আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যান্সার এবং স্ট্রেস

১৯৯৮০ সালে আমেরিকার চিকিৎসকরা সমবেত হয়েছিল একজন নামকরা মনোবিজ্ঞানীর দেয়া, ক্যান্সার সাথে স্ট্রেসের কি সম্পর্ক সে সম্পর্কে তার লেকচার শোনার জন্য। কিন্তু ওই সময় কোন চিকিৎসকই ওই মনোবিজ্ঞানীর দেয়া ধারনার সাথে একমত হতে পারছিলেন না। কিন্তু সম্প্রতি চিকিৎসকরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, স্ট্রেসের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেন বলেছিলেন যে বিষণ্ণ মানুষ অসুখ-বিসুখে বেশি আক্রান্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মহিলাদের স্তন কান্সারে ধরা পরে তাদের মধ্যে অধিকাংশই জীবনের কোন না কোন সময় বড় রকমের কোন স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে পার করেছে, যেমন- গর্ভপাত, বিবাহ বিচ্ছেদ, শিশুর অসুস্থতা অথবা চাকরি হারানো এইসব।

আপনাদের কি মনে হয়, আমাদের জীবনের এই নাটকীয় ঘটনাগুলোর সাথে অসুস্থতার কোন যোগসূত্র আছে? আমার মনে হয় আছে, আমি যেদিন খুব স্ট্রেসের মধ্যে থাকি সেদিন একটু কাজ করলেই খুব ক্লান্ত অনুভব করি। নিশ্চয় মন এবং দেহের সাথে কোন না কোন যোগসূত্র আছে, যা আমারা বেশিরভাগ সময়ই বুঝতে পারি না। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই মন ও দেহের এই সম্পর্ক বুঝা আরও কঠিন, কারন দেহে ক্যান্সারের শুরু হওয়ার পরও শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে ৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। আর একারণেই মানুষ ভুলে যায় কখন, কোন স্ট্রেস তার এই অসুস্থার জন্য দায়ী। স্ট্রেস কীভাবে ক্যান্সার সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে তা বর্ণনা করার আগে ক্যান্সার সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারনা নেয়া যাক।

ক্যান্সার মানুষের সমগ্র দেহকে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত করে। এই যুদ্ধে ক্যান্সার কোষগুলো হচ্ছে অস্ত্রধারী দুস্য যারা দেহের স্বাভাবিক নিয়ম কানুন মানতে নারাজ। তাদের প্রধান অস্ত্র হছে তাদের অস্বাভাবিক জীন যাদের কারনে ক্যান্সার কোষ সহজে দেহের স্বাভাবিক নিয়মকে ফাকি দিতে পারে। যেমন- দেহের কোথাও কোষ বিভাজন প্রয়োজন তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক কোষ তৈরি হওয়ার পর প্রত্যেক কোষ তার পার্শ্ববর্তী কোষকে আর বিভাজিত না হওয়ার জন্য সংকেত পাঠাতে থাকে, কিন্তু সেখানে যদি ক্যান্সার কোষ থাকে সে ওই সংকেতে সাড়া না দিয়ে, অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হতে থাকে। ক্যান্সার কোষগুলো যখন সংখ্যায় অনেক বেড়ে যায় তখন তাদের অতিরুক্ত খাদ্যের প্রয়োজন হয়।

আর এই অতিরুক্ত খাদ্য সরবরাহ করার জন্য পার্শ্ববর্তী রক্তনালীগুলোকে তাদের দিকে বর্ধিত হয়ে খাদ্য সরবরাহ করতে বাধ্য করে। কিছু দিনের মধ্যেই কোষগুলো টিউমারে পরিনত হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার কোষগুলো দেহের প্রতিরধ বাবস্থার কারনে তাদের শক্তি পুরুপুরি প্রয়োগ করেতে পারে না ফলে দেহের কাছে হার মানেতে বাধ্য হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন এবং খাদ্য প্রয়োজন দেহ সেই খাদ্য সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয় যার ক্যান্সার দুর্বল হয়ে পরে। প্রথমে দেখা যাক, আমাদের দেহ কীভাবে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে।

