আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন "বিরক্ত" মানুষ

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। একজন "বিরক্ত" মানুষ মোহাম্মদ ইসহাক খান ১. মোজাম্মেল হক সাহেবের পরিবার বেশ বড়, তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সল্প আয়ে বৃহৎ এই সংসার চালাতে গিয়ে তাঁকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে, কয়েকটার জন্যে সবাই তাঁর ওপরে বিরক্ত হয়েছে, সন্দেহ নেই।

কিন্তু কী করা? একটা পরিবার এই বাজারে চালানো চাট্টিখানি কথা নয়, কাজেই তাঁকে কিছুটা কঠিন হতে হয়েছে বৈকি। সহজ লোকের কাজ নয় এটা। অফিসের লোকজন তাঁকে "হক সাহেব" বলে ডাকে। তিনি এই কোম্পানির তৃতীয় শ্রেণীর একজন চাকুরে। নটা পাঁচটা অফিস করলে সবার মুখেই একটা ছাপ পড়ে, চেহারা দেখেই অনুমান করা যায় তিনি একজন চাকুরে।

হক সাহেবের মুখে অনেক আগেই এই ছাপ পড়েছে, বয়সের সাথে সেই ছাপ আরও গভীর হয়েছে। এক জায়গায় বসে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন বাইশ বছর, তাঁর গদিটা দেবে গেছে অনেকটা নিচের দিকে, পেছনের তোয়ালের সুতো বেরিয়ে পড়েছে, প্রমোশন আর হয়নি। তিনি নিপাট ভদ্রলোক একজন মানুষ, তাঁর প্রমোশন না হবার কোন কারণ থাকতে পারেনা, কিন্তু প্রমোশনের সাথে একভাবে কাজ করে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। প্রমোশন পাবার সৎ উপায় যেমন আছে, তেমন অসৎ উপায়ও আছে। সৎ উপায় হল, ডাইনামিক হতে হবে, কাজ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে, যেটা ভাগ্য খুব ভালো না থাকলে কাজে দেয় না।

অসৎ এবং জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে উপরমহলে কিছু টাকাপয়সা ঢালা। সে সামর্থ্য তাঁর নেই। আর তিনি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন একজন লোক, কাজেই কোনভাবেই তাঁর প্রমোশন হয়নি। তাঁর সহকর্মী মাসুদ সাহেব কায়দামত সব জায়গায় যোগাযোগ করে এখন ব্রাঞ্চ অফিসার, তিনি যে কেরানী সেই কেরানীই আছেন। জীবনের কাছে চাওয়াপাওয়াহীন এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়।

আর অল্পদিনই বাকী আছে, তারপর অবসর। কিন্তু অবসরের কথা ভাবতে চান না তিনি, মাথা থেকে দূরে রাখতে চান, কিন্তু অপ্রিয় চিন্তাটা কেন যেন তাঁকে অস্থির করে দেয়, সবসময় মাথায় ঘুরতে থাকে। "কেউ যদি তোমাকে বলে, তুমি এই মুহূর্তে গোলাপ ফুল নিয়ে কোন চিন্তা করবে না, তখন তখনই তোমার মাথায় কীসের ছবি চলে আসবে বল তো? গোলাপ ফুল। " এই ব্যাপার হয়েছে তাঁর। বহু বছর আগে যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন তিনি, তখন ছিলেন খুব মিশুক স্বভাবের, নতুন বিয়ে করেছেন, সবার সাথে আলাপ করতেন, প্রচুর কথা বলতেন।

কথা ছড়িয়ে দিতেন আর সবার মধ্যে। কালক্রমে সেসব আস্তে আস্তে বিদায় নিয়েছে। বুঝতে পেরেছেন, আজকাল আর সেই দিন নেই। নতুন ছোকরা ধরণের লোকজন অফিসে জয়েন করছে, সবাই কেমন যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, অন্যের ভালো নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা তাদের নেই। দেশ নিয়ে চিন্তা, সেসব তো অনেক দূরের কথা, সবাই চালিয়াত কিসিমের লোক।

তাদের থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করেন মোজাম্মেল সাহেব, এখন অফিসে আপনার লোক বলতে জামিল সাহেব, তাঁর বয়সী নিতান্ত সজ্জন লোক। মাসুদ সাহেবের চেয়ার তিনি দখল করেছেন, একমাত্র তাঁর সাথে কথা বলেই আরাম পাওয়া যায়। আর কী আশ্চর্য, তাঁরও দুই ছেলে, দুই মেয়ে। নিজের সাথে অজান্তেই তাঁকে মেলাতে চেষ্টা করেন মোজাম্মেল সাহেব, কিন্তু এই সামান্য মিলটুকু ছাড়া আর কোন মিল খুঁজে পান না। নানা ঝামেলা নিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা তাঁর, এদিকে জামিল সাহেবের সংসার বড় হলেও খুবই ছিমছাম, ঝঞ্ঝাটমুক্ত।

প্রথম শুনে মনে হতে পারে যে স্বামী-স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মোজাম্মেল সাহেবের ছয়জনের সংসার, কিন্তু আসলে সব মিলিয়ে তাঁর সংসারে দশজন মানুষ। ছেলেমেয়ে ছাড়াও আছে তাঁর বড় মেয়ের জামাই নির্মল, এক বছরের নাতনী ফারিয়া, মা ফয়জুন্নেসা এবং তাঁর একমাত্র শ্যালক নাফীস। এতবড় সংসার এক হাতে কী করে টেনে নিচ্ছেন নিজেই হিসাব মেলাতে পারেন না মোজাম্মেল সাহেব, নিশ্চয়ই আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে। যার সংসারে আল্লাহপাকের খাস রহমত থাকে তার কিছুই আটকায় না। তবে মোজাম্মেল সাহেবের ধারণা, তাঁর সংসারে রহমত জিনিসটা পুরোপুরি নেই।

