আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আহমেদের দেয়ালঃ নিষিদ্ধ বই ??

১৪ই মে দুপুরে বাংলাদেশে যারা টিভি দেখছিলেন তাদের অনেকের ই চোখ আটকে যায় একটি স্ক্রলে। প্রথম বার স্ক্রলের লেজ টুকু আমার চোখে পড়ে। দেয়াল উপন্যাসটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কিত ভুল তথ্যের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত এই নামে বিমল করের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। তার সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যা কান্ডের কোন সম্পর্ক নেই।

এ আবার কোন দেয়াল? কবে প্রকাশিত হল এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে স্ক্রল টি ঘুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটি স্ক্রল ঘুরে আসতে প্রায় ৫ মিনিট সময় লাগে। ৫ মিনিট কম সময় নয়। এর মধ্যে ডোরেমনে অনেক কিছু হয়ে যায়। আমার এগেরো বছরের ছোট মেয়ে চ্যনেল বদলের জন্যে তাড়া দিতে লাগলো।

দুপুরের এই সময়টায় টিভির উপর তার অধিকার ই সব চেয়ে বেশি। শেষ পর্যন্ত পুরো স্ক্রল টি দেখা হল। হুমায়ুন আহমেদের প্রকশিতব্য দেয়াল উপন্যাসটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কিত ভুল তথ্যের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিস্মিত হলাম। প্রকাশিতব্য উপন্যাস নিষিদ্ধ হয় কি করে? প্রকাশকদের বাইরে হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে সবচে বেশি খোজ খবর রাখে ABC রেডিওর আসিফ এন্তাজ রবি।

ফোনে পাওয়া গেল তাকে। তিনি বললেন অনন্যা প্রকাশনী থেকে দেয়াল বের হবার কথা রয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু নিষিদ্ধ হবার কারণ জানেন না। রবির কাছ থেকেই জানা গেল ১১ তারিখে প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে দেয়ালের কিছু অংশ ছাপা হয়েছে। হাতের কাছেই পাওয়া গেল প্রথম আলো।

ব্যস্ততার জন্যে সাময়িকী পড়া হয়নি। সম সাময়িক ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করা এক ব্যপক হ্যাপার কাজ। পাঠক চরিত্র গুলি থাকে পাঠকের পরিচিত। সময়টি আমাদের চেনা। ঘটনা গুলিও কম বেশি জানা।

তবে এক এক জনের জানার পরিধি এক এক রকম । যিনি ঘটনাটি যে ভাবে জানেন তার ব্যতিক্রম হলেই বিশ্বাস যোগ্যতায় টান পড়ে। এসব জানা থাকা সত্তেও হুমায়ুন আহমেদ এই দুরুহ কাজটি বেশ কয়েক বার করেছেন। জোসনা ও জনণীর গল্পে কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি থাকলেও অনাকের মতে এটি মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর সবচে' প্রামান্য উপন্যাস। বাদশাহ নামদার নিয়ে হুমায়ুন কে এ ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

কারন সে গল্প সুদুর অতীতের। সোমেন চন্দের জীবনী নিয়ে সেলিনা হোসেন যে নিরন্তর ঘন্টা ধ্বনি লিখেছলেন, তার জন্যে তাকে সমালোচিত হতে হয়নি। কারন সোমেন চন্দ অনেকের ই পরিচিত নন। ১৯৭৫ তো একেবারে কাছের সময়। এ সময়ের খল ও পার্শ্ব চরিত্রদের অনেকেই এখনও সমাজের আংশ।

১৯৭২- ১৯৭৫ সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ব পূরণ। সদ্য স্বাধীন রাস্ট্রটি বিভিন্ন কারনে তখন পর্যন্ত পূরব- পশ্চিম নিয়ে বিভ্রান্ত। যুক্ত রাস্ট্র ও রাশিয়ার মধ্য ঠান্ডা লড়াই টি তখনও দানা বাধেনি। এ সময় সদ্খেই যে কোন রাস্ট্রের পক্ষেই ফ্রিন্ড শীপ টু অল অ্যান্ড ম্যালিস টু নান, শত্রুমিত্র চেনার একটি বাহানা মাত্র। সেই সময়ের কাছে পরাজিত মানুষ যেমন আছে।

