আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপারেশন হ্যান্ড-টাচ

১. সরকারী ছাত্রাবাসের চতুর্থ তলার এক ঘুপচিতে আমার বসবাস । রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে আমি যুক্ত নই, তাই হাতে রয়েছে অখণ্ড অবসর । সেই অবসর কাটে জানালা দিয়ে মানুষ দেখে । নানা সময়ে নানা দৃশ্য দেখি । Observer হওয়ার ব্যাপারটা Physics যথেষ্টই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে, পেটেন্ট অফিসের জনৈক কেরানী Conventional Physicsকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলেছিলেন, 'আর হিসাব কইরা লাভ নাই, চুপচাপ দেখেন, যেদিক থিকা দেখবেন, সেদিক থিকা ঘটনা একেক রকম মনে হইব'।

দৃষ্টিভঙ্গির সেই গাণিতিক হিসাবের নাম Theory of Relativity, আর সেই কেরানির নাম আলবার্ট আইনস্টাইন । আমি আইনস্টাইন না । তবে আইনস্টাইন আর আমার মধ্যে একটা মিল আছে, সেটা হচ্ছে শৈশবে আমরা দুইজনই চূড়ান্ত নির্বোধ ছিলাম । বয়স বাড়ার সাথে সাথে আইনস্টাইন সাহেবের বুদ্ধিমত্তা বেড়েছে, আমারটা তেমন একটা বাড়েনি । গরীব দেশের মানুষ বলে স্রষ্টা হয়তো আমার ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্বের সাথে নেন নি ।

জানালা দিয়ে দুনিয়া দেখার সময় এই বিষয়েও ভাবি । অত্যন্ত গভীরভাবেই ভাবি । আজও নানা হাবিজাবি চিন্তায় আমি ব্যস্ত, এমন সময়ে খোরশেদের ফোন এলো । -হ্যালো দুস্থ (খোরশেদকে আমি 'দোস্ত' না বলে 'দুস্থ' বলি, প্রবল আর্থিক সংকটে পড়লে আমরা পরস্পরকে স্মরণ করি। দুজনের অবস্থা কাছাকাছি হওয়ায় সাধারনত কেউই কাউকে তেমন একটা সাহায্য করতে পারি না, তখন রাস্তার পাশে ব'সে ঝালমুড়ি খাই।

হতদরিদ্র এইদেশে এই একটা খাবার ৫টাকায় কেনা যায় এবং অনেকের সাথে শেয়ার করে খাওয়া যায়) -হ্যাঁ দুস্থ । কি করিস? -জানালা দিয়ে বাইরের দুনিয়া দেখি। -কোন রূপবতী দেখা যাচ্ছে নাকি?(খোরশেদের মাথায় অবশ্য এর ব্যতিক্রম কিছু কখনোই আসে না। টিভিতে আমরা যখন ক্রিকেট খেলা দেখায় মগ্ন থাকি, খোরশেদ তখন অধীর আগ্রহে মেয়ে দেখে। ) - নাহ, তেমন কোন রূপবতী তো দেখছি না।

-তাহলে রুমে বসে না থেকে করিম ভাইয়ের দোকানে আয়, গল্প-গুজব করি। ২. করিম ভাইয়ের চায়ের দোকান হচ্ছে আমাদের ওয়েটিং রুম। রেলষ্টেশনে মানুষ ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করে, আর করিম ভাইয়ের দোকানে মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রেমিক প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করে, জুনিয়র সিনিয়রের জন্য অপেক্ষা করে, এক কোণে ক্যাম্পাসের প্রাগৈতিহাসিক ভিক্ষুক থালা হাতে দানশীলের জন্য অপেক্ষা করে । আমিও অপেক্ষা করছি ।

গুরুত্বহীন মানুষদেরই অপেক্ষা করতে হয়, আবার অনেক সময় গুরুত্বহীনেরা অন্যদের অপেক্ষা করিয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে । আমাকে দীর্ঘ ২ লাখ ৮ হাজার ৮০০ সেকেন্ড(প্রায় ৫৮মিনিট) অপেক্ষা করিয়ে খোরশেদের আগমন ঘটল। তার ব্যতিব্যস্ত চেহারা দেখে বিলম্বের কারন জিজ্ঞেস করলাম না। সে নিজে থেকেই শুরু করল । পরবর্তী ২০-২২ মিনিটে সে যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে- খোরশেদ পঞ্চম বারের মত প্রেমে পড়েছে।

