আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজিমপুর কবরস্থানে সচিবের কবর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না

খবরে ধান্দাবাজি ঢাকায় একেবারেই নতুন। থাকি লালবাগ ভাট মসজিদের পাশে। ভাট মসজিদকে লোকজন বলে বাটা মসজিদ। আজিমপুর কবরস্থানের পাশ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি। এ পথে প্রায়ই লাশ দেখা যায়।

আজিমপুর, লালবাগ, নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগে কেউ মারা গেলে খাটিয়া কাঁধে করেই লাশ আনা হয়। দূরের এলাকা থেকে কবরস্থানে লাশ আনা হয় ট্রাকে। মৃত্যুর কোনো শুক্র-শনি নাই। যেকোনো সময় মানুষ মারা যেতে পারে, তেমনি লাশও আসে যখন-তখন। রাতে অবশ্য কম দেখা যায়।

লোকজন আসে, লাশ মাটি দেয়, চলে যায়। কেউ কাঁদে। কেউ চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। প্রথম যেদিন ঢাকায় আসি সেদিন টেম্পুর ভিতর থেকে কবরস্থান দেখে মনে হয়েছিল কোনো পার্ক হবে। টেম্পুর ভিতর অল্প ফাঁক দিয়ে দেখলাম চারপাশে উঁচু দেওয়াল।

ভিতরে ফুলের বাগান এবং বড় বড় গাছ। পরে সাইনবোর্ড দেখে তো চোখ ছানাবড়া। নিউমার্কেটে একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করি। লোকজন বলে, কবরস্থানের ভিতরের রাস্তা দিয়ে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়। প্রথম কয়েকদিন ভয়ে ভয়েই যাইনি।

একদিন প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে গেলাম কবরস্থানের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। মাঝবরাবর বড় একটা রাস্তা। আড়াআড়ি বেশ কয়েকটি ছোটো রাস্তাও আছে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। একেবারেই কোলাহল মুক্ত।

আমার বেশ ভালো লাগলো। ঢাকা শহরের পার্কগুলোর চেয়েও শান্ত। আম, নারকেল, ইউক্যালিপটাস ও মেহগনি গাছে ঢাকা পুরো এলাকা। এছাড়া রয়েছে বড় ঘাস ও নানা জাতের ফুল গাছ। কবরস্থানের মূলগেটের পাশেই কাফনের কাপড়ের একটা দোকান।

দোকানের নাম শেষ বিদায় স্টোর। নাম দেখেই কেমন ভয় ভয় লাগে। এসব দোকানে দাফনের প্রায় সবকিছু পাওয়া যায়। কাফনের কাপড়, বাকসো, বাঁশের চাটাই, আতর, লোবান, সুরমা, কর্পুর, গোলাপজল, সাবান ইত্যাদি। এসব দেখে আমার ছোটো বেলার কথা মনে পড়লো।

কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম, কোথায় যাব এই ভাবনাটা বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা জাগালো। ছোটোবেলায় আমাদের অবস্থা ছিল বেশ স্বচ্ছল। বাজারের সবচেয়ে বড় থান কাপড়ের দোকান ছিল আমাদের। এক নামে আমার বাবাকে সবাই চিনতো। এ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ ছিল না।

তবে ভাইবোনদের মধ্যে এ নিয়ে আমাদের একটা দুঃখ ছিল। দুঃখটা হলো বাবা ছিলেন ভীষণ কৃপণ। আমরা ভালো কাপড় দিয়ে জামা বানাতে পাড়তাম না। সবসময় বিক্রি করার পর যে টুকরো কাপড় বাচতো তাই দিয়ে আমাদের জামা বানাতে হতো। এমনও হয়েছে শার্ট বানানো হয়েছে তিন রকমের কাপড় দিয়ে।

হাতা এক কাপড়ের, বডি এক কাপড়ের আর কলার অন্য এক কাপড়ের। আমাদের দোকানের কাপড় বিক্রি হতো সবচেয়ে বেশি। মানুষ মারা গেলেই এলাকার লোকজন আমাদের দোকানে কাপড় কিনতে আসতো। আমার বাবা কাফনের কাপড় বিক্রির পর তা কেটে দিতে পারতেন। মৃতের শরীরে কাপড় পরানোর জন্য পোষাকটা তৈরি করতে হয়।

