আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোরানের বাংলা অনুবাদের সম্ভাবনা এবং বাস্তবতা

কতবার এমন হয়েছে যে আপনি কোরানের বাংলা অনুবাদ হাতে নিয়ে পড়া শুরূ করেছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাষার দুর্বোধ্যতায় চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে রেখে দিয়েছেন এবং এভাবে কিছুদিন চলার পর পড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনেকটা এরকমই। অথচ পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখায় কোরানের মোহনীয় ক্ষমতা রয়েছে(ইংরেজি অনুবাদ পড়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা)। বাংলায় বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিকগুলোর এত চমৎকার সব অনুবাদ আছে,অথচ আল্লাহর বানী কোরানের মানসম্মত কোন অনুবাদ চোখে পড়েনি। (কারো চোখে পড়লে দয়া করে অনুবাদকের নাম আর প্রকাশনীর নামটা উল্লেখ করবেন,ইন্টারনেটে থাকলে লিংক টা দিয়ে যাবেন।

)এ ব্যপারে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আন্তরিক উদ্যোগের অভাবও হতাশাজনক। বাংলা ভাষায় কোরানের অনুবাদগুলোর মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান,জহুরূল হক,হাবিবুর রহমান এদের অনুবাদগুলো মোটামুটিভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এর বাইরে খুব বেশি বাংলা অনুবাদকৃত কোরান আছে বলে জানা নেই। সৌদি আরব সরকারের দার উস-সালাম থেকে প্রকাশিত মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের অনুবাদ টি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে,বাংলাদেশে ইসলামের সুদীর্ঘ অস্তিত্বের পর ও বাংলায় অনুবাদকৃত কোরানের সংখ্যা ডাচ কিংবা ইটালিয়ান ভাষায় অনুবাদকৃত কোরানের সংখ্যার প্রায় সমান(উইকিপিডিয়ার সূত্রমতে)।

তার চেয়েও অবাক করা ব্যপার,সংস্কৃতে কোরানের কোন অনুবাদ নেই বললেই চলে। উইকিপিডিয়া ঘেটেই জানলাম,অতি সম্প্রতি(২০১০)দেওবন্দের রাজিয়া সুলতানা সংস্কৃতে কোরানের অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। আগ্রহ নিয়ে অনুবাদটি দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। বাংলা অনুবাদের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য উপরে উল্লেখিত অনুবাদকারীরা সবাই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু সবার প্রতি সম্মান রেখে বলছি;কোরানের ইংরেজি অনুবাদগুলো উল্টেপাল্টে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে মনে হয়েছে,(আমার দেখা)বাংলা অনুবাদগুলোতে ভাষার সাবলীলতা এবং শব্দার্থের ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে।

কিছু শব্দের অর্থ ও ত্রুটিশূন্য নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি,ফলে ভাষার সৌন্দর্যহানি ঘটেছে। এমনকি সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ব্যপার হল,অনুবাদে কিছু শব্দের অপ্রয়োজনীয় প্রবেশ এবং তাকে মূল বাক্যের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে ব্র্যাকেটে অন্তর্ভুক্ত না করে। সব মিলিয়ে বাংলা অনুবাদ গুলোকে বড়জোর ভাবানুবাদ বলা চলে। কিন্তু কোরানের ভাবানুবাদ কতটা যুক্তিসংগত সে প্রশ্ন ছাড়াও কোরানের ভাষাগত সৌন্দর্য (নির্ভুল শব্দচয়ন,সংক্ষিপ্ত অথচ দ্যোতক অর্থবহতা প্রভৃতি)পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য শাব্দিক অনুবাদের প্রয়োজন রয়েছে।

কোরানের linguistic study একটা বড় গবেষণার জায়গা এবং শুধুমাত্র এই বিষয়েই আল আজহার,মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আলাদা academic program চালু আছে। আবার এটাও ঠিক,কোরানের নির্ভুল শাব্দিক অনুবাদ সম্ভব নয়,এই বিষয়ে স্কলাররা একমত। এটা মূল বর্নভিত্তিক আরবী ভাষার কিছু অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে। কোরান নাযিল হয়েছে বেদুইন আরবদের ভাষায় এবং এর শব্দভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র ‘ভয়’ অর্থটি বুঝাতে কোরানে কমপক্ষে ১০ টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে,প্রতিটি শব্দের অর্থের মধ্যে সূক্ষ পার্থক্য রয়েছে এবং মেসেজের সাথে সঙ্গতি রেখে তা ব্যবহার করা হয়েছে।

আরবী ভাষার এই ব্যাপকতার জন্যই শাব্দিক অনুবাদ অনেক কঠিন হয়ে যায় যে ভাষায় অনুবাদ করা হবে তার সীমাবদ্ধতার জন্য। তার উপর আরবী ভাষার উপমানির্ভর ভাব এবং ব্যাকরণিক গঠন প্রচলিত অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার চেয়ে আলাদা হওয়ার কারণে অনেক সময় আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ এবং ভাষার প্রাঞ্জলতা এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। এতকিছুর পরও ইংরেজির মত তুলনামূলক নতুন এবং অপেক্ষাকৃত কম সমৃদ্ধ ভাষায় কোরানের বেশ ভালো মানের অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে ইউসুফ আলী,পিকথল,মুহসিন খান,সহীহ ইন্টারনেশনাল,মুহাম্মদ আসাদ এদের অনুবাদ বেশ জনপ্রিয়। ইংরেজির তুলনায় সংস্কৃত অনেক সমৃদ্ধ একটি ভাষা,বিশেষ করে ধর্মগ্রন্থের অনুবাদের জন্য এটি অনেক উপযুক্ত একটি ভাষা একারণে যে,সংস্কৃত ভাষাতে ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছে তাই religious terms এর অনুবাদ অনেকটাই সহজতর ইংরেজির চাইতে।

অথচ সংস্কৃতে কোরানের অনুবাদের কাজে অজ্ঞাত কারণে হাত দেয়া হয়নি। বাংলা ভাষায় বিপুল পরিমাণে তৎসম শব্দের অস্তিত্বের কারণে বাংলায় কোরানের ভালো অনুবাদ সম্ভব বলে আমার মনে হয়েছে। শুধুমাত্র কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে তৎসম ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহারে সামঞ্জস্য রাখা প্রয়োজন যাতে করে অনুবাদ অতিমাত্রায় দুরূহ কিংবা অতিমাত্রায় খেলো না হয়ে যায়। একই সাথে Quranic phrase গুলোর অনুবাদের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকাটা ও জরুরি। এই কাজে ভাষাগত দক্ষতা আর কোরানের linguistics এ ভালো দখল দুইই প্রয়োজন।

দ্বিতীয়টির অভাব থাকলে নিদেনপক্ষে যেকোন একটি স্বীকৃত ইংরেজি অনুবাদের (যেমন সহীহ ইন্টারনেশনাল) বাংলা অনুবাদ করা যেতে পারে এবং অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ভাষার সাবলীলতার দিকে। একই সাথে অনুবাদকৃত বইয়ের আকারের দিকে খেয়াল রাখা উচিত(পেপারব্যাক সাইজ হলে সবচেয়ে ভালো) এবং ভালো হয় আরবী না রেখে শুধুমাত্র বাংলা অনুবাদ এবং সাথে কিছু প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করলে। এতে করে এটা বিশাল আকারের তাফসীর গ্রন্থও হবে না আবার শুধুমাত্র অনুবাদ ও হবে না আবার পড়তে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.