আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-১১ অ্যাবোটাবাদ(প্রথম পর্ব)

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-১১ অ্যাবোটাবাদ(প্রথম পর্ব) রাতে হোটেলে ফিরে নাসের জানালেন-ওদের আত্মীয় ইব্রাহীম নাক্কাস যিনি ইসলামাবাদ থাকেন এবং সেনাবাহিনীর তালিকাভুক্ত বড় ব্যাবসায়ী। তাঁর সাথে যোগাযোগ করে অ্যাবোটাবাদ ভিজিট করানোর সুব্যাবস্থা চুড়ান্ত করেছেন। আমরা আগামী কাল লাঞ্চ করেই চলে যাবো ইসলামাবাদ। আমরা লাহোর থেকেই ইসলামাবাদ পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে রিজার্ভেশন নেই। লাহোর থেকে ইসলামাবাদের দুরত্ব প্রায় ১৩০ কিঃমিঃ।

লাহোর-ইসলামাবাদ চমৎকার হাইওয়ে-সেই সাথে উচু নিচু পাহাড়ী পথে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য! ২ ঘন্টায় আমরা ইসলামাবাদ পৌঁছি। পথে “পাক হাইওয়ে ইন” নামে একটি মোটেল কাম রেস্টুরেন্টে ওয়াশ এন্ড ক্লিণ হয়ে নাস্তা করি। হোটেলে পৌঁছতেই ইব্রাহীম নাক্কাস এসে আমাদের সাথে দেখা করেন এবং কুশলাদী বিনিময় করেন-তাঁকে দেখেই বোঝা যায় বহুতী মালদার আদমী। আমরা একসাথে “কাবুলী রেস্টুরেন্ট”এ ডিনার করি। ডিনারের বিল মিঃ ইব্রাহীম পে করেন-এটা পাকিস্তানীদের আতিথিয়েতার নিদর্শন।

ইব্রাহিম নাক্কাস ইসলামাবাদ সিটির বাসিন্দা হলেও মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস,ডাইরেক্টর জেনারেল অব ডিফেন্স পার্সেজ’র স্পেশাল ক্যাটাগরীর এনলিস্টেড সাপ্লাইয়ার হবার কারনে অ্যাবোটাবাদ, কাকুল মিলিটারী একাডেমীসহ সকল ক্যান্টনমেন্টে নিয়মিত যোগাযোগ ও যাতায়াত। সংগত কারনে উচ্চপদস্থ্য সেনা কর্মকর্তাদের সাথেও ভালো জানা শোনা। ইব্রাহিম নাক্কাস নাসের মাহমুদের নিকট আত্মীয় এবং আমি নাসেরদের বাংলাদেশী গেস্ট সেজন্য ওদের পরিবারের সকলেই খুশী। অবাক করার মতো হলেও সত্য,শিক্ষিত শ্রেনীর পাকিস্তানীরা এখনও বাংলাদেশীদের তাদের আত্মীয় মনে করে। তাদের কাছে যে কোনো বাঙালি অতিথি-অনেক আপনজন।

ইসলামাবাদ থেকে অ্যাবোটাবাদের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। আমরা যাচ্ছি ইব্রাহীম নাক্কাসের ল্যান্ড ক্রুজার জীপে(লক্ষনীয়, বাংলাদেশে উচ্চবিত্তদের যেমন পাজেরো জীপের কদর পাকিস্তানে উচ্চবিত্তদের মধ্যে ল্যান্ড ক্রুজার জীপের কদর)। চমত্কার হাইওয়ে। হাইওয়েকে পাকিস্তানীরা বলে মোটরওয়ে। আমি অবাক হলাম তাদের হাইওয়ে দেখে।

যে দেশের রাজনীতি এতটা অস্থিতিশীল,যাদের বহু শহরের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের আওতার বাইরে,সেই শহরের রাস্তা এবং ট্রাফিক সিস্টেম এতটাই আধুনিক যে,এটিকে ইউরোপ বললে হয়তো ভুল হবে না। পাহাড়ি রাস্তা শুরু। অ্যাবোটাবাদ যেতে পেশওয়ার পাশে রেখে ঢুকতে হয় ন্যাশনাল হাইওয়েতে। কট্টর মৌলবাদীদের আত্মঘাতী বোমা হামলার হুমকির মুখে থাকা এই দেশে কোথায় কোন বিপদের পরবো-আল্লাহ মালূম! কিন্তু আমার কোনোই ভয় করছেনা। পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানেরমত লাহোরেও সশস্র প্রাইভেট নিরাপত্তা রক্ষী ব্যাপক ভাবে প্রচলিত।

