আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুডবাই, মায়েস্ত্রো

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল আমার। দেখা বলতে- সামনা-সামনি হওয়া। চাইলে কথা বলা যায় এমন দূরত্বে আসা। ২০১২ সালের মে মাসে হুমায়ূন শেষ বারের মতো দেশে এসেছেন।

সবাই বলছে, বাঁচার আশা নাই তো, মায়ের সাথে শেষ দেখা করতে এসেছেন। ইতিমধ্যে স্লোয়ান-কেটরিং হাসপাতালে কেমো নিয়েছেন। আরোগ্য হয়নি, অপারেশন করতে হবে। দেশে ফিরে লোকজনের সান্নিধ্যে যেতে নিষেধ করেছিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু এবার দেশে ঘটনাবহুল সময় পার করলেন তিনি।

দেয়াল, আইন-আদালত, হৈ-হল্লা কম হলো না। ষোলকলা পূর্ণ হলো তার শেষ সিনেমা ঘেটুপুত্র কমলার প্রি-প্রেস শোর মধ্য দিয়ে। এই শোর দুইদিন পর তিনি চলে গিয়েছিলেন। ২৯ মে ছিল শো। অফিস থেকে বলা হলো, শো-টা আমাকে কভার করতে হবে।

বসুন্ধরা সিটির সিনেপ্লেক্সে শো। মঙ্গলবার, মার্কেট বন্ধ। পুরো মার্কেট স্তব্ধ, শুধু আট তলায় গুঞ্জন। হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ট সার্কেলের পুরোটাই উপস্থিত। দেখলাম, বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা সিনেপ্লেক্সের বাইরে গোল আসনে ঘিরে রেখেছেন তাকে।

একটু এগিয়ে গেলাম, থমমতো খেয়ে আবার দূরে চলে এলাম। কী বলবো? পরিচিত হয়েই বা কী করবো? তরুণ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস প্যারিতে দেখেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, পার্কে। মার্কেস ছিলেন রাস্তার অন্যপাশে। কাছে যেতে সময় লাগতো। গিয়ে হেমিংওয়েকে পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

তাই তিনি দূর থেকেই ডাক দিয়েছিলেন, মায়েস্ত্রো! হেমিংওয়ে জানতেন, এই পার্কে একমাত্র তিনিই মায়েস্ত্রো, মাস্টার, উস্তাদ। তাই বহু মানুষের মধ্যে তিনিই মার্কেসের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছিলেন। বলেছিলেন, দেখা হবে বন্ধু। এই ঘটনা মাথায় ছিল। আমি মনে মনে বলেছিলাম, দেখা হবে মায়েস্ত্রো।

ওই অনুষ্ঠানে দেখে, বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছিল, নিশ্চিতভাবেই তিনি ফিরবেন। টেলিভিশনে এর আগে যেমন দেখেছি, তেমনই তো আছেন। আত্মবিশ্বাসে একটুও চিড় ধরেনি, হাস্য-পরিহাসে কমতি নেই। নিজের রাজ্যে রাজা, সর্বেসর্বা। ওই একবারই কথাবিহীন দেখা।

দেখার সুযোগ তো কতই হয়েছিল। ঘনিষ্ট বন্ধুদের দুএকজন হুমায়ূন আহমেদের কাছে নিয়মিত যেতেন। আমারও যে দু'একবার তার বাসায় বা নূহাশ পল্লীতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তা নয়। এক ধরনের আড়ষ্টতা বারবারই বাধা দিয়েছে। বিশেষ আগ্রহও হয়নি।

হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ট লোকদের সূত্রে তো আমরা জানিই, তিনি কেমন, কী করেন, আড্ডায় কেমন, কীভাবে হাস্যপরিহাস করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের খবরও তো অজানা নয়। শুধু লেখকদের বেলাতেই নয়- মানুষের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে আমার বিরাগ আছে। বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে মিশে জেনেছি, মানুষকে দুই প্রকারে ভালোবাসা যায়। এক, দূর থেকে।

যেভাবে আমরা সেলিব্রেটিদের ভালোবাসি। দুই, খুব, একেবারে কাছে গিয়ে। যতটা কাছে গেলে ব্যক্তি মানুষের পাপ-অপরাধের ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। মানুষকে ভালোবাসার তৃতীয় কোন পথ নাই। অল্প কাছে গিয়ে লাভ নেই।

অল্প কথা বলে কিছু বোঝা যায় না। বরং একজন লেখকের ক্ষেত্রে লেখা যতটা তাকে জানতে সাহায্য করে ততোটা আর কিছুই করে না। এ উপলদ্ধি অবশ্য সর্বসাম্প্রতিক। কিছুদিন আগ পর্যন্ত, বলতে গেলে বরাবরই, হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে একটা অশ্রদ্ধা ও অনাস্থা পোষণ করে এসেছি আমি। বই মেলায় দেখেছি, পুলিশ প্রহরায় তিনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লাইনে দাঁড়ানো শত শত নারী-পুরুষকে।

