আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপারেশন THE APPENDIX

সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন, তার মধ্যে আমি একাই ৫৪ কিলোগ্রাম ১৫ অক্টোবর ২০১২। সেদিন সকাল থেকেই আমার পেট ব্যাথা, দুইখানা “ফ্ল্যাটামিল ডিএস” আর দুই-চামুচ “অ্যান্টাসিড প্লাস” খাইবার পরও যখন সাতবার বমি ব্যাতিত আর কোনও কাজ হয়নাই তখনই নিরুপায় হইয়া দুপুর ২টার দিকে চরম ব্যাথা লইয়া, নাক মুখ কোঁচকাইয়া, কোঁকাইতে কোঁকাইতে আমি গিয়া ঢুকিলাম “ডাঃ আজমল হাসপাতাল”-এ। আমার চোখ ক্রমাগতই আন্ধার হইয়া আসিতেছিল, সেই প্রায় আন্ধার চোখ দিয়া আমি দেখিলাম একখানা দরজার উপরে লিখা “১০৫ ইমারজেন্সি। ল্যাংচাইতে ল্যাংচাইতে সেইখানে ঢুকিবার উপক্রম করিতেই সেই দরজার পার্শ্ববর্তী টেবিলে বসিয়া থাকা এক ব্রাদার হাত ধরিয়া আমাকে ভিতরে লইয়া একখানা ট্রে (সেটাকে হসপিটাল বেড বলা ঘোরতর অন্যায় হবে) এর উপরে শোয়াইয়া দিলেন। “যাক এইবার আমার একটা গতি হইবে” ভাবিয়া আর এসির বাতাসে কিছুটা শান্তি পাইয়া আমি আশেপাশে কী ঘটিতেছে দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, আবিস্কার করিলাম এই রুমে রোগী বলিতে আমি একাই, আর আমার মাথার কাছাকাছি একখানা বিরাট টেবিলে একখানা ডাক্তারনী (তাঁহার ভাব যদি আপনারা দেখিতেন!!! পুরা সেইরাম...)।

আর সেই ডাক্তারনীর টেবিলের চারিপাশের কেদারায় উপবিষ্ট ৪-৫জন সুন্দরী ইন্টারনীরত হবু ডাক্তারনী। তেনারা বসিয়া “আর বোলবেন না আপা!! সেদিন হয়েছে কী...!!!” টাইপ খোশগল্পে মশগুল। তেনাদের দেখিয়া আমার কিরুপ শীত শীত করিতে লাগিলো, আমি নিরুপায় হইয়া কাঁপিতেছি এমন সময় কেউ একজন বলিলেন “বলেন আপনার প্রবলেম কী?!!” এতক্ষন চোখ বন্ধ ছিল, এবার তাকাইলাম (একবার ভাবিলাম যে বলিব সমস্যা আমার নহে, গ্যাসের ওষুধের, তাহারা ঠিক মত কাজ করিতেছে না) পরে সিদ্ধান্ত বদলাইয়া চোখ কোঁচকাইয়া বলিলাম “পেটে ব্যাথাআআ...” “হুম্ম” বলিয়া তিনি আমার শার্ট উঁচাইয়া পেটে হাত দিলেন, কাতুকুতু লাগিবে ভাবিয়া আমি শক্ত হইয়া মুখ আঁটিয়া পড়িয়া আছি। কিছুক্ষন এখানে সেখানে টেপাটেপী করিয়া তিনি “আপা...” বলিয়া হুঙ্কার ছাড়িলেন। চমকাইয়া উঠিলাম।

