি ফিরব। কলেজ থেকে বের হয়ে কিছুদুর না যেতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। আমরা তিন বন্ধু সুমন, শিপলু আর আমি শৌখিন ছুটলাম সাইকেল নিয়ে। বদমাইশির লিমিটের বাইরে ছিলাম বলে পুরো কলেজ আমাদের চিনত “এস গ্রুপ” নামে।

বৃষ্টির ভিতর পুরো রাস্তা ফাঁকা। আমরা তিনজনই হাতে একটি করে বেনসন জ্বালিয়ে ছুটছি। পথিমধ্যে হঠাত শিপলু ওর চশমা খুলে ফেলল। তারপর সেকি গান “নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা”। আমি আর সুমন পিছন দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম কারণ আমরা জানতাম চশমা ছাড়া ও কিছুই দেখতে পারে না।

আমরা খালি ভাবতেছিলাম। ভাবতে না ভাবতেই আমরা জোড়ে চিৎকার করে উঠলাম শিপলু সামনে রিকশা, আহ বেচারা চশমাটাও পড়তে পারল না। রিকশার সাথে এমন জোড়ে ধাক্কা খেল। না না, শিপলুর কিছু হয়নি উল্টো আমরা অবাক হলাম শিপলুর সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে রিকশার উল্টে যাওয়া দেখে আর রিকশার ভিতর থেকে এক তরুণীর পরে যাওয়া দেখে। সেকি কান্ড।

অবশ্য শিপলুর সাইকেলের সামনের চাকা বেকে গেল। তারপর তিনজন মিলে ধরাধরি করে ওর সাইকেলসহ ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা। এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে দেখি বাসার একটা অংশ ফাঁকা। হঠাৎ করে খেয়াল হল আমার সাধের বাইসাইকেলটা নেই। আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম “আম্মা, সাইকেলটা কই??” আম্মা বলল “সাইকেলটা তোর বাবা এক গরীব ছেলেকে দিয়ে দিয়েছে, ছেলেটা অনেক দূর থেকে স্কুলে ক্লাস করতে যায়।

” মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। শৈশব কৈশোরের কত স্মৃতি বিজড়িত আমার সাধের বাইসাইকেল। তবুও ভাল লাগছে এইভেবে অনেক অযত্নে আর অবহেলায় পড়েছিল আমার সাধের বাইসাইকেলটি, এখন কিছুটা হলেও যত্নে থাকবে। আরও ভাল লাগছে এইভেবে যে সাইকেলটা আবারও তার হারানো দিনগুলোকে ফিরে পেল। আবারও হয়তোবা সাইকেলটা কোন এক মিলি নয়তো কোন এক অবনীর বাড়ি যাবে নতুন এক ছেলেকে আরোহি করে।

ইস সাইকেলের মত আমিও যদি ফিরে পেতাম আমার হারানো দিনগুলোকে... এখন আমি বাইক চালায়। মাঝে মাঝেই মনে হয় আমার পায়ের নিচে কোন প্যাডেল নেই। ছোটবেলায় সাইকেল চালাতাম আর সাইকেলটাকে বাইক মনে করে ভুম ভুম শব্দ করতাম। আজ সত্যিকারের বাইক আমায় কোন সাইকেলের অনুভুতি দিতে পারে না। এখনকার হাজারো যানবাহনের ভিরে আমি খুঁজে ফিরি আমার সাধের বাইসাইকেলকে হয়তোবা খুঁজে ফিরব সারাজীবন কারণ আমার হৃদয়ের এককোণে চিরস্থায়ী ভাবে জায়গা করে নিয়েছে আমার সাধের বাইসাইকেল।

মায়া ব্যাপারটি বড়ই অদ্ভুত, এক জড়বস্তু সাইকেল সেও আমাকে কেমন মায়ার জালে বেধে ফেলেছে। যেখানেই থাকিস সুখে থাকিস, ভাল থাকিস, মনে রাখিস আমার প্রিয় সাধের বাইসাইকেল।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।