আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামীণ ব্যাংক ঘিরে ২৯ প্রশ্ন, ইউনূসের জবাব

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত এই বাংলাদেশী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটি ও তার ব্যাপারে ‘সমালোচকদের কিছু প্রশ্ন’ এবং সে বিষয়ে ‘প্রকৃত তথ্য’ দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ২৯টি প্রশ্ন উল্লেখ করে বিস্তারিতভাবে তার জবাব দিয়েছেন তিনি। নোবেলবিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের ব্যক্তিগত কার্যালয় ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ কোম্পানি ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে এবং মিডিয়ায় নানা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। হয়তো তথ্য না-জানার কারণে অনেকে কাল্পনিক তথ্য তৈরি করে তীব্র ভাষায় সমালোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। এতে দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

দেশের মানুষের জ্ঞাতার্থে, সমালোচকদের আলোচনার সুবিধার্থে গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ কোম্পানি ও প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন সম্প্রতি উত্থাপিত হয়েছে তার প্রকৃত তথ্য আমরা সংকলিত করে দিলাম। ” বিবৃতিতে জানানো হয়, “যে তথ্যগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকাশনায় আছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলির কাছেও আছে। সেখান থেকে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা যায়। প্রয়োজনে ইউনূস সেন্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাবে। ” ০১. প্রশ্ন: সরকার গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করতে চাইলে তাতে এত বাধা বা সমালোচনা হচ্ছে কেন? নোবেল লরিয়েট বলে তিনি কি তদন্তের উর্ধ্বে? উত্তর: সাধারণতঃ কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তদন্ত করা হয় যখন সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়।

গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। গ্রামীণ ব্যাংক একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান বলেই সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিবিড়ভাবে গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন করেছে। প্রতি বছর দু’টি আন্তর্জাতিকমান সম্পন্ন অডিট ফার্মও গ্রামীণ ব্যাংক অডিট করে এসেছে। কোনো অডিট টিম কোনো অনিয়ম নিয়ে কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি।

তাছাড়া সরকার প্রধান সংসদে, সংসদের বাইরে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন যা বিদ্বেষমূলক বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। অন্যদিকে সরকার প্রধানের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগা কি স্বাভাবিক নয়? এই তদন্ত কি তার মন্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হবে না? শুধু এই কারণেই বিভিন্ন সুধীজন এই তদন্ত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য কোনো কারণে নয়। নোবেল বিজয়ী বলে তিনি তদন্তের উর্ধ্বে নন। যারা আপত্তি তুলেছেন তারা এই তদন্ত বিদ্বেষমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে এই ধারণা নিয়েই আপত্তি তুলেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন যে, “আমি সংবিধানের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব, এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব”। আচরণ নিয়েই সমস্যা, তদন্ত নিয়ে নয়। বাস্তবে এই আচরণ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে তার প্রতিবাদ করা কি সব নাগরিকের কর্তব্য নয়? ০২. প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক তো একটি সরকারি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ইউনূস একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলেননি কেন? উত্তর: বর্তমান সরকারের আমলে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আগের কোনো সরকার, এমনকি আগের আওয়ামী লীগ সরকারও কোনোদিন এরকম দাবি করেনি। গ্রামীণ ব্যাংক ৯০ সালের পর থেকে বেসরকারি ব্যাংক হিসেবেই কাজ করে এসেছে। এখন এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে আগের ধারণাকে পাল্টে দেয়া হয়েছে। বর্তমান দাবির মূল কারণটি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আইনে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থা। ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের সংশোধনীর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি নিয়ন্ত্রনমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে এর ভিত্তিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, এবং গ্রামীণ ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছে।

এতে কেউ আপত্তি করেনি। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সটারনাল অডিটর বা অন্য কারো কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন আসেনি। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানাই শুধু বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি (বর্তমানে ৯৭%), ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়-দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি লক্ষণ হলো যে, তার রুলস এবং রেগুলেশান তৈরি করার সময় সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। ১৯৯০ সালের সংশোধনীর পর গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে এই বিধান আর রাখা হয়নি।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকার সময় সময় বিভিন্ন নির্দেশ দিতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে এমন বিধান রাখা হয়নি। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক মূলতঃ বেসরকারি মালিকানায় এর বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রণীত প্রবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে। এই ব্যাংকের কর্মচারীরা ব্যাংকের নিজস্ব নিয়মে (বোর্ড কর্তৃক প্রণীত প্রবিধান অনুযায়ী) চাকরি করে। বেতনের স্কেলসহ চাকরির সব সুযোগ-সুবিধা বোর্ড ঠিক করে দেয়।

