আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোকাবহ

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে। ব্রেইন স্ট্রোক করার পর ছোটোবোনের জামাইকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে। আমি খবর পেলাম শনিবার দুপুর ১২টার দিকে।

৪ দিনের ছুটিতে কুমিল্লায় ছিলাম আমার বাসায়। কী কী করতে হবে সমস্ত যোগাযোগ করছিলাম বাসায় বসে। রোগীর অবস্থা ভালো না; ডান হাত ও ডান পা পুরোপুরি অবশ; প্রচণ্ড খিঁচুনি; সেন্সলেস প্রথম দিন থেকেই। রোগীর শুশ্রূষা করার জন্য প্রয়োজনীয় আপন লোক নেই। চিকিৎসাও খুব ভালো হচ্ছে না।

রবিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিই। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় মেডিকেলে গিয়ে পৌঁছি। রোগীর নাম হায়াৎ আলী। প্রচণ্ড আকারে বুক খিঁচুনি ছাড়া হায়াৎ আলীর সমস্ত দেহ নিথর। চোখ জোড়া সামান্য খোলা।

প্রথমে মনে হলো ভিতরে কালো মণিটা সামান্য নাড়িয়ে হায়াৎ আলী আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো। আমি ওকে নাম ধরে ডাকলাম। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ওর কানের কাছে গিয়ে আবারো বেশ কয়েকবার ডাকলাম। হায়াৎ আলী প্রতিক্রিয়াহীন।

ডাক্তরাদের সাথে কথাবার্তা বলে জানা গেলো হায়াৎ আলীর বাঁচবার আশা ক্ষীণ। আমি ঢাকা নিয়ে যেতে চাইলাম। ডাক্তরাগণ বললেন, আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসাই দিচ্ছি এখানে। ঢাকা রেফার করে রিলিজ করা যাবে না। রিলিজ নিতে চাইলে রেফারবিহীন অবস্থায় সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে নিয়ে যেতে হবে।

আমার পরিচিত এক ঘনিষ্ঠ ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। সে এমন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রোগীকে কোনোরুপ মুভ করাতে নিষেধ করলো। স্থির হলো, হায়াৎ আলী আপাতত এ অবস্থায় এখানেই থাকবে। একটু সুস্থ হলে হায়াৎ আলীকে ঢাকা শিফট করবো। ভাগ্নি ও ভাগ্নে সকাল ১০টায় দোহার থেকে রওনা দিয়ে রাত সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে পৌঁছে।

ভাগ্নিকে হাসপাতালে রেখে যাওয়া নিরপাদ মনে হলো না; ওর শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়লে দুজন রোগীকে সামলানো খুব কঠিন হবে। ভাগ্নেকে রেখে ভাগ্নিকে লয়ে কুমিল্লায় ফেরত আসবো রবিবার রাতে। রাত ১২:২০-এ হানিফ-এর সর্বশেষ ট্রিপে কুমিল্লা আসবো। ভাগ্নিকে নিয়ে ১২:১৫-তে বাস-স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। এর মিনিট খানেক পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল থেকে হায়াৎ আলীর চাচাতো ভাই মোবাইল করে জানায়- ভাই, সব শেষ।

হায়াৎ আলী ভাই আর নাই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন)। বাসের টিকিট রিফান্ড করে ভাগ্নিকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। ৫১ নং বেডের জায়গাটি খালি। আমরা ভিতে ঢুকে ও-পাশের বারান্দায় যাই। সম্পূর্ণ শরীর কাঁথায় মুড়িয়ে চৌপায়ার উপর হায়াৎ আলীকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

ভাগ্নি দরাম খেয়ে বাপের শরীরের উপর পড়ে গেলো। আমি মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে হায়াৎ আলীর মুখমণ্ডল দেখলাম- কতো সজীব, অথচ প্রাণহীন দেহে হায়াৎ আলী ঘুমিয়ে আছে। ১০ হাজার টাকায় এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রাত ১:৫০-এ দোহারের উদ্দেশে রওনা দিলাম- আমি, আমার ডান পাশে ভাগ্নি (ওর নাম ডলি), সর্বডানে ডলির এক চাচা; পেছনে ডলির আরেক চাচা ও ভাগ্নে (সজীব)। ড্রাইভারের সাথে ২য় ড্রাইভার সামনের সিটে। এ্যাম্বুলেন্স রাতের সড়কে ছুটে চললো জীবন্ত ৭টি মানুষ আর একটি লাশকে বুকে ধারণ করে।

সকাল ৬টায় কুমিল্লায় পৌঁছলাম। মিনিট দশেকের জন্য আমার বাসার কাছে এ্যাম্বুলেন্স থামালাম। বাসায় নামাজ পড়লো কয়েক জন। আমার স্ত্রী গাড়িতে এসে মৃত হায়াৎ আলীকে শেষবারের মতো একবার দেখলো। আমরা পুনরায় রওনা করলাম।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সুতারপাড়া ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামে আমাদের এ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো। দরজা খুলে আমি নামলাম, আর তখনই বাড়ি ভরে মাতম উঠলো। পৌনে ১২টায় জানাজা শেষ করে সাড়ে ১২টার মধ্যে দাফন সম্পন্ন করলাম। বুধবার বাদ যোহর কুলখানি ও দোয়া মাহফিল সম্পন্ন করে পৌনে ৫টায় দোহার হলের বাজার থেকে 'আরাম' বাসে উঠি। পৌনে ৭টায় পোস্তগোলা ব্রিজের গোড়ায় নামি।

সাড়ে সাতটায় এশিয়া লাইনে উঠে সাড়ে ৯টায় কুমিল্লায় বাসায় ফিরে আসি। এই কিছুদিন আগে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মৃত‌্যু হলো (জাহিদ), যে ক্ষত এখনো দগদগে। রবিবার রাতে হারালাম ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে। আমার বোনের জামাইটি ছিল খুব নিরীহ ও ভালো লোক, কিন্তু অত্যন্ত গরীব। তার এক মেয়ে শাইনপুকুরের পদ্মা কলেজে আইএ ২য় বর্ষ, অন্য মেয়ে মালিকান্দা কলেজে ১ম বর্ষে পড়ছে।

ছেলে গতবার এসএসসি পাশ করে বাপের সাথে কাজ শিখছিল। গরীব বোনের সংসারটিকে আমি আর আমার ছোটো ভাই এতোকাল টানছিলাম। হায়াৎ আলীর মৃত্যুর পরও অনেক দিন ধরে, যদ্দিন ভাগ্নে কর্মক্ষম না হয়, টানতে হবে। এই যে এদ্দিন ওদের সংসার টানছিলাম, কিছুটা ক্ষোভ ছিল হায়াৎ আলীর উপর, তবু আমার বোনটার একটা স্বামী ছিল, ওর সন্তানদের ছিল বাবা। আমার বোন আজ স্বামীহারা, ওর সন্তানরা বাবাহীন।

এই দুঃখী পরিবারটির জন্য, আমার বোন আর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের জন্য আপনারা দোয়া করবেন, আর দোয়া করবেন হায়াৎ আলীর জন্য, আল্লাহ যেন ওকে বেহেশত নসীব করেন। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.