আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেনমোহর

--অসম্ভব! আমার মেয়েকে ২০ লাখ টাকাই দেনমোহর দিতে হবে। --আরে, ভাই। আপনি কি আপনার মেয়েকে আমাদের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন না, নাকি? এত টাকা দেনমোহর দেবার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। --আমার সাফ কথা, দেনমোহর ২০ লাখ টাকাই। নিজের মেয়ের ভবিষ্যত আমাকেই ভাবতে হয়।

--দেনমোহর ১০ লাখ হলে কি আপনার মেয়েকে আমাদের ছেলে কম সুখে রাখবে ভেবেছেন? কথায় বলে লাখ কথা না হলে নাকি বিয়ে হয় না। দেনমোহর নিয়ে প্রায় সব বিয়েতেই লাখ লাখ কথার বসচা বসে কনেপক্ষ ও বরপক্ষের লোকজনের মধ্যে। কনেপক্ষে চায় দেনমোহরের পরিমাণ যেন বেশি হয়, আর বরপক্ষ চায় এর পরিমাণ কমাতে। এই নিয়ে তর্ক চলতে চলতে কখনো কখনো বিয়ে ভেঙ্গে যাবার মত বিশ্রী পরিস্থিতিও তৈরি হয়, যা বর ও কণে উভয়ের জন্যই বিব্রতকর। আবার দেনমোহর নিয়ে উলটো ঘটনাও রয়েছে বিস্তর।

অনেক বর পরিবারের পুরোনো ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় মোটা অংকের দেনমোহর পরিশোধের অংগিকার নিয়ে বিয়েতে খুশিমনে কবুল বলে থাকেন। এই দেনমোহরের পরিমাণ যত বড়ই হোক, সত্যি সত্যি তো আর পরিশোধ করতে হচ্ছে না! কাগজে কলমে লেখার ব্যাপারেও কেন শুধু শুধু কিপ্টেমি করা? শুধু বর-ই নয়, এই বিশাল অংকের দেনমোহর বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে কনের স্ট্যাটাসটাও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। দেনমোহরের পরিমাণ কেমন হতে হবে, তা অনেক পরিবারই ধর্ম অনুযায়ী ধার্য্য করেন না। এ নিয়ে তাদের তেমন কোন সচেতনতাও দেখা যায় না। যেই দেনমোহর নিয়ে এত কাণ্ড, সেই দেনমোহর কেন বর দিচ্ছেন বা কনে নিচ্ছেন এ ব্যাপারে প্রায়ই দেখা যায়, কারোই এ ব্যাপারে সঠিক বা পূর্ণাংগ ধারণা নেই।

কেউ কেউ মনে করেন, কাবিনে বেশি টাকা দেনমোহর লেখা থাকলে স্বামী তালাক দিতে পারবে না অথবা তালাক দিতে ভয় পাবে। কিন্তু তারা কি ভেবে দেখেছেন, বিয়ের পরে যদি দেখা যায়, স্বামী মাদকাসক্ত, অসৎ অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম কিংবা দুশ্চরিত্র, লম্পট, পরকিয়ায় লিপ্ত বা স্বামী দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না, অথবা অন্য কোন কারণে একান্তই তালাক দেবার প্রয়োজন পড়ে তবে কোটি টাকার দেনমোহরের মোহে এমন বিয়ে টিকিয়ে রাখার সার্থকতা কী? স্ত্রীর যদি এ ধরনের কোন অক্ষমতা বা ত্রুটি থাকে, স্বামী কি দেনমোহর দেবার ভয়ে তালাক দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন? দেনমোহরের পরিমাণের চেয়েও নারীদের যে ব্যাপারে বেশি সচেতন হতে হবে তা হলো--- তাকে আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, কাবিন নামায় স্ত্রীর তালাক দেবার ক্ষমতা আছে কি না। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে দেনমোহর দেবার ভয়ে তালাক দেন না। বরং স্ত্রীকে এমন মানসিক ও শারীরিক কষ্টের মধ্যে রাখেন যেন স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে দেয় আর স্বামী দেনমোহর দেওয়া থেকে বেচে যায়। ওদিকে দেনমোহরের টাকা যদি না পান, এই ভয়ে স্ত্রী সব অত্যাচার মুখ বুঝে সয়ে যান আর মনে মনে আশা করেন স্বামী তাকে তালাক দিক।

অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তালাক স্বামী বা স্ত্রী যিনি-ই দিন না কেন, স্ত্রী তার পুরো দেনমোহরই পাওয়ার অধিকার রাখেন। দেনমোহর দিতে স্বামী অস্বীকার করলে স্ত্রী আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। অনেকের বিয়েতে দেনমোহর আংশিক বা পুরো পরিশোধ করা হয় গয়না, শাড়ি, বিভিন্ন উপহার, কসমেটিকস ইত্যাদি আনুষাংগিকের মূল্য ধরে। স্বামীর মূল্যবান সম্পদ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মাধ্যমেই শুধু দেনমোহর পরিশোধ করা যায়, যদি সেগুলোর কথা কাবিননামায় উল্লেখ থাকে। অনেকে দেনমোহরকে যৌতুকের সাথে তুলনা করে থাকেন।

দেনমোহর ও যৌতুক দুটিই বিয়ে ও অর্থের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, বরকে অত টাকা বা অমুক উপহার দিতেই হবে কিংবা বিয়েতে কনেকে অত টাকা দেনমোহর দিতে হবে। কিন্তু তারপরেও দেনমোহর ও যৌতুক এক নয়। যৌতুক একটি সামাজিক অপরাধ। কোন ধর্মে এর বিধান না থাকলেও নিসংকোচে ঠিকই যৌতুক গ্রহণ করে থাকেন অনেক পুরুষ।

এরজন্য কত গৃহবধুর অত্যাচারিত ও খুন হবার ঘটনাই না পত্রিকায় এসেছে! অন্যদিকে দেনমোহর নারীর অধিকার। ধর্মে এর বিধান থাকলেও তা অনেক স্বামীই তা ঠিকমত পরিশোধ করেন না। দেনমোহরের জন্য কোন স্বামী অত্যাচারিত হয়েছেন কিনা এমন খবর এখনো আমার কানে আসে নি। কিন্তু নিজের প্রাপ্য দেনমোহর আদায় করতে বহু নারীকে গলদঘর্ম হতে হয় আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে। যদিও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গালভরা একটি কথা প্রচলিত আছে, দেনমোহর নারীকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়।

যদি কোন কারণে তালাক হয়, তবে তা নারীর জন্য ক্ষতিপূরণও বটে। আদৌ নারীরা কি ঠিক মত তাদের প্রাপ্য দেনমোহর পেয়ে থাকেন, এটি একটি বড় প্রশ্ন। ইদানিং অনেক নারীই মনে করেন দেনমহোর নিয়ে বিয়ে করাটা তার আত্নসম্মানকে আঘাত করবে। কারণ, এই দেনমোহর পরিশোধের মাধ্যমে স্বামী তাকে স্পর্শ করতে ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছে। তাদের এ সম্পর্কে ভালবাসা থাকুক বা না থাকুক বা বহুদিনের ভালবাসা ফুরিয়ে যাক।

এতে যেন নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বকেই মেনে হলো, নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন মূল্য নেই। আর তাতে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কটি সহজ,সরল,সুন্দর, শ্রদ্ধাশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ না হয়ে প্রভু ও ক্রীতদাসীর মত হয়ে পড়বে। একজন আত্নমর্যাদাশীল ও সাবলম্বী নারী হিসেবে দেনমোহর গ্রহণ না করাটাই তাদের জন্য সম্মানের। কারণ, যে বিয়েতে ভালবাসা ও বিশ্বাস রয়েছে তা অর্থের পরিমান দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয় এবং এজন্য অর্থ গ্রহণ করা একজন নারীর জন্য অসম্মানজনকও বটে। একদিন দেশের সব নারী দেনমোহর না নিয়েই বিয়ে করার মত সাবলম্বী হবে, এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগে।

কিন্তু এজন্য আগে পুরুষদেরও নিজেদের সেই নারীর যোগ্য হতে হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৫ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।