আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ম্যারাডোনার দেশে-৩

অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া! ম্যারাডোনার দেশে-২ ম্যারাডোনার দেশে-১ আইএমওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো দুইদিনের পরীক্ষা। আমাদের দেশের যেকোন পরীক্ষার সঙ্গে এর অনেক পার্থক্য। প্রতিদিন সাড়ে চারঘন্টার পরীক্ষা কিন্তু সমস্যা থাকে মাত্র ৩টি করে। শুধু তাই নয়, যে সমস্যাগুলো থাকে তা এর আগে সারা পুথিবীর কোন পরীক্ষা, বই বা ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়নি।

বিষয়গুলো খালি জানা আছে –জ্যামিতি, বীজগণিত, নম্বরতত্ত্ব ও কম্বিনেটরিক্স। বোঝা যাচ্ছে যে কাজটা সহজ নয়। তবে, অনেকই সেগুলো করে ফেলে। কোন কোন শিক্ষার্থী ৬টি সমস্যারই পূর্ণাঙ্গ সমাধান করে পারফেক্ট স্কোরারের কৃতিত্ব দেখায়! ১০০টি দেশের ৫ শত ৪৮ জন শিক্ষার্থী ১০ ও ১১ তারিখ দুইদিনের পরীক্ষা দিয়েছে। আমার দেখা অলিম্পিয়াডগুলোর মধ্যে এবারই প্রথম প্রতিযোগীদের থাকার আর পরীক্ষার জায়গা একই স্থানে।

হোটেল প্রভিন্সিয়ালের দ্বিতীয় তলায় একটি বড় এবং একটি ছোট হলে ৫৪৮ জন পরিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সৌরভ ছাড়া আমাদের বাকী চারজন বড় হলঘরে পরীক্ষা দিয়েছে। সিট ব্যবস্থাপনাও সহজ। এক দেশের একজন তারপর অন্য দেশের একজন, এভাবে একই দেশের দ্বিতীয় জনকে পাওয়া যাবে ১০০ জন পরে। এরা কমপক্ষে ১৬টি ভাষায় কথা বলে।

সে কারণে বেশিরভাগই ইশারা ভাষা। পরীক্ষার্থীদের টেবিলে ফ্ল্যাগ/সিম্বল থাকে – পানি, কাগজ ইত্যাদি। খাতা থাকে না। প্রতিদিন প্রত্যেককে দেওয়া হয় ৩টি করে ফোল্ডার, প্রতি সমস্যার জন্য একটি করে। আর দেওয়া হয় একপাশে লেখা যাবে এমন কাগজ।

প্রতিটি পৃষ্ঠায় লিখে তা সমস্যা নম্বরের ফোল্ডারে রাখতে হয়। কথা বলার কোন সুযোগ নেই। তো, আমাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিক। এই ফাকে কয়েকটি তথ্য বলে নেই। এই নিয়ে বাংলাদেশ অস্টমবারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে।

অন্যদিকে আর্জেন্টিনা এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজক দেশ হয়েছে। এর আগে ১৯৯৭ সালে ৩৮তম আইএমও হয়েছে এই মার ডেল প্লাটা শহরে। সেই আইএমওতে অংশগ্রহণকারী আয়ারল্যান্ডের উপদলনেতা বাংলাদেশ গণিত দলের অন্যতম সুহৃদ গর্ডন লাসলি ১৫ বছরে শহরের অনেক পরিবর্তন চিহ্নিত করেছেন। তবে, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি বলে তিনি মনে করেন। আইওমও একটি গ্রীস্মকালীন অলিম্পিয়াড হলেও এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো দক্ষিণ গোলার্ধে এটি শীতকালীন অলিম্পিয়াডে পরিণত হয়েছে।

আর্জেন্টিনার দুইবার ছাড়া অস্ট্রেলিয়া আগে একবার এই আয়োজন করেছে। আর্জেন্টিনার ৭ম বৃহত্তম শহরটি রাজধানী থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে, আটলান্টিকের পারে এবং যথারীতি একটি পর্যটন নগরী। নগরীর সাড়ে ছয় লক্ষ অধিবাসীর সবাই কোন না কোনভাবে পর্যটন, মাছের বা বন্দরের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এটি একাধারে পোতাশ্রয়ও। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রতট জুড়ে প্রায় হাজারখানেক হোটেল, এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স রয়েছে।

