আমরা শুধু আপন মানুষ খুঁজি, আপন মানুষদের খুঁজতে হয় না, তারা পাশেই থাকে !! নামাজ শেষ করে বালুচরের রাস্তায় হাটছি। খুব বেশী মন খারাপ হলে কারো সাথে কথা বলতে মন চায় না, হাত পা কাঁপে। একটার পর একটা ফোন কাটছি, আর পাগলের মতো হাটছি। কয়েকটা মটরসাইকেল বারবার মনে হয় আমার উপর উঠে যাবে। কোন মতে বালুচরে গিয়ে রিকশায় উঠলাম।
-কই যাইবেন?
- শাহজালাল দরগা
- ৮০ট্যাকা দেওন লাগবো
- চলো
ভারা বড়জোর ২৫-৩০টাকা। রিকশায় উঠে মনে হলো বোকামী হয়ে গেল। গতকয়েকদিনের বেপরোয়া খরচে এমণিতেই মানিব্যাগ দূর্ভিক্ষ লেগেছে। সামনে ছোট ভাইটার বার্থডে আবার ওর ও বার্থডে । হাতে কয়েকটা টাকা না থাকলে হয় না।
কেন জানি রিকশা থেকে নামতে মন চাইলো না, বোকামীটাকে প্রশ্রয় দিলাম। রিকশায় উঠলেই রিকশাওয়ালাদের সাথে কথা বলি। তাছার ভারী মনটা হালকা করা দরকার। তা না হলে কখনযে টলে পরে সোজাসোজি ট্রাকের নিচে চলে যাই বলা যায় না।
-কি নাম তোমার মামা?
-আমার নাম মোতালেব, আপনের কি শরীর খারাপ?
বুঝতে পারছি না শরীর খারাপ কি না।
তবে রিকশাওয়ালা যেহেতু বলছে নিশ্চই কোন গোলমাল আছে। নাহ জোর করেও নরমাল হতে হবে।
-মোতালেব বাড়ী কই তোমার?
-আমার বাড়ি দিনাজপুর, পার্বতীপুর। মামা আপনার নাম কি?
-আমার নাম ফয়সাল।
-ফয়ছল নামে আমার একটা বন্ধু আছিল।
হ্যার অবশ্য এখন বিয়া হইয়া গেছে । একটা মাইয়াও হইছে এই বছর।
-তোমার বিয়া হয় নাই?
-না হয় নাই।
লজ্জার হাসির আওয়াজ পেলাম। সিলেট আসার পর প্রতি শবে-বরাতে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে শাহ জালাল মাজারে যেতাম।
এবার ই মিস হলো। সময় বড় নিষ্ঠুর। সময় মানুষের আপনজনদের কেড়ে নেয়। মানুষ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নিষ্ঠুর সময়ের কাছে কোন মায়া দয়া নেই।
অবশ্য আমার এখন আর খারাপ লাগছে না। মাতাল মাতাল ভাবটা চলে গিয়েছে। রিকশাওয়ালাকে আম্বরখানা রেখে মাজারের দিকে রওয়ানা হলাম।
মানুষ আর মানুষ। হাজারে হাজারে মানুষ দরগার ভেতরে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে।
ভীরে ঠ্যালাঠেলি করে কোনমতে মাজারের ভেতরে ঢুকলাম । আলাদা সওয়াব পাবার আশায় নয়, সব সময় আসতাম তাই মাজারে আজো আসলাম। তাছাড়া কেন জানি, জানি না এখন আসলে মনটাতে একটু শান্তি পাই।
মোতালেব মামাকে যেখানে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানেই আছে।
-চলো , আবার বালুচর চলো
-এতো তারাতারি চলে আসলেন !
-আর বইলো না, ভীরের মধ্যে ঠেলাঠেলি ভাল লাগে না।
আজতো শবে বরাত, রুটি হালুয়া খাইছ?
-গরীব মানুষ মামা, অতো শখ নাই। দ্যাশে যখন ছিলাম। মা রানতো। এইখানে তো আর মা নাই।
-মামা, তোমার মা তো এইখানে নাই, আমার মা তো পৃথিবীতেই নাই।
-দু:খ কইরেন না, আমারও বাপ মইরা গেছে। এই জন্যই কি আপনার মন খারাপ আছিল?
-আরে না না, আমার মা তো অনেক আগেই মরে গেছে। এখন আর মন খারাপ হয় না।
কোনমতে ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। মোতালেব প্রায় আমার সমবয়সী।
গায়ের রং কালো হলেও পোষাক-আসাক মুটামুটি ভালই পরেছে। মাথার চুলটা আচড়ানো থাকে ইউনিভার্সিটির ছেলে বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
-মোতালেব মামা, পড়ালেখা করছো?
-ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ছি। হেরপর আর কি গরীব হইলে যা হয় আর কি?
-ইন্টার শেষ করেতো অনেকেই চাকুরী করছে? তুমিও করতে পারতা !
-না মামা। চাকরীর লাইগা ট্যাকা লাগে ।
রাজনীতি , মারামারি করা লাগে। এই দ্যাশে নেতাগো চামচামি না করলে চাকরী পাওয়া যায় না।
-রাজনীতি তোমার ভাল লাগে না।
-কি যে কন মামা, শেখের ব্যাডী জিনিস-পত্রের দাম কমাইব বলছিল, কমাইছে। হের পার্টির কলেজের পোলারাতো মারামারি করে।
( কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক সাধারণ পাবলিক ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে এ ধারনাই পোষন করে)।
আপনাগো কলেজেও (সিকৃবি) হেইদিন পোলাপান কি মারামারি করছে।
- তাইলে কি তুমি বিএনপি জামাত পছন্দ করো?
- এই ব্যাডীতো আরো খারাপ। এই বুড়া বয়সে মুখে লিপিস্টিক মাইরা হুজুরগো লগে মিটিং করে। আমার বাপ দাদা আওয়ামিলীগ করছে ।
ঐসময় দেশতো অতো খারাপ আছিল না। আমার এক বন্ধু কারমাইকেলে (রংপুর কারমাইকেল কলেজ) পড়ে। হে শিবির করতো , বলছিল ট্যাকা পয়সা দিব, চাকরীও দিব ওগো লগে কাম করতে হইবো। একটা মিটিংএ ও গেছিলাম। ইসলামী জিহাদ করবার কয়।
পরে বুঝলাম আসলে ভন্ডামী।
-দেশে যে রাজাকার আলবদরের ফাঁসির দাবী উঠছে জানো? শুনলাম ঐখানে নাকি খারাপ কাম হয়? (একটু অভিনয় করলাম)
-মামা আপনে কি জামাত করেন?
-না না, তবে শুনেছি ঐখানে খারাপ কাজ হয়।
-ভূল শুনছেন। চৌহাট্টা (সিলেটের শাহবাগ) দিয়া রিকশা চালাইয়া যখন যাইতাম , তখন শুনতাম। পোলাপাইন সেই কি ছুলুগান মারে, রক্ত গরম হইয়া যায়।
পতিদিনই খালি শুনতাম। একদিন সাহস কইরা চইলা গেলাম ঐখানে। কি যে কমু মামা, দ্যাশেযে ভাল কিছু পোলাপান আছে হেইদিন বুঝলাম। এখন যেগুলা হুনেন সবই মিথ্যা, বানাইন্যা কথা। শেখের বেটি তো একটা বেকুব, জামাতের চাল ধরতে পারে না।
আমাগো দেশের মানুষের মানুষতো খারা বেইমান। সব ভূইল্যা যায়।
কথা শেষ হয় না, রাস্তা শেষ হয়। বালুচর পয়েন্টে আমাদের ক্যাম্পাসের একটি মুখ পরিচিত ছেলে দাড়িয়ে আছে। রিকশা পাচ্ছে না হয়তো।
দেখতেই ডাক দিলাম। একই ক্যাম্পাসে থাকি । দিনে হয়তো কয়েকবার ক্রস হয়েছে কিন্তু পরিচয় নাই। রিকশায় উঠে নাম পরিচয় জিজ্ঞাস করতেই বলে- বিপ্লব , ইকোনমিক্স থার্ড ইয়ারে উঠবে। আমি অবশ্য অনেক জুনিয়র ভেবেছিলাম।
বিপ্লব উঠার পর মোতালেব আর কোন কথা বলে নাই। ক্যাম্পাসে নামিয়ে দেয়ার পর আমি ওকে মানি ব্যাগের সব টাকা দিতে চাইলাম। ও একটা টাকাও নিতে চায় না। অনেক জোড়াজুরি করার পর আমার কাছ থেকে ১০০টাকার একটা নোট নিল। মোতালেব কে বিদায় দিয়ে হলে ঢুকছি।
ইতোমধ্যে বৃষ্টির কয়েকফোটা গায়ে লেগে গেছে। ক্যাম্পাসের মসজীদ থেকে বয়ানের আওয়াজ কানে আসছে।
হে মহান সৃষ্টিকর্তা, ভাগ্য নির্ধারনের রজনী পবিত্র শবে বরাতে প্রার্থনা করি, আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য দূর করে দাও। আমার ও মোতালেবের মতো দুখি মানুষদেরকে আর কষ্ট দিও না ! আমীন !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।