আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুয়েটে ভিসি পতনের আন্দোলন ও কিছু কথা

লেখার প্রথমেই যেটা জানিয়ে দিতে চাই তা হল, এই লেখার উদ্দেশ্য ভিসি-প্রোভিসি কিংবা শিক্ষক সমিতি কারোরই সমালোচনা কিংবা সমর্থন নয়। কাজেই কারো সপক্ষে বা বিপক্ষে জনমত তৈরি এ লেখার লক্ষ্য নয়। বরং এই লেখা বুয়েটের একজন ছাত্র হিসেবে, একজন শুভাকাংখী হিসেবে কিছু ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার গোছালো কিংবা অগোছালো সংকলন মাত্র। প্রাক-কথনঃ মূলত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, অন্যায্য উপায়ে পরীক্ষার ফল পরিবর্তন, ক্যাম্পাসে বিশৃংখলা তৈরীতে মদদ দান -এর মতো বেশ কিছু আলোচিত-সমালোচিত ও ভয়াবহ দূর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে ভিসি-প্রোভিসি’র পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক সমিতি এই আন্দোলনের ডাক দেয়। তারপর কয়েক ধাপে চলতে থাকে এই আন্দোলন।

কিন্তু ভিসি- প্রোভিসি কেউই সেই আন্দোলনে সাড়া না দিয়ে পদে বহাল থাকেন। এভাবে কোনোপ্রকার সফলতা ছাড়াই আন্দোলনে কয়েকবার ছেদ পরলেও চলতি টার্ম শুরুর পূর্বে সমিতি কর্তৃক আহুত একমাসব্যাপী ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশী সাড়া ফেলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী’র প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এবারও কোনোরকম চূড়ান্ত সাফল্য ব্যতিরেকেই ‘রেজিস্টারের ভূতাপেক্ষ নিয়োগ বাতিল’, ‘প্রশাসনের দূর্নীতি তদন্তে ৩সদস্যের কমিটি গঠন’ এর মতো কয়েকটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে একমাসের জন্য আন্দোলন স্থগিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিঃ গত ৭ জুলাই, ২০১২ থেকে প্রতিদিন ২ঘন্টা করে ক্লাসবর্জন ও অবস্থান ধর্মঘট এর মধ্য দিয়ে পুনরায় আন্দোলন শুরু হয়েছে। এছাড়া দাবি আদায় না হলে আগামী ১৪ জুলাই, ২০১২ থেকে লাগাতার ও সম্পূর্ণরূপে ক্লাসবর্জনের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।

এমতাবস্থায় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি উভয় পক্ষই শিক্ষার্থীদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে নিজ নিজ বক্তব্য সম্বলিত লিফলেট বিলি করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ দুপুর আনুমানিক ১২টায় শিক্ষক সমিতি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌথ অংশগ্রহণে একটি মৌন-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া মিছিল পরবর্তী সমাবেশ থেকে আগামী দিনও একই কর্মসূচী বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়। এছাড়া, এর আগে একটি সিনিয়র ব্যাচের পক্ষ থেকে শিক্ষকদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হবে বলে গুজব শোনা গেলেও ক্যাম্পাসে সে ধরণের কোনো পদক্ষেপ বা প্রচেষ্টাই পরিলক্ষিত হয় নি।

আমার ভাবনাঃ ** শিক্ষকেরা ক্লাস বর্জন করলে কি ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ করবেন? করলে কেন করবেন? তারা কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নিয়ে এতটাই চিন্তিত? তারা কি ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এতটাই ভালোবাসেন? কিন্তু তাহলে তারা ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ ও ইমেজ ধ্বংসকারী ভয়াবহ অপকর্ম কেন করলেন? যারা এত এত সব অপকর্ম করেন, যাদের সরকারে তথা প্রশাসনে এত এত খুঁটির জোর, যাদেরকে একমাসের ধর্মঘটেও পদত্যাগ করানো যায় না, তারা দৈনিক দুইঘণ্টার ক্লাসবর্জনে পদত্যাগ করবেন, এতটা কি আশা করা যায়? তাহলে এই ধর্মঘটে যদি কারো কিছু যায়-আসে তো সেটা কার বা কাদের? ** তদন্ত কমিটি নাকি বলেছে ভিসি-প্রোভিসি’র কোন দোষ নেই। অভিযোগ মিথ্যা। তাহলে, তারা কেন সেটা শিক্ষার্থীদেরকে বুঝাতে পারছে না, বিশ্বাস করাতে পারছে না? কেন তাদের গলাটা যথেষ্ট জোরালো নয়? কয়েকজন শিক্ষক তাদের ব্যক্তিগত রাজনীতি বা বিশ্বাসের কারণে তার বিরোধিতা করতেই পারে, কিন্ত বাকিরা? এত এত শিক্ষক, এত এত শিক্ষার্থী সবাই কি একসাথে ভুল বুঝছে? নাকি একমাত্র ‘তিনি ও তারা’ই বুঝতে পারছেন না কিংবা স্বীকার করতে চাচ্ছেন না? ** মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের হাফিজুল ইসলাম রানা স্যারের নামে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করার অভিযোগে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। বুয়েটের একজন শিক্ষককে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। এটা কি সমিতি কিংবা সিণ্ডিকেট কারো জন্যেই খুব একটা সুখকর কিছু হবে? রানা স্যার সমিতি’র আপ্যায়ন সম্পাদক।

