আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: পরকীয়া

“দেখুন, পরের বৌয়ের সাথে প্রেম করার মত ঝকমারি আর কিছুতেই নেই”। কথাটা বললেন আমার মুখোমুখি আসনে আসীন প্রায় পৌঢ় বয়সী সহযাত্রী যিনি মাত্র বিশ মিনিট পূর্বেও ছিলেন আমার অদেখা একজন। আমি তার কথায় রীতিমত ঘামতে শুরু করলাম। সর্বনাশ! এ লোক সর্বজ্ঞ, নাকি সর্বদ্রষ্টা! আমার গন্তব্য তাকে এইমাত্র বলেছি বা বলতে বাধ্য হয়েছি (প্রথম পরিচয়ে সৌজন্য বিনিময়ের অংশ হিসেবে তিনি আমার পুরো ঠিকুজিটাই জেনে নিয়েছেন); কিন্ত তিনি আমার এই রেলভ্রমনের উদ্দেশ্যও বুঝে ফেললেন নাকি! যাহোক, আমি তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা শোনার আশায় উৎকর্ণ হলাম। এই বিশ মিনিটেই তার স্বভাবের যে পরিচয় পেয়েছি তাতে বুঝেছি যে এ প্রসঙ্গে আলাপে আমরা প্রায় পঞ্চাশ কিমি অতিক্রম করতে পারব।

“প্রেম-ভালবাসা জীবনের এক অনিবার্য অংশ কিন্ত এক্ষেত্রে সফল হতে হলে সংযম এবং সঠিকতা দুইই খুব জরুরী”, ভদ্রলোক ঘোষণা করলেন। আমি কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, এ ধরণের আলোচনায় অংশগ্রহন করবার মত মনের অবস্থা আমার সে মুহূর্তে ছিলনা। বিশেষ করে তার জ্বলজ্বলে চোখজোড়া -- যা হৃদয়ের অতলস্পর্শী তলদেশও দেখতে পায় বলে মনে হচ্ছিল তার দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমার যোগাচ্ছিলনা মোটেই। দেশের উত্তর দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁতে থাকা ট্রেনটার শোভন কম্পার্টন্টের একটা আসনের টিকিটধারী যাত্রী আমি।

এ কম্পার্টমেন্টের কোন আসনই অপূর্ণ নেই। এরই মাঝে এক জুটি বিভোর হয়ে প্রেম করে চলেছে। ভদ্রলোকের প্রেমবিষয়ক কথামালা বোধকরি তাদেরকে দেখেই উৎসারিত-- একথা ভেবে আমি একটু স্বস্তিবোধ করবার চেষ্টা করলাম। “দেখুন, প্রেমে পড়লে মানুষ এমন অন্ধ হয়ে যায় যে সঠিক- বেঠিক নির্ণয়ের যোগ্যতা তার আর থাকেনা। আর সংযম সাধনারতো কথাই নেই।

হা-হা-হা। ” আমি ফের ঘামতে শুরু করলাম। কী বিড়ম্বনা! এতো জ্বালাবে দেখছি। এ রাতটা আমি এত লোকের ভীড়েও একান্তই আপনার করে কাটাতে চাই। রাত শেষে যে স্টেশনে এ ট্রেনটি থামবে বলে পূর্বনির্ধারিত, সেটিই আমার গন্তব্য।

গন্তব্যে পৌঁছে নিষ্ক্রিয়তার অবসর আর ভ্রমণজনিত ক্লান্তির বিলাসটুকু দেহে ঢেলে ঘুম নয়, বরং আমাকে ব্যস্ত হতে হবে নব নব আবিষ্কারের কুশলী সাধনায়। সেই আবিষ্কারের নেশা আমার মনকে আজ দুপুর হতেই এক অনির্বচনীয় অনুভূতিময় শিহরণ যুগিয়ে চলছে। দুপুর দেড়টায় আমি তার কাছ থেকে আমার বহু অনুনয়ের ফলাফল গ্রীন সিগন্যালটা পেয়েছি। এই রাত শেষে যে প্রভাত তার নতুন আলোর ধারায় ঘুমক্লান্ত ধরাকে স্নান করিয়ে সজীব স্নিগ্ধরূপে উদ্ভাসিত করে তুলবে তারই হাওয়ায় ভিজে কচি দূর্বার ফিকে সবুজ ডগাটুকুর মতই একটুকরো হিরকসম শিশিরবিন্দু উপহার নিয়ে আমি তার স্মরণ হব মানস করেই এই ট্রেনটিতে চেপে বসেছি। তাই আমি এখন কোন উৎপাত বরদাশ্ত্ করতে প্রস্তুত নই।

ভদ্রলোক বোধহয় আলাপচারিতায় আমার অনাগ্রহটুকু ধরতে পারলেন। কিন্ত দমে যাবার পাত্র তিনি নন। দ্বিগুন উৎসাহে বলতে থাকলেন, “আপনার বয়স কম, এসব বিষয় ঠিক বুঝবেন কিনা জানিনা, হয়ত ভুল বুঝবেন; তবুও আজ আপনাকে দেখে কেন জানি বলতে ইচ্ছে করছে। হয়ত আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আপনার জীবনে কোন কাজে আসবেনা, তবুও শুনে রাখুন। ইতিহাস থেকে আমরা কিছু শিখিনা ঠিকই; তাই বলে কি ইতিহাস জানা থেকে বিরত থাকা যায়? এতসব ভনিতার পর আমি বাধ্য হলাম তার প্রতি মনোযোগের ভাব দেখাতে।