এই পেশায় চাকরী এবং ব্যাবসা এখন পাকিস্তানে খুব জনপ্রিয়। শহরে ঢোকার পরই বুঝতে পারি-শহরটাই আইন শৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। একটা থমথমে ভাব। রাস্তায় মানুষ খুবই কম। শহরে ঢুকতেই সেন্ট্রাল বাস স্টেশন।

কিন্তু বাস স্টেশনেও ভীড় নেই। মোড়ে মোড়ে পুলিশ/মিলিটারী পুলিশের পাহারা/চেকপোস্ট। মিলিটারি হসপিটাল,সিএসডি-ব্রডওয়ে,গলফ ক্লাব,মিলিটারি মেস,স্কুল-সর্বত্রই পুলিশী/সেনা চৌকিতে জিজ্ঞাসা। আমি শারিরিক আয়তনে পাকিস্তানীদের কাছাকাছি হলেও গাত্রবর্ণ ও পোষাকে ভিনদেশি-তা বোঝা যায়। সেই কারনেই প্রতিটা চেকপোস্টের প্রহরীরা আমার দিকে কৌতুহলি দৃস্টিতে তাকায়।

ইব্রাহীম নাক্কাস তাঁর “ডান্ডি কার্ড” বেরকরে দেখালেই আর কোনো প্রশ্ন নাকরে আমাদের ছেড়েদেয়, উপরন্তু আমাদের গাড়িতে লাগানো আছে ক্যান্টমেন্টে চলাচলের জন্য বিশেষ স্টীকার। আমরা কাকুল মিলিটারী একাডেমী একদিকে রেখে অ্যাবোটাবাদ ক্যান্ট গ্যারিশন কমান্ডারের অফিসে যাই। মিঃ ইব্রাহীম আমাদের নিয়ে বৃগেডিয়ার জেনারেল সেজাদ খান’র সাথে দেখা করেন-আমাকেও পরিচয় করিয়েদেন। তরুন সেনা কর্মকর্তা বৃঃজেঃ সেজাদ আমার কুশলাদী এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা জানতে চান। বৃঃজেঃ সেজাদ জানালেন-তিনি Defence Services Command and Staff College ঢাকা থেকে PSC এবং দিল্লি'র National Defence College and Defence Services Command and Staff College থেকে এনডিসি কোর্স করেছিলেন।

বৃঃ সেজাদ ফোনে কাউকে জানিয়ে দেন আমি লাদেনের বাড়ি দেখতে যাবো। ওনার অফিসে আমরা কাজুবাদাম ,আখরোট, কফি খাবারপর তাঁর নির্দেশে কমর নামে একজন জেসিও(ওয়ারেন্ট অফিসার) সেনা অফিসারের সাথে আমি ও নাসের চলছি লাদেনের সেই বাড়ি দেখতে। ১০/১২ মিনিট হেটে পৌঁছে যাই বিল্লাল টাউন হাউজিং এলাকায়। আঁকাবাঁকা রাস্তা পার হয়ে অনেক দোতলা-তিনতলা বাড়ির উপর দেখি সেনা পাহারা। সেনাদের সাথে ওঃঅঃ কমর কথা বলেন-আমাকেও পরিচয় করিয়ে দেন।

আমি বাঙালি জানতে পেরে নিরাপত্তা ক্যাম্পের তরুন সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন মুক্তার আমার সাথে সৌজন্য বিনিময় করেন। আমাদের দুজনকে নিয়ে লাদেনের বাড়ির গেইট পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু লাদেনের বাড়ির ভিতরে কারোর যাওয়ার অনুমতি নেই। ক্যাপ্টেন মুক্তার জানালেন-সম্ভবত আমিই একমাত্র বিদেশী যে লাদেনের বাড়ির গেইট পর্যন্ত আসতে পেরেছি! বাড়ির চারপাশটা আমরা ঘুড়ে দেখছি। ছোট্ট পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিনতলা বাড়ি।