কিন্তু আজ রানা স্যারের বিপদে শিক্ষক সমিতি’র কাউকেই কেন পাশে পাওয়া যাচ্ছে না? তিনি তো বুয়েটের স্বার্থে, সমিতি’র স্বার্থেই কথা বলেছেন, সিনিয়র স্যারেরা কি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারতেন না? পারতেন না তরুণ শিক্ষক, ভুল করে ফেলেছে বলে ব্যাপারটার একটা ক্ষমাসুন্দর সমাধান করতে? কেন আজ সবার স্বার্থে লড়াই করেও একজন মেধাবী শিক্ষককে বিরুদ্ধ স্রোতে নিঃসঙ্গ লড়াই করতে হচ্ছে? কেন ওয়ারেণ্ট প্রত্যাহার করানোর দাবিতে ভিসি’র কাছে যাওয়ার সময় কয়েকজন জুনিয়র শিক্ষক আর শিক্ষার্থী ব্যাতীত আর কাউকেই তার পাশে পাওয়া যায় নি? আন্দোলন মাঠের সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে এমন আচরণই কি তার প্রাপ্য ছিল? ** প্রথম তিনটা পয়েন্ট লেখার কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলাম, শিক্ষকদেরকে আর ধর্মঘট করার সুযোগ না দিয়ে উপাচার্য নিজেই ঈদের ছুটিকে এগিয়ে এনে কিংবা গ্রীষ্মের ছুটির আজুহাতে টানা ৪২ দিনের বন্ধ দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন তিনি এই কাজ করলেন? যেখানে শিক্ষকদের ক্রমাগত অসফল ধর্মঘটে কোনো প্রাপ্তি দেখতে না পেয়ে এবং একাডেমিকালি ক্ষতিগ্রস্থ হতে হতে ছাত্র-ছাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছিলো, তিনি কেন সেখানে নিজেই বন্ধ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সেই বিরক্তিকে নিজের দিকে টেনে নিলেন? কেন যারা এতদিন সাঁতে-পাঁচে নেই বলে গাঁ বাঁচাচ্ছিল, সেই শিক্ষার্থীগুলোকেও তাঁর বিপক্ষে নামতে উদ্বুদ্ধ করলেন? কে বা কারা তাঁকে এরকম একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে ইন্ধন দিলো? নাকি তিনি নিজেই নিলেন? ** আন্দোলনে শুরু থেকেই নিশ্চুপ থেকেও হটাৎ করে মুনাজ স্যার কেন ভিসি-প্রোভিসি’র পক্ষে সরব হয়ে উঠলেন? কেবল মাত্র একজন আওয়ামীলীগপন্থী শিক্ষক বলেই? কিন্তু তাহলে ২৪ জন একাডেমিক পদত্যাগী ডীন ও বিভাগীয় প্রধানদের মধ্যে থাকা ১৭জন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক কেন তাঁর সাথে না থেকে বিপক্ষে গেল? এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দলীয় ভূমিকা তাহলে কি? ** বলা হচ্ছে, এটা জামাত-হিযবুত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের আন্দোলন। তাহলে, সরকারদলীয় প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেজ ওসমান, জামিলুর রেজা চৌধুরী’র মতো দেশবরেণ্য ব্যাক্তিরা কেন আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করছেন? তারাও কি জামাত-হিযবুতপন্থী নাকি? ** বুয়েটে তো সাদা দল, নীল দল নেই। শিক্ষক রাজনীতিও নেই। তাহলে পদত্যাগকারী শিক্ষকদের কেন নিজেদেরকে আওয়ামীপন্থী বলে পরিচয় দিতে হচ্ছে কিংবা তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় পত্রিকা’তে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে? ** প্রথম দফা পদত্যাগের সময় একই আবেদনপত্রে পদত্যাগ করায় সেটি গৃহীত হয় নি এবং বলা হয়েছে, যারাই পদত্যাগ করতে চাইবে তাদেরকে পৃথক পৃথক আবেদনপত্রে আবেদন করতে হবে।

সেই অনুযায়ী পদত্যাগে এখন পর্যন্ত ৩৫৬জন শিক্ষক নিজেদের সম্মতি জানিয়ে সাক্ষর করেছেন। বলা হয়েছিল, রবিবারের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেলে শিক্ষকেরা গণপদত্যাগ করবেন। কিন্তু তার একদিন আগেই আজ হটাৎ কি এমন হলো যে, পরবর্তী আলটিমেটাম ব্যাতীতই পদত্যাগ স্থগিত করে দিতে হলো? এর মানে কি আমাদের শিক্ষকদের পদত্যাগ করার মতো গাটস নেই? নাকি যারা প্রধানমন্ত্রীর আহবানেও আলোচনায় বসতে রাজী হন নি, তারা হটাৎ করেই জামিলুর রেজা চৌধুরী’র আহবানে নমনীয় হয়ে গেলেন? শুনেছিলাম, জামিলুর রেজা চৌধুরী নাকি শিক্ষামন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ প্রশ্ন জাগছে, জামিলুর রেজা চৌধুরী কি প্রধানমন্ত্রী’র চেয়েও ক্ষমতাবান ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলেন নাকি? পরিশেষেঃ বুয়েটে এমনিতেই সেশনজটের কোনো শেষ নেই। তার মধ্যে চলমান আন্দোলন সেই পরিস্থিতি করে তুলেছে আরো বেশী দুর্বিষহ।

এমতাবস্থায়, এই ধাপে ধাপের, ধীরে চলো নীতির আন্দোলন আর কত? এবার একটা ‘হয় এস্পার, নয় ওস্পার’ অবস্থাই কি কাম্য নয়? তাই পূরণ হোক বা না হোক, আশা করে যাই, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রশাসন সবাইকেই এই ব্যাপারটা অতিসত্ত্বর অনুধাবনের ‘তাওফিক’ খোদা-তা’লা দান করবেন। বুয়েটের পরবর্তী ভিসি হচ্ছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল! ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.