কিন্ত মন আমার সদাচঞ্চল মৃগশিশুর মত অকারণেই ছুটে চলছে, লাফিয়ে উঠছে, ক্ষণে ক্ষণে চমকে চমকে বিদিশা নাচছে। প্রেমরত যুগলের পানে ক্ষণে ক্ষণে অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে, ঠোঁটে একটা ধারাল হাসি ঝুলিয়ে ভদ্রলোক যে গল্পটি বললেন তা মোটামুটি এরকম। “আমি তখন পঞ্চগড় ভুমি রেজিস্ট্রি অফিসে নতুন যোগদান করেছি। অল্প বয়স, নতুন চাকরি, অঢেল উপার্জনের সুযোগ; কিন্ত আমাকে ধরল সততার নেশায়। বাপ ছিল কৃষক।

তার সীমাহীন দুর্ভোগ আমি সচক্ষে দেখেছি। সেক্ষেত্রে এরকম একটা জবরদস্ত চাকরি এত সহজে বাগাতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে ‘ইয়া আলী’ বলে সাংসারিক উন্নতির যুদ্ধে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করাটা নিয়ম হলেও আমাকে ধরল উল্টো রোগে। আমি বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ বাড়ি পাঠিয়ে বাকি টাকায় চাল-ডাল-নুন-তেল কিনে স্বপাকে ভর্তাভাত খেয়ে দিন-রাত কাটাতে লাগলাম। এদিকে জীবনপথে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা মনে যথেষ্ট-- বড় আমলা হওয়ার প্রস্ততিও তাই নিভৃতে চলছে। এরকম ক্ষেত্রে যা হবার তাই হল; অধঃস্তন কর্মচারীরা সঙ্গোপনে একজোট হয়ে আমার ক্ষীণ গদিখানা নাড়িয়ে দিল।

আমি যে যথেষ্ট পরিমানে ঘুষগ্রহন করে যথেষ্ট কাগজপত্র ছাড়াই একের জমি অন্যের নামে রেজিস্ট্রি করে দিই তা অনুধাবন করতে কর্তৃপক্ষের বিশেষ বেগ পেতে হলনা। আমাকে পঞ্চগড় থেকে উড়িয়ে নিয়ে একেবারে ভোলা জেলার চরফ্যাশনে নির্বাসন দিল। শুকনো খটখটে এলাকার ছেলে আমি, এসএসসি পাশের পর হতেই ছিলাম ঢাকাবাসী। এমন জলের দেশে এসে যখন খাবি খাওয়ার যোগাড় তখনই ঘটল সেই ঘটনা। ” ভদ্রলোক এই পর্যায়ে খানিকক্ষণ নিরব রইলেন।

বাকিটা শোনবার বিরক্তিকর প্রতীক্ষা যখন এই ভেবে সাঙ্গ করতে চলেছি যে যাক বাবা, বাঁচা গেল, আর হয়ত বলবেনা; তখনই তিনি বলতে শুরু করলেন। “অফিসার্স ক্লাব জিনিসটা সব জায়গাতেই থাকে, এখানেও ছিল। কিন্ত হাতে গোনা যে কজন অফিসার এখানে মাঝে মাঝে আসেন তাতে ক্লাব নামটির মাহাত্ম্য টেকা দায়। ঐ পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেউ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতে চাননা, অন্ততঃ তখন চাইতেননা। কাজেই মূল পোস্টিং এখানে হলেও প্রেষণে কাজ করেন বরিশাল নয়ত নোয়াখালী।

আমার মত দু’চারজন খুঁটির জোরহীন, অপাঙক্তেয় কর্মকর্তা কর্মহীনতার যজ্ঞ করতে এই ক্লাবচত্বরে এসে প্রতি বিকেলে মিলিত হয়। এখানেই পরিচয় হয় তার সাথে। ” এই ‘তার’ শব্দটি ভদ্রলোক যেভাবে উচ্চারণ করলেন তাতে বেশ বুঝতে পারলামযে তিনি এতক্ষণে মূল গল্পে চলে এসেছেন। আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। গল্পকথকও দম নেবার মত কয়েক সেকেন্ড নিরবতা দিয়ে ফের শুরু করলেন।

“তিনি ছিলেন ডি এল ও। পদমর্যাদায় আমার তুলনায় উঁচুতলায় তার অবস্থান, যদিও আমজনতার কাছে আমার মান ও ক্ষমতা অধিক বলে বিবেচিত। সে যাই হোক, তাকে দেখে আমার প্রথমেই যে অনুভূতি হল তার নামই বোধহয় ‘লাভ এট ফার্স্টসাইট’। প্রেমজ্বরে আমি বুঝি সে ক্ষণেই আক্রান্ত হলাম। আর এ জ্বরের যে কী প্রতাপ তা যে না পড়েছে তার পক্ষে বোঝা যেমন দুঃসাধ্য তেমনি যে কোন একসময় পড়েছে তার পক্ষে ভোলাও অসাধ্য।

আমার তখন যে অবস্থা তাকেই বোধহয় এককথায় বলে অনির্বচনীয়। খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা, সব কাজে ভুল করি, বুকের মাঝে কোথায় যেন একটা সার্বক্ষণিক চাপ অনুভব করি, কোন কাজে মন বসেনা, সত্যিকারের জ্বরো রুগীর মতই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে অথচ শুয়েও শান্তি পাইনা। পড়াশুনা শিকেয় উঠল অথচ জীবনে উন্নতির চেষ্টা মনের মাঝে আরো বেশি জাঁকিয়ে বসল। বুঝলাম, এভাবে হবেনা। আগে আমার একতরফা রোগটাকে ওপক্ষেও সংক্রমিত করা দরকার।