বাড়ির সামনে এক ঋজু দেহী বৃদ্ধ লোক রোদ পোহাচ্ছিলেন। তাঁকে সালাম দিয়ে আমি ভাঙা উর্দুতে জানালাম-বাংলাদেশ থেকে এসেছি লাদেনের বাড়ি দেখতে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শেক করে বললেন- “I’m Kasuri, Afzal kasuri, retards Lt. Colonel. It’s my privilege to offer you cup of coffee with me.” মাথা নুইয়ে সম্মতি দিতেই তিনি আমাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। লেঃকঃ আফজাল কাসুরী অবাক হন-আমি এত দূর থেকে এসেছি এই বাড়ি দেখতে তাও এমন অস্থিতিশীল ভয়াবহ পরিস্থিতিতে! বিল্লাল টাউনের “কাসুরী ডেল” নামের ঐ বাড়ি-যেখান থেকে লাদেনের সেই বাড়ির দূরত্ব মাত্র ৪০ গজ। এখানকার বেশীর ভাগ বাড়ির মালিক প্রাক্তন সেনা অফিসার।

কর্ণেল কাসুরী বলেন-ঐ বাড়িতে লাদেন থাকতেন তা কেউ কল্পনাও করেননি। তাঁর বাড়ির জানালা থেকে স্পষ্টই দেখা যেত লাদেনের বাড়ির দরজা। তিনি ওই বাড়ির ১/২ জন লোককে জুম্মা নামাজ পড়তে যেতে দেখেছেন মাত্র। কখনও কোনো বাচ্চা বা মহিলাও দেখেননি। ঢাকায় আমার বাড়ি কোন যায়গায় জিজ্ঞেশ করলে বলি ধানমন্ডি।

তিনি বলেন-ধানমন্ডি ঢাকার সব চাইতে অভিযাত এলাকা-তাইনা?শেখ মজিবুর রহমানের বাড়িওতো ধানমন্ডি। আমি বললাম-ধানমন্ডি একসময় ঢাকার অভিযাত এলাকা ছিল এখন আর নেই। জানতে চাই-তিনি কি বংগবন্ধুর বাড়ি চিনেন? কর্নেল কাসুরী জানালেন-৭১ সনের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি সায়েন্স ল্যাবোরেটরী সেনা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন-তখন তিনি ক্যাপ্টেন! কথাটা শুনেই আমার সাড়া শরিরে একটা হীমশীতল অনূভুতি বয়ে যায়...আমার চোখের সামনে ভেষে ওঠে পাক সেনাদের দেয়া আগুনে আমাদের বাড়িটা পুড়ে যাবার দৃশ্ব্য! আমার চোখের সামনে ভেষে ওঠে ঢাবি’র ততকালীন ইকবাল হলে আমার দুই মামার মৃত্যুর দৃশ্ব্য! প্রচন্ড শীতেও আমার শরির ঘামে ভিজে যাচ্ছে- মনে হচ্ছে আমার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে, আমার মাথাটা বনবন ঘুড়ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে-শরির অবশ হয়ে যাচ্ছে। কর্ণেল কাসুরী আমাকে বললেন-"কফি পিয়ে জেন্টেল ম্যান"> হঠাত কোনো এক অদৃশ্ব্য শক্তি আমাকে এক ঝটকায় কাসুরী ডেল থেকে বেড় করে নিয়ে আসে! আমি এখনও জানিনা-সেই অদৃশ্ব্য শক্তিই কি আমার আত্মসম্মানবোধ, সেই অদৃশ্ব্য শক্তির নামই কি দেশ প্রেম! মা, আমি তোমাকে দেখিনি, আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি-কিন্তু আমি আমার মাতৃভূমি, আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি, আমার দেশইতো আমার মা! লাদেন যেবাড়িতে থাকতেন-আমরা সেই বাড়ির সামনেই দাড়িয়ে। একটি সাধারন মানের তিনতলা বাড়ি।

