আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প

নাটকীয় (১) হারিসের সন্তানপ্রীতি দেখে আত্মীয়-স্বজনেরা অবাকই হয়। প্রথম স্ত্রী সালমা হত্যার মামলায় যখন তার উকিল নিয়োগের টাকা জোগাড় তো দূরের কথা, জীবন বাঁচানো নিয়েই আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন একরকম বাধ্য হয়েই সে সালমার পরিবারের সাথে আপোষ করে সালমার ছোট বোন - অবিবাহিতা ও দুই মাসের গর্ভবতী রেহানাকে বিয়ে করতে। বিনিময় হিসেবে সালমার বাবা ভাইরা মামলার ধারাবাহিকতা রক্ষা থেকে সরে আসে। “রেহানা এই আকামডা করল কার লগে?”- মিনমিনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল হারিস। “তুমি আপাতত তোমার আকামডাই সামলাও!”- গর্জে উঠে জবাব দিয়েছিল রেহানার বড় ভাই।

পরবর্তীতে হারিস আর কিছু জানতে চায়নি। রেহানার পরিবারের সবাইও বিষয়টা চেপে যায় সেখানেই। এখন রেহানার সন্তান আনিসের বয়স প্রায় তিন বছর। এবং আশ্চর্যের বিষয় এটাই, যে সন্তানের প্রতি হারিসের থাকার কথা সীমাহীন ঘৃণা আর অবজ্ঞা, তাকেই সে অসীম স্নেহে আগলে রেখেছে। (২) রুবেল হারিসের দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই।

বিয়ের এক মাসের মাথায় রুবেল যখন জীবিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমায়, তারপর নিঃসন্তান অসুখী দম্পতি সালমা-হারিসের সংসারের আগুনে নতুন করে ঘি ঢালতে বিলম্ব করেনি শিরিন। একই হাসপাতালের ডেলিভারি ইউনিটের ওয়ার্ড বয় আর আয়ার কাজ করত তারা। প্রথমদিকে শিরিনকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল হারিসের। কিন্তু পরবর্তীতে মামলার আসামী হওয়ায় আর রেহানাকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় সে আশাকে সেখানেই সমাধি দিতে হয়। এরপর ধুরন্ধর হারিসের দূরদর্শিতা যখন শিরিন ধরতে পারে, ততদিনে বহু দেরী হয়ে গেছে।

যখন শিরিন প্রথম গর্ভধারণ করে, সে সময় হারিস তাকে গর্ভপাত করতে দেয়নি এই বুঝিয়ে যে, নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বে যদি তারা সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করে তাহলে রুবেল এবিষয়ে শিরিনকে সন্দেহ করবে না; তাদের সন্তানকে রুবেল নিজের সন্তান বলেই জানবে। মুলতঃ, হারিস ইচ্ছা করেই এমন এক সময়ে শিরিনকে গর্ভবতী করেছিল যেন রেহানার কাছাকাছি সময়ে সন্তান প্রসব করানো সম্ভব হয়। এবং অদ্ভুত হলেও সত্য, হারিস খুব দক্ষতার সাথেই তার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল। হাসপাতাল কর্মক্ষেত্র হওয়ায় সন্তান প্রসবের পর দীর্ঘ সময় রেহানাকে অচেতন করে রাখা, শিরিনকে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সন্তান প্রসবে বাধ্য করা এবং সর্বোপরি, রুবেলকে সত্য ঘটনা জানিয়ে দেওয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে রেহানার সন্তানকে গ্রহণ করে নিজের সন্তানকে বদল করতে শিরিনকে সম্মত করা- এসকল কাজই হারিস সম্পাদন করেছিল নিরতিশয় সতর্কতা আর মুন্সিয়ানার সাথে। নিরুপায়ের শেষ অস্ত্রটি আঁকড়ে ধরে অভিশম্পাত করেছিল দুর্বল শিরিন, “খোদা তোরে মাফ করবো না কুত্তার বাচ্চা!” “জানি ময়না! আমার যে আর কিছুই করার আছিল না! শুধু এইটুকু জাইনা রাখো, হ্যায় আমার কাছে খারাপ থাকব না।

”- মলিনমুখে কথাগুলো বলে বেরিয়ে এসেছিল হারিস। তারপর রেহানা আর নবজাতক সন্তানকে নিয়ে দূরবর্তী এক এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে সে। (৩) খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল রুবেলের। বিছানায় উঠে বসে ঘুমন্ত সন্তান ও স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। এতদিনের এলোমেলো চিন্তাগুলো আবার ঘুরপাক করতে লাগলো মাথার মধ্যে।

আজকের দিনটার জন্য সে অপেক্ষা করে আছে প্রায় সাড়ে তিন বছর থেকে - আজকেই সে প্রমাণ করতে পারবে তার এতদিনের সন্দেহ আর অবিশ্বাসকে। প্রমাণটা হাতে পাওয়ার পর সে তার স্ত্রীকে জানিয়ে দিতে বিলম্ব করবে না – কেন সে এতদিন তাদেরকে সত্যিকার স্ত্রী আর সন্তানের মর্যাদা দিতে পারেনি। শিরিন বহুবার তার হাত-পা ধরে কসম খেয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, সে কোন অন্যায় করেনাই। কিন্তু রুবেল সে কথার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। আজকের এই দিনটার জন্য সে বহু ডাক্তার-কবিরাজের সাথে যোগাযোগ করেছে।

অভাবের সংসারে শুধু একটা ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর জন্য বিশ হাজার টাকা জমাতে তাকে কম বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু তার অবিশ্বাস এতটাই বদ্ধমূল হয়ে মনের মধ্যে গেঁথে গেছে যে, এখন শুধু প্রমাণটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষা। -“কই যাও এই সাতসকালে?” -“কাম আছে। ” -“কি যে চিন্তা কর সারাদিন! খোদা যে কবে একটু মুখ তুইল্যা তাকাবো আমার দিকে!” কোন জবাব না দিয়ে সন্তান রাহাতকে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুবেল। হাসপাতালের বারান্দায় ডিএনএ রিপোর্ট হাতে দাঁড়িয়ে রুবেল আবিষ্কার করল, কষ্টের অনুভূতি জাগায় এরকম বদ্ধমূল বিশ্বাসও যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলেও মুহূর্তের জন্য হতাশ লাগে! কিন্তু সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।

এই প্রথম সে স্নেহভরা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার একমাত্র সন্তান রাহাতের দিকে। তার সন্তান! যে কিনা বাবা-মা জীবিত থাকতেও দুজনের কাছ থেকেই এক ধরনের উপেক্ষা নিয়ে পার করেছে জীবনের তিনটি বছর! হঠাৎ করে ঝুঁকে রাহাতকে বুকে তুলে নেয় রুবেল। চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় তার মুখ। অবাক চোখে রুবেলের দিকে তাকিয়ে থাকে রাহাত। পিতার এই চেহারা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন।

রাহাতকে বুকে আঁকড়েই মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বাড়ির পথে ছুটল রুবেল। এতদিন স্ত্রীর প্রতি অনেক অবিচার করে ফেলেছে সে! আজই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। পথে শিরিনের জন্য একটা লাল রঙের শাড়ি কিনতেও ভুলল না সে... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।