আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিক মানস

পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিক মানস ফকির ইলিয়াস =================================== একটা বড় আইনি ধকল বয়ে গেল পাকিস্তানে। মনে করা হয়েছিল, ইউসুফ রাজা গিলানি পার পেয়ে যাবেন। না, পেলেন না। উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি অযোগ্য হয়ে গেলেন! আসলেই কি আইনি রায়? নাকি নেপথ্যে অন্য কিছু? তা দেখার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনি আসছেন বলে শোনা যাচ্ছে, তিনি বস্ত্রমন্ত্রী মাখদুম শাহাবুদ্দিন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী গিলানি দায়িত্বে থাকার যোগ্যতা হারানোর পর আগামী আট মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি খান জারদারি। সব মিলিয়ে একটা কালো মেঘ আবারো দানা বাঁধছে পাকিস্তানের আকাশে। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর একটা টানাপড়েন চলেই আসছিল। একদিকে গণতন্ত্রকামী মানুষ অন্য দিকে সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুর স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল নিয়মিত। আর জঙ্গিশক্তিটি বোমাবাজি করেই যাচ্ছিল যত্রতত্র।

বেনজির যেদিন জঙ্গিদের হাতে নিহত হন, মূলত সেদিনই বুঝা গিয়েছিল পাকিস্তানে একটি কালো দাঁতাল শক্তি কতো জঘন্যভাবে বেড়ে উঠছে। মৃত্যুর মাত্র আড়াই মাস আগে বেনজির দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে পাকিস্তানে ফিরেছিলেন। তার এই ফেরা নিয়ে নানা কথা হচ্ছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার নাকি, স্বৈরশাসক পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে আঁতাত- নিয়ে বিতর্ক ছিল সে সময়। কিন্তু বেনজির খুব সুদৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি মৌলবাদমুক্ত, স্বৈরশাসনমুক্ত পাকিস্তান চান।

যে কোনো মূল্যে তিনি কাজ করে যাবেন সে লক্ষ্যে। বেনজির তার প্রাণ দিয়ে কথা রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে বেনজির ভুট্টোর নামটি রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তার পিতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছায়ায় তার রাজনীতির শুরু হলেও ক্রমশ তিনি নিজের আসনটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছিলেন। মূলত একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় সাধিত হবার পর ‘পশ্চিম পাকিস্তানের’ শরীর থেকে পশ্চিম শব্দটি খসে পড়ে।

একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম হয়। যা ১৯৪৭ সালেই হতে পারতো। বাঙালিদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম সে সময় হলেই তা হতো উত্তম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। ফলে চব্বিশ বছর ‘হামভি মুসলিম, তুমভি মুসলিম’ এই বুলি আওড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষীরা বাঙালি জাতিকে শাসন এবং শোষণ দুটিই করে।

জিন্নাহ-লিয়াকত আলীরা যে গণতন্ত্রী ছিলেন নাÑ তা সে সময়ের ইতিহাসই বলেছে। গণতন্ত্র মানলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির শাসক, সংখ্যালঘিষ্ঠ উর্দুভাষীরা হয় কী করে? পাকিস্তানিদের গণতন্ত্রের মুখোশ খসে পড়েছিল সে সময়েই। কিন্তু তারপরও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকদের চিরতরে ধ্বংস করে দিতে তৎপর ছিল সামরিক জান্তারা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, কিংবা জে. ইয়াহিয়া খানরা জনগণের টুঁটি চেপে ধরতেই ক্ষমতা গ্রহণের নামে মার্শাল ল’ জারি করেন। এমন কি তারা বাঙালি জাতিকে মাতৃভাষা বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের বলপ্রয়োগ করার ধৃষ্টতা দেখান।

এরপরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ছিল এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু তারপরও কি পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চা হয়েছে? না হয়নি। বেলুচ, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পাঠান প্রভৃতি গোত্র-সম্প্রদায়ের নানা কূটকৌশলের কাছে পাকিস্তানিরা নিজেদের কাছেই প্রতারিত হতে শুরু করে বিভিন্নভাবে। শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর গদি কেঁপে ওঠে বিভিন্ন কারণে। কারণ তার গণতন্ত্র চর্চা স্বচ্ছ ছিল না।