তা তৈরির একটা কৌশল আছে। ইসলাম ধর্ম মতে, পুরুষের হলো তিনটি আর নারীদের পাঁচটি কাপড় পড়াতে হয়। লোকজন আমাদের দোকান থেকে কাপড় কিনে তা কেটে সেলাই করে নিয়ে যেতে পারতো। এতে এলাকার মধ্যে মোটামুটি সবাই জেনে গেল যে, ওই দোকান থেকে কাপড় কিনলে ঝামেলা কম হয়। কারণ, অন্য দোকান থেকে কাপড় কিনে তা বাসায় নিতে হতো।

মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে (যিনি কাফনের কাপড় কাটা জানেন) ডেকে এনে কাপড় কাটতে হতো। এরপর তা সেলাই করার জন্য আবার বাজারে যেতে হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলে তো ঝামেলা আরো বেশি। তাই আমাদের থানা এলাকায় কেউ মারা গেলে আমরা খবর পেতাম। আমি ছোটোবেলা থেকেই দোকানে থাকতাম।

একটু বড় হওয়ার পর আমিও কাফনের কাপড় কাটা শিখে গেলাম। একসময় লোকজনের সুবিধার জন্য রাতে দোকানে থাকা শুরু করলাম। লোকজন মধ্যরাত বা শেষরাতে আসতো কাপড় কিনতে। আমি নারী-পুরুষ ও বয়স জেনে আনুমানিক হিসেব করে কাপড় কেটে দিতাম। অনেককে বলে দিতাম, কীভাবে তা সেলাই করতে হবে।

লোকজন জিজ্ঞেস করতো, আর কী কী লাগবে। তাদেরকে বুঝিয়ে দিতাম, আতর, লোবান, গোলাপজল, সাবান, কর্পুর, কাঠের বাকসো অথবা বাঁশের চাটাই ইত্যাদি লাগবে। এর বাইরে ফালি করা কিছু বাঁশ লাগবে। অনেক রাতে ওই সব কেনা লোকজনের জন্য কষ্টকর। শেষে আমরাই সব গুছিয়ে রাখতাম।

অনেকটা শেষ বিদায় স্টোরের মতো। একরাতের কথা বলি। তখন বর্ষাকাল। সারা দিন বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে দোকানে গিয়ে বসে আছি।

বাবা দোকান বন্ধ করবেন। এর মধ্যে এক বুড়ো এলেন। চুল-দাঁড়ি পেকে গেছে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি। মাথায় লাল পাগড়ি।

উনি এসেছেন মার্কিন (কম দামের কাফনের কাপড়) কিনতে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে মারা গেছে?’ উনি সরাসরি কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। বাবা অনেক জোড়াজুড়ি করলেন। কিন্তু লোকটা কিছুই বলছে না। শেষে বাবা বললেন, ‘আপনি কাপড় দিয়ে কী করবেন তা না বললে আপনার কাছে কাপড় বিক্রি করবো না।

’ লোকটা তখন যা জানালো তা শুনে আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। লোকটার কাছে ছিল একটা ব্যাগ। ব্যাগটা তিনি কোলের মধ্যে নিয়ে কথা বলছিলেন। সিমেন্টের বস্তা কেটে বানানো ওই ব্যাগে একটা মানুষের মাথার খুলি। উনি ওই খুলিটা কিছুক্ষণ আগে কোনো কবর থেকে তুলে এনেছেন।

ওই রাতটা ছিল অমাবশ্যা। তিনি সেটা নিয়ে রাতে সাধনা করবেন। বাবা কোনো কথা না বলে তাকে কাপড় কেটে দিলেন। লোকটা চলে গেল। বাবাও দোকান বন্ধ করে চলে গেলেন।

আমি রাতে ভয়ে ভয়ে শুয়ে আছি। কখন ঘুমিয়েছি জানিনা। হঠাৎ বাইরে ডাকাডাকির শব্দ শুনতে পেলাম। একদিকে অমাবশ্যা অন্যদিকে টানা বৃষ্টি। আশপাশে কোথাও বাড়ি নেই।

বাজারে এক নাইটগার্ড ছাড়া কোনো মানুষের থাকার কথা নয়। কান খাড়া করে শুনলাম নাইটগার্ড হাসেম মিয়া আমার নাম ধরে ডাকছেন। আমি উঠলাম। উঠে দেখলাম একজন যুবক। সোহাগপুর চর থেকে এসেছেন।

মুকুন্দগাঁতী বাজার থেকে সোহাগপুর চর প্রায় চার-পাঁচ মাইল পথ। মাঝখানে যমুনা নদীও পার হতে হয়েছে। পুরো পথ তিনি হেঁটে এসেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে মারা গেছে?’ যুবক জানালেন, তার একটি মৃত সন্তান হয়েছে। তাকে দাফন করার জন্য তিনি কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন।

