আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি, সাদেক আর আজিজ সুপার মার্কেট

বাক স্বাধীনতা মানে সত্য বলার অধিকার। সাদেক আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে স্কুলে গিয়েছি। একসাথে খেলা করেছি। একসাথে আড্ডা মেরেছি।

একসাথে যাবতিয় দুষ্টুমি করেছি। আমরা একসাথে পড়েছি এইচএসসি পর্যন্ত- একই ক্লাসে। আমাদের সাথে অবশ্য আরও অনেক ছেলেই ছিল। কিন্তু সাদেকের কথা বিশেষভাবে বলার কারণ আমার এলাকার বন্ধুদের মাঝে সাদেক আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। অবশ্য ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিলো।

আমাদের হলও আলাদা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রথম দিকে আমি আর সাদেক একসাথেই থেকেছি কিছুদিন; যে পর্যন্ত আমার আর সাদেকের আলাদা ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠেছে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট আর হল আলাদা হবার ফলে দেখা গেল কিছুদিন পরেই আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগটা কমে গেল। দেখা হলে কথা হতো। মাঝে মাঝে আমি ওর কাছে যেতাম বা ও আমার কাছে আসতো।

সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে তাও হতো না। এর মধ্যে আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। আমি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। নামমাত্র পড়াশোনা করতাম। শুধু পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশোনা করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কোনমতে পরীক্ষা দিয়ে কোনমতে পাশ করতাম।

ওদিকে আবার আজিজ মার্কেট কাছে হবার সুবাদে আজিজ মার্কেটে ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। আজিজ মার্কেটের চিপায় বসে গাঁজা খাওয়ার মাঝে যে এক ধরনের বিশেষত্ব আছে তা আমি আগে আন্দাজ করিনি। পরে চিন্তা করে দেখেছি আসলে বিষয়টা গাঁজা নয়। আমি যাদের সাথে বসে গাঁজা টানতাম তারা সবাই বিশেষ ধরনের মানুষ ছিলো। যাদের সাথে আমি বসে গাঁজা টানতাম তারা কেউ সাধারণ মানুষ নয়- সবাই বিশেষ ধরনের মানুষ।

কেউ কবি, কেউ গল্প লেখক, কেউ সাংবাদিক, কেউ গায়ক আবার কেউ কেউ সব রকম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ। শুনেছি এখন তাদের মাঝে কেউ কেউ ব্লগারও হয়েছে। সবাই অবশ্য সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি এই আজিজ মার্কেটের চিপাতেই একজন ব্লগারের উত্তম মধ্যম খাওয়ার কথাও শুনলাম কিছুদিন আগে। আজিজ মার্কেটের চিপায় বসে আড্ডা দেয়ার মানুষেরা আর ব্লগে বসে বিতর্ক করার মানুষেরা যে এক জিনিস না সেটা মনে হয় সবাই আজও ধরতে পারে নি।

যাই হোক, ঐ সময় ওদের আমার আসলেই খুব ভালো লাগতো। কী চমৎকার ভাবে তারা উচ্চ মার্গীয় বিষয়াদি নিয়ে গল্প করে সময় কাটায়। সবার মাথার মাঝে কত রকম চিন্তা! সবাই বাস্তবধর্মী মানুষ। সারাদিন মার্কেটের চিপায় বসে আড্ডা মারা সত্তেও এরা এতটা বাস্তবধর্মী মানুষ কি করে হয়ে উঠলো তা আমি আজও নির্ণয় করতে পারিনি। আমিও ওদের সাথে মিশে গিয়েছিলাম।

আজিজ মার্কেটের দোতালার পশ্চিম দিকের একটা ঘরে প্রতি শুক্রবার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু করে আড়াইটা পর্যন্ত কার্ল মার্ক্স নিয়ে বিশদ আলোচনা হতো। সেখানে সনামধন্য দু একজন সাংবাদিক থাকতো বিধায় প্রকাশ্যে গাঁজা না চললেও সিগারেট চলতো অবিরাম। খুবই ভালো লাগতো আমার। যে ঘরে বসে আমরা কার্ল মার্ক্স কপচাতাম তার পাশের রাস্তার ও পারেই আছে একটা মসজিদ। ওখানে মুসল্লীরা জুম্মার নামাজ পড়তে যেত আর আমরা বসে বসে সিগারেট ফুঁকতাম আর কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল নামক বইয়ের ক্যাপিটাল ম্যানিফেস্টো নিয়ে কোন একটা লাইনকে কোরআনের আয়াতের চেয়েও গুরত্বপূর্ণ ধরে নিয়ে তার ব্যাখ্যা উদ্ধারে সচেষ্ট হতাম।