আমাদের গাইড মাউরোর ভাষ্যমতে তারপরও ট্যুরিজম সীজনে সমুদ্রের পাড়ে দাড়ানোরও জায়গা থাকে না! তবে, মার ডেল প্লাটাকে দেখে মূল আর্জেন্টিনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া মুশ্কিল। কারণ আর্জেন্টিনা মূলত গ্রাম প্রধান দেশ, শহর প্রধান নয়। সোয়া চারকোটি লোক থাকে ১০ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে! নামের সঙ্গে রুপা থাকলেও (ল্যাটিন আর্জেন্টাম মানে রূপা) এখানে রুপার কোন পাহাড় নাই। ধারণা করা হয় রূপার পাহাড়ের লোভে স্প্যানিশরা এখানে ঘাটি গেড়েছিল। এবং সেই কারণে দেশটির নাম হয়েছে আর্জেন্টিনা।

খাওয়া দাওয়ায় আমাদের তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। ওদের ঝালের কোন সংস্কৃতি নেই! সকাল, দুপুর, রাতে মিষ্টির আধিক্য বেশি। মুসলিম দেশের জন্য সেখানে হালাল কাউন্টারও আছে। প্রথমদিনের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমাদের মহাসমুদ্রে বেড়াতে নিযে যাওয়া হয়। ছোট ইঞ্জিন নৌকা।

আমাদের মতো খালি চোখে সরাসরি তাকিয়ে চালানো হয় না। অনেক যন্ত্রপাতি আছে দেখলাম! ঘন্টাঘানেক চলার পর বোঝা গেল প্রকৃতি বিরুপ। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল কিন্ত সমুদ্রে সেটা ঝড়ের রূপ নিল। ফলে আমরা বেশিদূর যেতে পারলাম না। নৌকার দুলুনিটা যথেষ্ঠ ভয়ের ছিল।

তবে জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাদের বেড়ানোর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য নৌকা নিয়ে গেলেন সীলের খাড়িতে। মোটা, ভুটকু, শুকনা আর লম্বা একদল সীলকে দেখা গেল সমুদ্র পাড়ে ঘুরে বেড়াতে। বেশি কাছে না গেলেও সীলের বোটকা গন্ধ টের পেয়েছি সম্যকভাবে। পরদিন সকালে সমুদ্রের কথা বলার সময় ধনঞ্জয় জানতে চাইলো সাতার জানি কিনা। সাব জিরো তাপমাত্রা আর আটলান্টিক মহাসাগর – জানলেই বা কী! দ্বিতীয় দিন পরীক্ষা শুরু হওয়ার পরপরই শুরু হয় আমার বাক্সপেটরা নিয়ে অন্য একটা হোটেলে যাওয়ার প্রস্তুতি।

বেশিরভাগ আইএমওতে এটি ঘটে। লিডার আর ডেপুটি লিডার চলে যান অন্য কোথাও যাতে শিক্ষার্থীরা মহা আনন্দে কাটাতে পারে। আমি আসলাম হারমিটেজ হোটেল। এটি প্রভিন্সিয়াল থেকে মাত্র ৩ মিনিটের হাটা পথ! নতুন রুমটা আমার খুবই পছন্দ হল। কারণ জানালা দিয়ে মহাসমুদ্র দেখা যায়! দুপুর নাগাদ ড. মাহবুব মজুমদারও এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন।

দুপুরে আমরা গেলাম পরীক্ষার হলের বাইরে। ধনঞ্জয় জানালো ওর দুইটা হয়েছে। বাকীদের অবস্থা ঠিক বোঝা গেল না। ৫ নম্বরের জ্যামিতি কেন সবাই ঠিকমতো পারলো না সেটা বোা একটু মুশ্কিলও হলো। অনেকদিন পরে ১ আর ৫ নম্বরের জ্যামিতিসহ আইএমওর পরীক্ষা শেষ হল।

পরের দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের মহা আনন্দ আর আমাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন। সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক। [ফেসবুকে আমার পাতায় তিনটি এলবামে ছবি আছে [যাদের ধৈর্য কম তারা ছুটির দিনে এই কাহিনীর একটি সারাংশ পড়ে নিতে পারেন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.