আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হয়তো

‘মনে হয়’ ‘হয়তো’ কিংবা ‘আমার ধারণা’ এসব দিয়ে আমরা কিন্তু বেশ মজায় দিন কাটাই। কোন দ্বায়িত্ব নেয়ার বালাই নেই, মিথ্যে প্রমাণিত হলেও নেই কোন শাস্তি। যে কোন বিষয়ে যে কোন ধরণের যুগান্তকারী মতামত দেয়া যায়, দেশকে রসাতলে পাঠানো যায় আবার ‘উন্নয়ন’এর জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়া যায়—শুধু প্রথমে যোগ করতে হবে ‘আমার মনে হয়’। ১/১১ এর পরের সময়কার একটা ঘটনা। সরকারী চাকুরীজীবী হওয়ার কারণে আমাকে তখন ‘ফাউন্ডেশান ট্রেনিং’ পাঠানো হয়েছে।

বিভিন্ন বিষয়ে কিছু সাধারণ ধারণা দেয়া হচ্ছে। সেদিন ক্লাস ছিল আইন এর ওপর। যিনি ক্লাস নিতে এসেছিলেন তিনি পেশায় উকিল। ক্লাস বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না—অনেকটা ‘আড্ডা’ ধাঁচের গল্প গুজব। আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুক্ষণ কথা বললেন।

এরপর শুরু হল আমাদের সাঁড়াশী আক্রমণ। সেই সময় অনেক কয়জন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কারাগারে ছিলেন। ক্লাসটা যে সময় হয়—তখন চলছিল তাঁদের জামিন পাওয়ার পালা। একটা প্রশ্ন ছিল, ‘কেন এমন হচ্ছে, একদিন আগেই যার জামিন আবেদন নাকচ হল—পরের দিনই আবার তাঁকে জামিন দেয়া হল। এতে তো বিচারকদের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে তাঁদের সততা নিয়ে।

’ সুন্দর একটি উত্তর দিলেন তিনি। বিচার ব্যবস্থা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে দুই পক্ষই সুযোগ পায় নিজের পক্ষকে নিরপরাধ প্রমাণ করবার। যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন। তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করেন। সব কিছু শুনে বিচারকের যা সঠিক মনে হয় তিনি সেই কাজটি করেন।

তাঁর এই মনে হওয়া সঠিক না ও হতে পারে—তিনি যাকে দোষী মনে করলেন সত্যি হয়ত তিনি দোষী নন কিংবা সত্যিকারের দোষীকে তিনি তথ্য প্রমাণের অভাবে নির্দোষ ভাবতে পারেন। এরপর ও তাঁর এই মনে হওয়াকে সম্মান দেখাতে হবে। দুইজন বিচারক একমত নাও হতে পারেন—সেটা হতে পারে নতুন তথ্য পাওয়ার কারণে, হতে পারে ব্যাখ্যার কারণে, হতে পারে নতুন আইনজ্ঞের নতুনভাবে উপস্থাপনের কারণে। বিচারক অসৎ উদ্দেশ্য তাঁর ‘মনে হওয়া’ সৃষ্টি করেছেন—এমনটা সন্দেহ মনে আসতে দিলে বা এমন বক্তব্য দেয়ার অনুমুতি দিলে—পুরো বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরবে। তাই এই ব্যপারে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।

ধরে নিয়ে চলতে হবে—তিনি যা রায় দিয়েছেন—তাঁর বিবেচনায় সঠিক মনে করেছেন বলেই দিয়েছেন—এর পিছনে অন্য কোন কারণ নেই। তাঁর সততা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। পৃথিবীতে অনেক ব্যবস্থা এসেছে—যে ব্যাবস্থা গুলোতে ‘সমালোচনা’ কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। কোথাও তো এমন ও হয়েছে খুজে বের করবার ব্যবস্থা চলেছে—মনের ভেতর কোন সমালোচনা দানা বাঁধছে কি না। ইরাকের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের গোয়েন্দা বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় কোমলমতি শিশুদের ধরে জিজ্ঞেস করত ‘আচ্ছা, যখন তোমাদের বাসায় টেলিভিশনে সাদ্দাম হোসেনের ছবি দেখায়—তখন তোমার বাবা মা কি বলেন?’ স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ করবে এটা অনুমেয়।

কারণ এই ব্যাবস্থা টিকে থাকবার জন্য—সবার আগে প্রয়োজন সমালোচনার অবসান। আজ একজন করছে—কাল দশজন করবে, এরপর অসন্তোষ দানা বাঁধবে—কোন একসময় তৈরি হবে জনস্রোত। যা শাসক শ্রেণীর জন্য হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর। গাদ্দাফী শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন তাঁর চেয়েও মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ‘কণ্ঠরোধ’ ব্যবস্থা। সিরিয়াতে ও শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ।

আমাদের দেশের ও একটি শাসক দল এখনও হিমসিম খায় এই ব্যাখ্যা দিতে—কেন তারা পাঁচটি বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাওয়ার পিছনে যতই সি আই এ বা গরবাচেভ কে দায়ী করা হউক না কেন—‘কণ্ঠরোধ’ ব্যাপারটার কোন ভূমিকা ছিল না এমনটা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশে এখন চালু হয়েছে গনতন্ত্র—অনেক জায়গায় কিন্তু পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছে সমাজতান্ত্রিক ধারার দলগুলো। ‘Power corrupts. Absolute power corrupts absolutely’ একটি ব্যবস্থা ভালো না খারাপ তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করবার সুযোগ না দিলে—এর খারাপটা খুজে বের করা যায় না। আর খারাপ অংশের খোঁজ না পেলে—শুধরানোর সুযোগ ও হাতছাড়া হয়ে যায়।

এরপর এমন একটা সময় আসে—খুব ভালো একটি ব্যবস্থাকেও মানুষ তখন সহ্য করতে পারে না। মনে মনে ফুঁসতে থাকে। প্রকাশ্যে না হোক গোপনে কিংবা একান্ত নিজস্ব পরিসরে ‘আত্মসমালোচনা’র ভঙ্গিতে হলেও ঘাটতি খোঁজার একটা চেষ্টা করলে কেমন হয়? এর প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হয়তো নাও হতে পারে। হয়তো ব্যাবস্থাটিকে আরও আধুনিকায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সমালোচনাকে ভয় পেয়ে বা এড়িয়ে যেয়ে কোন ব্যাবস্থাই নিজের বিকাশ ঘটাতে পারে নি।

কখনও এর পতন হয়েছে কখনও হারিয়ে গেছে। ক্রিকেট খেলার ‘আম্পায়ার’ বিতর্ক একসময় ছিল নিত্যদিনের ব্যপার। ‘নিউট্রাল আম্পায়ার’ ‘থার্ড আম্পায়ার’ ‘রিভিউ’ এমনই সব নতুন নিয়ম বিতর্কের সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। দেখাদেখি ‘ফুটবল’ এও শুরু হতে যাচ্ছে ‘রিভিউ’ সিস্টেম। সিস্টেম এর ভুল খোঁজার চেষ্টাই হয়তো সিস্টেম কে করে তুলেছে আরো পরিশীলিত, আরও পরিণত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।