আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ(লাহোর,Coock's Den)-৮

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ(লাহোর,Coock's Den)-৮ নির্ধারিত দিনের ৮ দিন পর শিয়ালকোটের কাজ শেষ করে UNICEF, UNFPA ’র দুই অফিশিয়াল,বাংলাদেশ দুতাবাসের কমার্শিয়াল সেক্রেটারী, Bureau Varitas এর ৬ কর্মকর্তা এবং নাসের মাহমুদ সহ আমরা বিরাট এক গাড়ি বহর নিয়ে লাহোর ফিরে আসি। UNICEF, UNFPA ও বাংলাদেশ দুতাবাসের কর্মকর্তাদের সংগী হওয়ায়-আমরা পুরো পথেই নিরাপত্তার জন্য সেনা-পুলিশের স্কর্ট পেয়েছিলাম। নাসের মাহমুদের ভাষায়-এই ধরনের সেনা স্কর্ট অতিরিক্ত বিপদের কারন হয়। সন্ত্রাসীরা বাড়তি আনুষ্ঠানিকতা দেখলেই আক্রমনে উতসাহী হয়। গত ৫ দিনে Ms Broheem’ আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছেন! তিনি গাড়িতে আমার পাশে বসেছেন।

সময় সুযোগ পেলেই তিনি আমার সাথে গল্প করেন পৃথিবীর তাবত বিষয় নিয়ে। মাঝে মাঝে উনি আমার সাথে শুধু জার্মান ভাষায়ও কথা বলেন-আমি বুঝলাম কি বুঝলামনা তা তাঁর খেয়ালে নেই-কিছুটা খেয়ালী মনের মহিলা! তিনি একজন প্রাকৃতিক ও শিল্প সৌন্দর্য্য পিয়াসী নারী। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ। তিনি আমার কাছে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও শিল্পীদের(চিত্র শিল্পী) সম্পর্কে জানতে চান-আমি আমাদের দেশের বিখ্যাতসব চিত্র শিল্পীদের নাম বলি। যাদের সম্পর্কে কিছু জানি-তাঁদের সম্পর্কে বলি।

আমি স্বীকার করি-আমি শিল্প সাহিত্য বিশেষ করে চিত্র শিল্পের বোদ্ধা নই। আমার কথা শুনে মিজ ব্রোহেম বলেন- “Real art Communicate Begore it is understood”- মানে,বোঝাবুঝির কী দরকার? ভাল লাগলেই হল। খুশীতে মনটা ভরে উঠলেই হল। আমি তাঁর কথায় সম্মতি দিলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন-পাকিস্তানী শিল্পী ইকবাল হোসেনকে জানি কিনা? আমার নাবোধক উত্তর শুনে উনি বিস্মীত হন! তিনি প্রশ্ন করেন Cook'’s Den রেস্টুরেন্টে খেয়েছি কিনা? আমি বলি-ঐ রেস্টুরেন্ট এর নাম শুনেছি-কিন্তু কখনও যাওয়া হয়নাই।

সাথে সাথে তিনি আমাকে Cook's Den রেস্টুরেন্টে ডিনার করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন-“It’s my privilege to offer you diner with me at Cook’s Den. মিজ ব্রোহেমের কথায়(ইনভাইটে) আন্তরিকতা ঝড়ে পরছিল! তিনি হোস্ট, আমি, নাসের গেস্ট। আমি রাজী হই। আমরা নিরাপদে লাহোর পৌঁছে Dynasty রেস্টুরেন্টে একত্রে লাঞ্চ করি-Dynasty restaurant Avari Hotel International এর অধীন লাহোরের অন্যতম একটি অভিযাত রেস্টুরেন্ট। UNFPA, UNICEF কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের দূতাবাসের কমার্শিয়াল সেক্রেটারী বাই এয়ার ইসলামাবাদ চলে যান।

