আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হয়তো তোমারই জন্য (সমাপ্ত)

সারাটা পথ ও কোন কথা বলেনি। চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষন পরেই প্লেনটা ল্যান্ড করবে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমার দেশের আকাশের রঙটাও এত সুন্দর, কেমন যেন আপন আপন লাগে।

নাকি দিপ্রা পাশে আছে বলে এমন মনে হচ্ছে। - দ্যাখো, সকালটা কি সুন্দর, তাই না? ..কোন কথা বলছেনা। আমি আবার প্রশ্ন করলাম - কি শরীর খারাপ লাগছে? তবুও কথা বলছেনা। বুঝলাম ও এখন কিছু বলতে চাচ্ছে না । কি আর করার, কথা আর বাড়ালাম না।

অনেকটা সময় পর বলল - তুমি কি দায়বদ্ধতা থেকে এই ডিসিশন নিয়েছো? - দিপ্রা তুমি ওভাবে নিচ্ছ কেন, যে ব্যাপারটা ছয় মাস পরে ঘটতো সেটা এখন হলেতো ক্ষতি নেই,তাই না? ছাদের দোলনাতে দোল খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি আমার সহধর্মীনি মানে দিপ্রার জন্য। কারন ওর অনেকদিনের স্বপ্ন বিয়ের রাতে ছাদে বসে জোৎস্না দেখবে। বিয়েতো দেশে যেদিন ফিরেছি সেদিনই করেছি আজ ফ্যামিলি থেকে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করল। সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা কাজী অফিস। দিপ্রার জন্য এটা একটা সারপ্রাইজ ছিল।

বলল- এভাবে কেমন হয়, তুমি কিছু লাল গোলাপ নিয়ে আসো। ..যা বলেছে তা তো করতেই হবে। বের হলাম লাল গোলাপের খোঁজে। কাছেই পাওয়া গেল। তারপর বিয়ের সব ফরমালিটিস শেষ করে বের হলাম।

- এবার চল বাসায় যাওয়া যাক। - কোন বাসায়? আমি বললাম - আমাদের বাসায় আমি , তোমাদের বাসায় তুমি। বাবা- মাকে বলে রেখো রাতে আমি আম্মা আর ভাইয়া - ভাবীকে নিয়ে আসব। - না আমি এখন বাসায় যাবনা। - কোথায় যাবে? - রিক্সা করে ঘুড়বো।

দেখোনা আকাশটা কেমন সুন্দর মেঘলা করেছে। সারাদিন ঘুড়ে সন্ধ্যায় বাসায় যাব। .... কি আর করার । আবার পাগলামো শুরু হয়েছে। রিক্সা ভ্রমন করলাম।

তবে ভালই লেগেছিল। - কি ঘুমাচ্ছে নাকি? - তুমি কখন এলে? - এইতো এলাম, আজ পূর্নিমা বেশ লাগছে না, তাই না? - হুম্ - গান ছাড়া কেমন যেন অপূর্নতা থেকে যাচ্ছে বলে মোবাইলে খুঁজতে শুরু করেছে। ... জোছনায় আলোকিত চারদিক, মাথার উপর রুপোর থালির মতন চাঁদ, আমার কাধেঁ দিপ্রা মাথা রেখে গুন গুন করছে যেটা ও ব্যাকগ্রাউন্ডে দিয়েছে - এই মধু রাত শুধু ফুল পাপিয়ার এ মায়া রাত শুধু তোমার আমার... অন্যরকম লাগছে পরিবেশটা যেন স্বপ্ন স্বপ্ন। আমি খুউব ধীরে ধীরে বললাম - আমার জীবনে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। - থাক আর ঢং করতে হবে না।

তুমি তোমার মতনই থাকো। তার থেকে বল - কি যে করনা , এখানে মশা ধরেছে, চল নীচে যাই। ওর কথায় দুজনেই হাসতে লাগলাম। সময় খুউব দ্রুত বয়ে যায়। এইতো মনে হল সেদিনের কথা অথচ দেখতে দেখতে নয় মাসেরও বেশী পার হয়ে গেছে।

আমি এখানে সেটেল হয়েছি। দিপ্রা গুছিয়ে নিয়েছে ওর সংসার। আমরা যৌথ পরিবারে থাকি। বিয়ের পর মা অবশ্য বলেছিলেন যে, আমরা ইচ্ছে করলে আলাদা বাসায় উঠতে পারি। সিদ্ধান্তটা আমি দিপ্রার উপড় ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কারন, ও ছোট পরিবারে মানুষ আমাদের এই কোলাহলের মধ্যে থাকতে পারবে কিনা। জানতে চাইলে বলেছিল - এখন যদি আমি নিজের সুখের কথা চিন্তা করে তোমাকে তোমার ফ্যামিলি থেকে দূরে রাখি ঠিক একদিন আমার সন্তানরাও তাই করবে। এটা আমি চাই না। বাসার ছোট বড় সবাই ওর উপড় নির্ভরশীল। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই - জীবনে কি এমন ভাল কাজ করেছিলাম যার জন্য বিধাতা আমাকে দিপ্রা উপহাড় দিয়েছেন! বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি আর ভাবছি এসব।