১২/ ১৪ ফুট উঁচু দেয়াল দেখে জেলা শহরের কোনো জেলখানা মনে হয়। দেয়ালের বাইরে ৪/৫ জন সেনা পাহারায়। বাড়ির ছাদ থেকেও সেনারা নজর রাখছিল দূরে। সুবজ রঙের গেটের বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই ভেতরে কী। বাড়িটি্র তিন স্তরে পাহারা বসানো।

আমাদের সাথে এসে যোগ দেন ক্যাপ্টেন মুক্তার। “আমি বাংলাদেশী”-পাকিস্তানে এটা অনেক সম্মানের যা ইতোমধ্যে মধ্যেই আমি বুঝেছি। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী শাসকদের বাংলাদেশীদের(পূর্ব পাকিস্তান)উপর অন্যায়-অবিচারের জন্য পাকিস্তানের বর্তমান শিক্ষিত প্রজন্ম নিজেদের অত্যন্ত লজ্জিতবোধ করে-যা আমার ভাললাগে। হয়ত ওদের অপরাধবোধের জন্যই বাংলাদেশ-বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের কাছে অনেক সম্মানের। তাই সর্বত্রই আলাপ শুরুর সময়েই আমি বলি-“আমি বাংলাদেশী”।

“কাসুরী ডেল” থেকে বেড়িয়ে আরও কথা হয় মোহাম্মদ তাইফুরের সঙ্গে। সেও এই এলাকার বাসিন্দা। তার কাছে ওসামা একজন বীর যোদ্ধা, একজন হিরো। যদিও কোনোদিন সে ওসামাকে দেখেনি! যিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকা-বৃটিশ-ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। ২০/২১ বছর বয়সী কলেজ ছাত্র সুলেমান মুবারকের কাছেও ওসামা তার আদর্শ-কারন,ওসামা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

তার ভাষায়,”বারাক ওবামা, হিলারী, আম্রেকা স্রেফ ইবলিশকা বাচ্চা, দো জাঁহাছে ওউরভি দুছরা বজ্জাত নেইহী জোহি শয়তান আম্রেকা” মার্কিনীরা ভন্ড,সত্যের শত্রু-পাপিষ্ঠের বন্ধু! বুশ, বারাক ওবামা সবাই শয়তান। মার্কিনীরা চায় পাকিস্তানকে বশে রাখতে-যা কোনোদিনই পারবেনা। জেঃ মোশারফ, জারদারী, নওয়াজ শরীফ চাইলেও পারবেনা। প্রত্যেকটা পাকিস্তানী মার্কিনীদের খতম করবে,ইহুদীদের খতম করবে। “-সুলেমান মুবারকের জেহাদী জোশ দেখে আমি আর কথা বলার সাহস দেখাইনি! আমরা ফিরে আসি গ্যারিসন কমান্ডার ব্রীঃজেঃ সেজাদ খানের অফিসে-যেখানে অপেক্ষা করছেন ইব্রাহীম নাক্কাস।

এবার আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা হয়। বৃঃজেঃ সেজাদের জন্ম ১৯৬৭ সনে, তাঁর স্ত্রী চিকিতসক, একভাই সেনা অফিসার, আব্বা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। সেনা অফিসার্স মেসে সেজাদ খান আমাদের লাঞ্চের আয়োজন করছেন। পাকিস্তানের উর্ধতন সেনা অফিসারগন সব থেকে শানশওকতে আছে-তা তাদের খাবার দাবার, বিলাশবহুল বাড়িঘর দেখলেই বোঝা যায়। উপমহাদেশের সব দেশেই সেনারা লাঞ্চ করে একই স্টাইলে।

তবে আমি বাংগালীবলেই হয়ত আমার সৌজন্যে অন্যসব রেগুলার খাবারের সাথে ভাতেরও আয়োজন ছিল! বেশীরভাগ পাকিস্তানী সেনা অফিসার প্রচুর ড্রিংক করে-সেজাদও তার ব্যাতিক্রম নন,সেইসাথে ইব্রাহীম নাক্কাসও। সম্ভবত ইনারা ‘বোতলকা ইয়ার’! (পরের পর্বে.........) ।


আরো পড়ুন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।