আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিশোধ

‘নিলে নেন, নাহলে যান গা, এত প্যাচান ক্যা!’ নিজের ছেলের বয়সী সেলসম্যানের কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ । মেয়ের জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল কিনতে এসে যে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে জানলে কে আসত। অনিমেষ থাকে রাজাবাজার। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কমপক্ষে এক ঘন্টা হাঁটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। গত পাঁচ বছরে একদিনও এই নিয়মের ব্যাতয় হয়েছে বলে মনে পড়ে না ওর।

আজকে একটু দেরি করেই বের হয়েছিল ও। অনেকদিন ধরেই মেয়েটা আবদার ধরেছিল একটা নতুন ড্রেসিং টেবিলের জন্য, পুরানোটা ঘুনে ধরে গেছে। অফিসের এক কলিগের কাছে শুনেছিল পান্থপথের এই ফার্নিচারের দোকানগুলোর কথা। অটবি, নাভানার থেকে নাকি একটু সস্তায় ফার্নিচার পাওয়া যায় এখানে। অনিমেষ ঠিক করেছিল শুক্রবার সকালে হাঁটা শেষ করে একবার ঢুঁ মারবে দোকানগুলোতে।

তাই আজকে অন্যান্য দিনের মত পাঁচটায় হাঁটতে না বের হয়ে আটটায় বের হয়েছিল ও। দুই ঘন্টা জগিং করে ও যখন পান্থপথের ফার্নিচারের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়াল তখনও অধিকাংশ দোকানই বন্ধ। ছুটির দিনে কে আর এত সকাল সকাল দোকান খোলে। একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চা এর অর্ডার দিয়ে দিনের প্রথম সিগারেট টা ধরাল অনিমেষ। অনেক চেষ্টা করেও সিগারেটের নেশাটা ছাড়তে পারছে না ও।

তবে আগের থেকে সংখ্যায় অনেক কমিয়ে দিয়েছে। দিনে পাঁচটার বেশি খায় না। আয়েশ করে সিগারেট টা শেষ করে ও এগিয়ে গেল একটা দোকানের দিকে। দোকানে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের কথা বলল অনিমেষ। সেলসম্যান এর ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে খুব অনিচ্ছার সাথে এই দোকানে কাজ করছে সে।

দুনিয়ার বিরক্তি তার চোখেমুখে। মুখ দিয়ে কথাই বের হতে চায় না। ভাবখানা এমন ‘নিলে নেন না নিলে না নেন, আপনি না নিলে আরো কত কাস্টমার আছে। ’ অনেকক্ষণ ছেলেটার ধ্যাষ্টামো সহ্য করার পর আর মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না অনিমেষ। হাত নিশপিশ করছিল বেয়াদব ছেলেটাকে চড় মারার জন্য।

কোনরকমে রাগ সামলে দোকান থেকে বের হয়ে এল ও। পাশের দোকানে ঢুকতে যেতেই বাধা পেল ও। ‘দোকান বন্ধ, কিছু বিক্রি হইব না এখন’- কাউন্টারে বসা এক মাঝবয়সী লোক পরোটা খেতে খেতে বলল কথাটা। মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল অনিমেষের। অনিমেষ এমনিতে নিপাট ভদ্রলোক, কেউ ওকে রগচটা বলবে না।

কিন্তু কেউ যখন ওকে গুরুত্ব দেয় না তখন প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় ওর। তখন ওর মনে হয় সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। আজকে পান্থপথের এই দোকানদারগুলো মনে হয় ঠিকই করে রেখেছে, সোনালী ব্যাংকের বড় অফিসার অনিমেষ আইচকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেবে না ওরা। আর একটা দোকান দেখবে বলে ঠিক করল অনিমেষ। তৃতীয় দোকানটায় ঢোকার আগে একটা সিগারেট ধরাল ও।

সিগারেট টা শেষ করে ও দেখল মোটামুটি সব দোকানই খুলে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বড় দোকানে ঢুকল ও। কিছুক্ষণ দেখার পর পছন্দও হল একটা ড্রেসিং টেবিল। -দাম কত? দোকানদার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল অনিমেষ। -একদাম বার হাজার টাকা।

-দিবা কত হলে? -দামাদামি নাই, একদর, নিলে নিবেন না হইলে নাই। -অটবিতেও তো এত দাম নেয় না, তুমি এত বেশি চাইতেছো কেন? -ওই মিয়া, নিলে নেন, নাহলে যান গা, এত প্যাচান ক্যা! রাগে অনিমেষের গা জ্বলে যাচ্ছিল তখন। কিছুক্ষণ বিষদৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল অনিমেষ। মার্কেটের সবগুলো দোকান যদি পুড়িয়ে দিতে পারত তাহলে বোধহয় একটু শান্তি পেত ও। বাসায় পৌঁছে ফ্যানের নিচে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরও রাগটা কমল না ওর।