হোন তিনি বয়ঃজেষ্ঠা, হোন উঁচুতলার বাসিন্দা, আমার মত অপাংক্তেয়কে তার পংক্তিতে বসাতেই হবে। এখনকার মত তখনকার দিনে ঠেলাগাড়িতে বসে ভিক্ষারত অন্ধ ভিক্ষুকের কোঁচড়ে মোবাইল ফোন ছিলনা। টি এন্ড টির ফ্রি হ্যান্ডসেট তখন সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। কারো কারো কোমরের বেল্টে পেজার শোভা পেতে দেখা যায়। যদিও এ সেবা ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি তবুও এসবের অধিকারীদের দেখলে বুকের কোনে কেমন এক খোঁচা অনুভব করতাম।

আমার বিত্ত ছিলনা, অর্থ কামাবার ঢের ভাল, সুচারু ও প্রায় নিয়মতান্ত্রিক সুযোগটাকে উপেক্ষা করে জনপ্রশাসনের একটি অংশ অর্থাৎ আমার কর্মক্ষেত্রে গতিসঞ্চার ও স্বচ্ছতার ব্যবস্থা করতে গিয়ে আজ আমি নির্বাসিত। নিজেকে সারাক্ষণ পৃথিবীর নিপীড়িত জনগোষ্টীর বঙ্গীয় প্রতিনিধি বলে বোধ হয়। এমন হীনম্মন্যতাবোধ নিয়ে হৃদয়ের প্রেমাবেগকে জীবনে বাস্তব করে তোলা কঠিন। কিন্ত মিসেস তাসনুভা রহমানকে দেখে আমার আত্মপ্রত্যয়বোধটা কেন জানি জেগে উঠল। তার শাড়ির আঁচলের সুদৃশ্য কারুকাজ, ভ্যানিটি ব্যাগের ভ্যানিটি, বিদেশি জুতার সুতীক্ষ্ণ হিল-- এসব কিছুই আমাকে তার থেকে বিকর্ষিত করতে পারলনা।

আসলে এসব জৌলুস সত্বেও তার মাঝে এমন এক অপূর্ব সারল্যমাখা সৌন্দর্য আমি একপলকেই দেখতে পেয়েছিলাম যে তার করোলা এক্স গাড়িখানার নিখুঁত চকচকে অবয়বও আমাকে ভয় পাওয়াতে পারলনা। আমি তাসনুভাকে আমার প্রেমটুকু নিবেদন করবার মানসে নানা অছিলায় তাকে ফোন করবার চেষ্টা করতাম। তবে অছিলা বিশেষ পর্যাপ্ত মিলতনা কারণ তার ও আমার কর্মক্ষেত্র ও কর্মকাণ্ড-- দুইই ভিন্ন। আরেক সমস্যা ছিল যোগাযোগব্যবস্থার অপ্রতুলতা। এখনকার মত ঢাকা- সেন্টমার্টিন চ্যাটিং সুবিধা তখনতো আর ছিলনা।

আমার হৃদয়ের কথার ফুলঝুরি তাই হৃদয়েই শুকাত। একমাত্র সরকারি টেলিফোনটি সম্বল করে অবিচ্ছিন্ন কথার মালাগাঁথা তাই সম্ভব হতনা। আমার দপ্তরে উকিল, মহুরী, দলিল লেখক, দালাল -- নানা শ্রেণী-পেশার লোকজনের অবাধ আনাগোনা। এর মধ্যে নিরুপদ্রব প্রেম করার সুযোগ কোথায়? কিন্ত তার সঙ্গে কথা না বলে আমি যে আমার দিন শুরুই করতে পারিনা। তাসনুভা থাকতেন জেলা সদরে।

তার স্বামীর দিনকাল তখন বোধকরি কিছু খারাপ যাচ্ছিল; নইলে তার মত লোকের স্ত্রীর এই দ্বীপে র্নিবাসিত হওয়ার কথা নয়। শুনেছিলাম তার স্বামী খুব উঁচুদরের লোক, রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন পরোক্ষ কেষ্ট-বিষ্টুও বটে। তবু তার স্ত্রীকে যে ঠিক কী কারণে রাজধানী থেকে উড়িয়ে একেবারে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত করা হল তা অবশ্য আমার জানা হয়নি। যাহোক, এটা তার পক্ষে যেমনই হোক তাসনুভার পক্ষে খুব খারাপ হয়েছিল বলে মনে হয়না। তিনি বরং উপভোগই করছিলেন।

সাংসারিক ঝামেলাবিহীন স্বাধীন জীবন, নতুন স্থান, ভিন্ন পরিবেশ -- এসবই নাকি ছিল তার উপভোগ্য। আসলে মহিলা খুব স্বাধীনচেতা আর বৈচিত্র্যপিয়াসী মনের অধিকারী ছিলেন। তাসনুভা ম্যাডামের সাথে দেখা করার জন্য আমার মনে এক দুরুদুরু ইচ্ছা দিনে দিনে অদম্য হয়ে উঠতে থাকল। এই জেলায় পদায়ন হলে পর তিনি প্রথম মাসেই সবগুলো থানা ভিজিট করে সেরেছেন। সেই ভিজিট করতে আসার দরুনইতো তার সাথে আমার পরিচয়টা ঘটতে পারল।

এখানকার ভিএস-এর সাথে আমার একটু বেশিরকম খাতির জমে গিয়েছিল, তাইতো তার সুন্দরী, স্মার্ট লেডি বসের সাথে আমাকে সেদিন বিশেষকরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেই পরিচয়ের সুবাদেইনা তাসনুভার হাতখানা আমি প্রথম দর্শনেই ছুতেঁ পেরেছিলাম। হ্যালো বলে হাতখানা তিনিই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এডিনবরায় পিএইচডি করা তাসনুভা রহমান আমার চেয়ে হাজার গুনে উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন”। এ পর্যায়ে এসে ভদ্রলোক দীর্ঘসময় চোখ বুজে মাথাটা সিটে হেলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পড়ে থাকলেন।

