আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদিবাসীদের দাবীগুলো কি কখনো পূরণ হবেনা???

আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালোবাসি মানুষকে ভালোবাসি আন্দোলন, ভালোবাসি চিন্তা করতে আমার সংগ্রামকে আমি ভালোবাসি দিন কয়েক আগে রাঙ্গামাটির আদিবাসী চাকমাদের অভিশাপ নিয়ে একটি ব্লগ লিখে ছিলাম। কাপ্তাই লেকের জলে একটি পাহাড়ি জনপদের কবর হবার নির্মমতার কথা লেখা ছিল সেখানে। পড়ুন এখানে। একই সাথে ফেবুতে একটি পেজে লেখাটি পাবলিশ হবার পর কিছু বাঙালি দেশপ্রেমের(!!!) প্রবল আবেগে পোষ্টে এসে আদিবাসীদের যাচ্ছেতাই ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করে। একটি বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে মত পার্থক্য থাকতে পারে এবং সেই বিষয় নিয়ে যৌক্তিক বিতর্ক সাধুবাদ যোগ্য।

কিন্তু যৌক্তিকতার ধারে কাছে না গিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের মোহে তারা আদিবাসীদের উপজাতি বলে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি আদিবাসীদের দাবী-দাওয়ার প্রতি চরম তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে। তাদের ভাষ্য পরে মনে হওয়া স্বাভাবিক আদিবাসীদের যেন তাদের দাবীর থেকেও অনেক বেশী দেয়া হয়েছে, সুতরাং তাদের এসব দাবী অযৌক্তিক। হাস্যকর এবং হাস্যকর!!!! সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে কিছু কোটা দেয়াতেই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী এই মানুষগুলোর ধারণা হয়েছে আদিবাসীদের আর কিছু দেয়ার নেই। উল্টো ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের সাথে এই নিয়ে কথা বলার সময় একজন এমনও বললো যে, আদিবাসীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সুবিধা দেয়াটা বাঙালিদের সাথে একরকম বৈষম্য, এটা তুলে নেয়া উচিত। আদিবাসীদের দাবীগুলো কি এটাই যারা জানেনা তারা কিভাবে আদিবাসীদের দাবী পূরণ হয়েছে কি হয়নি এ প্রসঙ্গে কথা বলে এটা আমার বোধগম্য হয়নি।

তাই তাদের জ্ঞাতার্থেই এই লেখাটি লিখতে বসা। আশা করব এটা পড়ার পর তাদের বোধদয় কিছুটা হলেও হবে। বাংলাদেশের নাগরিক এবং আদিবাসী হিসেবে চাকমাদের দাবীসমূহের কতটুকু পূরণ হয়নি তা নিয়ে লিখতে বসলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তালিকাটা এতই দীর্ঘ। পরীক্ষা থাকায় আজ সব নিয়ে লিখতে পারছিনা।

আজ শুধু আমার পূর্বের লেখার সূত্র ধরে কাপ্তাই লেকের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসীদের দাবীসমূহ কি ছিল আর তার কতটুকু পূরণ হয়েছে সেটুকুই লিখব। আশা করি পরবর্তীতে বাকি দাবীগুলো নিয়েও লিখতে পারব। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙ্গামাটি শহরের ৫৪০০০ একর জায়গা পানির নিচে তলিয়ে যায় যা ওই জেলার কৃষি জমির ৪০% এবং উদ্বাস্তু হয় ১৮ হাজার আদিবাসী পরিবারে প্রায় এক লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্থদের যথাযথ পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও কোন সরকারই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি।

সে সময় ৩শ ৬৯টি মৌজার মধ্যে ১শ ২৫টি মৌজা কাপ্তাই লেকের জলে নিমজ্জিত হয়। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার জন ছিল কৃষিজমির মালিক এবং বাকীরা জুমচাষী। ক্ষতিগ্রস্থদের পূনর্বাসনের জন্য কাচালং রিজার্ভ ফরেস্টে ৪০ বর্গমাইল এলাকা রিজার্ভ করা হয় এবং সেখানে প্রায় ১০ হাজার একর কৃষিজমি পাওয়া যায়। এই জমিতে প্রায় ৩হাজার ৭শ ৩৪ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। একই সময়ে রামগড় এবং বান্দরবানে বেশকিছু পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়।

