আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি বৈদ্যুতিক পাখা - গল্প

নিজে সুখে থাকুন প্রিয়জনকে সুখে রাখার চেষ্টা করুন কয়েকদিন ধরেই আমার মনটা ভাল যাচ্ছিল না। জানি দিন সবার সমান যায়না। কিন্তু পরীক্ষার টেনশন, প্রেমিকের সাথে মনোমালিন্য,পরীক্ষার খারাপ ফলাফল--- সবকিছু মিলিয়ে প্রচন্ড হতাশা গ্রাস করে নিচ্ছিল আমাকে দিনের পর দিন। মেডিসিন ওয়ার্ডটা আজ অন্য সব দিনের চেয়ে একটু বেশিই হট্টগোলে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছিল আমার কাছে। বিরক্তি নিয়ে পুরো ওয়ার্ডটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম।

রোগীর সাথে তার আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে পুরো ওয়ার্ড মেতে রয়েছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ রেজিস্টার আর ইন্টার্ণি ডাক্তারদের উপস্থিতি যেন একটু বেশি চোখে পড়ছিল। ক্লাস না হওয়াতে আর সামনেই ওয়ার্ড ফাইনাল থাকায় আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পেন্ডিং আইটেম ( ভাইভা পরীক্ষা) ক্লিয়ার করতে একজন দু’জন করে স্যারদের রুমে ঢুকছিল, আবার বের হচ্ছিল। একেবারে শেষ মাথায় ২৬ নম্বর বেডের চারধারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস করছিল তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। চারদিকে প্রচন্ড হই-হট্টগোলের ভীড়ে আনমনে একা একা ওয়ার্ডের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমি।

মাঝে মাঝে কোন কোন বেডে যেয়ে রোগির ফাইল চেক করছিলাম চুপচাপ। হতাশ আমি আরও হতাশার জলে নিমজ্জিত হচ্ছিলাম যেন। মনে পড়ল অনেকদিন কোথাও বেরাতে যাইনা, বন্ধুদের সাথে প্রাণ খুলে আড্ডা মারিনা, লেখালেখি করারও সময় পাইনা, এমনকি নিজেকে নিয়ে যে একটু ভাববো, সেই সুযগটুকুও যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে! মেডিসিন ওয়ার্ডের একেবারে সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে। উপরে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। খোলা জায়গাটা অবশ্য বেশিরভাগ সময়েই ফাঁকা থাকেনা।

গ্রীষ্মের এই ভ্যাপসা গরমে কেউ না কেউ ওখানে এসে দাঁড়াচ্ছে একটুখানি ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া পাওয়ার আশায়। আজ অনেকদিন পর ফ্যানটার দিকে তাকালাম আমি। কিংবা বলা যায় এই প্রথম ফ্যানটাকে নিয়ে একটু ভাববার অবকাশ পেলাম! বৈদ্যুতিক ফ্যানটার তিনটা পাখাই অনবরত ঘুরে চলেছে, সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। তার যেন কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন অভাব-অভিযোগ! হাস্পাতালে লোডশেডিং হয়না বলে এই গরমে এক মুহূর্তের জন্যেও ফ্যানটা বিশ্রামের সুযোগ পায়না। সে শুধু ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।

সে পরিশ্রান্ত কিংবা ক্লান্ত কিনা তা ভেবে দেখার ইচ্ছা অথবা সময় কারও নেই। ফ্যানের দিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম আমারও ঠিক এই মুহূর্তে এই ফ্যানটার মতই দুরবস্থা! সেই ভোর থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত একটার পর একটা ক্লাস,ওয়ার্ড, আইটেম, পরীক্ষা, টেনশন, হতাশা! সারাদিন শুধু ছুটেই চলেছি, ছুটেই চলেছি ঠিক এই ফ্যানের পাখা তিনটির মতই! কোন বিশ্রাম নেই, নেই নিজেকে নিয়ে এক দন্ড ভাববার অবকাশ। এই যে আমি ছুটে চলেছি অক্লান্তভাবে, তা নিয়ে কারও যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই। কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু দিনের পর দিন ছুটতে ছুটতে আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, দগ্ধ,হতাশ।