আগের গুলোতে সে তেমন একটা সিরিয়াস ছিল না, কিন্তু এইবারেরটা শুধু সিরিয়াস না, অতি অতি সিরিয়াস । ফেসবুককে কন্যার সাথে তার পরিচয়, ম্যাসেজ আদান প্রদান ইত্যাদি ইত্যাদি। খোরশেদের দাবী, তার দীর্ঘদিনের ক্যাম্পাস জীবনের অন্যতম বন্ধু হিসেবে আমার উচিৎ এই ব্যাপারটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহন করা । আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'অবশ্যই, অবশ্যই'। খোরশেদ সন্ধিগ্ধ গলায় বলল, 'তুই পুরো ব্যাপারটিকে ফাজলামি হিসেবে নিচ্ছিস, একটু সিরিয়াসলি নে।

' আমি আকাশ থেকে দৃষ্টি খোরশেদের উপর নিবদ্ধ করলাম,'তোর যাবতীয় অপকর্ম আমি সমর্থন করি । অতীতেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব। ' খোরশেদ ব্যথিত গলায় বলল,'আমি আবার কি অপকর্ম করলাম!?' আমি সান্ত্বনার সুরে বললাম,'এইটা যেহেতু তোর আসল প্রেম, সেই সাপেক্ষে আগের গুলোকে অপকর্ম বলা যেতেই পারে। 'অতীত হোক অপ তোমার, আগামী হোক ভালো'- এই হোক তোর মন্ত্র' খোরশেদ লাজুক গলায় বলল,'জানতাম, তুই আমাকে সাপোর্ট দিবি। ' অবশ্য কথা সত্য, বন্ধুবান্ধবদের যেকোনো কথাতেই আমি সমর্থন দেই ।

কিন্তু আমার সমর্থনের প্রত্যাশায় খোরশেদ এর পর যা বলল, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না । মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শেষ বর্ষের একজন ছাত্র যখন আবেগ জর্জরিত গলায় অদেখা (পরিচয় শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ) কাউকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ঢাকার কোন এলাকায় বাসাভাড়া কম, তখন অপ্রস্তুত হওয়াই স্বাভাবিক । আমি ক্ষীণ স্বরে আপত্তি জানালাম,'তুই তো এখনো মেয়েকে দেখিস নাই' । খোরশেদ হুঙ্কার ছেড়ে বলল,'তাতে কি ? আমি নিশ্চিত, এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব। এর সাথেই উৎপন্ন হবে তোর ভাতিজা-ভাতিজি।

' খোরশেদের আবেগ-জর্জরিত ভাষণ দেখে আমি 'উৎপন্ন' শব্দের ভাষাগত ত্রুটি নিয়ে কোন প্রশ্ন তুললাম না । শান্তস্বরে বললাম,'তুই কি বস্তু, এইটা আমার চেয়ে বেশি ক্যাম্পাসের কেউ জানে বলে মনে হয় না। আমার ধারনা, তুই মেয়ের হাত পর্যন্ত ধরতে পারবি না, ভাতিজা-ভাতিজির কথা তো 'দিল্লী বহত দূর কি বাত' আবেগপ্রবন দশায় মানবসন্তান নানা ভুল করে । খোরশেদ যা করল, তা 'ভুল' বললে ভুল হবে। ইতিহাসই বলে দেবে, এটা কতখানি ঠিক বা ভুল।

রাজধানীর এক রাজপথের পাশে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে খোরশেদ ঘোষণা দিল, মেয়ের হাত সে আজকেই ধরবে এবং আমাকে ভুল প্রমান করবে । আমি প্রমাদ গুনলাম । প্রেমিক, পাগল এবং ছোট সাইজের বানরকে কোন চ্যালেঞ্জ দেয়াটা বোকামি। তারা সেই চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে গিয়ে নানা কাণ্ড করে । খোরশেদ সেইসব কাণ্ড শুরু করল ।