এইবার সেই ভাবধৃত বড় ডাক্তারনী আসিলেন, (একা আসিলেও চলিত, কিন্তু তিনি সেই সুন্দরী সাঙ্গপাঙ্গ লইয়া আসিলেন) আসিয়াই গম্ভীর মুখে কহিলেন “উল্টাপাল্টা কিসু খাইসো?” (সোজাসাপ্টাই খাইনা, আবার নাকি উল্টাপাল্টা খাবো, হুহ্‌)। বলিলাম “নাহ্‌, সকাল থেকে এমন শুরু হয়েছে...” এইবার তিনি মহা উৎসাহের সহিত আমার পেট টিপিতে লাগিলেন, টিপিতে টিপিতে একজায়গায় আসিবার পর আমি “আঁআউ...” করিয়া নাক মুখ কোঁচকাইয়া লাফাইয়া উঠিলাম, আর তিনি তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকাইয়া ঘোষণা করিলেন “এখানে অ্যাপেন্ডিক্স থাকে” সাঙ্গপাঙ্গ মাথা দোলাইলো। (লক্ষ্য করিলাম তাঁহাদের কেউ কেউ আমার দিকে সমবেদনার দৃষ্টি লইয়া তাকাইতেসে... সুন্দরীদের চোখে সমবেদনা ব্যাপারখানা অপ্রত্যাশিত, তাই চোখ বুজিলাম)। বড় ডাক্তারনী আবার হুঙ্কার ছাড়িল “অরে একখান ‘কিজানিটিস* পুশ কইরা ঐ বেডে শুয়াইয়া দ্যাও। ব্লাড, ইউরিন নিয়া যাও, আর আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হোবে” এই ট্রে থেকে আমাকে অন্য কোথাও নেয়া হইবে এই ভাবিয়াই খুশি হইলাম।

অতঃপর ব্লাড নেওয়া হইলো, বহুত কষ্টে ইউরিনও ম্যানেজ করিয়া দিলাম, বাট আল্ট্রাসনোগ্রাম করিতে দেরি হইবে, আবার দুই ঘন্টা এমারজেন্সির স্পেশাল বেডে (বেডের মাঝখানে গর্ত) শুইয়া এসির ঠাণ্ডায় ঠক্‌ঠক্‌ করিয়া কাঁপিতে লাগিলাম। কে যেন বলিলো “ও খুব sick ওকে একটা কম্বল দিয়ো তো” (চোখ মেলিয়া আর সেই মায়াবতীকে খুঁজিয়া পাইলাম না)। ইতোমধ্যে ইনজেকশনের কারনে আমার ব্যাথা কিছুটা কমিয়াছে, ২-৪জন বন্ধুকে মেসেজে নিজের খবর জানাইলাম, কেয়া কল করিয়া আমার অবস্থার কথা সুনিয়া হাঃহাঃহাঃ করিয়া হাসিল কিছুক্ষণ, আসিফ কল করিয়া খোঁজ খবর নিলো, সাবধানে থাকতে বলিল। ইতোমধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রামের সময় হইয়াছে, বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিলাম যে “এই পরীক্ষার নাম “আল্ট্রাসনোগ্রাম” ক্যান হইলো!!! অইন্ন্য কিছু হইলেও তো তেমন ক্ষতি ছিলোনা”, অবশেষে গেলাম আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে, বেডে শোওাইয়া আমার প্যাটে “স্নো” মাখানো শুরু করতেই বুঝলাম আসলে “আলতা-স্নো” ব্যাবহার করিতে হয় বলিয়াই নামের এই হেতু। (আল্ট্রাসনোগ্রাম করার সময় আমার কিঞ্চিৎ কাতুকুতু লাগিয়াছিল অবশ্য, যাহা প্রকাশ করিনাই) আল্ট্রাসনোগ্রাম শেষে সেই “স্নো” মুছিবার জন্য শিরীষ কাগজের সমতুল্য একখানা টিস্যুপেপার দেওয়া হইয়াছিল।

৫মিনিটের ভিতরেই রিপোর্ট আসিলো। আজিকে রাত্তিরের মইদ্ধেই অপারেশান করিতে হইবে না হইলে “কাহিনী ঝিরঝির” খোঁজ পড়িল “ভালো সার্জন কই পাওয়া যাইবে?” ডাঃ মোঃ জহুরুল ইসলাম (পারিবারিক ডাক্তার) এর উপদেশে ডাঃ আকরাম হোসেন কে কল করা হইলো। ডাঃ আকরাম হোসেন মিরপুর-১৩নং “FAMMDAZ specialized Hospital” এ লইয়া যাইতে বলিলেন, তিনি রাত ৯টা৩০-এ সেখানে আমার অপারেশন করিতে আসিবেন। বিদায় লইলাম “ডাঃ আজমল হাসপাতাল” থেকে। (দুঃখের কথা এই যে, যেই মায়াবতী আমাকে কম্বল দিয়াছিলেন তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম না) আমি ৭টা৩০ থেকে FAMMDAZ Hospital এর নিচতলায় আরেকটা ট্রে টাইপ বেডে শুইয়া আছি, এই হাসপাতালটা একেবারেই নতুন, রোগীও বোধহয় খুব বেশী আসেনা, শুইয়া শুইয়াই আব্দুর রহমানকে কল করিলাম, “ঐ, আমি এই জায়গায় আছি, অপারেশন করতে হবে, টাকাপয়সা নাই, তুই হাজার দশেক টাকা নিয়া তাড়াআড়ি চলে আয়” সে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া চাকরির মন্ডু চটকাইয়া কিছুক্ষনের মদ্ধেই হাজির।