অথচ কারও কাছে কোন অভিযোগ জানানোর ক্ষমতা নেই আমার, নেই রাগ প্রকাশের কোন সুযোগও। ফ্যানটার মতই নির্বাক আমি নিজের বিশ্রামের ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করে নিজের সাথেই প্রতারণা করে যাচ্ছি! সবার মতই ফ্যানের অলার এই একটু খানি জায়গাটা আমারও বেশ প্রিয়। উল্টো-পাল্টা চিন্তা ভাবনায় মাথা গুলিয়ে গেলে নিজেকে ঠান্ডা করতে খাণিক্ষণ পরপরই ফ্যানটার নিচে এসে বাতাস খাচ্ছিলাম আমি। প্রতিদিনের মত আরও কয়েকজন ওখানে দাঁড়িয় গল্প-গুজব করছিল। প্রিয় বান্ধবী মনীষা ছাড়া আর কেউ নেই যার সাথে আমি মন খুলে গল্প করতে পারি, কিন্তু মনীষা দু’দিনের জন্য ঢাকা গেছে জরুরী কাজে।

তাই নিজেকে ভীষণ নিঃসংগ লাগছিল আজকে। একটা মেসেজ দিলাম ওকে, ‘মনীষা, তুই কবে আসবি?” যদিও জানি, ও আজকেই রওনা দিয়ে দিবে। তবুও এই একাকিত্ব, এই পরাধীনতা কিছুতেই ভাল লাগছিলনা আমার। হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মেরে ফ্যানের নিচ থেকে সরিয়ে দিতে দিতে তিয়ানা চিৎকার করে বলল। “সবাই সরে দাঁড়া, ফ্যানের স্ক্রু খুলে পড়েছে!” সাথে সাথে অনেকেই ফ্যানের তলা থেকে সরে গেল, আবার আগের মত ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।

তখনো আমি ঘোরের মাঝে ছিলাম, মনীষাকে মেসেজ লিখছিলাম। সবার নীরবতা দেখে চোখ তুলে তাকালাম ওদের দিকে। কেন যেন সবার দৃষ্টি উপরের দিকে নিবদ্ধ। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সিলিং ফ্যানের দিকে। ওরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ঘটনা দেখার জন্য।

আমিও অপেক্ষা করছিলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই হল। তিনটি পাখা নিয়ে প্রচন্ড শব্দে মেঝেতে আছড়ে পড়ল বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে ঘুরতে থাকা ভারী ফ্যানটি! কাছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই আর্তনাদ করে উঠল ভয়ে, কারও কারও চোখে আতংক, কেউবা আবার নিশ্চিত মত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার অশ্রু মুছে নিতে ব্যস্ত। আমিও আতংকিত হলাম, কিন্তু পরমুহূর্তেই যেন বদলে গেল আমার সেই অনুভূতি! আতংক ভুলে গিয়ে মনে মনে ভীষণ হাসছিলাম! আমি হাসছিলাম আর ধিক্কার দিচ্ছিলাম নিজেকে এই ভেবে যে, কথা বলার ক্ষমতা থাকা সত্বেও যেখানে আমি আজ পর্যন্ত নিজের অভাব- অভিযোগগুলো কারও সাথে ভাগ করে নিতে পারছিলাম না, কাউকে বিশ্বাস করে জানাতে পারছিলাম না নিজের ব্যর্থতাগুলোকে; সেখানে আজ আমারই মত হতাশায় ডুবে থাকা, ক্লান্ত, শ্রান্ত বৈদ্যুতিক পাখা খানা সিলিং থেকে খুলে পড়ে প্রচন্ড শব্দে জানান দিয়ে গেল তার সীমাবদ্ধতার কথা, তার নীরব অস্তিত্বের কথা, প্রতিবাদ করে গেল তার প্রতি অন্যায়-অবিচারের! জানিয়ে দিয়ে গেল তারও দরকার বিশ্রামের, তারও আছে রাগ--- ভীষণ রাগ পারলে ভিজিট করুন - FaceBook Timeline Cover Photos ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.