আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকায় আশা আশাহত আমরা

আহমদ বাসির উপমহাদেশ খ্যাত জনপ্রিয় ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী আশা ভোঁসলে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ম্যাকমের আমন্ত্রণে গত ৭ মার্চ রাতে তিনি ঢাকা আসেন। ৮ মার্চ হোটেল ওয়েস্টিনে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ৯ মার্চ রাতে আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত ‘ইন্টারনাল আশা-লাইভ ইন ঢাকা’ কনসার্টে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ কনসার্টে তিনি হিন্দির পাশাপাশি দু’তিনটি বাংলা গানও পরিবেশন করেন।

আশা ভোঁসলে এমন একজন শিল্পী যিনি পৃথিবীতে সর্বাধিক গানের রেকর্ড করেছেন এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাষায় তিনিই গান করেছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আশা প্রায় ১২ হাজার গান তার কণ্ঠে রেকর্ড করেছেন এবং প্রায় ২ ডজন ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে একবার ঢাকা এসেছিলেন। তত্কালীন হোটেল শেরাটনে গান পরিবেশন করেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো এমন একজন শিল্পীর বাংলাদেশে আগমন নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন, এটাই তার আখেরি ঢাকা সফর। ‘আখেরি’ কেন, জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘জীবনের ওপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আরেকবার ঢাকা আসার সুযোগ পাবেন এ জীবনে, সে আস্থাও তার নেই। ’ উপস্থিত সাংবাদিকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এ সময় আশাকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তিনি কোনো বিষয় নিয়ে বেশ বিরক্ত; কিন্তু সেটা কোনোভাবে প্রকাশ পাক এটা তিনি চাচ্ছেন না।

কেন আশার এই বিরক্তি, সেটা জানার সুযোগ অবশ্য কারও হয়নি। কিন্তু আশার এ আগমন বাংলাদেশের সুধীমহলে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের আবার নানা শাখা-প্রশাখা আছে। আমরা সেদিকে যেতে চাই না। দুটি প্রশ্ন আমাদের কাছে গুরুতর।

এ দুটি প্রশ্নই আমরা উত্থাপন করতে চাই। আশাকে যারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তারা শুরু থেকে কনসার্টটিকে একটি বাণিজ্যিক কনসার্ট বলে প্রচার করলেও শেষ পর্যন্ত সেটি যে বাণিজ্যসফল কনসার্ট ছিল না, তা কনসার্টের রাতেই উপস্থিত সবাই অনুভব করতে পেরেছেন। বলা হয়েছিল ১২ হাজার দর্শক আশার গান উপভোগ করবেন। বাস্তবে সে রাতে আর্মি স্টেডিয়ামে ২ থেকে আড়াই হাজারের বেশি দর্শক-শ্রোতা ছিলেন না। এদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, আমলা এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাও।

এদের কনসার্টের সৌজন্য টিকিট দেয়া হয়েছিল। এছাড়া গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্রে বহু দর্শক-শ্রোতা সৌজন্য টিকিট নিয়েই এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এক হাজার টিকিটও আয়োজকরা বিক্রি করেননি। অথচ ওই কনসার্টে আশার পাশাপাশি সুদেশ ভোঁসলেসহ মোট ২০ জন ভারতীয় শিল্পী এসেছেন। এরা যদিও সবাই কণ্ঠশিল্পী নন, বাদক দলও রয়েছে।

এত বড় একটি দল নিয়ে দুবাই থেকে ঢাকা এসেছেন আশা। যে পরিমাণ অর্থ এতে ব্যয় হতে পারে তা ওই এক হাজার টিকিটের মূল্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হওয়ারই কথা। এ থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, এ কনসার্টই আশার আগমনের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। অন্য কোনো উদ্দেশ্য এর মধ্যে নিহিত ছিল। এ অনুষ্ঠান নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কিছুটা লুকোচুরি করা হয়েছে।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, লায়ন্স ক্লাবের আদলে আইকন ক্লাব প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচিতে আশাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে আশার পরিবেশিত গান নিয়ে। আশা যত বাংলা গান গেয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে নজরুলগীতি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে এইচএমভি থেকে তার নজরুলগীতির রেকর্ড বের হয়। তিনি নজরুলের ষোলটি গান রেকর্ড করেছেন সে সময়।