সর্বনাশ! ঘুমুল নাকি! এ যে দেখছি গল্পের গাছে চড়িয়ে দিয়ে মইখানা নিল সরিয়ে, তাও আবার আলগোছে। এতো দেখছি সাংঘাতিক লোক! আমি অদম্য কৌতুহল বুকে চেপে আর কিছুতেই থাকতে না পেরে বলে উঠলাম, আঙ্কেল, না, ভাইজান কি ঘুমুলেন? উনি আড়মোড়া দিতে দিতে বললেন, নাহ্, ভাবছি আজ এসব কেন বলছি। কী হবে এসব বলে, যা ঘটবার তাতো ঘটবেই। সেতো বটেই। ওনার গল্পখানা উপদেশমূলক হলেও সে উপদেশ আমাদের মগজে ঢুকবেনা।

তাই বলে গল্পটাকেতো আর মাঝপথে ছেড়ে রাখা যায়না। আমি ওটা শেষ করার জন্য তাকে অনুরোধ জানাবার ভাষাটা মনে মনে খুঁজতে লাগলাম। ভদ্রলোক পকেট থেকে ছোট্ট একটা ডিব্বা বের করে তার থেকে একটা পান মুখে পুরে চুপচাপ চিবুতে লাগলেন। আমাদের ট্রেন এখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বুকের উপর দিয়ে ছুটছে। ট্রেনের নিয়মিত আওয়াজের সাথে ব্রিজের ঝনঝনানি যুক্ত হয়ে রাতের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে ইলিশবিরল নিস্তেজ পদ্মার ঘুম ভাঙিয়ে আমাদের ট্রেনটা ছুটে চলছে।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পেরিয়ে আসার পর চর্বিত পান-সুপুরীর অবশিষ্টাংশ জানালাপথে ছুঁড়ে ফেলে ভদ্রলোক ফের মুখ খুললেনঃ “তাসনুভাকে নিয়ে আমি অনেক দিবা স্বপ্নের জাল বুনতাম। সেসব স্বপ্নগুলো এত বিচিত্র, এত দ্রুতগামী ছিল যে তাসনুভার সাথে আমার গোটা জীবন জড়িয়ে মরণ এমনকি পারলৌকিক জীবন পর্যন্ত ছোট-বড়, খুঁটিনাটি নানা সুখের সম্ভারে সাজিয়ে কল্পনা করতে মাত্র ঘন্টাকয়েক(!) সময় লাগত। এ কয়েকঘন্টা যে নিরবিচ্ছিন্ন কল্পনাসুখ ভোগ করব সে ভাগ্য আমার নয়। তাই দাপ্তরিক কর্ম, ব্যক্তিগত কাজ, সামাজিকতা ও লৌকিকতার অবসরে কল্পনাজাল রচনা করতাম অথবা বলা ভাল আমার স্বপ্নাচ্ছন্ন অলীক কল্পজাল রচনার ফাঁকে ফাঁকে ঐসব কর্মরাশি অযাচিত ঢুকে আমার দেহমনজুড়ে অলক্ষে প্রবাহিত সুতীক্ষ্ণ সুখানুভূতির ধারাপ্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করত। এরকম ক্ষেত্রে সচরাচর যা হয়-- কাজে ভুল হয়, কর্মচারীদের ভুলগুলোও চোখে পড়েনা।

কর্মচারীরা এটা বুঝতে পেরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে, সুযোগ বুঝে কোন অসৎ কর্মচারী কোন দু’নম্বর কাজ সম্পন্ন করিয়ে নিতে চেষ্টা করে; এসব আমার দপ্তরেও ঘটতে শুরু করল। এসবের ফলাফলও কয়েকমাসের মাঝেই হাতে এল। কর্তব্যকর্মে অমনোযোগ, দায়িত্বের প্রতি উদাসীনতা, অফিস টাইমে অতিরিক্তি টেলিফোন ব্যবহার, কবিকবিভাব ইত্যাদি ধারাসমৃদ্ধ কারণ দর্শাও নোটিশ পাঠালে আমার দুঃখের কিছু ছিলনা কিন্ত চিঠি এল সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিযোগ বহন করে-- আমি নাকি ভুয়া দলিল তৈরি ও দলিল পিছু কমিশনগ্রহনের ক্ষেত্রে এদেশের অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রেকর্ডও ইতোমধ্যে ভঙ্গ করে ফেলেছি। বোঝেন ঠ্যালা! চরফ্যাশনের পাটও আমাকে শীঘ্রই গোটাতে হল। তাসনুভাকে দ্বীপদেশে ছেড়ে আমাকে যেতে হল পাহাড়ে।

যাত্রার পূর্বে তার সাথে আরেকবার দেখা করার দুর্দম ইচ্ছাটা কেন জানি শেষে স্তিমিত হয়ে এল। যে অপবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে আমাকে পাহাড়ে চড়তে হচ্ছে সেই কালিমাময় মুখখানা নিয়ে তাসনুভার সামনে দাঁড়াতে কেন জানি প্রবৃত্তি হলনা। লামায় এসে একটু গুছিয়ে বসে মন থেকে গ্লানি মুছে নতুন কর্মক্ষেত্রে মননিবেশ করতে যেতেই একদিন তাসনুভার ফোন এল। তার কণ্ঠস্বরের সাথে এখানকার ঝরণাগুলোর ঝিরঝির আর ভোরের শিশিরের টুপটাপকে তুলনা করা যেতে পারে। আমি আবেশে বিহ্বল হয়ে এক অবাস্তব মেঘের ভেলায় ভেসে কোন অচিন পথে অচিন দেশে মায়া জগতের গোলকধাঁধাঁয় ঘুরতে ঘুরতে বাস্তবের মাটিতে পড়ে দেখি আমি আমার দপ্তরের চেয়ারে টেলিফোন রিসিভার কোলে বসে আছি এবং আমার এমএলএসএস অফিস বন্ধ করবে বলে আমাকে বাসায় গিয়ে ঘুমোবার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছে।

