আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুতোষ মহাকর্ষ পাঠ-২

প্রতিমুহুর্তে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে, তবে আমরা মহাবিশ্বের অতিনগন্য একটি নক্ষত্রের আরও নগন্য একটি গ্রহে বসবাস করে তার কতটুকুই সংবাদ রাখছি? মহাবিশ্বের সকল কিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে- এই ধর্মিয় বিশ্বাস আরব উপদ্বীপে জন্ম নেওয়া প্রতিটি ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের মূল সুর। ৫০০০ বছর আগে আরব উপদ্বীপের মরুভুমিতে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, যারা দস্যুতা, পশুপালন এবং নৌবাণিজ্যকে নিজেদের জীবিকা হিসেবে গ্রহন করেছিলো তারা নিজেদের প্রয়োজনেই আকাশের নক্ষত্রের গতিবিধি খেয়াল করেছে, উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভুত-ভবিষ্যত যেমন কল্পনা করেছে মায়ান সভ্যতার মানুষেরা, তেমনই কল্পনা করেছে ব্যাবিলন, সুমেরীয় আর মিশরীয় সভ্যতার মানুষেরা। তাদের আকাশের নক্ষত্রগুলো ছিলো স্থির, হয়তো খালি চোখে দেখতে পাওয়া প্রায় ৬০০০ উজ্জ্বল নক্ষত্রের সবগুলোই কোনো না কোনো জ্যামিতিক নক্সায় সাজিয়ে তারা খেয়াল করে দেখেছে পৃথিবীর আকাশে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ধরণের নক্ষত্রসজ্জ্বা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তারা সেগুলোর ভিত্তিতে মানুষের ভবিষ্যত কল্পনা করেছে, বিভিন্ন নক্ষত্রের প্রভাবে জন্ম নেওয়া মানুষদের সামষ্টিক চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য বিশ্লেষণ করেছে। এমন কি এই প্রায় নিশ্চল পটভূমিতে সঞ্চারণশীল গ্রহগুলোর পর্যবেক্ষণ করে তারা দেখেছে কোনো না কোনো ভাবে এদর গতিপথ যতই উদ্ভট হোক না কেনো সেটা পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। সেই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই তারা ঘোষণা করেছে মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলোকে একদা ইশ্বর সৃষ্টি করেছেন, তারাই গ্রহগুলোকে সঞ্চারণশীল করেছেন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার অলৌকিক ব্যাখ্যাও প্রদান করেছেন তারা।

সেই দৃঢ় বিশ্বাসের একটা সংকলন করেছিলেন গ্রীসের এরিস্টটল। পারস্য সভ্যতার আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে গ্রীক সভ্যতার পুস্তকগুলো আরবিতে অনুদিত হয়েছে, সেভাবেই সেগুলো পরবর্তীতে পৌঁছেছে ইউরোপে, এমন কি গ্যালিলিও যখন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে জায়গীর থাকছেন তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এরিস্টটলের গ্রহতত্ত্ব, নক্ষত্রতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ানো হতো। অবশ্য তার আগেই টাইকো ব্রাহে গীর্জার মাণমন্দির থেকে নক্ষত্র ও গরহের গতিপথ সম্পর্কিত বিপূল পরিমাণ তথ্য সংকলন করেছেন। কোপার্নিকাস তার সেই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে জানালেন গ্রহগুলোর এই উদ্ভট গতিপথের ধাঁধা সহজেই সমাধান করা যায়, যদি ধরে নেওয়া হয় পৃথিবী নয় বরং সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র, চার্চের বিচারে তাদের গুরুতর শাস্তি হয়ে যায়। গ্যালিলিও তার নির্মিত টেলিস্কোপে বৃহ:স্পতির উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের আগেই চার্চের যাজকদের হুমকির সম্মুখীন হন, তিনি কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ তার ছাত্রদের শিক্ষার অংশ হিসেবে পাঠ করাতেন।

