আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এমসি কলেজ হোস্টেলে অগ্নি সংযোগে সিলেটবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

‘তুমি যাকে মৃত্যু বল, তুমি যাকে বল শেষ, সমূল পতন আমি তার গভীরে বিশ্বাসী বারুদের চোখ দেখে বলি এসব মৃত্যু কোন শেষ নয়, সব নয় এসব মৃত্যু থেকে শুরু হয় আমাদের সূর্যময় পথ। ’ সিলেটবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে গত সন্ধ্যা থেকে। কারণ, ক্ষতি অপূরণীয়। হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও আর ফিরে পাওয়া যাবেনা এই ঐতিহ্যের স্মারক। রবিবার রাতে ছাত্রলীগের উন্মত্ত আগুনে পুড়ে ভষ্মিভূত হয়ে গেলো সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক এমসি কলেজ ছাত্রাবাস।

সকলের চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো এমসি কলেজ ৯১ বছরের প্রাচীন ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লক। নান্দনিক স্থাপত্যের সুবিশাল আয়তনের সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের সাথে জড়িয়ে এই কলেজের সাবেক ও বর্তমান হাজার হাজার ছাত্রের আবেগানুভূতি। হোস্টেলের সামনে সুবিশাল মাঠ। খোলা মেলা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। ৬টি ব্লকে ভাগ করা হোস্টেল ভবন।

প্রতিটি ব্লক দৈর্ঘ্যে কয়েক শ’ ফুট লম্বা। এক ব্লক থেকে অন্য ব্লকের দূরত্বও অনেক। ৪র্থ ও ৫ম ব্লকের মাঝে রয়েছে ছাত্রদের গোসলের জন্য পুকুর। ছায়া ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন হোস্টেল এদেশে তো নেই-ই, এই উপমহাদেশেও বিরল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো হোস্টেল ভবনের ভিন্নধর্মী স্থাপত্য শৈলী।

স্থাপত্যকলায় সংশ্লিষ্টদের মতে, ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’-এর এত বিশাল ভবন বিশ্বের কোথাও হয়তো এখন আর অবশিষ্ট নেই। উপযুক্তভাবে বর্হিবিশ্বে উপস্থাপিত হলে অনেক আগেই এই হোস্টেলকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করতো ইউনেস্কা। অথচ, আগুনের লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে গেলো সিলেটবাসীর গর্বেরই এই ঐতিহ্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিলেটের স্বনামখ্যাত শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পিতামহ মুরারী চাঁদের নামানুসারে ১৮৯২ সালে স্থাপন করেন মুরারী চাঁদ কলেজ। শুরুতে কয়েক বছর কলেজের ব্যয় ভার বহন করেন রাজা নিজেই।

এরপর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল মজিদ সিআইই’র প্রচেষ্টায় বৃটিশ সরকারের অর্থানুকূল্য পাওয়ায় কলেজটি ১৯২১ সালে স্থানান্তরিত হয় টিলাগড়ে অবস্থিত থ্যাকারে টিলায়। এই সময়ে কলেজের জন্য একাধিক একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়। একই সময়ে কলেজের অদূরে নির্মিত হয় সুবিশাল এই হোস্টেল। প্রায় ২০ কেদার ভূমির উপর নির্মিত হোস্টেলের ভবন, এর অঙ্গ সজ্জা ও স্থাপত্য শৈলী যে কোন দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়তো। স্থপতি ও নাট্যকার শাকুর মজিদ জানান, যে স্থাপত্য কলায় হোস্টেলের ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল তা এখন বিশ্বে বিরল।

স্থাপত্যকলা বা আর্কিটেকচারের ভাষায় এ ভবনগুলোর নাম ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’। সিলেট অঞ্চল সে সময় ছিল আসামের অধীন। ব্যতিক্রমী স্থাপত্য শিল্পের এই ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’ ভবনগুলো নির্মিত হতো টিন শেডে। কড়ি-বর্গা সব কিছু কাঠের। টিন শেডের নীচে থাকে কাঠের বার্লিন।

ভবনগুলোর সিমেন্টিং বা দেয়ালের পলেস্তরাও হয় ব্যতিক্রম। জানা গেছে, ভূমিকম্প প্রবণ হওয়ায় এ ধরনের হালকা ধাচের অথচ ভূমিকম্প সহিষ্ণু সেমি পাক্কা ভবন সিলেট অঞ্চলেই প্রথম নির্মাণ শুরু করে বৃটিশরা। পরে তা আসামের পাহাড়ি অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করে। পুরনো আমলের অসংখ্য বাংলো এই প্রযুক্তিতে তৈরী। মূলতঃ ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সংঘটিত ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প, যা সিলেট অঞ্চলে ‘বড় বৈছাল’ নামে পরিচিত- এর পর থেকেই এই সেমি পাক্কা ভবন জনপ্রিয় হয়ে উঠে ভারত বর্ষের পাহাড়ি অঞ্চলে।