সে ফেসবুকে ম্যাসেজ পাঠাল, কন্যার সাথে সে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করবে । ৩. বেলা দ্বিপ্রহর । আমরা দাঁড়িয়ে আছি বলধা গার্ডেনের সামনে । আমার দীর্ঘদিনের ধারনা ছিল, এই গার্ডেনের নাম 'বলদা গার্ডেন' (অবশ্য যে 'বলদা' এইসব জায়গায় আসে না, তার বুদ্ধিশুদ্ধি এর'চে বেশি থাকার কথা না) । আমরা অপেক্ষায় আছি 'সুবর্ণা' নামক কন্যার জন্য।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলার এক পরাধীন নবাব(পিতার উপর নির্ভরশীল বলেই পরাধীন নামকরণ)। নবাবের গায়ে আমার ক্যাটস আইয়ের শার্ট । আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। শার্টটা এতো সুন্দর আগে খেয়াল করিনি, নাকি রমণীয় ভালবাসায় আপ্লুত তরুনের দেহে শার্টটির জৌলুশ বেড়ে গিয়েছে? বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হল না, 'সুবর্ণা' এসে পড়ল। নামের সাথে গাত্রবর্ণের অবশ্য তেমন মিল নেই ।

তবে মেয়েকে দেখে আমি আনন্দিত, আমার কৃষ্ণবর্ণের চেয়ে তার অবস্থা তুলনামুলকভাবে ভালো। মেয়ে এসেই খোরশেদকে জিজ্ঞেস করল,'ইনি কে?' খোরশেদ বলল,'আমার বন্ধু। ' মেয়ের তাৎক্ষনিক প্রশ্ন,'আপনি আমার সাথে দেখা করতে ইনাকে নিয়ে এসেছেন?' খোরশেদ ইতস্তত করে উত্তর দিল,'না মানে এখানে এসে দেখা । ও মনে হয় কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। ' বলেই ও আমাকে চোখে ইশারা করল।

নীরব সে ইশারায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, 'দূর হ হারামজাদা' আমি দূরে এসে বসলাম। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ খোর-বর্ণা জুটির উপর । সুবর্ণার দৃষ্টি এড়িয়েই আমি অপেক্ষায় আছি, কখন বন্ধুবর হাত ধরবে। দূর থেকেই আমি দেখতে পাচ্ছি, বন্ধু খোরশেদ একটু পর পর কেঁপে উঠছে। অবাক(এবং কিছুটা বিরক্ত) সুবর্ণার সামনে খোরশেদ অপ্রকৃতস্থের মত বসে আছে, ওর গায়ে আমার ক্যাটস আইয়ের শার্ট জানুয়ারি মাসের শীতের মধ্যেও ঘামে ভিজে যাচ্ছে ।

প্রায় আধঘণ্টা পর আলোচকরা আলোচনা অনুষ্ঠান শেষ করলেন এবং নিরাপদ দূরত্ব রেখে বিদায় নিলেন। 'অপারশেন হ্যান্ড-টাচ' ব্যর্থ হওয়ার পর ঘামে সিক্ত যোদ্ধা ও বিশিষ্ট আলোচক খোরশেদ ফ্যাকাসে মুখে আমার কাছে এসে ধপাস করে বসে পড়ল । সফল হোক বা ব্যর্থ হোক, আজকের মিশন শেষ হয়েছে । আমি বলধা গার্ডেনের ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম । ভাঙ্গা গলায় খোরশেদ জিজ্ঞেস করল,'দোস্ত, তোর শার্টটা মনে হয় সুতি না।

নাইলন বা টেট্রনের । কেমন যেন গরম গরম লাগছে। ' আমি উত্তর দিলাম না । নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, পৃথিবীতে আবেগ এখনো বেঁচে আছে । আবেগে মানুষ হাত ধরতে যায়, আবার আবেগের জন্য হাত ধরতে পারে না, এই আবেগ থেকেই জন্মায় জীবনের বেগ ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।