একবার উঁকি দিয়ে দেখার দরকার মনে করিনি। ভেবেছি, বাজারি সাহিত্যের বেচাবিক্রি চলছে। যেন গর্হিত কোনো অপরাধ হচ্ছে। চেয়ে দেখাও পাপ। আসলেই কি বই বিক্রি হওয়া লেখকের জন্য পাপ? কোথা থেকে আমার মাথায় এমন ভাবনা এসেছিল? ফিরে দেখি।

দেখতে পাই, এক ধরনের নিমবুদ্ধিজীবীতা আমাকে গ্রাস করেছিল। কিছু কিছু ভুল প্রচারণায় আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম- অল্প লেখেন যারা তারাই ভাল লেখক, বই বিক্রি কম হয় যাদের তারাই অবশ্যপাঠ্য, সহজ করে যারা বলতে পারেন তারা আসলে ছেলেভুলানো লেখা লেখেন। মনে আছে, কলেজে থাকতে কেমন একটার পর একটা বই পড়েছি তার। নন্দিত নরকে থেকে শ্রাবণ মেঘের দিন পর্যন্ত। তারপর বুদ্ধিজীবীতার আঁচ লাগলো- অন্যলোকদের নকল করে আমরাও বলতে থাকলাম, হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছেন, নতুন কিছুই দিতে পারছেন।

আর তার গল্পে সেই গভীর অনুসন্ধান, আবিষ্কার কোথায়? মধ্যবিত্তের পিঠ চাপড়ে দিয়ে আর কতদিন? মধ্যবিত্তের পিঠ চাপড়ালে আমরা কতই না অখুশী। আর কেউ যদি নিম্নবিত্তের পিঠ চাপড়ে দেয় তো তার মূর্তি বানিয়ে রীতিমতো চৌরাস্তায় বসানোর ব্যবস্থা করতেও রাজি আমরা। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আমার নিমবুদ্ধিজীবীতার অন্ত ঘটে বলতে গেলে ফরহাদ মজহারের হস্তক্ষেপে। আমার দেখা সবচেয়ে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিটির মুখে যখন হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে উচ্ছসিত মন্তব্য শুনে ফেললাম, মনে হলো, আবার পড়ে দেখি তো। সেই পড়াটা এখনও চলছে।

প্রথমে মুগ্ধতা, পরে অনাস্থা এবং এখন বিচার-বিশ্লেষণ। শুরুর মুগ্ধতাই তো ফিরে এলো। এখন অবশ্য আমি বুদ্ধিজীবীর চাইতে লেখক বেশি। একজন লেখক যখন অন্য আরেক লেখকের বই পড়েন তখন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যান। আবার পাতা ওল্টান।

বইয়ের বাধাই দেখেন। কভার খুলে দেখেন। পারলে সেলাইটা পর্যন্ত দেখে নেন। কীভাবে একটা উপন্যাস তৈরি হয়। কীভাবে এমন একটা উপন্যাস তৈরি হয় যা পড়া শুরু করলে শেষ না করে আর ওঠা যায় না? সেই বইটার বাধাই কেমন হয়? ভাষার গাঁথুনি কেমন হয়? কীভাবে বললে লোকে লেখা শেষ না করে উঠতে পারে না? আমি খোয়াবনামার মতো ঢাউস উপন্যাস, তিস্তাপুরাণের মতো জটিল গল্প একটানে পড়েছি।

দেখেছি অধিকাংশ উপন্যাস শেষ হয় ফজরের আজানের সময়। মার্কেসের হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুডের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মার্কেসে সব লেখার ব্যাপারেই তাই ঘটেছে। সারামাগোর উপন্যাসের বেলায় ভিন্ন কিছু ঘটেনি। এমনকি তলস্তয়, দস্তয়েভস্কির বেলাতেও।

তাহলে কে শেখালো যে দুষ্পাঠ্য রচনাগুলো ভাল? দুষ্পাঠ্য বই কি কেউ পড়ে আসলে? আমি নিজে অনেক বই হাতে নিয়ে কিছুদূর পড়ে ইস্তফা দেই। এই ক্ল্যাসিক লইয়া আমি কী করিব? ইহার স্থান পাঠকের মনে নয়, সাহিত্য সমালোচকের নোটবুকে। অনেকটা সময় তো গেছে, কিছু বুদ্ধি হয়েছে, কিছু বোধ হয়েছে। এখনও হুমায়ূন আহমেদের বই শুরু করে শেষ করতে হয়। শুধু আমি নই- বহু বিদগ্ধ ও ঘাঘু ব্যক্তিকে তিনি নিমেষে পাঠক বনতে বাধ্য করতে পারেন।