কখন যে দিপ্রা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। - কি করছো এখানে। - কিছুনা বৃষ্টি দেখছিলাম । আজ সারাদিন ঝড়ছে থামার কোন নাম নেই। আম্মা কি শুয়ে পড়েছেন।

- হুম। - চল তুমিও ঘুমিয়ে পড়। - এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। - দিপ্রা ছেলে মানুষি করোনা । চল আমি ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি।

ও বাধ্য মেয়ের মতন শুয়ে পড়ল। বুঝলাম শরীরটা বোধ হয় ভাল নেই যার কারনে জেদ করলো না। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি এর মধ্যে বলে উঠল - আচ্ছা মেঘার চোখটা কার মতন হবে? - তোমার মতন। - না, আমি চাই তোমার মতন হোক। - ঠিক আছে, তুমি যখন চাইছো তাই হবে।

আমি আর রাগালাম না ওকে। অনেকক্ষন কোন কথা নেই। চোখ বন্ধ করে আছে। আমি টেবিল ল্যাম্পটার নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু তন্দ্রার মতন এসেছে।

- এ্যাই কথন, শুনতে পাচ্ছ? আমি ভয়ে হুর মুর করে উঠলাম। - কি হলো শরীর খারাপ করছে? - না? - তা হলে কি, ঘুম আসছে না? - না। মেঘা বলছে বাইরে যাবে। - মানে এতো রাতে! - হুম্ , তা না হলে ও কান্না করবে। - ওকে বল কাঁদলেও লাভ হবে না, বাev নিবে না।

- প্লীজ এমন করোনা । ও ছোট মানুষ , মন খারাপ করেবে। আমি উঠে বসলাম - দিপ্রা এতো রাতে ছেলেমানুষি করোনা । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা পিচ্ছিল। ঘুমাও কাল বিকেলে বের হব।

কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম ও ঘুমায়নি, কাঁদছে। কি আর করার। বললাম - উঠ , আম্মা যেন টের না পান, তাহলে বের হওয়া যাবেনা। শহরটা নিশ্চুপ। রাস্তায় তেমন কোন মানুষ জন নেই বললেই চলে।

ঝির ঝির বৃষ্টি হচ্ছে। কেমন যেন নিস্তব্ধতা চারপাশে। ও জানালা খুলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোটাগুলো ভেতরে আসছে। - দিপ্রা জানালা বন্ধ কর, বৃষ্টিতে ঠান্ডা লেগে যাবে।

- আর একটু। - না, অনেক হয়েছে এবার বন্ধ কর তা না হলে এখনই ফিরে যাব। - ঠিক আছে করছি, এবার হলো - হুম্ , গুড। - হাই ওয়েতে চলনা , বেশ লাগবে। - না, এতো রাতে যাওয়া ঠিক হবে না, তাছাড়া ওয়েদার ভাল না।

- কিছু দূর গিয়ে না হয় ব্যাক করবো, প্লীজজজ। ...কি আর করার আগাতে লাগলাম। - আমার না এখন ঐ গানটা শুনতে ইচ্ছে করছে - কোনটা? - লিরিকস ঠিক মনে নেই ..তুমিহীনা সব কিছু বড় নিস্প্রান, স্মৃতি ঘেরা বেদনার বালুচর,গতকাল রাতের কান্নাতে ভেঙ্গে গেছে স্বপ্নে বাঁধা ঘর। - হুম, শুনেছি বোধ হয়। কিন্তু এখন তো নেই।

- শোন, মেঘাকে কিন্তু গান শেখাব। যাতে করে ওর লাইফে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য আইপডের হেল্প নিতে না হয়। ..বলেই হাসতে লাগল। সেই রিনি- ঝিনি হাসি। কেমন ভারী হয়ে গেছে শরীরটা , ডাক্তার অবশ্য বলেছে - এসময় এমনই হয় , টেনশন করার কিছু নেই।

সব নরমাল আছে। তবুও আমার ভয় লাগে কারন ও নিজের যত্ন একে বারে নেয় না। কত করে বললাম ওর মার ওখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসতে। কিন্তু আমার কষ্ট হবে দেখে যাবেনা। পাগল কে বোঝায়! - কথন সামনে বাস।