এ উপলক্ষে তিনি বেশ কিছুদিন কলকাতায় অবস্থান করেন এবং ‘সানন্দা’ পত্রিকার প্রতিনিধি সুদেষ্ণা রায়কে একটি সাক্ষাত্কার দেন। ওই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন—‘আমি এসেছিলাম আটটি গানের রেকর্ড করতে। ভেবেছিলাম তিন-চার দিনে হয়ে যাবে। কিন্তু ধীরেনবাবু এক-একটা করে গান শোনাতে লাগলেন এবং আমিও মুগ্ধ হয়ে যেতে থাকলাম। সেই গানটি গাইবার জন্য আবদার করলাম।

এভাবে চারদিনের বদলে থেকে গেলাম দশদিন। রেকর্ড করলাম ষোলটি গান। আজ অবধি বোধ হয় আর কোনো গান রেকর্ড করতে আমি এতটা মনোযোগ দিইনি। নজরুলগীতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। বম্বেতে আমাদের একই দিনে চার-পাঁচটা গান রেকর্ড হয়—সকালে, দুপুরে, বিকালে।

এর একেকটির এক এক রকম চরিত্র। আমি এবার নজরুলগীতির ক্ষেত্রে তা আর করিনি। তাই দশদিন একটানা ডুবে ছিলাম নজরুলের সুরের মূর্ছনায়। বম্বের সব অ্যাপয়ন্টমেন্ট ভেঙে ফেলে। ’ আশা রবীন্দ্রগীতির রেকর্ডও করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ওই একই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘যে গাইতে জানে তার পক্ষে রবীন্দ্র সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলা শক্ত। তার অসুবিধা হয়, শিল্পীসত্তায় বাধে। কিন্তু যে গাইতে জানে না তার কোনো অসুবিধাই হয় না, বাঁধাগতে গেয়ে গেলেই চলে। কিন্তু আমরা যারা ক্লাসিক্যাল বেস-এর শিল্পী, যারা এত গান গেয়েছি তাদের পক্ষে...। ’ পাঠক, এই ‘...’ এর শব্দটি নিশ্চয় আর বলে দিতে হচ্ছে না।

আশার ওই সাক্ষাত্কারে আরও অনেক কথা আছে। সব তুলে ধরা এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের বিস্ময় এখানেই। যে শিল্পী নজরুলের গানকে এভাবে গ্রহণ করেছেন, যে শিল্পীর সঙ্গে নজরুলের প্রাণের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ছে—সে শিল্পী কিনা বাংলাদেশে এসে এদেশের জাতীয় কবির কোনো গান পরিবশন করেননি। করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও তার স্বামীর (এসডি বর্মণ) সুরে দু’একটি গান।

কোনো বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব হয় না। আশা কি ঢাকা এসে ভুলে গিয়েছেন নজরুলের কথা। বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং তার তো নজরুলের কথাই আগে মনে পড়ার কথা। কেননা নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি আর নজরুলের গান সম্পর্কে আশার ভাষ্য তো আমরা উপরেই তুলে ধরলাম।

আয়োজকরাও ভুলে গেছেন নজরুলের কথা। দর্শক-শ্রোতাদের অনুরোধেও বুঝি নজরুল ছিল না। কীভাবে সম্ভব। নজরুলসঙ্গীতের শিল্পী হয়েও সেদিন আশার সঙ্গে একই মঞ্চে উঠে রুনা লায়লাও কি ভুলে গিয়েছিলেন নজরুলের কথা? আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের রসবোধ, আমাদের শিল্পবোধ বুঝি এতই পানেস হয়ে গেছে। নাকি সংবাদ সম্মেলনে বিরক্ত আশার সঙ্গে নজরুলের গান না গাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আশা সম্পর্কে যেসব লেখালেখি ও বলাবলি হয়েছে গণমাধ্যমে, তাতে নজরুলের নামটি একবারও উচ্চারিত হয়নি। নানা কথা বলা হয়েছে আশা সম্পর্কে; কিন্তু তার নজরুলগীতি সম্পর্কে কিছুই না। হায়, কোন পাতালের তলে আছি আমরা! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।