আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তথাকথিত আহলে হাদীসের আসল রূপ - পর্ব ০৬

মুফতী রফীকুল ইসলাম আল-মাদানীঃ সাহাবায়ে কেরাম (রা) সম্পর্কে গাইরে মুক্বাল্লিদদের আক্বীদা : ১। পূর্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনার আলোকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, রাসূল (সঃ) এর সম্মানিত সাহাবীগণের মূল্যবান বাণী ও তাদের অনুসৃত আদর্শ আমাদের জন্য পাথেয় এবং অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। আর এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত আক্বীদা। পক্ষান্তরে গাইরে মুক্বাল্লিদ বা সালাফীদের আক্বীদা হল যে, সাহাবাদের কোন বাণী, তাদের অনুসৃত আদর্শ অনুসরণযোগ্য নয় এবং অনুসরণ করা ধর্মহীনতা ও অন্ধ বিশ্বাসের নামান্তর। ২।

তাদের উক্ত আক্বীদার প্রমাণ স্বরূপ ভারতবর্ষে গাইরে মুক্বাল্লিদদের প্রধান মুখপাত্র নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খানের কয়েকটি উক্তি নিম্নে প্রদত্ত হল : “আর রওজাতুন নাদীয়াহ” নামক গ্রন্থে তিনি লিখেনঃ “ সাহাবাগণের (রঃ) কথা দলীল স্বরূপ পেশ করা যাবে না “ ( আর রাওজাতুল নাদীয়াঃ পৃ: ১/১৪১ ) “ এবং তাদের বুঝ নির্ভরযোগ্য নয়। ” ( আর রাওজাতুল নাদীয়াঃ পৃ: ১/১৫৪ ) অন্য গ্রন্থে আরও লিখেনঃ “ এবং সাহাবাগণের আমল দলীল হওয়ার উপযোগী নয়। ” ( আততাজ আল-মুক্বাল্লিদঃ পৃ: ১৯২ ) ৩। গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের সর্বাধিনায়ক সাইয়্যেদ নযীর হুসাইন বলেনঃ “ সাহাবীদের কথা প্রমাণযোগ্য নয়। ” ( ফাতাওয়ায়ে নজীরিয়াঃ পৃ: ১/৩৪০ ) ৪।

গাইরে মুক্বাল্লিদদের আক্বীদা সাহাবায়ে কিরামের (রা) আদর্শ অনুসরণের ব্যাপারে অনীহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের কতিপয় আলেম ভ্রষ্ট শিয়াদের পদাংক অনুসরণ করে সাহাবাদেরকে ফাসেক্বও বলেছে। ৫। গাইরে মুক্বাল্লিদদের বিশেষ মুখপাত্র নবাব ওয়াহিদুয্যামান তার রচিত গ্রন্থ নুযুলুল আবরারে লিখেছেনঃ “ সাহাবাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক ফাসেক্বও ছিল, যেমন:- ওয়ালিদ, তেমনিভাবে মুয়াবিয়া, উমর, মুগীরা ও সামুরা (রঃ) প্রমুখ সম্মন্ধেও অনুরূপ বলা যেতে পারে “ (!) (নুযুলুল আব্রারঃ পৃ - ২/৯৪) সম্মানিত পাঠকসমাজ ! সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) কি আমাদের সালাফ বা পূর্বসুরী নয় ? নয়কি তাদের অনুসৃত আদর্শ আমাদের জন্য পাথেয় ? আর তাঁরাই যদি আমাদের পূর্বসূরী না হয়, তাহলে কারা হবে ? সুতরাং সাহাবা সম্বন্ধেই যাদের এ হীন মন্তব্য আর আক্বীদা তাদের সালাফী দাবী করা অবান্তর, হাস্যকর ও গভীর চক্রান্ত বৈ আর কি হতে পারে। যদি হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) সম্বন্ধে তাদের এরূপ ধারনা আর এরূপ বৈরী আক্বীদা হয় তাহলে, সাহাবা পরবর্তী তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাদিগণ সম্বন্ধে তাদের কেমন জঘন্যতম আক্বীদা ও বিরাগ-বিকর্ষন হবে তা আর উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় আমাদের প্রশ্ন হলো এতদসত্ত্বেও কোন সূত্রে, কোন যুক্তিতে তারা সালাফী দাবী করে? ৬।

নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধন করলেই দেখা যাবে যে, তারা মূলত (মৃত ১২৫৫ হিজরী) ক্বাজী মুহাম্মদ ইবনে আলী আশ-শাওকানীর অনুসরন-অনুকরণ, তথা তাক্বলীদ করে চলছে। আর তিনি হলেন এমন ব্যক্তিত্ব যিনি ইমামগণের তাক্বলীদ করাকে সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও শিরক্ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর তিনিই গাইরে মুক্বাল্লিদদের ইমামের পদ অলংকৃত করেছেন ! এছাড়া একই মতাদর্শের বিধায় সুবিধামত কোন কোন ক্ষেত্রে ইমাম ইবনে হাযাম (মৃ: ৪৫৬ হিঃ) ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃ : ৭২৮ হিঃ) ইবনুল ক্বাইয়্যিম (মৃ: ৭৫১ হিঃ) এবং মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদী (মৃ: ১২০৬ হিঃ) প্রমুখেরও অনুসরণ করে আসছে বলে বাস্তবে দেখা যায়। সুতরাং এ প্রশ্নটি থেকেই যায় যে, তথাকথিত “ সালাফী “ দাবীদাররা ৫ম শতাব্দী বা ১৩শ শতাব্দী অথবা তৎপরবর্তী নিকৃষ্টতম যুগের লোকের পদাংক অনুসরণ করে যদি সালাফী দাবী করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে তাহলে সাহাবা এবং প্রথম যুগের ইমাম বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমামে আযম আবু হানিফা (রহঃ) (জন্ম ৮০ হিজরী, মৃত ১৫০ হিজরী) অথবা ইমাম মালেক (রহঃ) (মৃত ১৭৯ হিজরি) অথবা ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) (মৃঃ ২০৪ হিঃ) অথবা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ) (মৃঃ ২৪১ হিজরী) প্রমুখ প্রথিতযশা ইমামগণ কর্তৃক প্রদত্ত কুরআন-হাদীসের ব্যাখার অনুসরণ যাঁরা করে আসছে তাঁরা “ সালাফী “ হবে না কেন ? বরং আমরা বলবঃ তাঁরাই হলো প্রকৃত “ সালাফী “। আর তথাকথিত “ সালাফী “ নামের ধব্জাধারীরা নামে মাত্র “ সালাফী “।

সালফে সালেহীন বা পূর্ববর্তী সৎ ও মহৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের কোন সামঞ্জস্যতা নেই। তাই তারা সালাফী নয়, বরং তারা হলো “ খেলাফী “ অর্থাৎ বিরুদ্ধাচরণকরী। কারণ, তারা সালফ বা পূর্বসূরীদের কেবল খেলাফ ও বিরুদ্ধাচরণই করে আসছে, সালফে সালেহীনেরর আনুগত্যের লেশমাত্রও তাদের মধ্যে নেই। হ্যাঁ, সাম্প্রতিককালে সাউদি আরবের “ রবী আল্-মাদখালী ও মুহাম্মদ আল্-মাদখালী “ প্রমুখ কট্টরপন্থী ব্যক্তিদের আনুগত্য ও তাক্বলীদ করতে তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। আর এরাই তাদের সালফ তথা পূর্বসূরী ও অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচিত।

সুতরাং তারা এ সমস্ত কট্টরপন্থী (… সালাফুস সাউদিয়্যিন) সাউদি সালফের অনুকরণ করে হিসেবে তারা সালাফী। পক্ষান্তরে সমস্ত মুসলিম উম্মাহ সালফে সালেহীনের অনুসরণ করে বিধায় তারা হল প্রকৃত অর্থে “ সালাফী “। আশা করি উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীযমান হয়েছে যে, সালফে সালেহীনের সঙ্গে যাদের সামঞ্জস্যতা নেই তাদেরই নাম রেখেছে “ সালাফী “, আর হাদীসের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক নেই তাদেরই নাম রেখেছে “ আহলে হাদীস “। উল্লেখ্য যে, সালফের সঙ্গে যে তাদের সামঞ্জস্যতা নেই বা হাদীসের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই তা তেমন মারাত্নক ব্যাপার নয়, মারাত্নক হলো সালফের সাথে কোন সামঞ্জস্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজেরদের নাম সালাফী রাখা এবং সালাফী দাবী করা, আর হাদীসের সাথে কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের নাম আহলে হাদীস রাখা। কেননা এ নামের মুখোশ পরে সরলমনা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলামানদেরকে তারা সহজে প্রতারণা করতে সক্ষম হচ্ছে।

মোটকথা, তাদের সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জাল হিসেবে তারা এ সমস্ত নাম ও ইসলামী পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে আসছে। তাই এ নাম ও পরিভাষা সমূহের আসলরূপ উন্মোচন করা এবং এর মূল রহস্য উদঘাটন করে তা অনুধাবন করা প্রতিটি সত্যানুসন্ধিসু, ঈমানদার, উদার মুসলিমের একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য। মুসলমানদের বিরুদ্ধে লা-মায্‌হাবীদের আক্রমণের স্বরূপ ১। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ “ তোমার পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্‌বান কর, হৃদয়গ্রাহী হিক্‌মাতের সহিত বুঝিয়ে এবং শুভেচ্ছামূলক আকর্ষণীয় উপদেশ শুনিয়ে এবং তোমরা (প্রয়োজনে) বিতর্ক করো উত্তম পন্থায়। ” ( আন্‌-নাহ্‌লঃ ১২৫) ২।