লাহোরে আমাদের জন্য আগে থেকেই “পার্ল কন্টিনেন্টাল” হোটেলে রিজার্ভেশন ছিল। Bureau Varitas কর্মকর্তাদের হোটেল Avari Hotel International- ওরা ঐ হোটেলের কর্পোরেট গেষ্ট। মিজ ব্রোহেম তার সংগীদের নিয়ে Avari Hotel International যেতে গাড়িতে ওঠার সময় আগামী কাল Cook’'s Den রেস্টুরেন্টে ডিনারের কথা মনেকরিয়ে দিলেন এবং বললেন-“ If you don’t mind, I will pick-up you in the evening”. আমাদের গাড়ি আছে-তাই থ্যাঙ্কস জানিয়ে বলি-আমরা সময়মত পৌঁছে যাব। রাত সাড়ে আটটায় আমি ও নাসের মাহমুদ Cook'’s Den রেস্টুরেন্টে হাজির হই। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে মিজ ব্রোহেম এক সংগীসহ অপেক্ষমান।

Cook'’s Den রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কিছুটা অবাক হই। প্রাচীন একটা ৪ তলা বাড়ি। নির্মান কৌশলে মুঘলীয় ঐতিহ্য থাকলেও অযত্নের অভাব লক্ষনীয়-অনেকটা আমাদের পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং’র মত! Cook'’s Den রেষ্টুরেন্ট ভবন “"কুকস ডেন হলো এমন এক রেস্টুরেন্ট যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রনে তৈরী হয়েছে ব্যাতিক্রমী অনূপম এক রুপকথা-যা উপমহাদেশে আর কোথাও নেই”"-এই কথাটা মিজ ব্রোহেম বলেছেন। এ হলো এক ক্ষ্যাপা চিত্র শিল্পীর কল্পনার বাস্তব প্রতিফলন! সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাচীন এই বাড়িতে শিল্পী ইকবাল হোসেন প্রতিষ্ঠা করেছেন এই রেস্টুরেন্ট। পাকিস্তানের সব ঐতিহ্যবাহী ও দামি খাবারের জন্য ইতোমধ্যেই শুধু পাকিস্তানেই নয় বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছে কুকস ডেন।

অপরিসর রিসিপশন পেরিয়ে সরু কড়িডোর ভেংগে একটি বিশাল কক্ষে ঢুকে সত্যিকার অর্থেই অবাক হলাম। দেয়ালে, ক্যানভাসে, মেঝেতে নানান ভংগীমায় আঁকা নারীদের ছবি, হয় দেয়ালে ঝুলছে কিম্বা মেঝেতে পরে আছে। এমন আরো ৪/৫ টি বিশাল কক্ষ(মাঝারী আয়তনের হল রুম বলাই সঠিক) মিলিয়ে শিল্পী ইকবাল হোসেনের আর্ট স্টুডিও। শিল্পী ইকবালের শিল্প কর্ম দেখে বিশ্বখ্যাত আর এক ভিন্নধারার ভারতীয় শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন এবং বাংলাদেশের বোহেমীয়ান শিল্পী এস এম সুলতান এর কথা মনে পরে। কারন- শিল্পী ইকবাল হোসেন, ফিদা মকবুল হুসেন ও এস এম সুলতানের ছবির মূল উপজিব্য নারীর সৌন্দর্য্য।

তবে এই তিন শিল্পীর নারীর সৌন্দর্য্য উপস্থাপনে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। একতলা থেকে দোতলা, তিন তলা, চারতলায় যেতে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ঘোড়ানো-প্যাচানো কাঠের সিড়ি। তিনতলা পর্যন্ত শুধু ছবি আর ছবি-যেনো ছবিময় ভিন্ন রকমের এক পৃথিবী! চতুর্থ তলায় Cook'’s Den রেস্টুরেন্ট। আন্দাজ- দু’শ জন গেষ্ট এর আয়েশী বসার সুব্যাবস্থা। কুকস’র চেয়ার-টেবিল,পরিবেশনের তৈজসপত্র, বাতি,সজ্জাপ্রকরণ তথা সামগ্রীক পরিবেশের প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে শিল্প আর ঐতিহ্য কিন্তু নেইকোনো আতিশয্যের বালাই।