পুরোপুরি থাকলে তাঁর মনের অবস্থা সবসময় খারাপ থাকতো না, মন হতো শান্ত। সুখী মানুষ কখনো অস্থিরচিত্ত হয়না। কয়েক মাস ধরে মোজাম্মেল সাহেব লক্ষ করছেন, তাঁর ভেতরে বিরক্তি জমে উঠেছে, সবকিছুই কেমন যেন বিরক্তিকর ঠেকে। বিরক্তি ডেকে আনে রাগ। তাই আজকাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবার সাথে রাগারাগি করছেন, সম্পূর্ণ বিনাকারণে।

তিনি এটা চান না, কোনমতেই চান না। কিন্তু তিনি নিরুপায়, ঘরে ফিরেই কেন যেন সবাইকে একচোট ঝাড়তে ইচ্ছে করে। পরিবারের কেউ তাঁকে কিছু বলে না, কিন্তু কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মোজাম্মেল সাহেবের কেমন একটা সন্দেহ হয়, তাঁর মানসিক স্থিরতা নিয়ে সবাই সন্দেহ করছে। গুম মেরে বসে থাকেন তিনি। সকালবেলা, মোজাম্মেল সাহেব বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন।

এখান থেকে তাঁর অফিসে বাসে কিংবা রিকশায় যাওয়া যায়। তিনি পয়সা বাঁচানোর জন্য লোকাল বাসে যান, কখনো রিকশায় যান না। রিকশায় গেলে নগদ চল্লিশ টাকা লাগে, বাসে একবার উঠে পড়তে পারলে দু'টাকায় পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু আজ বেজায় ভিড়, তিনি উঠতে পারছেন না, পরপর দুটো লক্করঝক্কর বাস চলে গেল, কায়দা করা গেল না। রোদটা চিড়বিড়িয়ে উঠেছে, শরীরের চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে যেন।

ময়লা রুমালটা দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছলেন তিনি, সেটা দিয়েই কপালের ঘাম মুছলেন। আজ এত গরম পড়েছে কেন? একটা বৃষ্টি এলে ভাল হতো, খুব ভালো হতো। এই, থামো থামো। পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো রিকশাওয়ালাকে। তিনি তাকালেন।

পাশে এসে দাঁড়ালো একটা রিকশা। আরোহীকে দেখলেন তিনি, তাঁর অফিসের ছোকরা কর্মচারী, নাম জুয়েল। চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট, রোদ ঠেকাতে মাথার ওপরে ধরে রেখেছে ফাইলের মতো কিছু একটা। তাঁর সামনে থেমে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামাল সে, সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। চাচা, কেমন আছেন? ভালো আছি।

কপাল কুঁচকে গেছে মোজাম্মেল সাহেবের, অফিসে যাচ্ছ? নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন প্রশ্ন, এত সকালে সে অফিসে ছাড়া আর কোথায় যাবে? কিন্তু কেন যেন মানুষ সবসময় অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে বেশি করে। জি চাচা। উঠে পড়ুন। আমরা একই পথের পথিক, গল্প করতে করতে চলে যাবো। না না, এই তো, বাসে করে চলে যাবো।

আরে চলুন তো চাচা। না গেলে কষ্ট পাবো। না করলে শোনার ছেলে নয় জুয়েল, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে রাস্তায় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে। হয়তো দেখা যাবে রিকশা থেকে নেমে এসে পায়ে পড়ে গেছে। অতি বিনয়ী লোক থেকে সাবধানে থাকতে হয়, মোজাম্মেল সাহেবও সবসময় জুয়েল থেকে সাবধানে থাকেন, কিন্তু ভাগ্যের ফের, এই ছেলেটা কী করে যেন সবসময় তাঁর কাছেই উপস্থিত হয়।

অগত্যা তাঁকে রিকশায় উঠতে হল। জুয়েল ছেলেটা এমনিতে খারাপ নয়, কিন্তু খুঁজলে অনেক দোষ বেরিয়ে পড়ে। ছেলেটা চেইন স্মোকার, নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়ছে। তাঁর মতো একজন মুরুব্বী বয়সী লোককে ডেকে নিয়ে তুলেছে রিকশায়, কিন্তু সিগারেট ফেলেনি, পাশ ফিরে টেনে চলেছে। এ ব্যাপারে তার কোন সংকোচ আছে বলে মনে হল না, শুধু ধোঁয়া ছাড়ার সময় অন্যদিকে ফিরে ছাড়ছে।

লাভ হচ্ছে না যদিও, বাতাস এই দিকেই বইছে, সব ধোঁয়া এসে মোজাম্মেল সাহেবের মুখে পড়ছে। বাধ্য হয়ে তিনি বলে ফেললেন, ধোঁয়া আমার সহ্য হয় না, সিগারেটটা ফেলে দাও, জুয়েল। আই অ্যাম সরি, চাচা। বলে ফেলে দিল জুয়েল। মোজাম্মেল সাহেব দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।

সময় খারাপ, এখনকার ছেলেমেয়েরা বদমায়েশের চূড়ান্ত। এদের পরের জেনারেশন কী করবে তা ভাবতেও হৃদকম্প হয়। তিনি যখন এই বয়সী ছিলেন, তখন বাবার বয়সী কারো পাশে বসে সিগারেট খাওয়ার কথা চিন্তাও করা যেত না। মনে আছে, পাড়ার চায়ের দোকানে বসে একদিন ধূমপান করছিলেন, আশেপাশে কেউ অভিযোগ করার মতো ছিল না। কিন্তু কোথা থেকে যেন উড়ে এলেন বাবা, সবার সামনে তরুণ বয়সী মোজাম্মেলকে ধরে নিয়ে গেলেন, তারপর ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আন্দাজ করেছিলেন তিনি, কিন্তু কতটা খারাপ কল্পনা করেন নি। মশারীর স্ট্যান্ড খুলে নিলেন তাঁর বাবা, তারপর সেটা দিয়ে পেটানো শুরু করলেন। জন্তুর মতো ভোঁসভোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, "সিগারেট খাস, সিগারেট? গোঁফ না গজাতে বিড়ি ধরাতে শিখেছিস? মুরুব্বীদের মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়িস? এরপর তো সেয়ানা মেয়ে দেখলে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাবি। " বাবার কথা কানে যাচ্ছে না তাঁর, মার থেকে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আর ওদিকে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছেন মোজাম্মেলের মা, ওগো, ছেলেটা তো মরে যাবে, দরজা খোল। দরজা যখন খোলা হল, তখন মোজাম্মেল সাহেবের বাবার সারা গা দরদর করে ঘামছে, আর মোজাম্মেল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।

