আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"অপারেশন সার্চলাইট" এর বিস্তারিত কর্মপন্থা (খাদিম রাজার বই A stranger in my own country: East Pakistan হতে)

"A stranger in my own country: East Pakistan, 1969-1971" by Major General Khadim Hussain Raja বইটি থেকে অনুদিত। এতে অপারেশন সার্চলাইটের একমাত্র সংরক্ষিত লিখিত কপিটি তুলে দেয়া আছে। এই প্ল্যান থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ ১) পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছলে-বলে-কৌশলে বাংগালিদের ন্যায্য অধিকার স্বশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। ২) তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের নাম করে আলোচনার ছলে অতর্কিতে বাংগালিদের উপর হামলা করে নেতৃত্বশুন্য করে দেবার প্ল্যান করে। ৩) বাংগালি রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সংস্কৃতি-কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্র এবং সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকে চিরকালের মত স্তব্ধ করে দিতে চায়।

৪) এর জন্য বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হত্যা-লুন্ঠন-নারী নির্যাতনের সেই কাল রাত্রির কর্মপরিকল্পনাই হচ্ছে অপারেশন সার্চলাইট। এমনকি এতে, আলাদা ভাবে হিন্দুদের বাড়ি তল্লাশির কথা উল্লেখ আছে। (অনুবাদের অনুমতি না থাকায় বেশি আগানো হয়নি, শুধু রেফারেন্স হিসেবে অনুবাদ করা) - অনুবাদক Basis for Planning (প্ল্যান এর মূল লক্ষ্য) ১) আওয়ামীলীগের সকল কর্মকান্ড ও প্রতিক্রিয়াকে বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং যারা মার্শাল ল' কে বিরোধিতা করবে ও আওয়ামীলীগকে সমর্থন করবে, তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে একশন নিতে হবে। ২) যেহেতু সেনাবাহিনীর ইস্ট-পাকিস্তানিদের মাঝে আওয়ামীলীগের ব্যাপক সমর্থন আছে, এই অপারেশন খুবই দ্রুততার সাথে, ধূর্ততার মাধ্যমে, শত্রুকে ধোকা দিয়ে, হতচকিত করে করতে হবে। Basic Requirements for Success (সাফল্যের জন্য প্রাথমিক লক্ষ্য) ৩) এই অপারেশন সমগ্র প্রদেশে একই সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে।

৪) সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতা এবং শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝের উগ্রবাদীদের গ্রেফতার করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও শীর্ষ ছাত্রনেতাদের অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে। ৫) ঢাকায় এই অপারেশনকে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলে নিতে হবে এবং সার্চ করতে হবে। ৬) ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

যারা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে গোলা-গুলি করতে হবে। ৭) সকল প্রকার আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কেটে দিতে হবে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও, টিভি, টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস, বিদেশি কনসুলেটের সাথে ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিতে হবে। ৮) সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে হবে, কোত (অস্ত্রাগার) ও এমুনিশন (গোলা-বারুদ) পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের দ্বারা দখল ও পাহারা দেবার মাধ্যমে। একই নির্দেশ পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর জন্যেও প্রযোজ্য।

Surprise and Deception (চমকে দেয়া এবং ধোঁকা) ৯) উচ্চপর্যায়েঃ যদিও ভুট্টো সাহেব রাজী হবেননা মুজিবের দাবীতে, তবুও মুজিবকে ধোঁকা দিয়ে হলেও প্রেসিডেন্ট আলোচনা চালিয়ে যাবার জন্য ২৫শে মার্চ ঘোষণা দিবেন আওয়ামীলীগের দাবী মেনে নেবার - এই অনুরোধ করা হচ্ছে। ১০) At Tactical Level (কৌশলগত পর্যায়ে) ক) যেহেতু গোপনীয়তা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, শহরে ইতিমধ্যে অবস্থানরত সৈন্যরা নিম্নবর্ণিত প্রাথমিক অপারেশন পরিচালনা করবে। (১) মুজিবের বাসায় জোর করে প্রবেশ করে উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করা। এই বাসা সুরক্ষিত এবং প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে। (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ হলগুলোকে ঘেড়াও করতে হবে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, লিয়াকত হল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি।

(৩) টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ করে দিতে হবে। (৪) যেসব পরিচিত বাসা-বাড়িতে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের আলাদা করে ঘেড়াও করে রাখতে হবে। খ) টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ করার আগে ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যদের কোন কার্যক্রম শুরু করা যাবেনা। গ) অপারেশনের রাতে রাত ১০টার পরে কাউকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে দেয়া হবেনা। ঘ) কোন না কোন ছুতায় শহরের এইসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে - প্রেসিডেন্টের বাসভবন, গভর্ণরের বাসভবন, সাংসদ হোস্টেল, রেডিও, টিভি, এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকাসমূহ।