সর্বনাশ! আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! তাসনুভার ফোন এসেছিল লাঞ্চের পরপর, তারপর থেকে আমি......নাহ্, কেবল বদলী আমার জন্য যথেষ্ট শাস্তি নয়, আমার চাকরি থাকাটাই উচিৎ নয়। ” ভদ্রলোকের গল্প শুনে এতক্ষণে আমার হাসি পেল। দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি সত্যিই ফিক করে হেসে ফেললাম। ভদ্রলোকও হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “আমার অবস্থা শুনে আপনার হাসি পাচ্ছে? দেখুন এর চেয়ে কত খারাপ অবস্থাও মানুষের হয়, ঐযে।

” তাকিয়ে দেখি আমাদের কর্মার্টমেন্টের সেই প্রেমনিরত জুটি এখন এমন একটা পজিশন নিয়েছে যাকে প্রেমশাস্ত্রের একটা অন্যতম আকর্ষণীয় আসন বলা যেতে পারে। দু’টিমাত্র আসনের স্থানাভাব পুষিয়ে নিতে মেয়েটা হাঁটু ভেঙ্গে পা মুড়ে আসনপিঁড়ি করে শুয়েছে। শরীরের উর্ধ্বাংশ অবলীলায় ছেলেটার কোলে তুলে নিশ্চিন্তে চোখবুজে পড়ে আছে। সে যে ঘুমিয়ে নেই তার প্রমান-- ছেলেটা প্রায়ই মাথা ঝুকিয়ে মেয়েটার মুখের ইঞ্চিখানেক উপরে নিজের মুখ ঝুলিয়ে অস্ফুট ভাষায় কীসব বলে চলেছে; যাকে অনেকটা পায়রার বাকবাকুমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্ত মেয়েটার মুখের রেখায় কোন বদল নেই।

মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অসাড়ে ঘুমুচ্ছে। কোন কোন মেয়ে আছে যাদের মুখ দেখে নাকি তাদের ভেতরকার স্পন্দন, কম্পন, আলোড়ন কিছুই বোঝা যায়না। এমনকি বিশেষ সময়টিতেও এদেরকে মনে হয় অনুভূতিহীন; এ মেয়েটা বোধ হয় সেই জাতের। অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন, আমার জিএফ....না থাক; আমার গল্প বলবার জন্য আজকের এ গল্প নয়। আমার কেমন জানি অস্বস্তি হল।

আমি ঐ জুটি থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমার মনে হল, প্রেমের ঐরূপ প্রকাশের ক্ষেত্রে এই কম্পার্টমেন্ট অনুপযুক্ত স্থান, ওদের নির্জনতা প্রয়োজন। তারপরই মনে হল, পরিপূর্ণ নির্জনতায় কি আর বাকবাকুম জমে? সেখানে বাকযন্ত্র রুদ্ধ হয়, শরীর কথা বলতে শুরু করে। তারপর কী হয় তা অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেরই জানা আছে। প্রেমের অনির্বাণ অনুভূতিতো সেখানেই অনুভব করা যায় যেখানে তা নির্বানের সুযোগ নেই।

আমি আবার ভদ্রলোককে তার গল্পে ফিরিয়ে আনার জন্য বললাম, ভদ্রমহিলাকে কি আপনার মনের অবস্থা খুলে বলেছিলেন? ভদ্রলোক বোধহয় একটু অন্যমনষ্ক হয়ে ছিলেন। আমার প্রশ্নে তার সম্বিৎ ফিরে এল। বললেন, ও হ্যা, সেটা অনেক পরের কথা। আসলে এসব কথা মুখে না বললেও আঁচ পেতে কি কারো বাকি থাকে? তবে তাসনুভার ব্যাপার একটু অন্যরকম। সে যে আমার হৃদয়টাকে পড়তে পেরেচে এমন কিছুর আঁচ তার কথায় কখনো মিলতনা।

স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে প্রায়ই সে কোন না কোন টপিক পেড়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করত আর আমি কান পেতে কেবল শুনতে থাকতাম। তার কথা আমার কানে কেবল কথামাত্র বা জাগতিক কোন বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ কচকচানিমাত্র ছিলনা। তার কথা ছিল চৈত্রের রাত্রে উদাসী হাওয়ায় দিগন্ত থেকে ভেসে আসা প্রেমিক রাখালিয়া বাঁশির সুরের মত, আঁধারে অদৃশ্যমান সাগরতটে উর্মিমালার আঘাতের মত, কিংবা দারুন কোন মোহনীয় কণ্ঠে আবৃত্ত জীবনানন্দের কবিতার মত। আমি কান পেতে তার কথা শুনতাম আর মনের ক্যানভাসে তার ছবি আঁকার নিরন্তর চেষ্টা করতাম। এই ছবি আঁকার বিষয়টা একটু বলি।

একসময় আমি দিনকতক আর্টকলেজে পড়েছিলাম। পেইন্টিঙ ছিল আমার প্রিয় বিষয়। ওসময় জলরঙে আমি এমন কিছু ছবি এঁকেছিলাম যা আমার শিক্ষকসহ বন্ধুদের শতমুখের প্রশংসা পেয়েছিল। তারপরতো বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। বাবার আদেশে আর্টকলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রী নিয়েছি।