ঠোঁট আর কপাল কেটে গেছে, দরদর করে রক্ত পড়ছে। সেদিনই সারা গা ফুলে গেল তাঁর, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো, আকাশপাতাল জ্বর। তাঁর মা সারা গায়ে সেঁক দিতে লাগলেন, আর থেকে থেকে আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। আহা রে, আমার ছেলেটাকে কীভাবে মেরেছে। এতবড় ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে? কিন্তু সব কথাই ছিল আড়ালে, বাবার সামনে কেউ টুঁ শব্দটি করার সাহস পেত না।

তিনি কোন অন্যায় করলেও না। পরিবারে এমন একজন ডোমিনেটিং পারসন থাকলে সেই পরিবারের আর সবাই কেঁচো চরিত্রের হয়ে যায়, বাবাকে দেখলেই তাঁরা সব ভাইবোন পারলে গর্তে ঢুকে পড়তেন। পরিবার ছিল বাবার "আল্টিমেট কন্ট্রোলে"। সেই একদিনের ধোলাই খেয়েই সিগারেট জিনিসটার ওপর ঘেন্না ধরে গেল তাঁর, জীবনে আর ছুঁয়েও দেখতে রুচি হল না। বাবা বেঁচে নেই, জাঁদরেল মানুষটি একদিন ধপাস করে হার্ট অ্যাটাকে মরে গেলেন।

কিন্তু বাবার অভাব বোধ করেন মোজাম্মেল সাহেব, আজকালকার ছেলেপিলেদের জন্য দরকার এমন একজন বাবা, যাকে দেখলেই ছেলেমেয়েরা সব প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। এখনকার ছেলেমেয়েরা হাড়ে-মজ্জায় বজ্জাত। তাদেরকে সকালে উঠে একবার পেটানো উচিৎ, যাতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সোজা হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় আরেকদফা পেটানো হবে, তাতে পরদিন সকাল পর্যন্ত সিধে হয়ে থাকবে। এটা খুব পরীক্ষিত এবং ফলপ্রসূ উপায়।

এর কারণও আছে, বাঙালি হল গোলামের জাতি, দুশো বছর ধরে গোলামী করেছে তারা, ইংরেজের লাথিগুঁতো খেয়েছে, তাই হার্ড ট্রিটমেন্ট তাদের জন্য খুব ভালো কাজ করে। দীনবন্ধু মিত্রের নাটক "নীলদর্পণ" নাটকেও শ্যামচাঁদ চাবুক দিয়ে পেটানোর কথা আছে, এতে "শালালোক" বড় শাসিত হয়। রক্ত থেকে এটা এখনো যায় নি। নিজের সাথে নিজের বাবার তুলনা করেন মোজাম্মেল সাহেব, বাবা যেমন সবকিছু হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন, তিনি কি তেমন পেরেছেন? পারেননি। সবাইকে একা টানছেন, সেটা কারো আচরণে মনে হয় না।

বরং উল্টো সবাই কেমন যেন একটা অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখে তাঁকে, অন্তত তাঁর তাই ধারণা। দেশ নিয়েও অনবরত চিন্তা করেন তিনি, বয়সের সাথে অর্থহীন চিন্তা কমে আসার কথা, বিচক্ষণতা বাড়ার কথা। দেশ, সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদি বড় বড় বিষয় নিয়ে চিন্তা করার মতো অর্থহীন কাজ আর নেই, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেয়ার মতো, কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে উল্টোটা হচ্ছে, তাঁর ধারণা, দেশেরও এমন একজন নেতা দরকার, যে শ্যামচাঁদ চাবুক দিয়ে পিটিয়ে সবাইকে সিধে করে রাখবে। দেশে এমন নেতার খুব অভাব, সব তো চোর আর বাটপার। তিনি গণতান্ত্রিক একটি দেশে থেকেও ভাবেন যে মিলিটারি শাসনের মতো আর কিছু নেই।

ভাবতে ভাবতে অনেক কথাই ভেবে ফেললেন মোজাম্মেল সাহেব, তারপর জুয়েলের দিকে তাকালেন। এমনিতেই জুয়েলকে তাঁর পছন্দ নয়, কিন্তু আজ কেন যেন ওর সবকিছুই চোখে লাগছে, এবং ইচ্ছে করছে কষে একটা চড় লাগাতে। সে গোড়া থেকেই চাচা ডাক ধরেছে, অফিসের মধ্যে যে চাচা ডাক চলেনা, সেটা তাকে বোঝানো যায়নি কোনভাবেই। সবাইকে তো আর ডাকি না, চাচা। শুধু আপনাকে।

আপনার সাথে আমার মৃত চাচার চেহারার অসম্ভব মিল, বলেই চেহারাটা কাঁদোকাঁদো করে ফেলে সে, তিনি আর কিছু কীভাবে বলেন? ছেলেটার রুচিও খুব উঁচুমানের ঠেকছে না, সে হলুদ শার্টের সাথে পরেছে একটা সাদা আধময়লা প্যান্ট। সে কি জানেনা যে তাকে ছাগলের মতো লাগছে? পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত কম্বিনেশন বোধহয় হলুদ শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট। আবার সেই সাথে পড়েছে চকলেট কালারের জুতো, সবকিছু আলাদা আলাদাভাবে যেন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। বিরক্তিতে উসখুস করতে লাগলেন তিনি। সানগ্লাস খুলে নিয়েছে জুয়েল, দেখা গেল, তার চোখ লাল।