(পারতেন হবে)। কোন গুণে সেটি সম্ভব সেটা এখনও কেউ জেনেছে বলে আমি জানি না। লিখে গল্প বলা কঠিন কাজ। পুরো পৃথিবীতেই খুব কম লেখক লিখে গল্প বলতে পারেন। অধিকাংশই লিখে লেখেন।

তাদের মুখের ভাষা এক, ভাবনার ভাষা এক, তাদের সময়ের ভাষা এক, লেখার ভাষা আরেক। প্রজন্মের একটা ভাষাভঙ্গি থাকে, কমিউনিকেশনের একটা রীতি থাকে, ঐকতানের একটা সুর থাকে। সেটা সবাই ধরতে পারেন না। যিনি ধরতে পারেন, তিনি সমকালীন হন। বাকীদের মহাকালে রায়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়।

হুমায়ূন আহমেদ সমকালীন হয়েছেন। আর কী কী হয়েছেন সেটা তো সবাই জানে। মহাকাল কী রায় দেয় সেটা দেখার ভাগ্য আমাদের হবে না। সমালোচনা একটাই। সে সমালোচনা করে এখন লাভ নেই।

এক লেখক বন্ধুকে বলেছিলাম, এত ভাল লেখেন। নিয়মিত লেখেন, বড় ক্যানভাসে কাজ করেন। বন্ধুটি বললো, এইভাবে বলো না। ধরে নাও, যা লিখছি এর বেশি ক্ষমতা আমার নেই। তুমি বলবে, আমার অমুক গল্প ভাল- ওইরকম আর লিখছি না কেন? আমি ওইভাবে ভাবি না।

আমি যেভাবে ইচ্ছা যা ইচ্ছা লিখবো। তুমি স্বাধীন। পারলে পছন্দ করো না পারলে নাই। হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন। বলা হয়ে থাকে, সিরাজুদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।

হুমায়ূন আহমেদই মনে হয় বাংলার শেষ স্বাধীন লেখক। লেখার ক্ষমতা ছিল, জনপ্রিয়তা ছিল। কাউকে তোয়াজ করার দরকার হয় নাই। অন্যেরাই নিজেদের প্রয়োজনে তাকে তোয়াজ করতো। তার কলমে নিজেদের নাম একবার দেখার জন্য হন্যে হয়ে থাকতো।

রাজা হুমায়ূনের দেয়াল নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। কত নিউজ হয়েছে। কত কথা। হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, একটি শব্দও বদলাবেন না। দেয়াল প্রকাশিত না হোক, তা-ই সই।

কাকে বা কাদের বলেছেন সেটা নিশ্চয়ই ক্রমে বের হয়ে আসবে। আমি শুধু খবরটা দিয়ে রাখলাম, যাচাইয়ের জন্য। কারা যেন লিখেছে, শান্তিতে মরে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ক্যান্সারের মৃত্যু কি শান্তিতে হয়? আমাদের বন্ধু বনানীদিকে দেখেছি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে গিয়েছেন। ব্লাড ক্যান্সার।

বোম্বেতে তার মৃত্যুর যে বিবরণ শুনেছি, তা এতই বেদনাদায়ক যে বর্ণনা অসম্ভব। আমার দাদি ক্যান্সারে মারা গেছেন। ক্যান্সারের রোগী যখন মৃত্যুপথযাত্রী হয় তখন তার কষ্ট দেখে নিকটাত্মীয়রা প্রার্থনা করেন যেন আল্লাহ তাকে নিজের কাছে টেনে নেন। অন্তর্জলীযাত্রার কথা সবাই জানেন। মুসলিমদের মধ্যে আছে খতমে জালালি বা খতমে শেফা।

মনে আছে,দাদি যখন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর- তখন আমরা প্রার্থনা করেছিলাম, হে আল্লাহ তার যদি হায়াত থাকে তবে তা তুমি তাকে দাও। আর যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে তুমি তাকে নিজের কাছে ডেকে নাও। আমাদের প্রিয় লেখক কি কম ভুগেছেন? জানি না। আমার চাচা আলেম মানুষ। উচ্চশিক্ষিত।

তিনি দাদির জানাজার দোয়ায় বলেছিলেন, যার ক্যান্সারে মৃত্যু হয় তিনি শহীদের মর্যাদা পান। নিজের মা বলেই তিনি এমন বলেছিলেন কি? নাকি সত্যিই এমন কিছু আছে? আমি জানি না। হুমায়ূন আহমেদ অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে দেখিয়ে গেলেন একজন স্বাধীন লেখকের জীবন কেমন হতে পারে। তার লেখা পাঠকরা পড়বে কি না জানি না। লেখকদের পড়তে হবে।

কেন পড়তে হবে তা এখন না বলে আগামীতে বলা যাবে। গুডবাই, মায়েস্ত্রো। আল বিদা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।