Sequence of Action (কাজের ক্রম পরিকল্পনা) ১১)ক) সময় রাত ১ টা খ) বের হবার সময় (১) এক প্লাটুন কমান্ডো - মুজিবের বাসায় - রাত ১টা (২) টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ - রাত ১১ টা ৫৫ মিনিট (৩) বিশ্ববিদ্যালয় ঘেড়াও করে সৈন্যদের অবস্থান গ্রহণ - রাত ১টা ৫মিনিট (৪) শহর থেকে সৈন্যদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও অন্যান্য পুলিশ স্টেশনের নিকটস্থ হউয়া - রাত ১টা ৫মিনিট (৫) নিম্নবর্ণিত এলাকাসমূহ ঘেড়াও করা - রাত ১টা ৫মিনিট (ক) মিসেস আনোয়ারা বেগমের বাসা, রোড নং ২৯। (খ) বাসা নং ১৪৮, রোড নং ২৯। (৬) কারফিউ জারী - রাত ১টা ১০মিনিটে প্রাথমিক ভাবে আধঘন্টা লাউড স্পীকারে সাইরেন বাজানো। প্রথম অবস্থায় কাউকে কারফিউ পাস দেয়া হবে না। সন্তান প্রসব ও গুরুতর হৃদরোগ বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে সেনা বাহিনী সরিয়ে নেবে রোগীদের।

পরবর্তি আদেশ দেয়ার আগ পর্যন্ত কোন পত্রিকা বের হবেনা। (৭) সৈন্যরা তাদের নিজ নিজ সেক্টরে নিজ নিজ দায়িত্ব শেষ করার জন্য বের হবে রাত ১টা ১০মিনিটে। (সৈন্যদের সজাগ করার জন্য ড্রিল করাতে হবে)। হল দখল করে সার্চ করতে হবে। (৮) সৈন্যদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ ভোর - ৫টায় (৯) রোড ব্লক ও নদী অবরোধ স্থাপন - রাত ২টায়।

গ) দিনের বেলার অপারেশন (১) ধানমন্ডিতে সন্দেহভাজনদের বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি, এছাড়াও পুরান ঢাকার হিন্দু বাড়িগুলোতে তল্লাশি (তথ্য সংগ্রহ) (২) সকল প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ করে দেয়া। সকল সাইক্লোস্টাইল মেশিন (ইউনিভার্সিটি, টিএন্ডটি কলেজ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, ট্যাকনিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট) জব্দ করা। (৩) কড়া ভাবে কারফিউ জারি করা। (৪) অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতার করা। ১২) সৈন্যদের কাজ বরাদ্দ (Allotment of Troops to Tasks) - ব্রিগেড কমান্ডাররা বিস্তারিত ঠিক করবেন।

তবে নিম্নবর্ণিত কাজ অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবেঃ ক) ইস্ট পাকিস্তানি ইউনিটদের অস্ত্রাগার, সিগ্ন্যাল সরঞ্জাম ও এডমিনিস্ট্র্যাটিভ অবস্থান দখল করতে হবে। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে। ব্যাখ্যাঃ আমরা পূর্ব পাকিস্তানি সৈনিকদের বিব্রত করতে চাইনি। আর, তাদের এমন কাজও দিতে চাইনি যা তাদের ভাল লাগবেনা। খ) পুলিশ স্টেশন নিরস্ত্র করা গ) ডিরেক্টর জেনারেল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগারের নিরাপত্তা রক্ষা করা।

ঘ) সকল আনসার রাইফেলের দখল নেয়া। ১৩) তথ্য প্রয়োজন (Info Required) ক) নিম্নবর্ণিতদের খবর সংগ্রহ (১) মুজিব (২) নজরুল ইসলাম (৩) তাজউদ্দিন (৪) ওসমানী (৫) সিরাজুল আলম (৬) মান্নান (৭) আতাউর রহমান (৮) প্রফেসর মুজাফফর (৯) অলি আহাদ (১০) মিসেস মতিয়া চৌধুরী (১১) ব্যারিস্টার মউদুদ (১২) ফাইজুল হক (১৩) তোফায়েল (১৪) নূরে আলম সিদ্দিকী, (১৫) রউফ, (১৬) মাখন ও অন্যান্য ছাত্র নেতারা। খ) সকল পুলিশ স্টেশন ও সকল পিলখানা দপ্তর গ) শহরের শক্ত ঘাঁটি ও সশস্ত্র বাসভবন ঘ) ট্রেনিং ক্যাম্পের অবস্থান ও এলাকা ঙ) সামরিক অবস্থানের বিরোধিতাকারী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অবস্থান চ) প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের নাম-ঠিকানা যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকান্ডকে মদদ দিচ্ছে। ১৪) Command and Control দুটি কমান্ড স্থাপন করতে হবেঃ ক) ঢাকা এলাকা কমান্ডার- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী স্টাফ - ইস্টার্ন কমান্ড স্টাফ সৈন্য - ঢাকায় অবস্থিত সৈন্য খ) প্রদেশের বাকি অংশ কমান্ডার- মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা স্টাফ - হেড কোয়ার্টার ১৪ ডিভিশন সৈন্য - ঢাকার বাইরের সৈন্য মূল লেখাঃ "অপারেশন সার্চলাইট" এর বিস্তারিত কর্মপন্থা (খাদিম রাজার বই A stranger in my own country: East Pakistan হতে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।