আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সা খরচের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন

বেলভ্যুতে সাড়ে চার কোটি টাকা খরচের কথা বলা হলেও বাস্তবে এক ডলারও ব্যয় হয়নি পরিচয় গোপন রেখে স্বল্পআয়ের একজন অভিবাসী হিসেবে নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। এর আগে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ক্যান্সার রোগ নিরাময়ের বিশেষায়িত হাসপাতাল মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টার ছেড়ে সরকারি বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিত্সা বাবদ ওই হাসপাতালে অর্ধ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা) ব্যয় হলেও সরকারি চিকিত্সা (মেডিকেইড) সুবিধা নেয়ায় লেখকের পরিবারকে একটি ডলারও পরিশোধ করতে হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ এসব তথ্য জানতেন কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ তথ্য গোপন করে চিকিত্সা সুবিধা নেয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন এই লেখক এবং নিউইয়র্কে বসে একটি লেখায় তিনি তা প্রকাশও করেছিলেন।

এমনকি জীবদ্দশায় তিনি জেনে গেছেন স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টারে তার চিকিত্সায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়েছে। অথচ বেলভ্যু হাসপাতালের হিসাব বিভাগে হুমায়ূন আহমেদের মেডিকেইড সুবিধা নেয়ার তথ্য এখনো সংরক্ষিত আছে। ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় বাংলাদেশিদের বিনামূল্যের চিকিত্সা সুবিধা নেয়ার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন হুমাযূন আহমেদ। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাঙালি ব্যবস্থায় আমি চিকিত্সা নেব, এই প্রশ্নই ওঠে না। ’ কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল এই লেখক নিজের সমালোচনাকে পেছনে ফেলে বিনা খরচের চিকিত্সা নিয়েছেন নিউইয়র্কে।

যদিও অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম চিকিত্সার সব ব্যয় বহন করবেন—এমন আশ্বাস দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে বলেছিলেন, ‘চিকিত্সার অর্থ কীভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে—তা দেখার দায়িত্ব আপনার নয়। ’ টাকা কীভাবে জোগাড় হবে হুমায়ূন আহমেদ জানতে চাইলে মাজহারুল ইসলাম তাকে কথা দিয়েছিলেন যে, কারও কাছ থেকে এক ডলার সাহায্য নেবেন না এবং এই মুহূর্তে তার হাতে ৫০ হাজার ডলার আছে। এদিকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত নিউইয়র্কের জনপ্রিয় ‘সাপ্তাহিক বাঙালী’ তাদের শনিবারের সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সা সংক্রান্ত একটি ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রতিবেদন ছেপেছে। ওই প্রতিবেদনে বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সার রেকর্ড পর্যালোচনা করে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচয় গোপন রাখার কারণেই হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সা সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখা হতো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সাপ্তাহিক বাঙালীর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত প্রায় ১০ মাসের চিকিত্সায় মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টারে ভর্তি হবার পর সেখানে হুমায়ূন আহমেদকে মাত্র দুটি কেমো দেয়া হয়েছিল। বাকি ১০টি কোমোথেরাপি দেয়া হয় বেলভ্যু হাসপাতালে। এখানেই গত ১২ জুন প্রথম অস্ত্রোপচার হয় হুমায়ূন আহমেদের। সফল অস্ত্রোপচার শেষে বাসায় ফিরে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে ভেতরে রক্তক্ষরণ হওয়ার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর আবার বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আরো দুটি অস্ত্রোপচার এবং পরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হাসপাতালেই চিকিত্সাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় জনপ্রিয় এই লেখকের।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছে হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটির সাউন্ডভিউ ব্রডকাস্টিংয়ের রেস্ট হাউসে ওঠেন। পরদিনই তিনি পূর্বনির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টারে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, অন্যপ্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম, মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত্ সাহা, লেখক পূরবী বসু ও ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। ওই হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে এবং সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে চিকিত্সকরা জানান যে, হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার শেষ ধাপে (ফোর্থ স্টেজ) এসে ধরা পড়েছে এবং কেমোথেরাপির মাধ্যমেই তা নিরাময় সম্ভব। এজন্য প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার আগেই জমা দিতে হবে।