..দিপ্রার চিৎকারে দেখলাম একটা যাত্রীবাহি দূর পাল্লার বাস। সাইড দিতে গিয়ে পারলাম না, দেরী হয়ে গেছে। অবশেষে পনেরদিন মরনের সাথে লড়াই করে বেঁচে উঠলাম। সবাইকে দেখতে পেলাম কিন্তু দিপ্রা আসেনি। বাসার সবাই বলল যে,দিপ্রা বাসায়, অসু্স্হ্য তাই আসতে পারছেনা।

কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না কারন ও যতই অসুস্হ্য হোক না কেন ওকে কেউ বেঁধে রাখতে পারবেনা, আমার কাছে আসবেই। বাসায় যাবার জন্য আমি মরিয়া হয়ে গেলাম, মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছিল। তারও দশদিন পরে আমাকে রিলিজ করা হলো। এরই মধ্যে আমি জেনে গেছি-দিপ্রা নেই। সেদিন ডাক্তার একজনকে বাঁচাতে পারবে বলেছিল।

দিপ্রা ডাক্তারকে কারও অনুমতি নিতে দেয়নি। নিজেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে , মেয়েকে বাঁচাতে বলেছে। মাঝে তিনটি বছর কেটে গেছে। দিপ্রা চলে যাবার পর আমি বাইরে চলে যাই। কিন্তু ওখানে গিয়েও একফোঁটা শান্তি পাই নি।

চারপাশে দিপ্রার হাতের ছোঁয়া। আয়নায় নিজেকে দেখলেও মনে হয় এও দিপ্রার দেয়া। আজকের আমিতো দিপ্রারই সৃষ্টি। হঠাৎ করে ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ে গেল। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী।

মনে পড়ে সেদিনের কথা। দিপ্রা, তুমি কোথায়? একটি বারের জন্য কি ফিরে আসবে। আমি তোমাকে তোমার মতন করে ভালবাসব। একটুও কষ্ট দিবনা। তুমি যা বলবে তাই করব, শুধু একবার ফিরে আসো।

তোমাকে ছাড়া আমি ভাল নেই, এ জীবনে ভাল থাকা আর হবে না। কি করে পার‡j তুমি এতোটা স্বার্থপর হতে! তোমাকে কত কথা বলার ছিল। মনে আছে দিপ্রা তোমাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম - আমাকে তুমি এতো ভালবাস কেন? তুমি বলেছিলে - তোমাকে ভালবাসলে আমি ভাল থাকি। ..আমিও ভাল থাকতে চাই দিপ্রা। তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি দিপ্রা।

তোমার জন্য হেরে গলায় গাইব - হয়তো তোমারই জন্য - গানটা। তবুও তুমি আসো। - কথন কাঁদছো কেন? ফিরে তাকালাম। মেঘা। আমার মেয়ে।

ওর এই নামটা আমার পছন্দের একটা নাম। পরিচয়ের শুরুতে দিপ্রাকে বলেছিলাম। ও মনে রেখেছে। সব সময় বলতো -দেখো মেঘা একদিন পৃথিবীতে সত্যি সত্যি আসবে। হ্যাঁ ,মেঘা পৃথিবীতে এসেছে।

দিপ্রা নিজের বিনিময়ে আমাকে মেঘা দিয়েছে! অথচ সেই মেঘার মুখ আমি আজ প্রথম দেখছি। এতোদিন এই শিশুটিকে আমি দেখিনি। কেবলই মনে হতো ওর জন্যই আমি দিপ্রাকে হারিয়েছি। জানি, ওর কোন দোষ নেই এতে। - কি হলো কথা বলছো না কেন, মা'র জন্য মন খারাপ? আমি ওকে দেখছি।

সেই রেশমী চুল, সরু নাক, অদ্ভুত সুন্দর গায়ের রং। এ যেন দিপ্রার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ওর চোখটা হয়েছে আমার মতন। না, আমি চাইনা আরও একটি দিপ্রা আসুক এই পৃথিবীতে, যাকে আমার মতন কোন এক কথন মূল্যায়ন করতে পারবেনা, না বুঝে শুধু কষ্ট দিবে। আমি ওকে আমার মতন করে গড়ে তুলব।

কোলে তুলে নিলাম ওকে। - কথন নয় বাবা বল - সবাই যে কথন বলে - বলুক , তুমি বাবা বলবে, কেমন? মাথা দুলালো , ঠিক দিপ্রার মতন। আমার ভেতরটা হু হু করে উঠছে। বুকের সাথে চেপে ধরলাম ওকে। কে জানে কতটুকু পারব! প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর ।

হয়তো দেখা যাবে আমার দৃষ্টির আড়ালেই মেঘার মধ্যে দিয়ে আরও একটি দিপ্রা বেড়ে উঠবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।