ব্যালকনীতে গিয়ে বাইরে তাকাতেই অভুতপুর্ব পূলকে কেঁপে উঠল চোখের পাতা। ব্যালকণীর ওপাশেই আলো ঝলমল বিশাল বিস্তৃত বাদশাহী মসজিদ আর লাহোর ফোর্ট। মাথার উপড় নীল আকাশে সাদাসাদা মেঘের ভেলা। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে। একটার পর একটা খাবার আসছে।

Cook'’s Den রেস্টুরেন্ট দেয়ালে পোস্টারিং আছে- “"ওয়াইন রেস্ট্রিক্টেড"” কিন্তু বিয়ারে মানা নাই। যদিও হার্ড ড্রিকংস এর গন্ধে পুরো ডাইনীং ভুরভুর করছে। মিজ ব্রোহেম আজ একটু বেশী পান করছেন। আমাকে টেনে নিয়ে একটা খোলা যায়গায় বসালেন, বললেন-খোলা আকাশের নিচে পান করায় অন্য রকম এক আমেজ, অন্যরকম এক আবেশ! আমি খাচ্ছি আর ব্রোহেম পান করছেন... ওপেন স্কাই রুফ রেস্টুরেন্টে খেতেখেতে উপভোগ করছি মুঘল স্থপত্যশৈলীর ক্লাসিক্যাল মাধূর্য্য। ঘরের মধ্যে আলো আধাঁর বাইরে ঐতিহাসিক জগত আর আলোকমালা আমাদের মুহুর্তেই নিয়ে গেল সত্যিকার অর্থেই রুপকথার এক অনির্বচনীয় ঐশ্বর্য্যের মাঝে! আমরা অবিভূত!! বিমোহিত!!! আমার মনে হচ্ছে- হোস্ট মিজ ব্রোহেম ছাড়া সংগী-গেস্ট সকলেই স্বুস্বাদু খাবারের পুঁজারী হলেও মিজ ব্রোহেম খাবারের চাইতেও শিল্প ও শিল্পীর চিত্রকর্মের ব্যাপারে বেশী আবেগী তেমনি পানেও উদার! মিজ ব্রোহেম আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে অন্যহাতে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন।

হঠাত মিজ ব্রোহেম বললেন-"“মিঃ কবির, আমাদের কি আবারও, বার বার দেখা হতে পারেনা”"? আমি যেনো এমন একটি কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তাই উত্তর দিতে দেরী হয়নি। আমি বললাম-“"আমি চাইনা, আবার আমাদের দেখাহোক, সুযোগ থাকলেও যেনো দেখা নাহয়......। "“ মিজ ব্রোহেম গ্লাশে শেষ চুমুক দিয়ে নতুন আরো একটা বোতল নিলেন............ Cook'’s Den এর কিচেন Cook'’s Den রেস্টুরেন্ট শুধুমাত্র মজাদার খাবারের জন্যই বিখ্যাত নয়। শিল্পী ইকবাল হোসেনের অণুপম শৃজনশীলতার জন্য বিশ্বের বিখ্যাতসব লোকদের কাছে Cook'’s Den রেস্টুরেন্ট পরিচিতি এনেদিয়েছে।