দেহকে বাহিরের কোন শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য দেহের কিছু কোষ বিশেষ ধরনের antibody নামক সৈনিক তৈরি করে। যে কোষগুলো এই সৈনিক তৈরি করে তাদেরকে বলা শ্বেত রক্ত কণিকা। সব থেকে ভাল হয় যদি আমাদের রোগ প্রতিরধকারী কোষগুলো কীভাবে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে তার সরাসরি দেখা যেতো। এই কাজটি করেন মিলার নামক একজন বিজ্ঞানী, তিনি ক্যান্সার কোষে আক্রান্ত একটি ইদুরের পেট থেকে কোষ নিয়ে তাকে অণুবীক্ষণ জন্ত্রের নিচে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান শ্বেত রক্ত কণিকা ক্যান্সার কোষকে আক্রমন করছে, তিনি আরও দেখতে পারেন যে প্রাকৃতিক ঘাতক (Natural killer) কোষ নামের কোষও ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করছে। Natural killer কোষ আর শ্বেত রক্ত কনিকার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, অপরিচিত শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করতে শ্বেত রক্ত কণিকার একটু বেশি সময় লাগে, অন্য দিকে natural killer কোষ খুব দ্রুত বাহির থেকে প্রবেশ করা যেকোনো শত্রুকে আক্রমন করে এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে মেরে ফেলে।

কান্সারের একটা প্রধান করন হচ্ছে প্রদাহ, প্রদাহ আমাদের দেহের জন্য ভাল খারাপ দুটো কাজই করে থাকে। অনেক সময় সক, কাটা ছেরা, পোড়া অথবা ইনফেকশনের করনে আমাদের দেহে নতুন কোষে তৈরি করা প্রয়োজন হয়ে পরে। যখনই কোন টিস্যু ধ্বংস হয় তাকে সনাক্ত করে রক্তের অণুচক্রিকা নামক কোষ এবং নিজেদেরকে ওই ধ্বংস হওয়া টিস্যুর আশেপাশে একত্রিত করে সেই সাথে টিস্যুকে মেরমত করার জন্য Platelet derived growth factor, নামক পদার্থের মধ্যমে বার্তা ছড়িয়ে দেয়। সম্পূর্ণ মেরামত পক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য শ্বেত রক্ত কণিকাও কিছু কেমিক্যাল নিঃসৃত করে যেমন-সাইটোকাইন, প্রস্টাগ্যান্ডিন ও লিউকটাইরিন্স ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই পক্রিয়াকেই বলা হয় প্রদাহ, যা শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ অবস্থায় রাখার জন্য খুবই প্রয়োজন।

কিন্তু এই একই পক্রিয়া যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় তখন আমাদের অনেক বড় রকমের ক্ষতির কারন হতে পারে। প্রদাহের মাধ্যমে দেহ যেভাবে তার, ক্ষত পুরন কররে সেই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ নিজে বাড়তে থাকে। যে পদার্থগুলো যেমন- সাইটোকাইন, প্রস্টাগ্যান্ডিন ও লিউকটাইরিন্স প্রদাহের মাধ্যমে দেহের ক্ষত পুরনের কাজ করতই সেই তারাই আবার ক্যান্সার কোষের বেড়ে উঠার জন্য সার হিসেবে কাজ করে। স্বাভাবিক কোন ক্ষতের ক্ষেত্রে, ক্ষত সেরে যাওয়ার পর প্রদাহ কমে যায়। কিন্তু কান্সারের ক্ষেত্রে প্রদাহ কমে ত না ই আবার আসে পাশের কোষগুলতে তাদের প্রদাহের বার্তা ছরাতে থাকে।

যার ফলে কোষ ফলে কোষ বিভাজন পক্রিয়া বন্ধ না হয়ে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে থাকে। এছাড়াও যেসব কোষের স্বাভাবিক ভাবে মারা যাওয়ার কথা, তারা মারা না গিয়ে বরঞ্চ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি করতে থাকে। প্রদাহ তৈরির জন্য যে পদার্থগুলো দায়ী, তাদের অতিরুক্ত উৎপাদনের কারনে মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ বাবস্থা হয়ে যায় খুবই দুর্বল। এমনকি শ্বেত রক্ত কণিকা, Natural killer cell ক্যান্সার কোষের সাথে যুদ্ধ করার কোন চেষ্টাই করে না, ফলে ক্যান্সার কোষ দেহের মধ্যে আরাম আয়েসে বড় হতে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ক্যান্সার হলে প্রদাহ সৃষ্টির জন্য যে পদার্থগুলো দায়ী তাদের পরিমান দেহে অনেক বেরে যায় তাই ওই পদার্থগুলোর মাত্রার উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে ক্যান্সার কত শক্তিশালী এবং রুগী কত দিন বাঁচবে।