যা অর্ধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা দশ বছর পূর্তির পর যেকোনো সময় গ্র্যাচুইটি ও পেনশনসহ অবসর নিতে পারে যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সময়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এই প্রতিষ্ঠানে বোর্ডই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সরকার নিজেই সরকারের কাছে কোনো ক্ষমতা রাখেনি। এ কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পেরেছে।

ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বোর্ড নিয়োগ দেয়। বোর্ডকে সে ক্ষমতা আইনে দেয়া আছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিধান গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে সন্নিবেশিত আছে। আইনানুযায়ী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্ষদ কর্তৃক দেয়া শর্তাধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার নিয়োগের জন্য কোনো বয়সসীমা নির্ধারিত নেই।

গ্রামীণ ব্যাংকের মতো পৃথক আইনে সৃষ্ট আরেকটি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেয়া যায়। সেটি হলো এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন (এ.ইউ.ডব্লিউ)। গ্রামীণ ব্যাংক যেরূপ একটি বিশেষ আইন বলে সৃষ্টি হয়েছে সেরূপ চট্টগ্রামে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ও একটা বিশেষ আইনে সৃষ্টি হয়েছে। এ.ইউ.ডব্লিউ সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এর কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারী নন।

এর ভাইস-চ্যান্সেলরও সরকারি কর্মচারী নন। তাকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো মেনে চলতে হয় না। গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি না বেসরকারি এটা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হতে পারে। মূখ্য বিষয় হচ্ছে ২০১১ সাল পর্যন্ত এটা বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে চলেছে। এটা নিয়ে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক কারো মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না বলেই গ্রামীণ ব্যাংক তার কার্যক্রমে সাফল্য অর্জন করতে পেয়েছে।

এখন যদি এটাকে সরকারি পরিচয় ধারণ করে তার চরিত্র সংশোধন করে চলতে বলা হয় তাহলে এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাই হলো মূল কথা। যদি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, বর্তমানে যে আইন আছে তাতে এটা বেসরকারিভাবে চলার কোনো উপায় নেই, এতদিন ভুল করে বেসরকারিভাবে চলেছিল, তাহলে আইন সংশোধন করে এটাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি করে ফেলতে হবে। এর আর কোনো গত্যন্তর নেই। এরকম আইন করে দিলে গ্রামীণ ব্যাংক মজবুত, স্থায়ী ব্যাংক হিসেবে চলতে পারবে।

জাতীয় প্রয়োজনে তাই করতে হবে। সরকারি ব্যাংক হিসেবে চলতে গেলে এটা মুখ খুবড়ে পড়ে যাবে। ০৩. প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক তো সরকারের অর্থে চলে। তাছাড়া বিদেশ থেকেও গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য শত শত কোটি টাকা আসে। এই টাকা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখা কি সরকারের কর্তব্য নয়? উত্তর: না, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের অর্থে চলে না।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই চেষ্টা হচ্ছিল যেন ব্যাংকটি কেবলমাত্র সদস্যদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার এটাতে রাজি হয়নি। জন্মকালে (১৯৮৩ সালে) গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৬০% ছিল। প্রফেসর ইউনূস ৬০% সরকারি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় মোটেও রাজি ছিলেন না। তাকে বুঝানো হলো যে, ব্যাংক চালু হয়ে গেলে এটা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হবে।

১৯৮৬ সালে সেটা করা হয়েছিল। ৭৫% শেয়ার বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল অধ্যাদেশ সংশোধন করে। প্রফেসর ইউনূস সরকারের শেয়ারের অংশ টোকেন অংশীদারিত্ব হিসেবে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। যার ফলে সরকার ২০০৮ সালে ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে সরকারের শেয়ার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করে। পরে বর্তমান সরকার তা সংসদে পেশ করে আইনে পরিণত না করায় সরকারের শেয়ার পূর্বের মতো ২৫ শতাংশে ফিরে গেছে।