ইতোমধ্যেই ৪জন সিস্টারের মিলিত প্রচেষ্টায় ইয়া মোটা এক “ক্যানোলা” পড়ানো হইয়াছে আমার ডান হাতে... তেনারা নাকি রগ খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না। স্যালাইন লাগানো হইলো, সারাদিন না খাইবার দরুন কিঞ্চিৎ দুর্বল বোধ করিতেছিলাম এতক্ষনে। এইবার রিসাত রাজিন নিজের জ্বর সঙ্গে লইয়া টেনশিতো মুখে হাজির, তারেও বলিয়াছিলাম যে টাকাপয়সা লাগিতে পারে। রাজিন আসিয়াই পকেট চাপড়াইয়া বুঝাইয়া দিলো “দোস্তো নো টেনশন!!!” এই দুইটার কথাবার্তা কাজকর্ম দেখিয়া আমি হাসিতে হাসিতে অ্যাপেন্ডিক্স ব্যাথা মাথা পর্যন্ত উন্নীত করিলাম। যদিও অ্যাপেন্ডিক্স এর অপারেশন খুবই সিম্পল, তাহার পরেও আব্দুর রহমান মেহেদী ভাইকে কল করিয়া এ’পজেটিভ ব্লাড এর কথা বলিয়া রাখিলো, রাজিন বলিলো যে সে নাকি আরও দুই ব্যাগ ম্যানেজ করিতে পারিবে।

(তাঁহাদের আচরনে আমার সন্দেহ হইতেছিল যে আমার কী আসলেই অ্যাপেন্ডিক্স? নাকি ওপেন হার্ট সার্জারি) ৮টা৪৫এর দিকে আমাকে চারতলায় অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হইলো। পড়ানো হইলো সবুজ রঙের “মহিলাদের ম্যাক্সি” টাইপ কিছু একটা... (সেটার পিছনে আবার ভ্যাল্কো টেপ দেয়া)... আমি চ্যাঁচাইয়া উঠিলাম “আরে এইটা মহিলা রোগীর জন্যে তো!!” ও.টি. বয় ভাব নিয়া গম্ভীর মুখে বলিল “বলসে আপ্নেরে!! সব রোগীর কমন ড্রেস” আমি সুবোধ বালকের মত ঘাড় নাড়াইয়া ও.টি. বয়ের পিছন পিছন মেইন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম (এইটারে থিয়েটার বলার কোনও কারনই খুঁজিয়া পাইলাম না। কোনও বসার সুব্যাবস্থা নাই, বড় স্ক্রিন, সউন্ড সিস্টেম, কিছুই নাই)। নিজেকে ল্যাবরেটরির ভিতরে গিনিপিগ মনে হইতেছিল। অপারেশন বেডে শোয়াইয়া দুই হাতে নানান কারবারি জিনিসপত্র লাগাইতে শুরু করিলো।

