আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোকাবহ আগস্ট, ৭৫ থেকে ২০০৪; ইতিহাসের কলংকিত অধ্যায়ের ধারাবাহিক উপাখ্যান ও একটি নক্ষত্রের পতন

আমি সত্য জানতে চাই বছর পরিক্রমায় বাঙালিকে কাঁদাতে আবারো এসেছে আগস্ট, শোকাবহ আগষ্ট। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে রক্তের আখরে লেখা একটি মাস। বীর বাঙালির ইতিহাসে কলংকিত অধ্যায়ের ধারাবাহিক উপাখ্যান রচিত হয়েছে এ মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি কলংকমুক্ত হলেও আমাদের প্রতিটি শিরা উপশিরা ও ধমনিতে তীব্র ঘৃনার উদ্রেক করে এ মাস। এই মাসের মধ্য রজনীতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে, সপরিজনে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক সহকর্মীর চক্রান্ত ও প্ররোচনায় সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ১৫ সদস্য। এঁরা হলেন বঙ্গ মাতা, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁদের তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, নবীন সেনা অফিসার শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশু পৌত্র সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, রিন্টু, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিল। এ ছাড়া নিহত হয়েছিলেন কর্তব্যরত কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী। শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার জন্য প্রাণে রক্ষা পান। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেই কুমিল্লা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দেশীয় চক্রান্তের সঙ্গে যোগসূত্র বেধে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন বিক্ষুব্ধ কিছু আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সামরিক কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ষড়যন্ত্রের হোতাদের সাথে খন্দকার মোশতাকের একাধিক বৈঠক হয় কুমিল্লার বার্ডে। আর ওই বছরের আগস্টে সেনানিবাসের বালুমাঠে ষড়যন্ত্র চুড়ান্ত রূপ পায়। আর ওই ষড়যন্ত্র পূর্ণতা পায় খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

সংবাদ মাধ্যমে এ ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেণ্ট্রাল ইণ্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-কে দাযী করা হয। বাংলাদেশে অবস্থিত তৎকালীন রাষ্ট্রদুত ইউজিন বুস্টারের বরাত দিয়ে লরেন্স লিফসুল্জ সিআইএ-কে অভ্যুত্থান ও গণহত্যার জন্য দোষারোপ করেন। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদের বই ‘বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ক্ষমতার লোভের বশবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো, খোন্দকার মোস্তাক এক হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল নক্সা প্রণয়ন করেছেন। অন্যেরা কুশিলব মাত্র। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে নৃসংসভাবে জাতির জনককে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি খুনীরা।

ইতিহাসের এই নির্মম হত্যা কাণ্ড কুৎসিত প্রতিহিংসা প্রকাশ পেয়েছে শিশু হত্যা, নারী হত্যা, অন্তঃসত্ত্বা রমণী হত্যার পৈশাচিক উল্লাসের ভেতর দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহকে অসম্মান করা হয়েছে যেভাবে তার ভয়াবহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন গবেষণামূলক বইতে। চরম অমানবিক, আশুরিক আচরণ করা হয়েছে জাতির পিতার মরদেহের সঙ্গে। হত্যার পর জাতির জনকের মরদেহ তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাডায় নিয়ে যাওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ নেয়ার সময় যাচ্ছেতাই ভাবে তাঁকে অসম্মান করেছে।

নিজ জন্মভূমি গোপালগঞ্জে তার লাশ মাটিতে ফেলে অকথ্য অপমান করেছে। জানা যায় তাঁর ডান হাতের তর্জনী বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রিসালদার মোসলেহ উদ্দীন বঙ্গবন্ধুর দেহে লাথি মেরেছে। এক পর্যায়ে তাকে চাপামাটি দিতে চেয়েছিলো সৈনিকরা। পরে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তাড়াহুড়ো কওে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পারিবারিক গোরস্তানে সামরিক তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয। অন্যান্যদের দাফন করা হয ঢাকার বনানী কবরস্থানে।

এ ভাবেই বাংলার আকাশের উজ্জল নক্ষত্রটির পতন হলো অভিশপ্ত আগস্টে। সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পরিবর্তে তাঁকে হত্যা করে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনা জাতি মেনে নেয়নি। উপর্যপরি জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে জারি করা হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। যার কারণে একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে বছরের পর বছর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয় যা ছিলো আইনের শাসনের পরিপন্থী।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর অবদান মুছে ফেলার প্রক্রিয়াও সমানভাবে চালানো হয়েছে। তাঁকে খাটো করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে কিন্তু তারা সফল হয়নি। বরং মৃত বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন হয়ে উঠেছেন আরও শক্তিশালী। জাতীয় ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অবদানই তাকে অজেয় করে রেখেছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই কেবল বিচারের সম্মুখীন হয়ে সাজা ভোগ করছে না; তার অবমূল্যায়নকারীরাও আজ পরাজিত।

দেরীতে হলেও বঙ্গবন্ধু তনায়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কুখ্যাত সেই অধ্যাদেশ বাতিলের পর দেরিতে হলেও বিচার কাজ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পলাতক খুনিদের দেশে এনে তাদের শাস্তি কার্যকর করা সরকারের দায়িত্ব। আগস্ট দেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় এবং শোকাবহ মাসের নাম।

এ মাসে সপরিবার জাতির পিতার অপমৃত্যু জাতির জন্য এক করুণ ট্র্যাজেডি । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ দিন। আর দূর্ভাগ্য ক্রমে বাঙালির ইতিহাসে এ মাসে যুক্ত হয় আরও একটি শোকের দিন। ঘাতকচক্র ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় ইতিহাসে যে কালিমা লেপন করেছিল তার পথ ধরে জাতির জনকের দুরপনেয় নামটি মোছার অনেক অপচেষ্টা হয়। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে যে হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে তার পিছনে কাজ করেছে ক্ষমতার লোভ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।

পরবর্তীকালে এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাস বিরোধী সামাবেশে ঘাতকরা সুপরিকল্পিত ও ঘৃন্য গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বীভৎসময় মৃত্যুপুরীতে পরিনত করেছিল। এই পৈশাচিক হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী আইভী রহমান সহ চব্বিশ জন। আর আহত হয়েছিলেন প্রায় ৪০০ নেতা কর্মী । এদের অনেকেই এখনও শরীরে গ্রেনেডের বিষাক্ত স্পি¬ন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই বিভীষিকাময় ঘটনায় আহতদের বিড়ম্বনার শেষ হয়নি আজও।

বিগত ৮ বছর যাবৎ স্বজন হারানোর বেদনাকে ধারণ করে সেই নারকীয় হামলার বিচার দেখবার জন্য প্রত্যাশার দীর্ঘ প্রহর গুনছে বাঙ্গালী জাতি। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিসহ ২১ আগষ্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী এবং হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এটা দেশবাসীর সময়ের দাবী। তা না হলে আবারও দেশে নাশকতা কাজে জড়িয়ে পড়বে এসব নষ্ট মানুষরূপী হায়েনাদের দল। আমরা প্রত্যাশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই পৈশাচিক হত্যার বিচার করে জাতি কলংকিত মুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ ও জাতির সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তার আপন মহিমায় প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরাও গৌরবান্বিত হব।

বাংলাদেশ ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে গোড়াপত্তন হয়; বঙ্গবন্ধু আজীবন আমৃত্যু একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের যেস্বপ্ন দেখেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের যথাযথ রূপায়ণ সম্ভব হবে বলেই আমাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস।  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.