চেয়ারম্যানের নিয়োগ সরকারের কাছে থেকে গেছে। সরকার ব্যাংকের জন্মকালে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিল। এখনো সরকারের মোট শেয়ারের পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাক প্রত্যেকে ৩০ লক্ষ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছে। ফলে সরকারের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছিল এক কোটি ৮০ লাখ টাকা।

জন্মের পর থেকে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে এক কোটি ৮০ লক্ষ টাকার বেশি আর কোনো টাকা দেয়নি। সরকার তার মূলধনের পরিমাণ না বাড়ানোতে কার্যতঃ সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারের অনুরোধে বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক বিদেশী ঋণ ও অনুদান নিয়েছে। বিদেশী ঋণ ও অনুদান নেবার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের উপর সময় সময় চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেসব তথ্য বিভিন্ন প্রকাশনায় লিপিবদ্ধ করা আছে।

যেসব বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছিল তা চুক্তি মোতাবেক শোধ করে দেয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধে গ্রামীণ ব্যাংক কোন সময় এক দিনের জন্যও বিলম্ব করেনি। ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর বিদেশী ঋণ বা অনুদান নেবে না। চালু ঋণ/অনুদানগুলি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চালু থাকে। এরপর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশী ঋণ বা অনুদান নেয়নি।

সরকারি অনুদান গ্রামীণ ব্যাংক কোনকালেও নেয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধনের প্রধান উৎস সদস্যদের শেয়ার কেনা বাবদ অর্থ। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। সরকার কর্তৃক বেঁধে দেয়া মূলধনের সর্বোচ্চ সীমা ২০০৮ সালের পূর্বে কম ছিল বলে, গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সদস্যকে একটির বেশী শেয়ার দিতে পারেনি। যদিও সদস্যদের ইচ্ছা তারা বেশি করে শেয়ার কিনবেন, কারণ গ্রামীণ ব্যাংক শেয়ার প্রতি ২০% থেকে ৩০% মুনাফা দিয়ে থাকে।

০৪. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লক্ষ সদস্য কি ব্যাংকের প্রকৃত শেয়ার হোল্ডার? নাকি সব ভূঁয়া? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকাংশ সদস্য ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। শেয়ার কিনেছেন এমন সদস্যের সংখ্যা ৫৫ লক্ষ। মোট সদস্য ৮৪ লক্ষ। যারা শেয়ার এখনো কিনেননি তাঁরা ক্রমান্বয়ে কিনবেন। এজন্য কোন তাড়া দেয়া হয় না।

সম্মিলিতভাবে সদস্যরা ৯৭% শেয়ারের মালিক। আরো সদস্য শেয়ার কিনতে থাকলে সদস্যদের মালিকানা ৯৭%-এর উপরে চলে যেতে থাকবে। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। সদস্যের সঞ্চয়ী হিসেবে ১০০ টাকা জমলে তা দিয়ে তিনি ১০০ টাকা দামের একটি শেয়ার ক্রয় করেন। তিনি শেয়ার কেনা বাবদ ১০০ টাকা ব্যাংকের শেয়ার খাতে জমা দিয়েছেন এমর্মে সেটা সদস্যের পাস বইতে লিখে দেয়া হয়।

এর ফলে শেয়ার হোল্ডার রেজিস্টারে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এই রেজিস্টার থেকে পরিচালক নির্বাচনের সময় ব্যাংকের ভোটার তালিকায় তার নাম তোলা হয়। ০৫. প্রশ্নঃ যদি শেয়ারহোল্ডার থেকে থাকে, তবে কোনদিন তাদেরকে ডিভিডেন্ড দেয়া হলো না কেন? মুনাফার টাকা কি প্রফেসর ইউনূস এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাহলে হজম করে ফেলেছেন? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংক বরাবর শেয়ারহোল্ডারের ডিভিডেন্ড দিয়ে এসেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যেক সদস্য যেকোন সময় ১০০ টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শেয়ার কিনতে পারেন। ৮৪ লক্ষ ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৫৫ লক্ষ ঋণ গ্রহীতা এ পর্যন্ত শেয়ার কিনেছেন।