এ কারণে ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’ নামের ভবন স্থাপত্য কলায় নতুন একটি কনসেপ্ট বা ধারণার জন্ম দেয়। তিনি বলেন, বর্তমানে সিলেটে এ প্রযুক্তির ভবন নির্মাণ না হলেও এখনো আসাম ও বৃহত্তর সিলেটের কোন কোন স্থানে টিকে আছে ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’ ভবন। তবে, সম্ভবতঃ বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বড় ‘সেমি পাক্কা আসাম’ টাইপ স্থাপনাটি হচ্ছে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস। স্থপতি শাকুর মজিদের মতে, এই টাইপের এত বিশাল ভবন উন্নত বিশ্বের কোন দেশে থাকলে ইউনেস্কো বহু আগেই এটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করতো। এমসি কলেজ হোস্টেলে অগ্নি সংযোগে ভবনগুলো পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় আক্ষেপ করে স্থপতি শাকুর মজিদ বলেন, সিলেটবাসীর কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো- তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা।

শুধু স্থাপত্য মূল্য নয়, ঐতিহাসিক দিক দিয়েও এই এমসি কলেজ হোস্টেলের রয়েছে স্বতন্ত্র আভিজাত্য। অসংখ্য নামজাদা ও কীতির্মান ব্যক্তিত্ব যেমন এই হোস্টেলে থেকে অধ্যয়ন করেছেন, তেমনি অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পদধূলি পড়েছে এখানে। বাংলা সাহিত্যের উজ্জলতম নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সফরে এলে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ২১ কার্তিক একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন এমসি কলেজ হোস্টেলে। গত রাত সাড়ে ৮টায় এমসি কলেজ হোস্টেলে গিয়ে দেখা যায়, দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। এই কলেজের সাবেক ছাত্রদের অনেকেই ছিলেন সেখানে উপস্থিত।

ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও আগুন নেভানোর সরঞ্জাম নিয়ে চেষ্টা করছিলো আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু সবার চোখের সামনেই একে একে আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছিল হোস্টেলের শতবর্ষ প্রাচীন কড়ি কাঠ-বর্গা-ঢেউটিন-দরজা-জানালা। টিন কাঠের স্থাপনা হওয়ায় আগুনের ব্যাপ্তি ও তাপ যেন ছিল অনেক বেশী। হোস্টেলের বুক চিরে দু’ভাগ করা রাস্তার বাম পাশের ৩টি ব্লকই পুড়ছে নিদারুনভাবে। আগুনের লকলকে জিহবা যেন গ্রাস করে নিচ্ছিল হৃদয়ের অন্তঃপুরে থাকা ভালবাসার কোন নির্দশনকে।

দূরে দাঁড়িয়ে হাহাকার করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা তখন। বাম পাশের শ্রীকান্ত ব্লক রয়েছে অক্ষত। কিছুটা অক্ষত আছে এর পেছনের ব্লকগুলোও। শ্রীকান্ত ব্লক থেকে পানি এসে হোস্টেলের কয়েক জন মেট বালতিতে করে পানি ছুড়ছিল আগুনের দিকে। এদের একজন কিশোর বুরহান।

হাউ মাউ করে কাঁদছিল সে। বুরহান জানায়, কিভাবে আগুন লেগেছিল। বোরহান বলে, সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই ৪০/৫০ যুবক অস্ত্র নিয়ে হোস্টেল কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ে। তারা আগে থেকে কমাউন্ডে সশস্ত্র অবস্থান নেয়া অপর পক্ষকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়। এরপর একে একে কক্ষগুলোতে ঢুকে আগুন লাগায়।

কয়েক মিনিটের মাঝেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে হোস্টেলের সবগুলো ব্লকে। এমসি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র ও হোস্টেলের এক সময়ের বাসিন্দা অধ্যাপক ভানুজ কান্তি ভট্টাচার্য তার হোস্টেল জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, এই হোস্টেলের সাথে কত ছাত্রের যৌবনের আবেগ ও ভালবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো কোটি টাকা ব্যয়ে এর চেয়ে নান্দনিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু হাজার কোটি টাকা খরচ করেও আর ফিরে পাওয়া যাবেনা সিলেটবাসীর এই ঐতিহ্যের অংশটিকে। গত রাতে মুঠো ফোনটি বার বার বাজতে থাকে।

এদের বেশীর ভাগই এমসি কলেজ হোস্টেলের সাবেক আবাসিক ছাত্র। উদ্বিগ্ন তারা। অনেকেই আক্ষেপ করতে থাকেন হোস্টেল পোড়ানোর খবর শুনে। কেউ কেউ আবার সরেজমিনে ঘুরে এসে হৃদয়ের হাহাকারের সাথে নীরবে বিসর্জন দেন বেদনার অশ্রু। ফোন করেন এই হোস্টেলের এক সময়ের আবাসিক ছাত্র ও শাহজালাল কলেজের অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ।

আবেগ তাড়িত কন্ঠে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ঘটনা ঘটলো সন্ধ্যার আগে। তখন কি করছিল প্রশাসন। যে বা যারাই আগুন লাগাক, তারা নিরাপদে পালিয়ে গেলো কিভাবে ? তিনি বলেন, যারা সিলেটবাসীর এই অপূরণীয় ক্ষতি করলো, তাদেরকে হাজার বার ফাঁসি দিলেও তো ক্ষতিপূরণ হবেনা। সিলেটের সচেতন মহল মনে করেন, যে বা যারাই এই আগুন দিয়ে থাকুক না কেন, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধু অগ্নি সংযোগের কারণে তাদের শাস্তি দিলেই তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবেনা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি, বিশ্ব ঐতিহ্যের ক্ষতি করার জন্যও তাদেরকে এমন শাস্তি দিতে হবে, যেন তা ইতিহাসে নজির হয়ে থাকে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.