আশেপাশে থেকে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাবধানে “টুঁট..টুঁট..বিপ..বিপ...” আওয়াজ একবার আমাকে গীটারের মেট্রোনামের কথা মনে করিয়া দিলো, পরোক্ষনেই সাইন্স ফিকশনের কথা মনে পড়িলো। আমি পাশের মনিটরে নিজের পালস্‌ দেখিতে থাকিলাম, ৯৪, ৯২, ৯৬, ৯৪.... হাসিখুশি ডাঃ আকরাম সময় হইবার আগেই পৌঁছাইয়া গ্যালেন, ও.টি. বয় তাহাকেও আমার মতই সবুজ ম্যাক্সি পড়াইয়া দিলো। তিনি নিজে আমাকে উঠাইয়া বসাইলেন, ভাবিলাম “আহা!!! কি আন্তরিক ডাক্তার!!!” তারপর তিনি যাহা করিলেন তাহার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না... পরপরপর করিয়া পিঠের ভ্যাল্কো টেপ খুলিয়া “টিস” করে মেরুদণ্ডে অ্যানেস্থেশিয়া পুশ করিলেন, বলিলেন “তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়” শুইলাম, নিয়মিত ভাবে দুই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়াচাড়া করিয়া দেখিতেছি যে অবশ হইয়াছে কী না... রুমে আরো দুইজন ডাক্তার ছিলেন, ছোট ডাক্তার ঝাড়ি মারিলেন “এতো নরেন ক্যান!! চুপ কইরা থাকেন” আমি তো “গুডবয়” তাই চুপ করিয়াই থাকিলাম। কিন্তু আর কতক্ষন?!! মিনিট তিনেক পরে অনুভব করিলাম আমার পেটে কিছু একটা করার অপচেষ্টা চলিতেছে, বলিয়া উঠিলাম “এখনো অবশ হয়নাই তো!! আরেকটু পরে কাটেন। ” ডাঃ আকরাম তাঁর পাশের ডাক্তারকে (মাঝারি ডাক্তারকে) বলিলেন “এতক্ষনেও কাজ হয়নাই!!! ভুল করসো, এরে তোমার ফুল এনেস্থেসিয়া দেওয়া দরকার ছিল”, মাঝারি ডাক্তার আমার মাথার কাছে এসে বলিল “জোরে জোরে নিঃশ্বাস ন্যাও বাবা, জোরে জোরে...” আমি জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পাশের মনিটরে দেখিলাম আমার পালস ৯৬, ৯৮, ১০০, ৯৮... করিতেছে... চেষ্টা করিয়াও পা নাড়াইতে না পারিয়া বুঝিলাম “এতক্ষনে সিস্টেম হ্যাঙ করিয়াছে”, ঘাড় উঁচাইয়া দেখিলাম আমার একমাত্র পেটখানা কাটাকুটি শেষ, একজন রক্ত মুছিতেছেন, আরেকজন চিমটা টাইপ কিছু একটা লইয়া বড় ডাক্তারকে দিতেছেন...।

এইসময় ছোট ডাক্তার আসিয়া আমার কপাল ধরিয়া বেডে শোওাইয়া দিয়া গ্যালেন। বুঝিলাম যে নড়াচড়া করা ঠিক না। একটু পরে আবার মাথা উচাইয়া দেখিলাম চিমটা টাইপ জিনিষটা আমার পেটের ভিতরে ঢুকাইয়া ডাঃ আকরাম একটা বিশেষ কিছু করিতেছেন, এইবার ছোট ডাক্তার রীতিমতো খেপিয়া আসিয়া আমার চোখের সামনে একখানা সবুজ পর্দা টানইয়া দিলেন, আমার আর নিজের অপারেশন দেখার সৌভাগ্য হইলো না। বড় ডাক্তার মাঝারী ডাক্তারকে বলিলেন “ফুল অ্যানেস্থেশিয়া দ্যান নাই ক্যান!!” (কণ্ঠে বিরক্তি)। মাঝারী ডাক্তার ছোট ডাক্তারকে বলিলেন “ওকে ২৫ মিলিগ্রাম ঘুমাইটিসিন** দ্যাও”| ছোট ডাক্তারের মুখোশ ঢাকা মুখে হাসির আভাস দেখিলাম, তিনি মনেহয় আমার উপরে কিঞ্চিৎ বিরক্তও ছিলেন।

ক্যানোলা দিয়া যখন সেই “২৫ মিলিগ্রাম ঘুম” আমাকে দেওয়া হইতেছে আমি তখন আমার পালস্‌ দেখিতে ব্যাস্ত... ৯৬, ৯৮, ৯৬, ৯৮, ১০০, ৯৮, ১০০, ১০২, ১০০.... তারপর আমার ঘুম ভাঙ্গে দুলুনিতে, দুলুনি বুঝিলেন না?!! যেই বেডে আমার অপারেশন হইয়াছিল সেই বেডসিট এর চারপাশে ৫-৬জন ধরিয়া দোলাইয়া দোলাইয়া আমাকে স্থায়ী বেডে স্থানান্তরিত করেন, সেখানে চোখ মেলিয়াই দেখি দাদা দাঁড়াইয়া আছে, তারপর দেখা করিতে আসিয়াছেন মেহেদী ভাই, রাফি ভাই, সহ আরও অনেকে... সেইদিনের কথা আপাতত এতোটুকুই মনে পড়িতেছে... তারপর? তারপর সুগভীর ঘুম ঘুম ঘুউম........... * ওষুধের আসল নাম মনে নাই ** ওষুধের আসল নাম মনে নাই ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।