এর মাধ্যমে তারা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ৯৭ শতাংশ মূলধনের মালিক হয়েছেন। সরকার ও সরকারি ব্যাংক ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার শেয়ার কিনে ৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এপর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক সরকারকে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ২ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা, সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংককে প্রত্যেকে ৩০ লক্ষ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৬৩ লক্ষ টাকা লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে। সদস্যরা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৭৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ পেয়েছেন (সদস্যরা তুলনামূলকভাবে কম পেয়েছেন, যেহেতু ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে যারা শেয়ার কিনেছেন তারা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মেয়াদে লভ্যাংশ পেয়েছেন)। প্রত্যেক সদস্যকে প্রতি বছর লভ্যাংশ তার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।

পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে বাৎসরিক হিসাব অনুমোদন করার সময় বছরের অর্জিত মুনাফা কীভাবে বন্টন করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুনাফার কী পরিমাণ অংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে শেয়ার মালিকদের কাছে বন্টন করা হবে সে বিষয়ে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ লভ্যাংশ দেয়ার মত পর্যাপ্ত না থাকায় ডিভিডেন্ড প্রদান করা হয়নি। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারের দেয়া শর্ত পূরণের জন্য ডিভিডেন্ড প্রদান সম্ভব হয় নি। ডিভিডেন্ড প্রদান না করে সকল মুনাফা পুনর্বাসন তহবিলে প্রদানের শর্তে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর অব্যাহতি প্রদান করে এজন্য বোর্ড ডিভিডেন্ড প্রদান করতে পারেনি।

২০০৬ সাল থেকে সরকারের এই শর্ত রহিত হওয়ার পর বোর্ড ২০০৬ সালে ১০০%, ২০০৭ সালে ২০% এবং ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রতিবছর ৩০% হারে লভ্যাংশ প্রদান করেছে। মুনাফার পরিমাণ কম হলে গ্রামীণ ব্যাংক যাতে একই হারে মুনাফা বন্টন করে যেতে পারে সেজন্য “মুনাফা সমতা আনয়ন তহবিল গঠন করেছে। ২০১০ পর্যন্ত এই তহবিলে ৬৯ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা জমা আছে। গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু প্রফেসর ইউনূস বা তার সহকর্মীদের কোন শেয়ার নাই তাঁরা গ্রামীণ থেকে কোন লভ্যাংশ নিতে পারেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তার শুধু বেতন ভাতা পান।

শুধু সেটুকুই তারা নিয়েছেন। ০৬. প্রশ্নঃ সরকারের আইন অনুসারে ৬০ বছর বয়সের পরও প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকেছেন। এটা কি বেআইনী কাজ হয়নি? এই অতিরিক্ত সময়ে বেতন-ভাতা গ্রহণও কি বেআইনী নয়? উত্তরঃ ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা ৬০% থেকে কমে ২৫% এবং ব্যাংকের সদস্যদের মালিকানা ৪০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫% এ উন্নীত হয় এবং মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা হ্রাস পাওয়ায় অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের উপর ন্যস্ত করা হয়। সংশোধিত অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়ার পূর্বানুমতিদানের অনুরোধ জানিয়ে ১৪-০৮-১৯৯০ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৫-০৮-১৯৯০ তারিখে চিঠি দিলে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বিষয়ে পূর্বানুমোদন দেয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার অনুমোদন পত্রে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বেলায় কোন বয়সসীমা উল্লেখ করেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন পত্রের ধারাবাহিকতায় কোন বয়সসীমা উল্লেখ না করে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত অবস্থায় জুলাই ২০, ১৯৯৯ তারিখে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালকমণ্ডলীর ৫২তম সভায় স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তার অবসর গ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে বোর্ডকে অবহিত করেন। পরিচালকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যতদিন পর্যন্ত পরিচালকমণ্ডলী অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেবে ততদিন পর্যন্ত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বহাল থাকবেন। উল্লিখিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে একটি রেগুলেশন তৈরির সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। উক্ত রেগুলেশনেও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের জন্য কোন বয়স সীমা আরোপ করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ ব্যাংকের উপর ৩১-১২-৯৯ তারিখের স্থিতি ভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি মর্মে আপত্তি উত্থাপন করে। গ্রামীণ ব্যাংকের উপর ব্যাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯৯ সালের স্থিতি ভিত্তিক বিষদ পরিদর্শন প্রতিবেদনের অনিস্পত্তিকৃত কিছু বিষয়ের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ জন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ জন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ১৫-০১-২০০১ তারিখে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ সভায় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনের কতিপয় অনুচ্ছেদ নিস্পত্তি হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কতিপয় অনুচ্ছেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংক যাচিত ডকুমেন্টসসমূহের কপি সরবরাহ করলে আপত্তিসমূহ নিস্পত্তি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। সে প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক ১৬-০১-২০০২ তারিখে যাচিত ডকুমেন্টসহ পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে।