এই ছবিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে মানসিক অবস্থা রুগীর দেহে কান্সারকে প্রভাবিত করে। Antoni et al. Nature Reviews Cancer 6, 240–248 (March 2006) | doi:10.1038/nrc1820 এতক্ষনের আলোচনায় যা বললাম সবই তো ছিল গেল দেহের কার্যক্রম, এখন দেখা যাক আমাদের মানসিক অবস্থা কীভাবে এই শারীরিক অবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। আগের আলোচনায় জানা গেছে যে, ক্যান্সার কোষের বেঁচে থাকার জন্য রসদ জোগান দেয় প্রদাহ সৃষ্টিকারী পদার্থগুলো আর দে এদের উৎপাদন বেড়ে যায় যখন কেউ নিজকে খুব নিঃস্ব এবং আসহায় মনে করে। এ ধরনের মানসিক অবস্থায় দেহে আরও দুটো পদার্থের পরিমান বেড়ে যায় যাদেরকে বলা হয়, নরএড্রেনালীন এবং করটিসল। এদেরকে বলা হয় স্ট্রেস হরমোন, এরাই প্রদাহ সৃষ্টির জন্য দেহে টিস্যুগুলোকে প্রথম উদ্ভুদ্ধ করে।

একই সাথে এই স্ট্রেস হরমোন আবার দেহের রোগ প্রতিরোধ বাবস্থাকে দুর্বল করে দেয়, ফলে ক্যান্সার কোষের সাথে যুদ্ধ করার মত শক্তি তাদের থাকে না। বিজ্ঞানের নূতন এই ক্ষেত্রকে বলা হয় সাইকোনিউরোইমিউনোলোজী। এই শব্দের তিনটি অংশ আছে, সাইকো- যার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে মানুষের সাইকোলোজীক্যাল অবস্থা- ধরা যাক একজন লোক জীবনের অনেক কঠিন সময় পার করছে সে মনে করছে তার জীবনটা অর্থহীন, সে অসহায় এই হচ্ছে তার সাইকোলোজীক্যাল অবস্থা। তারপর নিউরো- হচ্ছে নিউরোলোজীক্যাল অবস্থা। লোকটির নিজকে অসহায় মনে হওয়ার কারনে তার মস্তিকের নিউরন তৈরি করে স্ট্রেস হরমোন যেমন এড্রেনালিন, করটিসল।

এই হরমোন ফলে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন, বেড়ে যায় রক্তের চাপ এবং মাংস পেশীগুলো হয়ে যায় টান টান। এই নিঊরলজীক্যাল রেসপন্স কে বলা হয় “ Fight-or-flight response” . এই স্ট্রেস হরমোন আরও একটা ফলাফল হল ইমিঊনোলজিক্যাল রেসপন্স, স্ট্রেস হরমোনের বার্তা গ্রহন করার জন্য শ্বেত রক্ত কনিকার পৃষ্ঠে একধরনের গ্রাহক যন্ত্র থাকে, যা রক্তে স্ট্রেস হরমোনের উপস্থিতি বুঝতে পারে এবং তার বার্তা অনুযায়ী বেশি বেশি প্রদাহ সৃষ্টিকারী পদার্থ তৈরি করতে থাকে। এই স্ট্রেস হরমোন আতই ধ্বংসাত্মক যে তারা Natural killer cell এর কার্যকারীতা একেবারে বন্ধ করে দেয়। আর সবকিছু মিলেয়ে দেহে এক anarchy এর সৃষ্টি যাতে ক্যান্সার কোষ সব থেকে বেশি লাভবান হয়, এবং কোন বাধা বিপত্তি ছারাই বেড়ে উঠে এবং ধীরে ধীরে রুগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে হেয়। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.