কিন্তু তা যাই হোক না কেন আবার সামরিক শাসক জে. জিয়াউল হকের ক্ষমতা গ্রহণ প্রমাণ করেছিল, পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রের চেয়ে গাদ্দারি মার্কা একনায়কতন্ত্রই বেশি পছন্দ করে। বিভিন্ন টালবাহানা করে প্রায় জোর করেই ভুট্টোর ফাঁসির হুকুম দেয় সামরিক জান্তারা। যে জুলফিকার আলী ভুট্টো জনরায় না মেনে দুই পাকিস্তানের শাসক হতে চেয়েছিলেন, তাকে বিদায় নিতে হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। জেনারেল জিয়াউল হক বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শাসন চালাতে থাকেন। এরপর মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হক নিহত হলে দেশের রাজনৈতিক প্রবাহ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।

একটি কথা লক্ষণীয় পাকিস্তানে মৌলবাদী জঙ্গিরা কিন্তু মূলত সংগঠিত হতে শুরু করে জেনারেল জিয়াউল হকের সময়েই। কারণ এ রকম একটি মৌলবাদী শক্তির খুব প্রয়োজন ছিল জিয়াউল হকের। এরপরে পাকিস্তান শাসন করেন বেনজির ভুট্টো। কিন্তু জঙ্গিবাদের বিষক্রিয়া তিনি থামাতে পারেননি। তাছাড়া তার নিজ স্বামী আসিফ আলী জারদারিসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সিংহভাগের দুর্নীতি ছিল সীমাহীন।

ফলে তিনি টিকে থাকতে পারেননি। ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয়ভাবে দেউলিয়া করে তুলে তার সরকারকেও। বিশেষভাবে সীমান্তবর্তী দেশ আফগানিস্তান থেকে আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গিবাদের দাপট কাঁপিয়ে তুলে পাকিস্তানের গুহা, মরু, পর্বত। কারো কারো মতে পাক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই খুব কৌশলে নিজেদের রাষ্ট্রটিকে আংশিক অকার্যকর করে তোলে।

সে সুযোগ নিয়ে খুব পারিকল্পিতভাবে নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন জেনারেল পারভেজ মুশাররফ। জে. মুশাররফ শুরু থেকে কী বলে আসছিলেন, তা বিশ্বাবাসীর এখনো মনে আছে। তিনি যে গণতন্ত্রকে ভয় পেতেন, তা কারোই না জানার কথা নয়। আর সেজন্যই বেনজির এবং নওয়াজকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তিনি খুব কঠোরভাবে চালাতে থাকেন তার স্টিম রোলার। সবচেয়ে মারাত্মক কথা হচ্ছে, জে. মুশাররফও জেনারেল জিয়াউল হকের কায়দায় পাকিস্তানে জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ককে ম“ দিয়েছেন, নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।

তিনি একই কাজটি করেছিলেন নওয়াজ-বেনজিরের জনপ্রিয়তাকে হরণ করার জন্য। আর খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, জে. মুশাররফের এসব ভাঁওতাবাজি, ভ-ামিকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বুশ প্রশাসন। জে. মুশাররফ ওয়াশিংটনে এসে বুশের সঙ্গে করমর্দনরত ছবি ছাপিয়েছেন, বিশ্ব মিডিয়ায় আইওয়াশ করেছেন বিশ্ববাসীর। অথচ তার প্রধান লক্ষ্য কী তা প্রমাণিত হয়েছে, নওয়াজ শরিফকে প্রথমবার দেশে আসতে বাধা দেয়ায়। এরপরে বেনজির ভুট্টোকে কৌশলে পাকিস্তানে ফিরিয়ে এনে তার জীবন বিপন্ন করে তোলেন মুশাররফ।