সর্বোচ্চ সংখ্যক পরিবারকে পুনর্বাসিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ সংশোধন করা হয়। নতুন বিধিতে ১০ একরের বেশী কৃষিজমি কাউকে বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পরে যা আবার ৫ একর করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত কৃষিজমির অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ সকলকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ ৮ হাজার পরিবারকে কোনভাবেই পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়নি। সেইসময় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোতে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিয়েও ক্ষোভ ছিল।

কারণ একর প্রতি প্রথম শ্রেণীর জমির জন্য ৬০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর জমির জন্য ৪০০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণী বা গ্রোভল্যান্ডের জন্য ২০০ টাকা, পরিবারপ্রতি বসতবাড়ি বাবদ ৫০০ টাকা, প্রতি ফলবান বৃক্ষ ১০ টাকা, অফলবান বৃক্ষ ৫ টাকা, প্রতি কলাগাছ ২৫ পয়সা এবং প্রতি আনারস গাছ ৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে ক্ষতিপূরণ খাতে বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যে ২৮ লাখ টাকা অবিলিকৃত থেকে যায়। ওই টাকা ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাঙামাটিতে তৎকালীন ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার এক বক্তৃতায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারসমূহের মধ্যে বন্টন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই ঘোষণা আজ অবধি কার্যকর হয়নি। ১৯৮০ সালে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর এক প্রতিবেদনে জানা যে, কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল। বাস্তবে মাত্র খরচ করা হয়েছে ২.৬ মিলিয়ন ডলার, যা মোট বরাদ্দের চেয়েও ১শ ৩০ ভাগ কম।

তাছাড়া তখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে না হওয়াতে জমির মালিকরা প্রকৃত জমির ক্ষতিপূরণ থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছে তেমনি বঞ্চিত হয়েছে জুমিয়া পরিবার। অন্যদিকে যাদের নিজস্ব বসতভিটা ছিল না বা যারা খাসজমিতে বসবাস করছিল তারা বসতভিটা এবং ফলের বাগানের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণই পায়নি। আমেরিকান এইডের কারিগরি এবং আর্থিক সহযোগিতায় কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হয়েছে অভিযোগ করে বিভিন্ন সময় কাঁপ্তাই বাঁধ উদ্বাস্তু কল্যাণ সমিতি আমেরিকান সরকারের কাছেও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আসছে। ১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট আমেরিকান সরকারের কাছে প্রথম এ বিষয়ে লিখিতভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানান তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা চারু বিকাশ চাকমা। এরপরও বিভিন্ন সময় তিনি আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ব্যাপারে লেখালেখি করেছেন।

২০০০ সালের ২০ মার্চ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখেও তার কাছে তিনি একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন। তিনি ১৯৯৮ সালের ১১ মার্চ ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস বরাবরেও একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন। সংক্ষেপে উল্লেখিত দাবীসমুহ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে বহুকাল। তাদের প্রতি এ বৈষম্য শুধু ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রেই নয় বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা, সংস্কৃতি সবখানেই। সময় করে সেসব নিয়েও বলা যাবে কোন একসময়।

সুতরাং এ কথা বলার কোন অবকাশ নেই যে আদিবাসীদের দাবীগুলোকে কোন সরকার মুল্যায়ন করেছে বরং আমাদের সবারই উচিত তাদের ন্যায্য দাবীগুলোর সাথে একাত্মতা দেখিয়ে তাদের দাবীপূরণের সংগ্রামে সামিল হওয়া। নইলে একদিন আদিবাসীদের প্রতি করা অবিচারের জন্য বিধাতা আমাদের উপরেই তার প্রতিবিধান করবেন। তথ্যসুত্রঃ সাপ্তাহিক ২০০০ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.