ওসব রঙ-টঙের কারবার করার সময় আর মেলেনি, হয়ত মনও চায়নি। কিন্ত এবার আমি ফের আর্টিস্ট হতে উঠেপড়ে লাগলাম। ডরমিটরীতে আমার ঘরটাকে রীতিমত স্টুডিও বানিয়ে ফেললাম। মাঝে মাঝে ছাদে ইজেল টাঙিয়ে খোলা হাওয়ায় বিহঙ্গের কাকলি শুনতে শুনতে প্রকৃতির ছবি আঁকি। তবে প্রকৃতিই আঁকি কি নাগরিক জীবনের কোলাহলই আঁকিনা কেন, সেখানে অবধারিতভাবে একজন নারী থাকবে যার মুখখানা......কি বুঝলেনতো? এভাবে নানা পরিস্থিতিতে নানা অবস্থানে রেখে আমি তাসনুভাকে কল্পনা করতাম এবং তার নানা ভঙ্গিমার ছবি আঁকতাম।

খুব ইচ্ছে করত তার পোট্রেট আঁকতে কিন্ত কাজটা সহজ ছিলনা। কারণ পোট্রেট আঁকতে হলে বা পোট্রেটে বিশেষ কোন মুখভঙ্গি, দেহভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে হলে মডেলকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা দরকার হয়। কিন্ত তাসনুভাকে আমি কতটুকুইবা দেখেছি? ঐতো একটা দিনের ফরমাল সাক্ষাত। কতটা সময়ইবা সে ছিল? তাছাড়া তখন আমি এতটা সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি কিছুই। শুধু মনে পড়ে যে তাসনুভা তার গজদন্ত বের করে একবার বেশ হেসেছিল।

আর কথা বলার সময সে তার ভ্রুজোড়াকে একটু উপরে তোলে। এতে করে তার মায়াবী চোখদুটো আরো টানা টানা দেখায়। আচ্ছা, হাসলে কি তাসনুভার গালে টোল পড়ে? মনেতো পড়েনা। তো ঐটুকু দেখাতে কী করে তার পোট্রেট আঁকি? তাই নানা পরিবেশের মাঝে একজন নারীকে বসিয়ে তার মুখটায় তাসনুভার আদল ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি। এভাবেই আমার ছবিগুলোতে তাসনুভা কখনো পল্লীবঁধূ, ট্রেনের জানালাপথে মুখ বের করে ফসলী খেত দেখতে থাকা কৌতুহলী তরুণী কিংবা গোধূলীলগ্নে দিগন্তজোড়া সোনারঙা মেঘের পানে বিষণ্ন চোখে চেয়ে থাকা মানবী।

এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। সপ্তাহের ছয়দিন কাটে তাসনুভার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে দাপ্তরিক কাজ করে আর একদিন অর্থাৎ ছুটির দিনটা কাটে তাসনুভার ছবি আঁকার চেষ্টা করতে গিয়ে তার মুখটা ভেবে ভেবে। ডরমিটরীতে ফোন নেই, তাই ছুটির দিনে তাসনুভার সাথে কথাবলার কোন সহজ উপায় নেই। দোকানে গিয়ে পেফোন থেকে কথা বলা যায় কিন্ত তাতে কথা বলা বা শোনার আনন্দ পাওয়াটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমাদের কথাতো কেবল প্রয়োজনে নয়, প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কথার মালা বুনে চলাটাই যে এখানে বড় প্রয়োজন।

ভাগ্যিস তখন সাপ্তাহিক ছুটি মাত্র একদিনের ছিল। মে মাসের এক দুপুরে তাসনুভা জানালযে সে আসছে বান্দরবান, খুব শিগগিরই, হয়ত আগামী সপ্তায়। সেদিনের বিকেলটা ছিল লামায় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিকেল। মংচু পাহাড়ের ওপারে সূর্যটা লুকিয়ে গেল কিন্ত আলোকোচ্ছ্বাসে আকাশ তখনো রঙিন। আমি ডরমিটরীর ছাদে এসে সেই বিলীয়মান আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ আর পাহাড়ের শিখরে শিখরে সবুজের বুকে একঝলক যাইযাই আলোর নাচন দেখে এমন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে আপ্লুত হয়ে পড়লাম যা আমার জীবনে ইতোপূর্বে কখনোই অনুভূত হয়নি।

আমি বহুক্ষণ বিহ্বলভাবে ছাদের কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘনায়মান অন্ধকার সিঁড়ি ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম। ঘরে এসে আলো না জ্বেলেই বিছানায় অবশ-বিবশভাবে পড়ে রইলাম। আমার রুমমেট তখনো ঘরে ফেরেনি। একা একা অন্ধকারে কতক্ষণ পড়ে থেকে হঠাৎ এই প্রথম আমার মনে হল, তাসনুভা কেন আসছেন? তিনি বলেছেন বান্দরবান আসছেন, লামার কথাতো বলেন নাই। তবে কি তিনি আশা করছেন যে বান্দরবান গিয়ে আমি তার সাথে দেখা করি? তবে বান্দরবানেই বা তিনি কেন আসছেন? বেড়াতে? একা, নাকি সঙ্গে কেউ থাকবে? ধুর! কী উজবুক আমি! এতসব প্রশ্নের একটাও তখন মাথায় আসেনি।

তাসনুভা আসছেন, এই খবরেই আমার সর্বইন্দ্রিয় এমন মাতাল আবেশে ঝিম ঝিম করতে শুরু করেছিল যে অন্যকোন বাস্তববোধ আর কাজ করতে পারেনি। পরপর দুইদিন ছুটি ছিল। সাপ্তাহিক ছুটির সাথে কী একটা সরকারি ছুটি যোগ হওয়ায় একটানা দুইদিন ছুটি পেয়ে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে বা আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। ডরমিটরী প্রায় ফাঁকা। অতিকষ্টে চটপট করে দুটো দিন পার করলাম।