নেশা-ভাং করেনা তো? আজকালকার ছেলেপুলেরা তো কিছুই বাদ দেয় না, তরল বায়বীয় কঠিন, সব নেশাই করে। নিজের ছোট ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর, আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ছেলেটাও বোধহয় শুরু করেছে। এমন একটা ভদ্র ঘরে কিনা নেশাখোর ছেলে, ভাবা যায়? যাকগে, পরের ছেলে নিয়ে এত ভাবছেন কেন তিনি, আগে তো নিজের ঘর সামলাও! জুয়েল ছেলেটার দাঁতও ময়লা, গাঢ় হলুদ, দেখে খারাপ লাগলো তাঁর। দাঁত হল অমূল্য ধন, দাঁত দেখে মানুষ চেনা যায়। ময়লা দাঁতের লোকেরা সুবিধার হয়না।

পরিষ্কার দাঁত সুরুচির পরিচায়ক। তবে যুগ পাল্টেছে, ময়লা কিংবা পরিষ্কার, কোন দাঁতের লোকই সুবিধার নয়। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনে চলেছে জুয়েল, আর থেকে থেকে মাথা নাড়ছে। হাঁটুর ওপর টাট্টু বাজাচ্ছে, পাশে বাবার বয়সী একজন বসে আছে, তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখানোর প্রয়োজন বোধ করছে না। নিজের ছেলে হলে কী করতেন তাই ভাবছেন মোজাম্মেল সাহেব।

সবচেয়ে অস্বস্তি দেয় যে ভাবনাটা, সেটা হল জুয়েলের চালচলন। সে রিকশায় করে অফিসে যায়, রিকশা করে আসে। যাওয়া আসায় কমপক্ষে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ একশো টাকা খরচ হওয়ার কথা। তার র‍্যাঙ্কের একজন কর্মচারীর বেতন কত হতে পারে? খুব বেশি নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু তার চালচলন একেবারে শৌখিন লোকের মতো।

চুপ করে নেই জুয়েল, অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে তাঁকে। চাচা, সোনালি ব্যাংকের তহবিল তছরুপ হয়েছে, শুনেছেন তো? সরকারের লোক নাকি জড়িত, হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ। (জুয়েলের হাসিটাও বিশ্রী ঠেকল মোজাম্মেল সাহেবের কাছে, সুন্দর হাসির লোকের মনটাও সুন্দর হয়। অসুন্দর হাসির লোকের মন হয় অসুন্দর। ) ভার্সিটিগুলোতে কী শুরু হল বলুন তো? সেদিন তো দেখলাম পেপারে ছবি দিয়েছে একজনের গায়ের উপর উঠে পাড়াচ্ছে, হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ।

হাসলে আলজিব পর্যন্ত দেখা যায় জুয়েলের, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতো দৃশ্য। কোন প্রশ্নের জবাব দিলেন না তিনি, তবে সেটা নিয়ে জুয়েলের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। মোজাম্মেল সাহেব জুয়েলের ডাকাতেমার্কা হাসি শুনতে শুনতে যাত্রা শেষের অপেক্ষা করছেন, এ জার্নি বাই রিকশা। পথ ফুরোল, রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে গেলেন, হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো জুয়েল। আরে আরে করেন কী? আমি দিচ্ছি চাচা।

জোরাজুরি করলেন না তিনি, লাভ নেই। ছেলেটা তাঁকে কখনো ভাড়া দিতে দেয় না। নিজের অজান্তেই মনে হয় তাঁর, অল্প অল্প করে ছেলেটার কাছে ঋণী হয়ে পড়ছেন তিনি, শোধ দিতে পারছেন না। হোক না সামান্য রিকশাভাড়া, তবুও টাকা তো। কারো কাছে এক টাকার ঋণ নিলে তাঁর ঘুম হয় না, বাবার স্বভাব পেয়েছেন তিনি।

বাবারও অভাবের সংসার ছিল, নানাকারণে যার-তার কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো। সেটা শোধ না করা পর্যন্ত তিনি ঘুমোতে পারতেন না। সেই স্বভাব মোজাম্মেল সাহেবের মধ্যেও এসেছে। মোজাম্মেল সাহেব তাঁর বহুদিনের পুরনো চেয়ারে এসে বসলেন, তাঁর কলম পেষা শুরু করলেন। আরও কিছুদিন নিষ্ঠার সাথে এই কাজ করে যেতে হবে।

এই অফিসের সর্বোচ্চ পদে বসে যিনি এই অফিস চালান, তাঁর নাম মোহাম্মদ সোলায়মান চৌধুরী। তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি। অফিসের সবকিছুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো দেখেন, সন্দেহ নেই, দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় তিনি ঝুলিতে জমা করেছেন অনেক অভিজ্ঞতা, কিন্তু তাঁর ব্যবহারে অহংকারের লেশ মাত্র নেই। তিনি সবাইকেই আপনি করে বলেন, এমনকি "এক আঙুলে ছোকরা" জুয়েলকেও। মোজাম্মেল সাহেব তাঁর অতি প্রিয় পাত্র।

প্রায় সময়ই তাঁকে নিজের কামরায় ডেকে গল্পগুজব করেন, যা তাঁর মতো একজনের কাছ থেকে আশাই করা যায় না। কাজকর্ম বাদ দিয়ে তিনিও গল্প করে আসেন, বড় সাহেবের ডাক উপেক্ষা করা যায় না। উপর মহলের কাছের মানুষদের তাড়াতাড়ি প্রমোশন হয়, কথাটা সত্যি নয়। এতবছর ধরে বড় সাহেবের সাথে খেজুরে আলাপ করেও মোজাম্মেল সাহেব প্রমোশন পাননি। হয়তো তাঁর সত্যিকারের কাছের মানুষ হতে পারেননি।