আরো এক আয়াতে আছেঃ “ তোমরা আহ্‌লে কিতাবের সঙ্গে মতবিরোধে উত্তম পন্থা পরিহার করো না । ” ( আনকাবুতঃ ৪৬) ৩। এভাবে আল্লাহ তা’য়ালা মূসা (আঃ) ও হারুন (আঃ) কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেনঃ “ ফিরাউনের মত অবাধ্য কাফেরের সাথেও নম্র আচরণ করা উচিত। ” ( ত্বোয়া-হাঃ ৪৪) ৪। বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিতঃ “ রসূলুল্লাহ (সঃ) অশ্লীলতাকে কোন ক্ষেত্রেই পছন্দ করতেন না।

” ( আহমাদঃ ২/১৯৩ হাঃ ৬৮২৯ ) ৫। এক হাদীসে তিনি বলেনঃ “ ঈমানদারকে গালি দেয়া ফাসেক্বী এবং হত্যা করা কাফেরের কর্ম। ” ( আহমাদঃ ১/৪৩৯ হাঃ ৪১৭৭ ) ৬। রসূলুল্লাহ (সঃ) আরও ইরশাদ করেনঃ “ তোমরা পরস্পর ক্রোধ-ক্ষোভ, হিংসা-নিন্দা, গীবত ও সমালোচনা পরিহার করতঃ ভাই ভাই হয়ে যাও। ” ( আবু দাউদঃ ৫/২১৩ হাঃ ৪৯১০ ) এভাবে তিনি সাহাবায়ে কিরাম (রঃ)-কে গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।

৭। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ “ মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ কাফিরদের মোক্বাবিলায় ছিলেন অত্যন্ত কঠোর আর পারস্পরিক হৃদ্যতায় ছিলেন পুষ্পকোমল। ” ( সুরা ফাত্‌হ্‌ - ২৯ ) বলা বাহুল্য যে, এ ধরণের আরও অগণিত আয়াত ও হাদীসের দ্ব্যার্থহীন দাবী হচ্ছে দ্বীন-ধর্মের কাছে তর্ক-বিতর্ক অথবা মতবিরোধের প্রয়োজন হলে তা করতে হবে উত্তম পন্থায়-শালীনতার আলোকে। মতবিরোধ ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে। সাহাবায়ে কিরামের (রঃ) মধ্যেও ছিল।

কিন্তু তা হতে হবে কোরআন সুন্নাহর সীমারেখা অনুসারে। ক্রোধ-ক্ষোভ, হিংসা-নিন্দা, গীবত-সমালোচনা, গালমন্দ-অশ্লীলতা ইত্যাদি হারাম কাজ পরিহার করতঃ সুন্দর ও শুভেচ্ছামূলক উপস্থাপনা, উত্তমপন্থা এবং শালীনতার সাথে তর্ক-বিতর্ক বা মতবিরোধ করা কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ এবং রসূল (সঃ) ও সাহাবা (রঃ) গণের আদর্শ। ( বিস্তারিত উদাহরণ সহ জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ মুফতী রফীকুল ইসলাম আল-মাদানী রচিত “ মায্‌হাব মানি কেন? ” এর মতবিরোধ অধ্যায়) ৮। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাম্প্রতিক কালে কিছু এমন মতাদর্শীর আবির্ভাব ঘটেছে যে, শুধু হিংসা-গীবত, অকথ্য গালমন্দ, অশালীন আচরণ, কুৎসা রটানো আর অপবাদ দেয়াই এদের নিকট প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অন্যতম হাতিয়ার। ৯।

বিশেষ করে “ আহলে হাদীস ” নামক এ সম্মানজনক উপাধির দাবীদাররা আজ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সকল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, মায্‌হাব অবলম্বী সাধারণ মুসলমান বিশেষতঃ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও হানাফী মায্‌হাব এবং পাক ভারতের প্রথিতযশা আলিম উলামাগণকে বিদ্বেষী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। সাল্‌ফে সালেহীন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করা এদের মজ্জাগত অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর নাম শুনলে তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। বে-আদব এবং অভদ্র-অশালীন হওয়া তাদের নিকট বীর হওয়ার সমতুল্য। কিছু কথাঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে লা-মায্‌হাবীদের আক্রমণের স্বরূপ সম্পর্কে পরবর্তী পর্ব থেকে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাল্লাহ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ) ৫ম পর্বঃ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.