সময়ের কাধে সওয়ার হয়ে বৈতরণী পার হওয়া মানুষ খুব কম নেই। এই সময়কে যারা দেখেছে, তাদের পক্ষে সেই সময় কে নিরাবেগ ভাবে তুলে ধরা শুধু দুরুহ নয়, প্রায় দুঃসাধ্য। হুমায়ুন আহমেদ সাহসী মানুষ। অসাধ্য সাধনে পারঙ্গম। এই বিশ্বাস নিয়েই ১১ তারিখের প্রথম আলো হাতে নিলাম।

সাহিত্য সাময়িকী তে হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসের দুটি অধ্যায় ছাড়াও সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। দেয়াল সম্পর্কে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের বক্তব্যটি পরিস্কার। তিনি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের নতুন উপন্যাস দেয়াল। এটি রাজনৈতিক উপন্যাস। প্রকাশিত হওয়ার আগেই লেখক-গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দেয়াল-এর প্রেসকপি পড়ে জানাচ্ছেন ক্যানসার করাল ব্যাধিটি তাঁকে যে কিছুমাত্র নিঃস্ব করতে পারেনি, বরং পরাজিত হয়েছে, উপন্যাসটি তার প্রমাণ তিনি এই লেখাটিকে দেখছেন ইতিহাসের দায় মুক্তি হিসাবে।

তার ভাষায় আমাদের জীবনকালের যে ইতিহাসে আমরা ছিলাম, তা নিয়ে যখন বিতর্ক সৃষ্টি হয়, নানা বিকৃতির রং তার ওপর চাপানো হয়, তখন একজন ইতিহাসবিদের ভূমিকা নিশ্চয় হওয়া উচিত সত্যসন্ধানীর। যখন সে রকম উদ্যোগ চোখে পড়ে না, অথচ ইতিহাসের সত্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তখন একজন লেখক নামতে পারেন সেই সত্যসন্ধানীর ভূমিকায়। দেয়াল উপন্যাসে সেই কাজটি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ এবং আমাদের অনেকের স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটে যাওয়া একটি বছরের ঘটনাবহুল কয়েকটি দিনের ইতিহাস একটি গল্পের আবরণে সাজিয়েছেন অপূর্ব নিপুণতায়। এই উপন্যাসে তিনি কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন। তিনি আরও বলেন বঙ্গবন্ধু গল্পের কয়েক জায়গায় আবির্ভূত হন।

তাঁকে খুব অন্তরঙ্গ, কিছুটা আমোদপ্রিয় মানুষ হিসেবে আমরা দেখি, অথচ তাঁকে ঘিরে ভয়ানক যে কূটচালগুলো খেলতে থাকে খলনায়কেরা, সেগুলো যখন বর্ণনা করেন ঔপন্যাসিক, আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধু মানুষ চিনতে কখনো কখনো ভয়ানক ভুল করেছেন, ট্র্যাজিক নায়কদের মতো, যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদকে, খালেদ মোশাররফকে; হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন; কর্নেল তাহেরকে পুনরধিষ্ঠিত করেছেন তাঁর বীরের আসনটিতে। এ দুই চরিত্রের এক আশ্চর্য নিরাবেগ চিত্রায়ণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের দায় থেকেই। এ উপন্যাসে জিয়াউর রহমানও আছেন এবং আছেন তাঁর ভূমিকাতেই। জিয়ার প্রাণ রক্ষাকারী বন্ধু কর্নেল তাহেরকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, দেখা গেল কর্নেল তাহেরের কোনো অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে, শুধু অসম্ভব এক স্থিরচিত্ততার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বীরত্ব এবং দেশপ্রেম কাকে বলে তার এক অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন। উপন্যাসটিতে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও আছেন, যেহেতু নিজেও তিনি পঁচাত্তরের ইতিহাসে ছিলেন।