কয়েকটা ডকুমেন্টের কপি তৈরি করছিলেন মোজাম্মেল সাহেব, তখন ডাক পেলেন বড় সাহেবের। যান, চা খেয়ে আসুন, অমায়িক হাসি হেসে বললেন জামিল সাহেব। শুষ্ক হাসি হেসে তিনি রওনা হলেন। কাঁচে ঘেরা সুন্দর গোছানো একটা রুম। টেবিলে চারটি টেলিফোন, প্রায় সময়ই কোন না কোন জায়গায় সোলায়মান সাহেব কথা বলছেন।

তার মধ্যে থেকেই আশ্চর্য কৌশলে তিনি মোজাম্মেল সাহেবের সাথে কথা বলেন, দু’পক্ষের কারোরই অসুবিধা হয় না। এখন তিনি কানে ধরে আছেন লাল টেলিফোনটা, বলে চললেন, হ্যাঁ, বলুন। ঐ শিপমেন্টটা পাঠাতে হবে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আজকের মধ্যেই পাঠাতে হবে, কী বললেন? পাঠাতে পারবেন না? তাহলে কিন্তু আমাকে অন্য রাস্তা দেখতে হবে। না না, হুমকি দেবো কেন, আমার অপিনিয়নটা শুধু বলছি।

জি, পাঠিয়ে দেবেন। বসুন মোজাম্মেল সাহেব। আপনার খবর কী? না না, আপনাকে বলিনি, আমার সামনে এখন আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ বসে আছেন, তাঁকে বলেছি। হ্যাঁ, তাহলে ওটা পাঠিয়ে দেবেন, ঐ কথাই রইলো। রাখি।

চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন সোলায়মান সাহেব, তিনি আকারে ছোটখাটো মানুষ, পুরো শরীরটা চেয়ারের ভেতরে ডুবে আছে। কেমন আছেন, হক সাহেব? জি স্যার, আপনাদের দোয়ায় ভালো। চা খাবেন? জবাব দেবার আগেই তিনি বেল টিপে চা আনতে বলে দেন। গরম পড়েছে খুব, তাই না? জি স্যার। সোলায়মান সাহেবের মুখ হাসিহাসি, তাঁকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।

মোজাম্মেল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আপনাকে আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। হ্যাঁ, খুশির কারণ ঘটেছে বৈকি। কী, স্যার? বলা যাবে? অবশ্যই বলা যাবে। আমাদের সাথে একটা বিদেশী কোম্পানির বিশাল ডিলিং হয়েছে, ওদের কাছ থেকে আমরা বড় অ্যামাউন্টের একটা টাকা পাবো। বিনিময়ে ওরা কী নেবে জানেন? কী? আমাদের কিছু কর্মচারীকে ওদের কাছে পাঠাতে হবে, হা হা হা।

ও, সে তো ভালো কথা। খুবই ভালো কথা। আপনি একটু পরামর্শ দিন তো, কাকে পাঠানো যায়? স্যার, আমি সামান্য কর্মচারী, আমি ... ... না না, লজ্জা করবেন না। আমি সবসময় সবার কাছ থেকে পরামর্শ নিই, তারপর সিদ্ধান্ত নিই। অন্য সেকশনের মজুমদার সাহেবের অ্যাডভাইসও নিয়েছি, আপনার সাথে মিলিয়ে দেখবো।

কয়েকজনের নাম বললেন মোজাম্মেল সাহেব। আরও কিছু বিষয়ে কথা হল, তারপর বেরিয়ে এলেন মোজাম্মেল সাহেব। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে, ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবারটা সারতে হবে। খাবার ভালো নয়, কিন্তু কী আর করা? কোনমতে নাকেমুখে গুঁজে দেয়া। দামে সস্তা।

বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসা আরেক হাঙ্গামা। সোলায়মান সাহেব মিথ্যা বলেছেন। বিদেশী কোম্পানির সাথে কোন ডিল হয়নি। আজকাল তাঁর এই সমস্যা হয়েছে, ক্রমাগত মিথ্যা বলেন। তিনি অত্যন্ত উঁচু পদে বসে আছেন, সামান্য কর্মচারীদের সাথে মিথ্যে বলার কোন দরকার নেই, তারপরও বলেন।

কে জানে, এটা হয়তো কোন অসুখ, মানসিক রোগের চিকিৎসকদের ভাষায় হয়তো এর কোন একটা গালভরা নাম আছে। প্রায়ই এখানে-সেখানে মিথ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। যে কারণে অকারণে চুরি করে তাকে বলে "ক্লেপ্টোম্যানিয়াক"। যে কারণে অকারণে মিথ্যে বলে তাকে কী বলে? এই কোম্পানি বলতে গেলে এখন সূঁচের ডগায় বসে আছে, যেকোনোদিন বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে লালবাতি জ্বলে যাবে, ফোলানো বেলুনটা চুপসে গেলো বলে। সোলায়মান সাহেব খুব সাবধানে নিজের দিকটা গুছিয়ে নিচ্ছেন, কেউ যেন কিছু ধরতে না পারে।

কাজটা সহজ নয়, সর্বোচ্চ আসনে বসেও খুব সহজ নয়। নানা ফ্যাঁকড়া বাঁধছে, নানা হিসাবে গণ্ডগোল। সব টাকা সিঙ্গাপুরের একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেনামে সরিয়ে ফেলছেন তিনি, সেটা একধাপে করা যাচ্ছে না, ভেঙে ভেঙে টাকা নিতে হচ্ছে। খারাপ কিছু যদি ঘটেই যায়, তাহলে যেন তিনি নিজে না ডোবেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও তিনি রোজ মোজাম্মেল সাহেবের সাথে গল্প করে যাচ্ছেন, হয়তো করেই যাবেন।