বেনজির পাকিস্তান আসার পরপরই আক্রান্ত হন। কিন্তু তারপরও তার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি। লাল মসজিদে জঙ্গিরা যে কা- ঘটিয়েছিল, তা ছিল গোটা পাকিস্তানের প্রতিচিত্র। কিন্তু জে. মুশাররফ তা কঠোর হস্তে দমন করতে পারেননি। বরং প্রকারান্তরে ডানপন্থী ছোট ছোট রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে মোর্চা করে কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, সে ভাবনায় বিভোর থেকেছিলেন।

বেনজির আক্রান্ত হতে পারেন, তা তিনি নিজেও জানতেন। তারপরও জঙ্গিমুক্ত স্বদেশ ছিল তার একমাত্র আরাধ্য মাতৃভূমি। রাওয়ালপিন্ডিতে তার শেষ জনসভায়ও তিনি তা বলেছিলেন খুব স্পষ্ট ভাষায়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির ব্যর্থতা যতো বেশিই থাকুক না কেন, জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে পিপিপি যে কঠোর ভাষা উচ্চারণ করে যাচ্ছিল, বর্তমান বিশ্বে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ, সার্থক দিক। পাকিস্তানের আপামর মানুষও বেনজিরের পাকে সাড়া দিয়ে সমবেত হতে শুরু করেছিলেন।

বেনজিরকে কে বা কারা হত্যা করেছিল, তা খোঁজার পাশাপাশি তাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল, তার নিগূঢ় কারণটি খুঁজে দেখা জরুরি ছিল। পাকিস্তানিরা তা পারেনি। আর পারেনি বলেই তাদের জন্য মৌলিক গণতন্ত্র এখনো থেকে গেছে খাঁচার বাঘ। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেনজিরকে হত্যার মাধ্যমে খুনিরা জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। জে. মুশাররফ যে কালো সাপগুলো তার আস্তিনের পকেটে পুষেছিলেন, সেগুলোই এখন ছায়া ছড়াচ্ছে অনেক প্রশাসনে।

একটি বিষয় খুব স্পষ্ট আমরা দেখেছি, পাকিস্তানের ইতিহাসে গিলানিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির দুর্নীতি মামলা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সুইস কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাতে রাজি না হওয়ার অপরাধে গত ২৬ এপ্রিল গিলানিকে দোষী সাব্যস্ত করে সুপ্রিম কোর্ট। তাহলে আমরা কি ধরে নেবো পাকিস্তানের উচ্চ আদালতই এখন সে দেশে আইনি শাসন প্রতিষ্ঠায় খুব তৎপর! যদি তাই হয় তবে আমরা দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দেখার আশা করতেই পারি। আর যদি অন্য কোনো অপশক্তি রাজনীতিকদের হেনস্থা করে ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নে বিভোর থাকে তবে মানতে হবে পাকিস্তানীদের ভাগ্যে আরো দুর্গতি আছে। এটাও প্রশ্ন আসছে তবে কি কোনো জঙ্গি শক্তিকে ম“ দেয়ার নেপথ্য চেষ্টা করা হচ্ছে? মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানে দানব শক্তির উত্থান, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্ববাসীর জন্য শঙ্কার কারণ চরমভাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ নিয়ে মার্কিন সিনেট-কংগ্রেসে লবিং শুরু করেছেন। পাক-আফগান সীমান্তে অবস্থানরত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি বদ্ধপরিকর। কিন্তু এর পাশাপাশি যারা জঙ্গিবাদকে মদদ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, জঙ্গিরা মানবতাবাদের প্রকৃত শত্রু। পাকিস্তানিরা তাদের দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র চাইলে, সেই মানস তৈরি করতে হবে।

বিভিন্ন প্রদেশে পারস্পরিক ঐক্য তাই দরকারি বিষয়। মানুষ সামনের দিকে এগোচ্ছে। তাই পাকিস্তানবাসীরা যদি সেই সত্য অনুধাবন করে এগিয়ে না আসেন তবে নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারবেন। ২১ জুন ২০১২ ============================================ দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২৩ জুন ২০১২ শনিবার প্রকাশিত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.