আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি ছিলাম আওয়ামীলীগের সমর্থক

মাঝে মাঝে অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। যেমন আজকে বন্ধুদের সাথে আড্ডার একপর্যায়ে যখন একজন বলল, তুইকি বিএনপির নমিনেশনে ইলেকশনে দাঁড়াবি নাকি? আমার মনে পড়ে গেল আনুমানিক ২১/২২ বছর আগের কথা, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশ্বকাপ ফুটবলে একটা দল সাপোর্ট করি। আবাহনী-মোহামেডানেও দল সাপোর্ট আছে। তাহলে এখানে নয় কেন? অতশত না বুঝে, চিন্তা করে দেখলাম, দেশটাতো স্বাধীন করেছে আওয়ামীলীগ।

বিএনপি আবার এল কবে থেকে। আওয়ামীলীগই জিতুক। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাও রানার আপ হয়, আওয়ামীলীগও রানার আপ। ৯৬ সালে হরতাল অবরোধে স্কুল লাইফ মন্দ কাটেনি। তবে, কষ্ট করে মাঝে মাঝে এক স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে যেতাম।

যাই হোক, ৯৬ সালের ১২ই জুন, আমার দল আওয়ামীলীগ ঠিকই নির্বাচনে জিতে গেল। সাপোর্টের দল জেতাতে আমি বেশ ভাল খুশিই হলাম, এর সাথে দেশের উন্নয়ন যদি বোনাস হিসেবে পাওয়া যায়, ক্ষতি কি (ততদিনে নির্বাচন-রাজনীতি নিয়ে আরো বিস্তারিত জ্ঞান হয়েছে)। সেবার ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থিদের জন্য প্রশ্নোত্তর বা কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। অংশ নিলাম প্রতিযোগিতায়।

সম্ভবত এটা ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটে হয়। অনেক স্কুলের ছেলে-মেয়েরা এসেছিল। এত ছেলে-মেয়ে এসেছিল যে অডিটোরিয়ামে জায়গাই হচ্ছিল না। একবার অডিটোরিয়ামের গেটে ভীড়ে ঠেলা-ঠেলিতে ধাক্কা খেতে খেতে চিড়ে-চ্যাপ্টা হতে হতে আবিস্কার করলাম, আমার চারদিকে শুধু মেয়ে। ওরা হলিক্রস না ভিকারুননেসার মেয়ে ছিল, তা আজ এতদিন পরে আর মনে নেই।

তবে, এত ধাক্কাধাক্কির ভীরে চ্যাপ্টা হতে হতে আমি কোনরকমে সেই ভীড় থেকে বের হয়ে এসেছিলাম, মেয়েরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে একজন সম্ভবত আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়েছিল। যাই হোক, আমরা সেই অডিটোরিয়ামে বসে অনেকের বক্তৃতা শুনলাম। আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সাজেদা চৌধুরী - আরো অনেকেই এসেছিলেন। সবচেয়ে অবাক করা কান্ড ঘটেছিল, আমি যে কিনা কোন কাজের দক্ষতার প্রমাণ ততদিন পর্যন্ত রাখতে পারিনি, সেই আমি কিনা যুগ্ম ভাবে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ফেললাম।

প্রথম স্থানে ২ জন থাকায় আর আমার আগে আরেক তৃতীয় স্থানেরজন পুরস্কার নেওয়ায় আমার ভাগ্যে জুটল পঞ্চম পুরস্কারের ক্রেস্ট। এত বড় ক্রেস্ট আমি জীবনে আগে পাইনি আর ভবিষ্যতেও কখনো পাইনি। আনন্দের আতিশয্য আমি পুরস্কার একজনের কাছ থেকে নিলেও মঞ্চে বসা সকলের সাথে হ্যান্ডশেক করে আসলাম। তারপর সীটে ফেরত এসে স্কুলের ছেলেদের ক্রেস্ট দেখতে দিলাম। তারা মন খারাপ করে আমার ক্রেস্ট নেড়ে-চেড়ে দেখল আর আমি আমার দাঁতের পাটি যতক্ষণ সম্ভব বের করে রাখলাম।

আসলে আমার জীবনের এই সময়গুলো ছিল আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি ভাল ছাত্র হিসেবে স্কুলে পরিচিত ছিলাম না। তবে, স্যারেরা ভাল ছেলে হিসেবে আমাকে আলাদা করতে পারতেন। এই প্রতিযোগিতার জন্য বাসার মুক্তিযুদ্ধের উপর থাকা প্রায় সব বই আর সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো পড়ে ফেলেছিলাম। প্রথম বারের মত জীবনে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করেছিলাম।