আমাদের মধ্যেকার বড় সাংবাদিক যিনি ছিলেন তিনি সাধারণত আলোচক হতেন। আর আমরা হতাম শ্রোতা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কি করে আমাদের দেশটাকে ও আমাদের দেশের মানুষগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সেটা চিন্তা করে শিহরণ জাগতো মনের ভেতর। জানালা দিয়ে বাইরে মসজিদের ভিতরে নামাজে দন্ডায়মান মানুষগুলোকে এক একটা আস্ত পাঁঠা বলে মনে হতো। ইমাম সাহেবকে দেখলে মনে হতো ইবলিশ।

যদিও আমি তখন ইবলিশ বা আল্লাহ্‌ কোন কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না। যাই হোক কিছুদিন পরে আমি যখন গাঁজায় চুর হয়ে মার্কেটের ভিতরে রাত্রি যাপন করা শুরু করেছি- এমতাবস্থায় একদিন সাদেকের সাথে আমার দেখা হলো। দীর্ঘদিন সাদেকের সাথে আমার দেখা হয় নি। না, পাঠক যা ভাবছেন তা নয়। সাদেক দাড়িও রাখেনি বা ইসলাম ধর্মে পূর্ণ আত্মনিবেশকারীতে পরিণত হয়েছে এমনও নয়।

কিন্তু সে আগের মতই আছে। সে নিজেই আমার কাছে এসেছিলো। আমার সাথে দেখা হবার পর আমার গাঁজা টানা নিয়ে খানিক্ষণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘তুই যে এত ভালো একটা সাবজেক্টে পড়ে গাঁজাখোর হয়ে যাবি আমি সেটা ভাবিনি’। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, গাঁজা টানলে মাথা খোলে। আজিজ মার্কেটে গিয়ে আমি যাদের সাথে ওঠাবসা করি তাদের দুএকজনের পরিচয় দিলাম।

কী আশ্চর্যের বিষয় সাদেক একজনকেও চিনতে পারলো না!! আমি বললাম, ‘ঐ হাঁদারাম, তুই কী দেশের খবর কিছু রাখিস?’ ও বলল, ‘সবসময় রাখতে পারি না। কিছু কিছু খবর রাখি। ‘ এ কথা বলে ও মৃদু হাসতে লাগলো। আমি বললাম, ‘হাসছিস কেন রে হাঁদারাম?’ ও বলল, ‘দেশের খবর যে এখন আজিজ মার্কেটের চিপায় পাওয়া যায় তা জানতাম না। ‘ রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো আমার।

ওকে একরকম অপমান করে দিয়ে বিদায় করে দিলাম। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমরা দুজনেই পাশ করেছি। সাদেক অনেক ভালো রেজাল্ট করে এখন পিএইচডি করতে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। আমি এখন একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি।

বেতন ভালোই পাই কিন্তু সেই হেন করেংগা তেন করেংগা অনুভূতিটা আর নেই। আজিজ মার্কেটের চিপায় আর যাওয়া হয় না। গাঁজা টানা ছেড়ে দিয়েছি। সেই সাংবাদিক ভাই ছালার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আজও আজিজ মার্কেটের চিপায় বসে ছেলেদের নিয়ে কার্ল মার্ক্স কপচান কিনা আজ আর খবর রাখি না। মসজিদে যাই না।

কিন্তু মসজিদে যাওয়া মানুষগুলোকে খুব সুখী মনে হয় আমার কাছে। নিজেকে কেমন তুচ্ছ আর ছোট মনে হয়। আল্লাহ্‌ আছেন কিনা এই ইস্যুতে এখন আর গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করতে ইচ্ছা হয় না। আগে নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবতাম। এখন মনে হয়, আমি কতটুকুই বা জানি?(কাল্পনিক) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.