পরবর্তীতে তাকে মুচলেকা দিতে হয়, স্বীকার করে নিতে হয় তিনি তার ছাত্রদের পরবর্তীতে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ পড়াবেন না। অবশ্য চার্চের প্রধান যাজকের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের দরুণ তাকে তেমন কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয় নি। কিন্তু তার এই লড়াই তার বিশ্বাস এবং বাস্তবতার লড়াই। তিনি ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিলেন, তিনি ইশ্বর, ইশ্বরপূত্র এবং সে ইশ্বরের পৃথিবীকেন্দ্রিকতায় বিশ্বাস করতেন। মাত্র ২০ বছর আগে তার ধর্মবিশ্বাসচ্যুতির অভিযোগ থেকে তাকে অব্যহতি দেয় চার্চ।

তিনি যাজকদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ পাঠ দানের জন্য পরবর্তীতে তাকে গৃহান্তরীণ করে রাখা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদও পরিত্যাক্ত হয়েছে, বর্তমানের পর্যবেক্ষণে জানা গিয়েছে মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র নেই, কোনো সীমান্ত নেই, পৃথিবী, সূর্য, আমাদের সৌরজগত, আমাদের মিল্কিওয়ে কোনোটাই মহাবিশ্বের কোনো বিশিষ্ট অংশ নয়, মহাবিশ্বের সকল অংশই একই রকম নগন্য। এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুকণার গতিপথ নির্ধারণ করছে বৃহৎ আঙ্গিকে কেবলমাত্র মহাকর্ষ। প্রতিটি বস্তুকণার উপরে অপরাপর বস্তুকণাগুলোর আকর্ষণ বল মহাবিশ্বের চুড়ান্ত ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। যেহেতু মহাকর্ষীয় বল শুধুমাত্র পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং এ ভর বস্তুকণাগুলোর ভরের সমানুপতিক সুতরাং ভারী বস্তুর মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব অধিকতর বিস্তৃত হবে, ক্ষুদ্র ভরের বস্তুকণাগুলোর মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব ক্ষুদ্র অংশকে প্রভাবিত করবে।

এই বক্তব্যটি একটু জটিল করে বলা আছে আইন্সাইনের সার্বজনীন মহাকর্ষ তত্ত্বে। যেহেতু সূর্য প্রতিনিয়ত ফিউশন কিংবা হাইড্রোজেন সংযোজন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করছে সুতরাং প্রতিনিয়তই সূর্যের ভর কমছে। যেহেতু সূর্যের ভর কমছে সুতরাং সূর্যের আকর্ষণ বলের পরিমাণও ক্রমশ: কমে যাচ্ছে। এর সাম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে? পৃথিবীর কক্ষপথে এর কি ধরণের প্রভাব পরবে? এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে, সান্তনার বিষয় আগামী কয়েক সহস্রাব্দে পৃথিবীর কক্ষপথের তেমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটবে না। শুধু তাই নয় প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীতে বিপূল পরিমাণ কসমিক রে প্রবেশ করছে, এই কসমিক রে'র অধিকাংশই মূলত মহাবিশ্বের সূচনা লগ্নে উৎপন্ন হওয়া প্রোটন, এরা পৃথিবী ভেদ করে কোথাও চলে যাচ্ছে না, সুতরাং এদের কারণে পৃথিবীর ভরও প্রতিমুহুর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ কসমিক রে পৃথিবীতে আসলেও যেহেতু প্রোটনের ভর অতিনগন্য- একের পর ২৪টা শুণ্য দিয়ে যে সংখ্যাটা তৈরি হবে, সে পরিমাণ প্রোটন একসাথে মাপলে সেটার ওজন হবে ১ গ্রামের মতো। এসবের কারণে পৃথিবীর ওজন প্রতিবছর প্রায় ১০০ টন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বলের অতিনগন্য পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই ভরবৃদ্ধিও গুরুতর ভাবে পৃথিবী-সূর্যের পারস্পরিক স্থিতিবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্য একটি পরিস্থিতি কল্পনা করা যাক, ধরা যাক বৃহ:স্পতির মতো ভারী কোনো গ্রহ হঠাৎ করেই সূর্যের আকর্ষণে সূর্যের ভেতরে প্রবেশ করলো, সেই দুর্ঘটনার প্রভাব পৃথিবীর কক্ষপথে কতটুকু পরবে? আমরা কি পৃথিবী থেকে এই দুর্ঘটনার প্রভাব অনুভব করতে পারবো? বৃহ:স্পতির মতো ভারী কোনো গ্রহ যদি সূর্যের ভেতরে প্রবেশ করে( বৃহ:স্পতির ভর সূর্যের ভরের ১০০০ ভাগের এক ভাগ, সূর্যের ভর ১০০০ ভাগের ১ ভাগ বৃদ্ধি পেলে সেটা পৃথিবী থেকে খুব সুক্ষ্ণ যন্ত্র দিয়ে হয়তো পরিমাপ করা যাবে।