সহজ সরল এই কর্মচারীটি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন না, পারার কথাও নয়। দেখতে শুনতে সজ্জন এই লোকটি আসলে অনেক ধুরন্ধর, সব বড় মাপের বিজনেসম্যানকেই খুব ধুরন্ধর হতে হয়। তিনি তাঁর কর্মচারীদেরকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। মোজাম্মেল সাহেবকে নিয়েও খেলেন। গল্পের ছলে তিনি বের করে নিয়ে আসেন অনেক কিছু, তিনি নিশ্চিত, কোম্পানির একজনও ভেতরের খবর জানে না, নিকট ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে।

নিজের ভেতরে দুশ্চিন্তা গোপন করে রাখতে পারার ক্ষমতা আছে সোলায়মান চৌধুরীর। তাঁর কোম্পানি এখন তলা ফেঁসে যাওয়া একটা জাহাজ, যেটা ডুবে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। নানা জায়গা থেকে দুঃসংবাদ আসছে, সেটা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু সোলায়মান চৌধুরী মুখ হাসিহাসি করে রেখেছেন। দুশ্চিন্তা ভেতরে চেপে রাখলে প্রথমে যেখানে প্রভাব পড়ে তা হল পরিপাকতন্ত্র।

প্রথমেই পেটের গোলমাল দেখা দেয়। সোলায়মান চৌধুরীরও এই সমস্যা হয়েছে, যা খান তাই বদহজম হয়ে যায়, টক ঢেঁকুর ওঠে। মিথ্যা বলতে আজকাল আর খারাপ লাগে না তাঁর, ব্যবসা মানেই মিথ্যা বলা। সামান্য সেলসম্যান থেকে বিশাল শিল্পপতি পর্যন্ত মিথ্যা বলে। কারণে অকারণে বলে, সময়ে অসময়ে বলে।

একসময় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় ব্যাপারটা, দেখা যাবে হয়তো ভুলক্রমে একটা সত্যি কথা বলে ফেললে শরীর গুলাচ্ছে। উপরে ওঠার রাস্তা হল ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলা। আজ যে এই পজিশনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, তার পেছনে আছে অনেকগুলো মিথ্যা। দুশ্চিন্তা আরেকটা যোগ হয়েছে। তাঁর স্ত্রী ফোন করেছিলেন, জানিয়েছেন দুর্ঘটনার কথা।

তাঁর ছেলে কী একটা "ওষুধ" খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছে। এখন হাসপাতালে। নেশাখোর ছেলের এই দশা আজ হোক কাল হোক হবেই, তিনি জানতেন। নিশ্চয়ই এবার লিমিট ঠিক রাখতে পারেনি, এখন মরণবাঁচন দশা। তিনি হাসপাতালে যাবেন, তবে এখন নয়, রাতে।

তাঁর এখন অনেক কাজ, সেগুলো সারতে হবে। অপদার্থ ছেলের জন্য উতলা হবার কোন কারণ নেই। ২. অফিসের বড় ঘড়িটা পাঁচবার ঢং ঢং করে জানিয়ে দিল, সময় শেষ। সবাই বেরিয়ে এলো। ধীরে ধীরে নিজের ফাইলপত্র গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন মোজাম্মেল সাহেব।

জামিল সাহেব বিদায় নিয়ে আরেকদিকে চলে গেলেন, তাঁর বাড়ি খিলগাঁও, লেগুনা নামক হিউম্যান হলারে চড়লেন। এই ছোট্ট জিনিসটার ভেতরে এতজন মানুষ কী করে ধারণ করে কে জানে? আবার পা-দানিতে ঝুলতে থাকে আরও তিন থেকে চারজন। দুটো পয়সা বাঁচাতে মানুষ কত কষ্টই না করছে। মোজাম্মেল সাহেব বাসের অপেক্ষায় আছেন, এমন সময় জুয়েল এসে বলল, চাচা, চলুন একসাথে যাই, রিকশা ঠিক করেছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি উঠে বসলেন।

মোজাম্মেল সাহেবের বাসা এসে গেছে, তিনি বললেন, জুয়েল, আমার ব্যাগটা ধর তো। রিকশা থেকে নামবো। নেমে তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিয়ে দিলেন তিনি, মানা করার সুযোগ পেল না জুয়েল। সবসময় তো তুমিই দাও, জুয়েল, আজ না হয় আমি দিলাম। ছি ছি, আমাকে লজ্জা দিলেন চাচা।

বড়ই শরমিন্দা করলেন। একটা ছোট কৌশল খাটিয়েছেন মোজাম্মেল সাহেব, ব্যাগটা হাতে থাকায় জুয়েল ভাড়া দিতে পারেনি, তিনি দিয়েছেন। আপোষে কিছুটা ঋণ কমিয়ে নেয়া গেল, ভাবলেন তিনি। একটা টিনের বাসা মোজাম্মেল সাহেবের, নিচু গেট হাত ঢুকিয়ে খোলা যায়। খুললেই বারান্দা চোখে পড়ে, বড় টানা বারান্দা।

গেটটা খুলে মেজাজটা আরও খারাপ হল তাঁর। বারান্দায় হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি তুলে বসে আছে তাঁর বড় জামাই, ঘসঘস শব্দ করে লোমে ভরা পা চুলকোচ্ছে। দৃশ্যটা এত কুৎসিত লাগলো তাঁর কাছে যে বলার মতো নয়। তাঁকে দেখে অবশ্য সে লুঙ্গি নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো, হাসিমুখে বলল, ফিরেছেন বাবা? জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, শোন বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। তুমি আপত্তিকরভাবে বসে পা চুলকোচ্ছিলে, দেখতে ভালো লাগে না।

পা চুলকোতে হলে নিজের ঘরে বসে চুলকোবে, বুঝেছ? মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল নির্মলের, বলল, জি বাবা। তোমার চাকরির কিছু হল? এখনো হয় নি বাবা, জোর চেষ্টায় আছি। আর কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেলেন মোজাম্মেল সাহেব, একটু গরম পানি হলে গোসলটা করে আরাম পাওয়া যেত। আরাম গরীবের ঘরে থাকে না, সব আরাম আয়েশ আশ্রয় নেয় পয়সাওয়ালা লোকের ঘরে। তাদের ঘরে থাকে পানি গরম করার গিজার, দু রকম কল থেকে গরম ঠাণ্ডা দুরকম পানিই আসে।