এ দুদিনে ইজেলেও মন বসাতে পারিনি। শনিবার সকালে প্রায় ছুটতে ছুটতে অফিসে গিয়ে টেবিলে রাখা লাল ফোনসেটটার দিকে চেয়ে বসে রইলাম। তখনো আমার কেরানী-পিয়নদের কেউ আসেনি। সুইপার ঝাড়ামোছা শুরু করেছে মাত্র। হঠাৎ আমার হাসি পেয়ে গেল।

আমি কল্পনার চোখে দেখতে পেলামযে লোকটা তার জনবিরল, ধুলিওড়া অফিস ঘরে একাকী রোমাঞ্চিত মনে উৎসুক নয়নে ফোনসেটটার দিকে ব্যগ্র হাতখানিকে নিয়ন্ত্রনে রেখে চুপচাপ বেহুদা বসে বসে বহুল পরিমানে ধুলোবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিলিয়ে গলাধঃকরণ করছে। ঝাড়–দারটা নিশ্চিত তাকে একটা উজবুক ভেবে হতভম্ব মনে আড়নয়নে মাঝে মাঝে দেখছে। আমার হাসিতে ভদ্রলোকও হাসলেন। বললেন, “দেখুন, জগতে আমার একারই কেবল অমন দুরবস্থা হয়েছিল তা কিন্ত নয়; অ্যাডাম-ইভের বংশধরদের মাঝে অগনিত জনের অবস্থা নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে ঢের খারাপ হয়েছে; ইতিহাসেও তার যথেষ্ট উদাহরণ আছে। ” আমি সায় দিলাম কিন্ত মনে মনে বললাম, ইতিহাস কেন? চলিষ্ণু বাস্তব উদাহরণতো সামনেই বসে।

ঐ প্রেমরত জুটির কথা বাদই দিলাম, ওদের ব্যাপারতো আমি বিশেষ কিছু জানিইনা; কেবল প্রেমিকের দেহভাষা, মুখভঙ্গিমা, উজ্জ্বল চোখের তারা আর প্রেয়সীর ঢুলু ঢুলু কামনামদির আঁখি, ঢলে ঢলে পড়া জাতীয় সমর্পণভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে যে ওরা এ ধুলোবালির তৈরি কঙ্করময় বাস্তব পৃথিবীতে নয়, বিচরণ করছে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বেহেস্তের চেয়ে ঢের বেশি সুখময়, রোমাঞ্চকর, শীর্ষ অনুভূতির কাঁপন ছড়ান কোন জগতে। আর এই যে প্রেমিকপ্রবর তার প্রিয়ার সাথে একঝলক বিদ্যুৎচমকের মত সুতীব্র, দীপ্তিময়, অত্যুৎতপ্ত সময় অতিবাহিত করতে প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিনশ’ মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছে তার গল্পটা জগতে কে জানছে? তার হৃদয়াবেগ, তার কষ্ট-জ্বালা-আনন্দ, সুতীব্র সুখের দহনটা যদি যথাযথ ভাষায় কথিত বা লিখিত হত তবে সেটা কি খুব ফ্যালনা প্রেমোপাখ্যান হত? আসলে জগতে কারো প্রেমই তুচ্ছ নয়, কোন প্রেমকাহিনীই অকিঞ্চিৎকর নয়, কিন্ত উপযুক্ত লেখকের হাতে পড়ে যেমন কোন কোন কাহিনী ক্লাসিকের মর্যাদা পায় ঠিক তেমনি উপযুক্ত কথকের মুখে কোন কোন কাহিনী কিংবদন্তীতে পরিণত হবার সৌভাগ্য লাভ করে”। ভদ্রলোক বোধহয় আমাকে একটু অন্যমনষ্ক দেখে চুপ করে ছিলেন। আমি সচেতন হয়ে তার মুখপানে চেয়ে দেখি তিনিও যেন কী একটা ভেবে চলেছেন। আরো খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বাধ্য হয়ে আমি বলে বসলাম, ম্যাডাম তাসনুভা কি এসেছিলেন? “এ্যা, কী বলছেন?” ভদ্রলোক একটু চমকে গেলেন মনে হল।

-- বলছিলাম উনি কি লামায় এসেছিলেন? “উনি সেদিন আসলে কি আর এই গল্প আজ আপনাকে করি? আমরা কত সামান্যের উপর ভর করে কত বড় স্বপ্নের সোনালী সৌধই না নির্মান করি! একবার ভেবেও দেখিনা যে এতবড় স্বপ্নটার ভিত্তি কত দূর্বল কিংবা ভিত্তি নাই বললেই চলে। ” সেই আকণ্ঠ প্রেমে নিমগ্ন জুটিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ওদেরতো ভাগ্য ভাল যে ওরা একে অপরকে একটিবারের তরে হলেও, এত লোকের ভীড়ে হলেও কত নিবিড় করে পেল। কিন্ত আমি? তবে মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন? তাসনুভা সেদিন না এসে বুঝি ভালই করেছিল। যদি সেদিন সে আসত তাহলে এতক্ষণ আপনাকে আমার যে হৃদয়ানুভূতির বর্ণনা দিলাম সেসব আমার স্মৃতিতে ফিকে হয়ে তার সংস্পর্শের অনুভূতি ও তার সাথে একত্রে অতিবাহিত সময়ের স্মৃতিই বেশি উজ্জ্বল হযে থাকত। আর যদি আমাদের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগুতো তাহলে তা হত আরো দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।