এই ইতিহাসকে দেয়ালবন্দী হতে দেখেছেন, ফলে দেয়ালটা ভাঙার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে হয়তো এ তাঁর নিজস্ব দায়মুক্তি। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের লেখাটি আমার কাছে দেয়াল পড়ার ক্ষেত্রে একটি তাড়না হিসাবে কাজ করে। প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে উপন্যাসটির ৪ও ১০ অধ্যায়। ৪ পড়তে গিয়ে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি।

কর্নেল ফারুকের যে চেহারাটি আমরা চিনি দেয়ালের ৪রথ অধ্যায়ের ফারুকের সাথে তার মিল নেই। ফারুক মুক্তি যুদ্ধের সময় মধ্য প্রাচ্যে প্রশিক্ষণ রত ছিলেন। ১২ ই নভেম্বরের পর তিনি পক্ষ ত্যাগ করতে সক্ষম হন। যুদ্ধে যোগ দেন তার ও পরে। ফলে মুক্তি যোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম ঊঠতে একটু সমস্যা হয়।

যুদ্ধের পর এই সমস্যার সমাধানের জন্যে সুপারিশ করেন তার মাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। কিন্তু ফারুক কার অধীনে কোন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিষয়টি স্পস্ট হয়নি। দুর্জনেরা বলে ফারুক যুদ্ধে যোগদান ্করার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই কথাটি বিশ্বাস করে না। হুমায়ুন আহমেদ এই রকম একটি চরিত্র কে এত বড় যোদ্ধা হিসাবে কেন ফুটিয়ে তুললেন মাত্র একটি অধ্যায় পড়ে সেটি বুঝা সম্ভব নয়।

আবার এই উপন্যাসেই তিনি ওসমানীকে লেঃ কর্নেল হিসেবে বর্ণনা করেছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসাবে কখনও মেজর মহিউদ্দিন ক খনও নুর কে চিহ্নিত করেছেন। সব মিলিয়ে মনে হয়েছে তথ্য গত বিভ্রান্তি আছে। পুরো না পড়ে মন্তব্য করা ঠিক হচ্ছে না। ১৫ তারিখের পত্রিকায় আদালতের বক্তব্য এসেছে এ ভাবে আদেশ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে বিব্রত করতে চাই না’ সংশোধন করে ‘দেয়াল’ প্রকাশের আশা আদালতের খবরে বলা হয় গত ১১ মে প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিতব্য ‘দেয়াল’ উপন্যাসের দুটি অধ্যায় ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, দেয়াল হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিতব্য রাজনৈতিক উপন্যাস।

এ উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭৫ সালে ঘটে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনা। সেখানে শেখ রাসেলের মৃত্যুর বর্ণনা ও খন্দকার মোশতাকের ভূমিকার সম্পর্কে ছাপা তথ্যের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গতকাল সোমবার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মাহবুবে আলমের এই দৃষ্টি আকর্ষণের প্রেক্ষিতে আদালত জানান ‘হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমরা কোনো আদেশ দিয়ে তাঁকে বিব্রত করতে চাই না।

তবে নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানুক, সেটাও আমরা চাই না। ’ এছাড়া হুমায়ুন আহমেদ কে সঠিক তথ্য সরবরাহের ও নিরদেশ দেওয়া হয়। আমি আদালতের বক্তব্য শুনে কনফিউজড। আদালতের বক্তব্য প্রে মনে হয় না যে উপন্যাস টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে টিভির স্ক্রলে স্পস্ট করেই বলা হয়েছে নিষিদ্ধের কথা।

আদালতের বক্তব্যের পর বিভিন্ন মহলে ব্যপক আলোচনা হয়েছে। প্রথম আলো ব্লগে বেশ কয়েক জন ব্লগার আশা প্রকাশ করেছেন। এই বইএর ব্যাপারে আইনি জটিলতা অচিরেই নিরশন হবে। দেয়াল প্রকাশিত হবে আমাদের মনের দেয়াল ভেঙ্গে দেবার জন্যেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.