এ সময় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এর বয়স ছিল ৬১ বছর ৬ মাস। অর্থাৎ তার বয়স এ সময় ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে ঘটনাত্তোর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা বলেননি। এর ফলে নিস্পত্তি হয়ে যাওয়া এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী কোন বিষদ পরিদর্শন প্রতিবেদনেই এ প্রসংগটি আর কখনোই আসেনি। উল্লেখ্য যে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই প্রফেসর ইউনূসের বয়স ষাট বছর উর্ত্তীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার তার বয়স নিয়ে কোন আপত্তি তোলেনি।

মোট ১১ বছরে এটা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর কোন প্রশ্ন তোলেনি। ২০১১ সালে প্রশ্ন তোলা হলো। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে গেলেন। আদালত তার আবেদন গ্রহণ করলো না এই বিবেচনায় যে তার প্রতিকার চাওয়ার ‘লুকাস স্টান্ডি’ নেই, অর্থাৎ আবেদন করার যোগ্যতা নাই। তিনি আপিল বিভাগে গেলেন।

সেখানেও তার আবেদন একই যুক্তিতে অগ্রাহ্য হলো। তিনি এরপর পদত্যাগ করলেন। তিনি যে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করলেন এটা কি তার অপরাধ, নাকি যাঁরা তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের অপরাধ, নাকি যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়ে এই নিয়োগকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন তাদের অপরাধ, এটা স্থির করতে হবে। ০৭. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে কতজন নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি রয়েছেন? ওরা কারা? কীভাবে তারা বোর্ডে আসেন? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের আইন অনুসারে বোর্ডে নয়জন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচন পদ্ধতি গ্রামীণ ব্যাংক নির্বাচন বিধিমালা তৈরির মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের নয়টি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রতি নির্বাচনী এলাকায় তিন স্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়। নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন পরিচালনা করেন। নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়।

যারা শেয়ার কিনেছেন শুধু তাঁরাই ভোটার তালিকায় স্থান পান। প্রত্যেক স্তর থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। প্রথম স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মিলে দ্বিতীয় স্তরের নির্বাচনে ভোটার হন। দ্বিতীয় স্তর থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় স্তরের প্রতিনিধিরা মিলে তৃতীয় স্তরের প্রতিনিধি পরিষদ গঠন করেন।

এই পরিষদ যাকে নির্বাচিত করেন তিনিই ওই নির্বাচনী এলাকার বোর্ড সদস্য হিসেবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হন। যিনি শেষ পর্যন্ত বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হলেন তাঁকে তিন স্তরের প্রতিটি স্তর থেকে নির্বাচিত হয়ে সর্বশেষ স্তর পর্যন্ত নির্বাচিত হতে হয়। খুবই কঠিন একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে তাঁকে বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হতে হয়। বিভিন্ন গুণাবলী যাচাই করে প্রতি স্তরের ভোটাররা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে পরিচিত তার একটি প্রমাণ হলোঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ১৩ জন সদস্য গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

৪০২২ জন সদস্য ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে ৯৮ জন সদস্য মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, একজন সদস্য উম্মুক্ত আসনে পুরুষ প্রতিদ্বন্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। একজন পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ১৮৪ জন পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাছাড়া সদস্যদের স্বামী ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৪৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

২৪৮ জন্য পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এসংখ্যা হলো যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সংখ্যা। যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কিন্তু নির্বাচিত হতে পারেননি তাদের সংখ্যা এর চাইতে অনেক বেশি। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নেতৃত্বদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাদের সবাইকে যত অবলা নারী চিন্তা করে কথাবার্তা হচেছ, তারা মোটেই তা নন।