কতরকম খাদ্যইনা পরিবেশন করা হয়েছে-যা আমার কাছে যেমন অনাস্বাদিত তেমনি অপরিচিতও। খুব অল্প কয়েকটা পাকিস্তানী খাদ্যের স্বাদ আগে পেলেও এখানকার বেশীরভাগ খাদ্যের নামই অজানা! একটা কথা নাবললেই নয়- Cook'’s Den রেস্টুরেন্ট বিরোধী লোকজন বিশেষভাবে লাহোরের ফাইভ/সিক্স/ সেভেন স্টার হোটেল রেস্টুরেন্ট কর্তিপক্ষ এখানকার খাবারকে “স্ট্রীট ফুড” এমনকি “প্রস্টিটিউট ফুড” বলেও সমালোচনা করে! কারনটা একটু পরেই খোলাশা হবে। Cook'’s Den এর একটি মেন্যু এবার শিল্পী ইকবাল হোসেন সম্পর্কে কিছু বলিঃ- ইকবাল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালে লাহোরের হীরামন্ডি। হীরামন্ডি উপমহাদেশের বিখ্যাত নিষিদ্ধ এলাকা। মোঘল আমলে মোঘল সম্রাট,তাঁর পদস্থ্য কর্মকর্তা ও সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থান থেকে এমনকি আফগানিস্তান, ইরান,ইরাক, ইয়েমেন,লেবানন থেকেও সুন্দরী মেয়েদের এনে এখানে রাখাহতো......এখনও হীরামন্ডি পাকিস্তানের নিষিদ্ধ পল্লী! শিল্পী ইকবালের জন্মও একজন যৌন কর্মীর গর্ভে-যা শিল্পী কখনোই অস্বীকার করেননি।

বরং শিল্পীর মা শিশু ইকবালকে কত যত্ন করে, কত কস্ট করে প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও লালন-পালন করেছেন,লাহোর এবং লন্ডনের দামী ইংরেজী স্কুলে লেখাপড়া শিখিয়েছেন তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেন। শিল্পী ইকবালকে তার ভক্তরা “পুওরেস্ট পেইন্টার” সম্বোধন করেন-বিকজ ইকবাল ফলোজ হিজ ওন ভিশনস...। পাকিস্তানী মেয়েদের অসয়ায়ত্ব,ক্ষমতাহীনতা,অন্তর্গত দহন সুন্দর করে তুলে ধরেন এই শিল্পী তাঁর তুলিতে। আবার আঁঘাত করেন সমাজের হিপোক্রাট য়্যাটিচুডকে! তাঁর বেশীরভাগ ছবির মডেল হীরামন্ডির যৌনকর্মীরা। সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে শিল্পী ইকবালের ছবির কদর।

বিশ্ব শিল্প বোদ্ধারা তাঁকে সম্বোধন করে –“আর্টিস্ট অব গ্রেটেস্ট আর্টিস্ট”! “পেইন্টার অব প্রোস্টিটিউট য়্যান্ড ড্যান্সিং গার্ল”-হিসেবে। ইকবাল যেসব মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন তারা কখনোই পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেনা। পাকিস্তানেরমত কট্টরপন্থী মুসলিম দেশে শিল্পী ইকবাল বিতর্কিত কিন্তু আদৃত চিত্রকলা শিল্পী। সমালোচকেরা ইকবালকে সম্মান করে প্রথাবিরোধী শিল্পী হিসেবে। পাঠক, প্রসংগত বলছি-পাকিস্তান তথা উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী নূরজাহানের জন্মও এই হীরামন্ডিতে।

কি খেয়েছি, কত কী খেয়েছি-বলতে পারবোনা। শিল্পের সৌন্দর্য্য আর আয়েশী ভোজনে আমার চোখের ঘোর কাটছেনা, মনের ঘোর বেড়েই যাছে। আমি ছাড়া সবাই কম বেশী নেশাতুর! আমিও নেশাতুর লোকদের দেখে নেশা অনূভব করছি...... মধ্যরাত কড়া নাড়ে-কুক’স ডেনে। কিন্তু ভোজন রশিক, শিল্প পিপাসু ব্যাক্তিবর্গ আর দেশী বিদেশী অভিযাত পর্যটকদের আসার বিরাম নেই...বরং যতই রাত বাড়ে কুকসের অন্তর্গত সৌন্দর্য্য ততই প্রস্ফুটিত হতে থাকে...নতুন নতুন অতিথিদের আগমনে। মাথার উপর চাঁদ হাসে... মিজ ব্রোহেমকে ধন্যবাদ জানাই গভীর করমর্দনে।

বিদায় কুকস ডেন...... বিদায় ব্রোহেম...। । সপ্তম পর্বের লিংকঃ-http://www.somewhereinblog.net/blog/jullvern/29641363 (পরের পর্বে.........) ।


আরো পড়ুন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।