এই অর্থ জমা না দিলে তার চিকিত্সা শুরু সম্ভব হবে না। হুমায়ূন আহমেদ তার চিকিত্সা ব্যয় মেটাতে দেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছেন, যা ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন। চ্যানেল আইয়ের কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর তাকে চিকিত্সার জন্য ৫০ হাজার ডলার দিতে চেয়েছিলেন, তাও সময়মত পাননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত লেখক পূরবী বসুর অঙ্গীকারে স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ হুমায়ূন আহমেদের শরীরে দুটি কেমো দেয়, যাতে প্রায় ৪০ হাজার ডলার ব্যয় হয়। অর্থের সংস্থান না হওয়ায় পরবর্তী সময় তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এরপর তথ্য গোপন করে নিম্নআয়ের লোক হিসেবে অর্থাত্ সপ্তাহে ১০০ ডলার আয় দেখিয়ে হুমায়ূন আহমেদের নামে বেলভ্যু হাসপাতালের মেডিকেইড কার্ড সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য কেউ যাতে না জানতে পারে এজন্যই হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে প্রবাসীদের দূরে সরিয়ে রাখা হত। অথচ তিনি চাইলে দেশ-বিদেশের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারতেন। এমনকি গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামাইকার বাসায় হুমায়ূন আহমেদকে গিয়ে ১০ হাজার ডলার অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন। প্রয়োজনে আরো অর্থ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদই তখন বলেছিলেন যে তিনি নিজেই ২ কোটি টাকা খরচ করতে পারবেন। এর বেশি লাগলে তিনি জানাবেন। এদিকে প্রথম অপারেশনের পর নিউইয়র্কের বাসায় এক অনুষ্ঠানে ধারণ করা ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, মেহের আফরোজ শাওন বলছেন যে হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সা বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়েছে। বেলভ্যু হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে হুমায়ূন আহমেদকে রেখে ডাক্তারদের ওই পরিমাণ অর্থ দাবি করা এবং শাওন এজন্য কান্নাকাটি করেছেন বলেও ভিডিওতে দেখা গেছে। কিন্তু বেলভ্যু হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী হুমায়ূন আহমেদ মেডিকেইড সুবিধার অনুকূলে চিকিত্সা নিয়েছেন বলে উল্লেখ আছে।

ইউটিউবে প্রচারিত ওই ভিডিওচিত্রে শাওনের দেয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যদিও হুমায়ূন আহমেদ দুইটি হাসপাতালেই অর্থ লেনদেনের কোনো অংশেই দৃশ্যমান ছিলেন না। কারণ দুইটি হাসপাতালেই তখন তিনি ছিলেন অপারেশন থিয়েটারে। আর হুমায়ূন আহমেদ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করেছেন স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসেব দেয়ার পর। ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার পরিশোধ করা হয়েছে সে তথ্য দুইটি হাসপাতালের কোথাও সংরক্ষিত নেই।

স্লোয়ান-কেটারিংয়ে এক কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হলে সেখানেই কেমো সম্পন্ন হতো হুমায়ূন আহমেদের। ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় হুমায়ূন আহমেদ যে তথ্য উল্লেখ করেছেন, তাতে স্লোয়ান-কেটারিং হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তিন লাখ টাকা, শরীরে কেমো দেয়ার জন্য মেডিপোর্ট বসাতে ৮ লাখ টাকা এবং ৮টি কেমোর জন্য এক কোটি টাকা দেয়ার কথা। পরে লেখক পূরবী বসুর মধ্যস্থতায় দুইটি কেমোর খরচসহ হুমায়ূন আহমেদের চিকিত্সায় স্লোয়ান-কেটারিং কর্তৃপক্ষকে ৪০ হাজার ডলারের কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরপরই হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরিচয় গোপন করে তার নামে মেডিকেইড কার্ড সংগ্রহ করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ এই তথ্য জানতেন কিনা, নাকি কোনো মহল তাকে ব্যয় সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দেয়নি—তা নিয়ে এখন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

কারণ হুমায়ূন আহমেদ নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, স্লোয়ান-কেটারিং সেন্টারে ১ কোটির বেশি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখাটি একটি দৈনিকে ছাড়াও বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র : Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.