পুরস্কার পাবার পর অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, তাহলে পরিশ্রম করলে সাফল্য সত্যিই আসে। এরপর থেকে আমি আসলেই পরিশ্রম করে খারাপ ছাত্র থেকে ভাল ছাত্রতে পরিণত হয়েছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ। তাই, এই দিন আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ১৯৯৬ সালের ১৫ই আগস্ট। সেদিনের বক্তৃতাতে সাজেদার চৌধুরীর একটি কথায় অবাক হয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আসলে সত্যি অভিযোগ ছিল।

কৌশলগত কারণে তখন তা অস্বীকার করা হয়েছিল। আমি ভাবছিলাম, কেন পাকিস্তানের নাগরিক হয় বংগবন্ধু ভারতের সাথে মিলে এই কাজ করবেন যেখানে ভারত পাকিস্তানের শত্রু। কিন্তু, এটাও পরে বুঝেছিলাম, Desperate time needs desperate measures. আমার চাওয়া মত সবকিছু হয়তবা হবেনা। ব্রিটিশরা ঠিকই ভারত ভাগ করে চলে গেছে যার ফলে শক্তিশালী ভারতের বদলে একে অন্যের সাথে হানাহানি করা কয়েকটা দেশের উদ্ভব হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করে গেছে, যার ফলে এখনো এই কিছুদিন আগেও ভারতের আসামে বাংলাদেশি অভিযোগে বাঙালি মুসলমানদের উপর হামলা করা হয়।

"ট্রেন টু পাকিস্তান" এ খুশবন্ত সিংয়ের বর্ণনায় দাঙ্গার কিছু চিত্র পেয়েছি। এখন আর সেই অখন্ড ভারত সম্ভব নয় যেখানে সবাই শান্তিতে মিলে মিশে থাকবে। তেমনি সম্ভব ছিলনা পাকিস্তানের সাথেও একসাথে থাকা। আওয়ামীলীগের শাসনামলে প্রথম প্রথম কিছু দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হই। যেমন, সংসদ টিভিতে সম্প্রচার শুরু হয়।

পড়ালেখা ফেলে এটা দেখায় আমার কোন আগ্রহের কমতি ছিলনা। শেখ হাসিনা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। সেখানে প্রথম প্রশ্ন মাহফুজ আনাম করেন, "আপনি কোন অধিকারে আজ জনগণের রাস্তা বন্ধ করে নিজে চলাচল করে জনগণকে ট্রাফিক জ্যামের ভোগান্তিতে ফেললেন?" শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এমনটি আর হবেনা এবং এটি বন্ধ হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। তারপর আবার কিছুদিন পর চালু হলেও আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমাদের দেশের জন্য এ এক সুন্দর সময় এগিয়ে যাবার জন্য।

কিন্তু আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন পরে। ঠিক কবে থেকে আমি আর আওয়ামীলীগের সমর্থক ছিলামনা, তা আর আমার মনে নেই। তবে, সন্ত্রাস-দুর্নীতি আর গডফাদার সৃষ্টিতে আমার মনটা যে বিষিয়ে গিয়েছিল, মেজর রফিক, সাবের হোসেন আর মতিয়া চৌধুরীর মত মানুষেরাও আমার সেই ভাঙ্গা স্বপ্নকে আর জোড়া লাগাতে পারেননি। আমি দেখেছিলাম, একটা চিহ্নিত সন্ত্রাসীর পক্ষে দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো কিভাবে কথা বলে যেখানে তাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। পরবর্তি নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন করলাম যদিও ভোটাধিকার তখনো হয়নি।

স্বাধীনতার ইতিহাস আমার ভাল করে জানা থাকার পরেও জামায়েত ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট আমাকে নাড়া দিতে পারেনি, আমি এতটাই পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব ছিলাম। অবশ্য নির্বাচনের পরে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছিল। অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় এলাকার সব টাউট আর রাস্তার মোড়ের মাস্তান গুলো কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেনা হেফাজতে কিছু হার্ট এটাকের ঘটনা ঘটলেও আমি অবস্থার সার্বিক উন্নতিতে খুশি হয়েছিলাম। এটাও বুঝেছিলাম, আমি আর কোনদিন আওয়ামীলীগকে পূর্ণভাবে মন থেকে সমর্থন করতে পারব না। (বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমি কখনো কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলাম না।

তবে, আমার ভোটাধিকার প্রয়োগ করি শেষবারের বুয়েট ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.