আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবিসির বিশেষ প্রতিবেদন : গুমের কবলে বাংলাদেশ

অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...! পর্যবেক্ষক গুম- বাংলাদেশে নতুন আতঙ্কের নাম। শুরুটা বেশ আগে হলেও বর্তমানে বেড়েছে এর ভয়াবহতা। পেশাজীবী, ছাত্র থেকে রাজনীতিক কেউই আর বাদ যাচ্ছেন না। সবশেষ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ আতঙ্ক ঝড় তুলেছে দেশের বাইরেও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরছে।

বাংলাদেশের ‘গুম’ নিয়ে বিবিসির ইথিরাজন আনবারাসন করেছেন একটি বিশেষ ফিচার। ‘ইনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স হান্ট বাংলাদেশ’ বা ‘গুমের কবলে বাংলাদেশ’ শিরোনামে লেখাটিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গুমের বিষয়টি তুলে ধরেছেন ইথিরাজন। তার লেখায় স্থান পেয়েছে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সামাজিক জীবনধারার মর্মস্পর্শী বাস্তবতা। ইথিরাজন আনবারাসন শুরুতেই ঢাকায় গুম হওয়া যশোরের নাজমুল ইসলামের ঘটনা তুলে ধরেন। বর্ণনা দেন- গত বছরের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক রাতে ঢাকার রাজপথ থেকে গুম হওয়া নাজমুলের লাশ পরদিন সকালে শহরের উপকণ্ঠে পাওয়া যায়।

তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল। নাজমুল প্রধান বিরোধী দল বিএনপির যশোর জেলার নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন তার স্ত্রী সাবিরা ইসলাম। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় আস্থা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী গুম হওয়ার ওই রাতেই পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম এবং তাকে খুঁজে বের করার অনুরোধও করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের সহায়তা করেনি।

’ সাবিরা ইসলাম বললেন, ‘এমন কি ঘটনার দুই মাস হয়ে যাওয়ার পরও ওই খুনের কোনো কারণ সম্পর্কে আমরা জানতে পারিনি। ’ তিনি বললেন, ‘আমার পাঁচ বছর বয়সী ছোট ছেলে প্রতিনিয়ত জানতে চায়, তার বাবা কখন ফিরবে? আমি জানি না, তার এ প্রশ্নের জবাব কীভাবে দেব?’ নাজমুলের গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, বাংলাদেশের অব্যাহত ‘গুম এবং ‘সিক্রেট কিলিংসের’ ঘটনার একটি কেবল নাজমুলের গুম হওয়া। ওই ঘটনার প্রায় চার মাস পার হতে যাচ্ছে। আর গুমের এসব ঘটনায় বাংলাদেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে।

এদিকে কয়েকদিন আগে ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় আজ রোববার হরতাল ডেকেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। কারা দায়ী? সাবিরার মতো ঢাকার এক মানবাধিকার কর্মীর গল্পও প্রায় একই ধরনের। ঝর্ণা খানম বলেন, ‘গত বছর বাসার কাছ থেকে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরিচয়ে একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। এখন পর্যন্ত তার অবস্থান সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

’ রাজনৈতিক কারণে শামিম আখতারকে গুম করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ শামিম একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর ছাত্র রাজনীতি করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নামের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। গুমের শিকার পরিবারগুলোর অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো তাদের আত্মীয়-স্বজনদের গুম করেছে। আর গুমের ঘটনা দিন দিন বাড়তে থাকায় উদ্বেগও বাড়ছে।

ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে মাত্র দুই ব্যক্তি গুমের পর ২০১০ সালে গুম হন ১৮ জন। ২০১১ সালে গুমের সংখ্যা ৩০ জনে উন্নীত হয়। আর কেবল ২০১০ সালের জানুয়ারিতেই নিখোঁজ হন নয়জন। তবে বেশিরভাগ গুমের ঘটনাই সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় না। মানবাধিবার সংগঠন ‘অধিকার’-এর মহাসচিব আদিলুর রহমান খান বললেন, ‘বিগত সরকারগুলোর সময়ও এ ধরনের গুমের ঘটনা ঘটতো।

বর্তমানে এটা আবার ফিরে এসেছে এবং উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ’ গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, শ্রমিক নেতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীও রয়েছেন। এছাড়া অপরাধ সংশ্লিষ্টতা এবং ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেও অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেলেও বেশিরভাগেরই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারা এসব ঘটনার সাথে জড়িত? মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ প্রশ্নের উত্তরে বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্থাগুলোর মধ্যে দায়মুক্তি দেয়ার মানসিকতা থেকেই গুমের সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

তাই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে কেউ অপরাধী মনে হলেই তাকে গুম হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের এলিট নিরাপত্তা বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নকে (র‌্যাব) এসব অপকর্মের জন্য দায়ী করা হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, ২০০৪ সাল থেকে গুমসহ এক হাজার ৬০০ বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সাজানো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা হেফাজতে রেখে এদের হত্যা করা হয়। এদিকে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র‌্যাবের হত্যার পরিমাণ কমে এলেও, গুমের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে।

উদ্বেগের বিষয়, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অপরাধের ধরণ একটি থেকে আরেকটিতে পরিবর্তন করেছে। ‘দলগত দ্বন্দ্ব’ মানবাধিকার সংগঠনের এসব প্রতিবেদন ‘সঠিক নয়’ বলে জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্থাগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেয়া পরিসংখ্যান নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলছে। র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মোহাম্মাদ সোহায়েল বলেন, ‘এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ। এসব ঘটনার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

এমনকি গত তিন বছরে আমরা বহু অপহরণের ঘটনা সমাধান করেছি। ’ গুমের বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেয়া ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক এবং দলগত দ্বন্দ্ব-সংশ্লিষ্ট বলে তিনি জানান। সোহায়েল জানান, ‘আপনি যদি যারা অপহরণ কিংবা নিখোঁজ হচ্ছে তাদের জীবনবৃত্তান্ত দেখেন, তাহলে দেখবেন তাদের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী আছে এবং তারা নিজেরাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ’ এদিকে সমালোচনার মুখে ডিসেম্বরে এ ধরনের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান এবং বেশ কিছু সমস্যার সমাধানেরও দাবি করেছে।

নিরাপত্তা বাহিনী এসব কর্মকা-ের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গত জানুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে এবং তারা গুম করা নয়, বরং গুম প্রতিরোধের জন্য কাজ করছে। ’ অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মীরা ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জন্য দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। অধিকার মুখপাত্র আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতি সহিংসতা প্রবণ এবং এখানে দায়মুক্তি দেয়ার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। এজন্য রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এর সুযোগ নিচ্ছে।

’ এরপরও প্রিয়জন হারিয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.