অর্থ্যাৎ সূর্যের ভর যদি ১০০০ ভাগের এক ভাগ বেড়ে যায় কোনো মহাজাগতিক বিপর্যয়ে এর প্রভাবে পৃথিবীর কক্ষপথ হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিন্তু পৃথিবী-সূর্যের মধ্যকার আকর্ষণ বলের পরিমাণ খুব বেশী পরিবর্তিত হবে না। অন্য দিক থেকে ভাবা যাক, সূর্য জ্বলতে জ্বলতে একটা পর্যায়ে শ্বেত বামন নক্ষত্রে পরিণত হবে, যেসব নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের ১ দশমিক ৪ গুণ, তারা একটা পর্যায়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে। যখন নক্ষত্রের জ্বালানী কমে যায়, অর্থ্যাৎ এর হাইড্রোজেনগুলো ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয় তখন হঠাৎ করেই এর তাপমাত্রা কমে যায়, তাপমাত্রা কমে গেলে ফিউশন প্রক্রিয়াও প্রভাবিত হয়, ফলে উত্তপ্ত নিউক্লিয়াসগুলোর উর্ধমুখী চাপ মহাকর্ষীয় নিম্নমুখী চাপকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না, নক্ষত্র সংকুচিত হয়। নক্ষত্র সংকুচিত হওয়ার সাথে সাথে এর উত্তাপ বৃদ্ধি পায়, একটা নির্দিষ্ট মাণে পৌঁছানোর পর সংকুচিত নক্ষত্র হিলিয়ামকে ফিউশন প্রক্রিয়ায় কার্বণে রুপান্তরিত করতে শুরু করে। এভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় কার্বন-অক্সিজেন-নিয়ন- সিলিকন বিভিন্ন নিউক্লিয়াস তৈরি হয়।

এভাবে যখন নক্ষত্রের নিউক্লিয়াসগুলো লোহায় পরিণত হয়, তখন নক্ষত্র মূলত গলিত লোহার বৃহৎপিন্ডে পরিণত হয়। অত্যাধিক ভারী এই লৌহনক্ষত্র তখন শীতল হতে শুরু করে- চন্দ্রশেখর হিসেব করে দেখালেন যদি কোনো নক্ষত্রের ভর সুর্যের ১ দশমিক ৪ গুণ বেশী হয় তাহলে পাউলি বর্জনসূত্রের কারণে ইলেক্ট্রন যে চাপ সহ্য করতে পারে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের প্রভাবে সৃষ্ট চাপ তার সমান হবে। এটাই সীমান্তবর্তী মাণ, যদি কোনো নক্ষত্রের ভর এই সীমার উপরে হয় তাহলে পাউলির বর্জন সূত্রের ইলেক্ট্রন চাপ সেটাকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবে, ফলে প্রতিটি বস্তুকণাই কেন্দ্রের দিকে পতিত হবে। অসীম ঘণ এই পিন্ডের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল অতিক্রম করে এমন কি আলোও বের হতে পারবে না। ফলে একটি নক্ষত্র তার সম্পূর্ণ ভর ও জ্বালানীসমেত আমাদের চোখের সামনে থাকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

যদি এই মুহুর্তে সূর্য ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয় তাহলে পৃথিবীর কক্ষপথে কি এর কোনো প্রভাব পরবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় পৃথিবীতে প্রাণের বিলুপ্তি ঘটবে, কারণ সূর্য পৃথিবীর সকল প্রাণের উৎস ও প্রতিপালক। সেই সুর্যের অভাবে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ও প্রজনন থেমে যাবে কিন্ত মহাকর্ষীয় বলের পরিমাণে তেমন তারতম্য হবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।