০৮. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নির্বাচিত মহিলা পরিচালকরা কি প্রফেসর ইউনূসের হাতের পুতুল নয়? বোর্ড সভায় তাঁরা কি কোনো ভূমিকা পালন করেন? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে সিদ্ধান্তের জন্যে খুব রুটিন বিষয় আসে। বোর্ড সভায় কোন ঋণ প্রস্তাব পাশ করার প্রয়োজন হয়না। ঋণ প্রস্তাব সাধারণতঃ শাখা এবং এরিয়া পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। বোর্ডে শুধু নীতি বিষয়ক প্রস্তাব আনা হয়, বাজেট আনা হয়, পরিকল্পনা আনা হয়। বোর্ড সদস্যরা বোর্ড সভায় অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে সকল বিষয়ে তাদের মনোভাব, প্রশ্ন ও অভিমত প্রকাশ করেন।

নির্বাচিত বোর্ড সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে বোর্ড সভায় গ্রামীণ ব্যাংকের বহু নীতির পরিবর্তন হয়েছে এবং বহু নতুন নীতি প্রণীত হয়েছে। নির্বাচিত সদস্যরাই পরিচালনা পর্ষদের মূল প্রাণশক্তি। চেয়ারম্যান ও সরকারি সদস্যরা তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই সম্মিলিতভাবে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। বোর্ডের মোট ১৩ জন সদস্যের মধ্যে চেয়ারম্যান ও সরকারের দু’জন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আজ পর্যন্ত কোন দিন ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শুরু থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের বিজ্ঞ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রণীত বিধান অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা বোর্ড নির্বাচন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার সদস্যগণের মধ্য থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নয় জন নির্বাচিত পরিচালকের উপস্থিতিটাই ব্যাংক পরিচালনায় আলোচনার ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাদের সঙ্গে ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় ও যাচাই করা যায়।

এই জ্ঞান তাদের কাছে ব্যতীত পৃথিবীর আর কারো কাছে নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের তারা সরাসরি মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ফল তাদের উপর বর্তায়। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের জীবন সরাসরি জড়িত। তারা উপস্থিত থাকেন বলে আলোচনা জীবন-ভিত্তিক হতে বাধ্য হয়।

শুরু থেকেই চেয়ারম্যানসহ সরকার মনোনীত পরিচালকগণ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গৃহীতা শেয়ারহোল্ডার সদস্যগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত পরিচালকগণ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন। স্মরণ রাখতে হবে যে, তাদের সুযোগ্য পরিচালনার ফলেই গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে নোবেল প্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে। তারা যখন বোর্ডে প্রস্তাব পাশ করে নীতি নির্ধারণ করে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান- তাদের প্রণীত নীতি যদি সদস্যদের পছন্দ না হয় তা হলে নিজ গ্রামের সদস্যসহ আশেপাশের দশ গ্রামের সদস্যরা তাদের উপর চড়াও হবে সেটা তাদের জানা থাকে। সেখানে তখন তিনি সবার সামনে একা। ওদের সঙ্গেই তাকে বসবাস করতে হয়, সাপ্তাহিক মিটিং করতে হয়।

তাদের চটাতে তিনি কোনো অবস্থাতেই চান না। ০৯. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংক কি অত্যন্ত উচ্চ সুদের হারে মহাজনী কায়দায় গরিব মানুষকে শোষন করে আসছে না? উত্তরঃ বাংলাদেশে সরকারি ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন। গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদের হার ২০%। এটা সরল সুদ। ক্রম হ্রাসমান পদ্ধতিতে সুদের হার ঠিক করা হয়।

যা ফ্লাট পদ্ধতিতে ১০% এ দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি (এমআরএ) দেশের সকল ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারণ করেছে ২৭%। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার এই হারের চাইতে ৭% কম। গ্রামীণ ব্যাংকের গৃহনির্মাণ ঋণের বার্ষিক সুদের হার ৮%। উচ্চশিক্ষা ঋণের সুদের হার, শিক্ষা জীবনে ০% (অর্থাৎ সুদ নেই) এবং শিক্ষা সমাপ্তির পর ৫%।

ভিক্ষুক সদস্যদের জন্যে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ০% (অর্থাৎ সুদ নেই)। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণের উপর সর্বনিু সুদ নেয়, এবং সঞ্চয়ের উপর সর্বোচ্চ (৮.৫% থেকে ১২%) সুদ দেয়। এসব তথ্য দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিমালা প্রকাশনা ও ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছেও এই তথ্য রয়েছে। তবু অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে কল্পিত বিভিন্ন উচ্চতর সুদের হার গণমাধ্যমে উল্লেখ করে থাকেন, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