আর মোজাম্মেল সাহেবের মতো লোকের কপালে আছে ফুটো বালতি। গোসল করতে করতেই উচ্চস্বরে বড় মেয়ে মিলির কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন তিনি, আন্দাজ করতে পেরেছেন তখনই। "ধাড়ী গাধাটা" (বড় জামাইকে মনে মনে এই নামেই ডাকেন মোজাম্মেল সাহেব) নিশ্চয়ই বউয়ের কাছে গিয়ে বলেছে, বাবা আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছেন, আমি একজন এডুকেটেড পারসন, সেটা উনি মনেই রাখেন না। কাজকর্মের মুরোদ না থাকলে কী হবে, ধাড়ী গাধাটার সপ্তাহে তিনদিন নিজের আত্মসম্মানে ঘা লাগে, আর কেঁদেকেটে পাড়া মাথায় তোলে মিলি। কষে একটা চড় লাগাতে পারলে ভালো লাগতো, কিন্তু পারেন না মোজাম্মেল সাহেব।

সব ইচ্ছে পূরণ করা যায় না। ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলা নাকি আজকাল খুব খারাপ আচরণ বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে যেমন-তেমন, আমেরিকায় গায়ে হাত তুললে নাকি পুলিশে ফোন করে দেয় সন্তান, তখন পুলিশ এসে বাবা-মাকে ধরে নিয়ে যায়। এটা কোন উন্নত জাতির লক্ষণ? খারাপ সময় এসেছে, খুব খারাপ সময়। বড়মেয়েকেও দেখতে পারেন না মোজাম্মেল সাহেব, সব কথাতেই আহ্লাদী।

কথার অর্ধেক মুখ দিয়ে বলে, আর অর্ধেক নাক দিয়ে বের করে। বিপদে পড়ে উঠেছি এখানে, আর সামান্য ভাতের খোঁটা? আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। আর বলে দিচ্ছি বাবা, আমার পেছনে তোমার যত টাকা খরচ হয়েছে, পাই পাই করে সব শোধ করে দেবো। বলে সে ঠিকই, কিন্তু যাবে কোথায়? আশ্রয় দেবে কে? ভাত জুটবে কোথা থেকে? মিলির শ্বশুরবাড়িতে কেউ তাদের মুখ পর্যন্ত দেখে না। এরা বাসা থেকে বের হয়ে গেলে স্বস্তিই পেতেন মোজাম্মেল সাহেব, কিন্তু আপদ দূর হচ্ছে না।

ঐ ধাড়ী গাধা আবারো বারান্দায় বসে লোমশ পা চুলকোবে, তিনি নিশ্চিত। মেয়ে এখন ভুলেই গেছে যে একদিন নিজের বেকার স্বামীকে নিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে গিয়েছিল সে। হ্যাঁ, ঘর জামাই। ভার্সিটি পড়ুয়া বড় মেয়ে এই অকাল কুষ্মাণ্ডটাকে একদিন কোর্ট ম্যারেজ করে এসে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে পায়ে পড়ে গেল। দুজনে দুই পা ধরে বসে আছে, মেয়ে আর মেয়ের জামাই, যেমন হাস্যকর তেমনি অরুচিকর দৃশ্য।

তিনি সাফ না করে দিতেন, কিন্তু স্ত্রী পর্যন্ত কেঁদেকেটে ওঠাতে মত পাল্টাতে হয় তাঁকে। সব শেয়ালের এক রা, সব এক ক্ষুরে মাথা মুড়িয়েছে। এখন ভার্সিটিতে লেখাপড়া হয় না, হয় প্রেমপ্রীতি আর গোলাগুলি। সেদিন জলস্পর্শ করলেন না তিনি, মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন বারান্দায়। তখন সবাই মেতে উঠলো আনন্দে।

তিনি রাগে স্ত্রীর সাথে দু’দিন কথা বললেন না। তার স্ত্রীও এমন, টেরই পেলেন না যে তিনি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। যেই অভিমানে কোন সাড়া পাওয়া যায় না, সেই অভিমান নিয়ে বসে থাকা যায় না। বড় মেয়ে সম্পর্কে সবসময় উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন তিনি, বেশ মেধাবী মেয়ে ছিল, রেজাল্ট বরাবরই ভালো করতো। তার চয়েজ এই? একটা "ধাড়ী গাধা" ধরে নিয়ে এসেছে? আরে, ভুল যখন করেই ফেলেছিস, একজনের গলায় যখন ঝুলেই পড়েছিস, তখন ভালো দেখে একটার গলায় ঝুলে পড়তি, পয়সাওয়ালা স্বাবলম্বী একটা ছেলে।

কী দেখে ঐ লোমশ পা-ওয়ালা বেকার ছাগলটার দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিল সেটা মোজাম্মেল সাহেব এখনো ভেবে পান না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বুদ্ধিমান হয় বলে জানতেন, ধারণাটাই পাল্টে গেছে। পয়সাওয়ালা জামাইয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি? হয়তো, অবচেতন মনে। দারিদ্র্য শুধু বাইরেটাকেই ছোট করে না, ভেতরটাকেও ছোট করে দেয়। দারিদ্র্য গুণ নষ্ট করে, সেগুলোকে দোষে বদলে দেয়।

মেধাবী মেয়ে বলে সবকিছু মেনে নিতেন বড় মেয়ের, ধমকধামক দিতেন না। সেটাই ভুল হয়েছে। সেনসিটিভ মেয়ে ছিল, একবার পরীক্ষা খারাপ করে খানিকটা ফিনাইল খেয়ে ফেলেছিল। এখন যায় তখন যায় অবস্থা, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে স্টমাক ওয়াশ করানো হল, বেঁচে ফিরল সে। তারপর থেকেই আহ্লাদী শুরু।