তিনি প্রথমে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরে বাড়ি থেকে বলা হয়েছে, দোকানের ভিতরে লোক আছে। নাইটগার্ডকে দিয়ে তাকে ডাকতে হবে। আমি তাকে জানালাম, মৃত সন্তানের দাফনের প্রয়োজন নাই। তাকে বাড়ির আঙিনা বা অন্য কোথাও পুঁতে রাখাই নিয়ম।

এ কথা শুনে যুবকের মুখ শুকিয়ে গেল। যুবক জানালেন, তার প্রথম সন্তান। কবরস্থানে পানি উঠেছে। তিন গ্রাম দূরে একটা উঁচু কবরস্থান আছে। তিনি ভেবেছেন, সেখানে কবরস্থ করবেন।

আমি বললাম, ‘সন্তান যদি জন্মের পর চিৎকার না দেয় তাকে দাফন করার নিয়ম নেই। ইমাম সাহেবরা তো এই নিয়মের বাইরে যাবেন না। ’ যুবক ফিরে গেলেন। সেই রাতে আমি আর ঘুমাতে পারিনি। আজিমপুর কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।

কবরস্থানের দ্বিতীয় গেটের সামনে অনেকগুলো প্রাইভেট কার দাঁড় করানো। পাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছে। পোষাক দেখে মনে হচ্ছে এরা উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। রাস্তার পাশে কাঁদার মতো কোনো কিছু এদের জীবনে সাধারণত ঘটে না। তারপরও কাঁদছে।

আশপাশে মানুষজন জমে গেছে। ছোটোখাটো একটা জটলা। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, কী হইছে?’ লোকটা বললো, ‘আর কি অইবো, কবর খুঁইজা পাইতাছে না। ’ কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। কোনোদিন তো এমন আজব কথা শুনি নাই।

গ্রামে থাকতেও কোনোদিন এমন কথা শুনি নাই। কবর খুঁজে পাওয়া যাবে না কেন? লোকটাকে বললাম, ‘ভাই ব্যপারটা কী বলেন তো?’ লোকটা বিরক্ত ভাব নিয়ে বললো, ‘আরে মিয়া ঢাকায় নতুননি? জানেন না বুঝি! কবর চুরি হয়। আত্মীয়-স্বজন কবর দিয়া যাইবেন। এক বছর পর আইয়া দেখবেন কবর নাই। হাওয়া হইয়া গেছে।

’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম। লোকটা বলে কি! কবর চুরি হয়! তারপর যা শুনলাম তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। বছর দশেক আগে একজন সচিব মারা গেছেন। তাকে ভিআইপি সারিতে কবর দেওয়া হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা কেউ দেশে থাকে না।

বড় ছেলে লন্ডন। ছোটটি কানাডা। একটিমাত্র মেয়ে থাকে সিডনি। দুই ভাই বউ-বাচ্চা নিয়ে দশ বছর পর দেশে এসেছেন বাবার কবর দেখার জন্য। কবরটি দেখে জিয়ারত করবেন এই ছিল আশা।

কিন্তু কিছুতেই কবর খুঁজে পাচ্ছেন না। কর্তৃপক্ষ বলেছে, নির্দিষ্ট কবরটি কোথায় সেটি তারা সনাক্ত করতে পারছেন না। এদিকে কবরস্থানের শ্রমিকরা বলছে, ‘কবর চুরি হয়া গেছে। ’ প্রবাসীরা বুঝতে পারছে না, কবর চুরি বলতে লাশ চুরি বোঝাচ্ছে কিনা। শেষে একজন কবরশ্রমিক এসে তাদের বোঝালো যে, দেড়-দুই বছর পর লাশ মোটামুটি মিশে যায়।

বাকি যে হাড়গোড় থাকে সেগুলো সরিয়ে ওই কবরে নতুন কাউকে দাফন করাটা হল কবর চুরি। এটা ভিআইপিদের ক্ষেত্রে সাধারণত হয় না। তারপরও ভিআইপিদের আত্মীয়-স্বজনরা শবে বরাত, ঈদ, জন্মদিন, মৃত্যুদিনে না এলে দুই-তিন কি পাঁচ বছর পর নতুন ভিআইপিকে সেখানে কবর দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের কবর এক-দুই বছর পরই চুরি হয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.