স্বর্গীয় দেবব্রত আইচ এর বড় ছেলে অনিমেষ আইচ, সবার কাছ থেকে সমীহ আর শ্রদ্ধা পেয়েই অভ্যস্ত। আর পান্থপথের কোন এক দোকানের সেলসম্যান কিনা ওর সাথে এরকম ব্যবহার করল! এই ঘটনাটার রেশ এত সহজে কাটল না। ঐ সপ্তাহ পুরোটা অনিমেষ খুব মনোকষ্টে কাটাল, এমনকী সকালে হাঁটতে পর্যন্ত গেল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব দুঃখের রঙই ফিকে হয়ে আসে। অনিমেষের ক্ষেত্রেও তাই হল।

পরের শুক্রবার থেকে অনিমেষ আবার স্বাভাবিক। সকাল পাঁচটায় ঊঠে হাঁটতে যাওয়া, নয়টা-পাঁচটা অফিস, অফিসের পরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা- সব কিছু রুটিন মাফিকই চলতে লাগল। তবে সকালে হাঁটতে যাওয়ার সময় সচেতন ভাবেই ও পান্থপথ এলাকাটাকে এড়িয়ে যেতে লাগল। ওখানে গেলেই আবার যদি মনটা খারাপ হয়ে যায়! তবে এই মনোভাবটাও স্থায়ী হল না বেশিদিন। একসময় অনিমেষ ভুলেই গেল সেই সকালের ঘটনাটার কথা।

কিছুদিন পর এক রবিবারের সকালে অনিমেষ বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। ঘড়িতে তখন কেবলমাত্র পাঁচটা বাজে। পুরো রাস্তা নীরব। হাঁটতে হাঁটতে ও চলে আসল বসুন্ধরা সিটির সামনে। নাইট গার্ডরাও তখন সারারাত ডিউটি শেষে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একটু চোখ বুজেছে।

রিকশার নিচে হারিক্যানের জন্য কেরোসিন তেল বিক্রি করে যে ভ্রাম্যমান দোকানগুলো, সেরকম একটা দোকানের এক দোকানদার তার ব্যবসার সরঞ্জাম পাশে রেখে ফুটপাতের উপর শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খুলে রাখা কেরোসিনের কন্টেইনার থেকে তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে ভালোভাবে দেখল অনিমেষ। কাল রাতে ওর বিক্রি বোধহয় ভালো হয়নি। পুরো কন্টেইনারটাই ভর্তি।

হঠাৎ অনিমেষের মনে পড়ে গেল সেই শুক্রবারের কথা। ওর জীবনের সেই ব্ল্যাক ফ্রাইডে। অদম্য এক প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল ওর ভেতর। ‘সব পুড়িয়ে দাও অনিমেষ, সব ছারখার করে দাও’- কে যেন ওর কানে কানে বলতে লাগল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল অনিমেষ।

সোনারগাঁও এর মোড় থেকে গ্রীনরোড এর মোড় পর্যন্ত কোথাও কেউ নেই। সবগুলো দোকানের ঝাঁপও বন্ধ। ঝট করে কন্টেইনারটা তুলে নিল ও। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সেই দোকানটা- ‘জুয়েল ফার্নিচারস’। দোকানের সামনে পড়ে আছে কিছু শুকনো কাঠের টুকরো।

দেরি না করে সবটুকু কেরোসিন অনিমেষ ঢেলে দিল ঐ কাঠ আর দোকানের বন্ধ দরজার উপর। তারপর একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে কেরোসিনের উপর ছুঁড়ে দিয়েই হনহন করে হাঁটা দিল অনিমেষ। আসবাবের দোকানে দাহ্য পদার্থের অভাব নেই, বাকি কাজটুকু ওদের কল্যাণেই হয়ে যাবে বলে অনিমেষের বিশ্বাস। হোটেল সোনারগাঁও এর সামনে পর্যন্ত যেতেই হইচই কানে আসতে লাগল ওর। সকালের হাঁটা শেষ করে ও যখন বাড়ি আসছে তখন পান্থপথের ঐ মার্কেটের সামনে অনেক লোকজনের ভীড়, পাঁচ-ছয়টা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি।

বাড়িতে এসে টিভি খুলতেই ব্রেকিং নিউজে দেখল-‘পান্থপথের ফার্নিচার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ’ অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল অনিমেষের মুখে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।