কারন আমাদের জীবন বাস্তবতা এমনই যে এ সম্পর্ক একসময় তিক্ততা দ্বারা অবসান হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে ঐ তিক্ততাটুকু সব মিষ্টতার পরে পুরু প্রলেপ তৈরি করত। আর যদি আমরা সব রূঢ় বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে আপন ভুবন রচনায় সমর্থ হতাম তাহলে আজ ঐ অনুভূতিগুলোকে সযত্নে স্মৃতিপটে সাজিয়ে রাখার কোন অর্থই হয়ত আমার কাছে থাকতনা। বিষয়টা তখন আমার কাছে মামুলি কোন লজ্জ্বা বা তামাশার ঘটনা হয়ে দাঁড়াত। ” আমি স্পষ্টতঃ হতাশ হলাম।

ভেবেছিলাম কোন জমাট প্রেমকাহিনী শুনব, তা না.........., যাহোক, এ বেশ ভালই হল। ভদ্রলোক যদি আর কোন নীতিবাক্যযুক্ত গল্প ফেঁদে না বসেনতো বাকি রাতটা আমি একটু চোখ বুজে কাটাতে পারি। আগামীকালের জন্য আমি নিজেকে তরতাজা রাখতে চাই। কিন্ত তাসনুভা কেন এলেননা তাতো জানা হলনা। আর ভদ্রলোক ঐ প্রেমরত জুটিকে দেখে কেন তার জীবনে হলেও হতে পারত মার্কা প্রেমকাহিনীটা সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাকে বলতে শুরু করলেন? গাড়ি ঈশ্বরদী স্টেশনে এসে পৌঁছার মিনিট পাঁচেক পূর্বে শুনি সেই জুটির প্রেয়সী মোবাইল ফোনে কাউকে বলছেঃ হ্যা, গাড়ি আর কয়েক মিনিটের মাঝেই লাগবে.....হ্যা, বন্ধ ছিল.....জানিনাতো.....কীভাবে যেন চাপ লেগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এইমাত্র অন করলাম.....সরি, বুঝতে পারিনি.....তুমি এতক্ষণ অপেক্ষা করছ? ইস্, কী কষ্ট হল.....আচ্ছা, এইতো এসে গেছি.....হ্যা, শোভন ‘ঘ’....না, ভারী কিছু নেই, তোমাকে কম্পার্টমেন্টে উঠতে হবেনা।

চেয়ে দেখি সেই প্রেমপাগল প্রেয়স এখন দিব্যি সুস্থভাবে প্রেয়সীর ট্রাভেলব্যাগসহ হোল্ডঅলটা দুহাতে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। আমার সহযাত্রী চোখ টিপে বললেন, বুঝলেন কিছু? আমি কিছু বুঝলামনা কিন্ত সেই প্রেয়সের গমনপথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় এখন তার একাকী ফিরে আসাটা দেখতে পেলাম। তার এখনকার মুখটা দেখতে কেমন? বিষণ্ন, নাকি প্রেমক্লান্ত? ভদ্রলোক জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্লাটফর্মের দিকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন, দেখুন। আমি উঁকি দিলাম। প্ল্যাটফর্মের অনুজ্জ্বল আলোয় একজন মাঝবয়সী, সুদেহী, সুবেশা মানুষকে এগিয়ে এসে ঐ প্রেয়সীর হাত থেকে লাগেজগুলো নিতে দেখলাম।

আমার সহযাত্রী তার দেহটাকে আসনে আয়েসী ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, এমনই হয়, এমনই হতে পারত। এতক্ষণে আমার বুকের ভেতরটা কেমন মোচড়াতে লাগল। আমার মানসীর তিনি প্রবাসী। দেশে ফিরলে তবে কি....নাহ্, আমি ভাবতে পারছিনা। ভাবতে না চাইলেও বুকের ভেতরটায় নানা কাল্পনিক দৃশ্যরা ভেসে উঠে আমার বুকের মোচড়কে অসহনীয় ব্যাথায় রূপান্তরিত করে অহেতুক হৃদয়টাকে ব্যাথাতুর করে তুলতে লাগল।

চেয়ে দেখি সেই প্রেয়স এখন মুখের পরে একটা খোলা বই উপুড় করে দিয়ে চুপ করে নিথর পড়ে আছে। হঠাৎ আমার মনে একটা বিচিত্র ভাবোদয় হলঃ আগামীর কথা ভেবে আজকের ক্ষণটা কেন নষ্ট করি? এইযে রাতে আমি আমার মনের মানুষের সাথে দেখা হবার উত্তেজনার কাঁপন, ভালবাসার শিহরণ, প্রেমাস্পদকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনার বেদন আর সুতীব্র কামনাময় নিষিদ্ধ প্রেমের দহন বুকে চেপে ছুটে চলছি ক্ষণিক মিলনের প্রত্যাশ্যায় -- এ রাতটা কি জীবনে আর ফিরে আসবে? নৈতিকতা, সামাজিকতার বাঁধনে বাঁধা হিসেবী প্রেমতো জীবনে আসতেই পারে কিন্ত এমন উন্মাতাল আবেগময়তা কি তাতে থাকে? নাহ্, আমি আমার উপভোগ্য বর্তমানে বাঁচতে চাই; অজানা, অনিশ্চিত, অনিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যতে নয়। বিচিত্র এক নাসিকাগর্জনের ধ্বনিতে আমার ভাবসুত্র ছিন্ন হলে সমুখে তাকিয়ে দেখি আমার সহযাত্রীটি এতক্ষণে নিদ্রার কোলে ঠাঁই পেতেছেন। এত বিচিত্র কাণ্ডের মাঝে এত সহজে কোন মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারে! আজব! আমি তার নিশ্চিন্ত ঘুমে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে আমার একান্ত খেয়ালী জগতে তীব্রমধুর আবেশময় খেয়ালের ঘোরে ডুবে গেলাম। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।