উল্লেখযোগ্য যে, ২০১১ সালে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও এই সুদের হার এবং আদায় পদ্ধতি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে। ১০. প্রশ্নঃ বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের ওপর কি নিপীড়ন করা হচ্ছে না? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম লগ্ন থেকে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নীতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এটার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে যেহেতু সদস্যরা নিজেরাই সঞ্চয়ের ব্যাপারে অভ্যস্থ ও আগ্রহী হয়ে গেছেন সে কারণে পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নিয়ম রহিত করা হয়। সে থেকে সকল সঞ্চয় সম্পূর্ণরূপে ঐচ্ছিক।

এখন গ্রামীণ ব্যাংকে কোন বাধ্যতামূলক সঞ্চয় নেই। গ্রামীণ ব্যাংক গোড়া থেকেই সঞ্চয়ের উপর ৮.৫% থেকে ১২% চক্রবৃদ্ধিহারে পর্যন্ত সুদ দেয়। (মাইক্রোফিনান্স রেগুলেটরি অথরিটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির জন্য সঞ্চয়ের সর্বনিম্ন সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছে ৬%)। সদস্যরা এর ফলে উৎসাহী হয়ে বেশি টাকা সঞ্চয়ে জমা করেন। যেমন পেনশন ফান্ডে জমা করার ব্যাপারে তাদের খুবই উৎসাহ।

কারণ এ টাকায় ১২% সুদ পওয়া যায়। তাদের জমা টাকা তাড়াতাড়ি বড় হয়। অনেকে এককালীন দীর্ঘ মেয়াদী সঞ্চয়ে টাকা জমা রাখেন। সঞ্চয়ের টাকা যখন ইচ্ছা তখন তোলা যায়, জমা দেয়ার পরদিনই তোলা যায়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের মোট সঞ্চয়ের ব্যালেন্স ৭ হাজার কোটি টাকা।

যেখানে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের কোন ব্যাপার নেই সেখানে নিপীড়নের মাধ্যমে সঞ্চয় নেবার কথা উঠে কী করে? ১১. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি দিতে না পেরে অনেক মহিলা কি আÍহত্যা করেনি? অনেক মহিলাকে কি ভিটে-বাড়ি ছাড়তে হয়নি? অনেক মহিলা কি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে না? উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের একজন সদস্য আত্মহত্যা করতে পারেন, পালিয়ে বেড়াতে পারেন, আয়ার কাজও করতে পারেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে তাকে এটা করতে হয়েছে এরকম ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একজন সদস্য গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে পালিয়ে বেড়াবে কেন? গ্রামীণ ব্যাংক কি তার উপর অত্যাচার করে? গ্রামীণ ব্যাংক কি তাকে পুলিশে সোপর্দ করে? তার বিরুদ্ধে কি মামলা করে? গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৫ বছরের ইতিহাসে কেউ কি কোনদিন শুনেছে গ্রামীণ ব্যাংক কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেছে? অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট কেইস করার ক্ষমতা সরকারই গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক এক দিনের জন্যেও এই আইন কারো উপর প্রয়োগ করেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংকারদের অভিযোগ হলো গ্রামীণ ব্যাংক একটুতেই ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়- যাতে ঋণগ্রহীতাকে “ঋণখেলাপী” বলতে না-হয়।

এটা সত্য কথা। ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংক কার্পণ্য করে না। কারণ এটা গ্রামীণের মূল দর্শনের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। গ্রামীণ ব্যাংক মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাসী, বিশেষ করে গরিব মানুষের। গ্রামীণ ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে গরিব মানুষ যতটা না স্বেচ্ছায় খেলাপী হয়, তার চেয়ে অনেক বেশী খেলাপী হয় পারিপার্শিক কারণে।

ব্যাংক তাদের পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে তাদের পুরনো ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করে; নতুন করে পুঁজি পূনরুদ্ধার ঋণ প্রদান করে। তবে প্রতিবার ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সময় সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া ঋণের ৫০% এর সমপরিমাণ প্রভিশন করা হয়, অর্থাৎ সেটা খর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.