তার তলে তলে যে এই ছিল কে জানতো। অবশ্য আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, এই মেয়েটার রুচি খুবই খারাপ, যে মেয়ে আত্মহত্যার জন্য বাথরুম পরিষ্কারের ফিনাইল বেছে নেয় তার কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়? সেদিনের পর থেকে এই সিন্দাবাদের ভূত মোজাম্মেল সাহেবের ঘাড়ে চেপে বসেছে, এক বছরের মধ্যে তাদের একটা মেয়েও হয়ে গেছে, যে কীনা ঘণ্টায় ঘণ্টায় কাঁথা ভেজায়। জামাইয়ের একমাত্র কাজ বউয়ের পা ধরে বসে থাকা, আর এক বছর বয়সী বাবুর ভেজা কাপড় বদলে দেয়া। চাকরি বাকরির "জোর চেষ্টা" চালাচ্ছে, সবসময়েই বলে, কিন্তু মোজাম্মেল সাহেব জানেন, সর্বৈব মিথ্যা। নাতনীটা কেমন হবে কে জানে, দুই গাধা বাপ-মা থেকে তার জন্ম, নিশ্চয়ই আরেকটা গাধাই হবে।

গোবরে কখনো পদ্মফুল ফোটে না। এই ব্যাপারটাও তাঁকে আর সব কিছুর মতো খুব ভাবায়, সবসময় দেখা যায়, একজন মানুষের এমন একজনের সাথে সম্পর্ক হয়, যে ঠিক তারই মতো। "মুমিনে মুমিনে মিলে, কমিনে কমিন, মুমিনে কমিনে মিলে নাহি কোনদিন। " জামাইকে তিনি মনে করেন এক নম্বরের অপদার্থ, এবং তার প্ল্যান দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। প্রায়ই গা ঘেঁষে বসে গল্প করতে আসে সে, আর তো কয়েকটা দিন।

তারপর আর এখানে থাকবো না, মিলিকে নিয়ে সোজা নতুন বাসা ভাড়া করে উঠবো। বাবা মাকে দেখবেন "গলিয়ে" ফেলবো। তারপর হবে আমাদের "বিবাহোত্তর সংবর্ধনা" অনুষ্ঠান। ধুমধাম হবে। কী বলেন, দারুণ হবে না? একটু দেরীতে, কিন্তু তাতে কী? এসব চিন্তা আসে শুধু মেরুদণ্ডহীন লোকদের।

পৃথিবীর প্রাণীদেরকে দশ ভাগে ভাগ করা যায়, তার মধ্যে নয় ভাগই অমেরুদণ্ডী; তেলাপোকা, শামুক এর মধ্যে পড়ে। শুধু এক ভাগই মেরুদণ্ডী, যেমন মানুষ, কিন্তু বড় জামাইকে দেখে মোজাম্মেল সাহেবের ধারণা হয়েছে, কিছু মানুষকে তেলাপোকার দলে ফেলা যায়। নইলে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা একটা ছেলে ঘরজামাই থাকে? তাও দিনের পর দিন? একটা মেয়ে হয়ে গেছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তা নেই, সে আছে "বিবাহোত্তর সংবর্ধনা" নিয়ে? শরীর মন কোনটাই ভালো যাচ্ছে না মোজাম্মেল সাহেবের, কয়েকদিন ধরেই তিনি খুব অন্যমনস্ক, বিরক্ত। সবসময় মাথায় ঘুরছে আজেবাজে, উল্টোপাল্টা কিছু চিন্তা। কেন? মাঝে মাঝে মাথা খুব গরম হয়ে যায়, হার্টবিট খুব বেড়ে যায়।

তখন তিনি বারান্দায় এসে বসেন, মাথায় পানি ঢালেন। পানি গিয়ে পড়ে বারান্দার ছোট গোলাপ গাছটার ওপরে। লক্ষ করেছেন, তিনি একা একা গাছটার সাথে কথা বলেন। এই বছর ক’টা ফুল দিবি? বেশি করে দিস। ফুল ফোটাবিই যখন, তখন বেশি করে ফোটাবি।

হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে। ভারী লজ্জা লাগে তখন। পেছনে তাকিয়ে দেখেন, কেউ দেখে ফেলেনি তো? মানুষের চেয়ে গাছ ভালো, ভাবেন তিনি। কথা বলতে পারে না, শুধু শোনে। মানুষ শুধু কথা বলে, কাজ করে কম।

এবং অর্থহীন কথাই বেশি বলে। সারাদিন কাজের পর যখন গোসল দেন, শরীরটা খুব ঝরঝরে লাগে। তিনি আজও অনেক সময় নিয়ে গোসল করলেন, যতক্ষণ তিনি গোসল করেন, চোখ বন্ধ করে রাখেন, কল্পনা করার চেষ্টা করেন, তিনি একটা ঝর্ণার পানিতে গোসল করছেন, উপর থেকে অঝোরে নেমে আসছে শীতল পানির ধারা। গায়ে একটা হালকা পাঞ্জাবী চাপিয়ে তিনি ড্রইং রুমে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবেন তিনি, তারপর রাতের খাওয়া খেয়ে ঘুম।

অনেকদিনের রুটিন এটা, কেউ তৈরি করে দেয় নি, আপনাআপনিই তৈরি হয়ে গেছে। সকালের বাসী পত্রিকাটা টেনে নিলেন তিনি। পত্রিকা রাখা একটা বাড়তি খরচ, কিন্তু তিনি এটা কখনো বন্ধ করেন নি। সংবাদপত্র হচ্ছে একটা শিক্ষিত পরিবারের চিহ্ন। বাসী পত্রিকার সাথে গরম চা খুব ভালো যায় না।

টাটকা একটা পত্রিকা হলে খুব ভালো লাগতো। এমন কি উপায় করা যায় না যে রাতে টাটকা খবর নিয়ে একটা পত্রিকা বের হবে? বি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.