আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখী হতে চাই

আনাড়ী লেখক আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার বন্ধু আকরাম ছিল আমার সবসময়ের সাথী। সব কাজ দুজনে মিলে মিশে করতাম। ক্লাসে আমরা একই বেঞ্চে বসতাম। সবকিছুতেই আমাদের শেয়ারিং ছিল।

অনেক ভাল বন্ধু বলতে যা বোঝায়, ও তেমনটাই ছিল। ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিলনা। মাঝে মাঝেই ও আমার কাছে এসে থাকতো। আমি বুঝতে পারতাম, বাড়িতে নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে। আমিও কিছু বলতাম না।

বরং আমার সময়টাও ওর সাথে ভালই কাটতো। আম্মু আমাকে আর ওকে আলাদা করে দেখতোনা বা কোনদিন বলতোনা এই ছেলেটা এত ঘন ঘন আমাদের এখানে আসে কেন। আমাদের বাড়িতে লোকজন এমনিতেই কম। ও আসলে আমাদের সবারই ভাল লাগতো। যতদিন আমি ওর সাথে মিশেছি, আমি একটি জিনিস আবিষ্কার করেছি।

ওর জীবন নিয়ে ওর সন্তুষ্টি ছিলনা। সবসময় একটা কষ্ট কাজ করতো ওর মাঝে। ও বুঝাতে চাইতো... “আমার জীবনটা এমন কেন?, এতো কষ্ট কেন আমার? , সবাইতো অনেক সুখে আছে”। এরকম আরো অনেক কিছু। একদিন ছুটির দিন দুপুরে আকরাম আর আমি আমার রুমে ফ্লোরে বসে ছবি আঁকছিলাম।

আম্মু আমাদের দুজনের জন্য দুই গ্লাস জুস দিয়ে গেলেন। আর আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “রুমেই থাকো... বাইরে যেওনা, কেমন? বাইরে অনেক রোদ... ত্বক পুড়ে যাবে। “ আম্মু চলে যাওয়ার সাথে সাথে ও বললো- “তোর আম্মুটা কত্ত ভাল”। আমি বললাম- “কেন তোর আম্মু ভালনা?” ও তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে বললো- ভাল, তবে তোর আম্মুর মত না। “ ও মাঝেই মাঝেই বলতো তোদের এই বাড়িটার মত আমাদের যদি একটা বাড়ি থাকতো!!! একদিন পুকুরে আমরা দুজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলাম।

ও বলে ফেললো – আমাদের যদি একটি পুকুর থাকতো তোদের মত!!!! শুধু আমার সবকিছুকে নয়... ও অন্য অনেকেরই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আফসোস করতো। আমার যদি এটা থাকতো... আমার যদি সেটা থাকতো............ আমাদের স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিনের কথা। আমাদের স্কুলটা অনেক সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল। আমি যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছে দেখলাম- আকরাম আসেনি। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আকরাম অনেক দেরিতে আসলো। আজ সবাই অনেক সেজেগুজে এসেছে। বিশেষ করে মেয়েগুলো। যে মেয়েদের দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার আর তাকাতে ইচ্ছে করেনি, সেই মেয়েগুলো এতো সুন্দর করে সেজে এসেছে যে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। শুধু আকরামই ব্যতিক্রম।

উস্কুখুস্কু চুল, তেল চিটচিটে সেই শার্ট, স্কুল ড্রেসের হাফপ্যান্ট, আর তালি দেওয়া একজোড়া সেন্ডেল। আমি বললাম এতো দেরি করলি কেন? আর এই অবস্থা কেন তোর? আমার কথার ও কোন উত্তর দিলনা। একটু পরে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রসাশক আসলেন। আমরা গেটে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। পাজেরো গাড়ীতে আসলেন জেলা প্রসাশক, সাথে সুন্দরি ওয়াইফ এবং একটি আমাদের বয়সী ছেলে।

সে কি আভিজাত্য জেলা প্রসাশকের!!! আকরাম তার স্বভাব সুলভ কথা বললো। এইবার একটু বেশিই বলে ফেললো ও। বললো “ এই জেলা প্রশাসক যদি আমার বাবা হতো!!!! আমি বললাম “ আকরাম, তোর মাথা গেছে। কি বলছিস এসব?” - তুই শুধু একটু কল্পনা কর। আমি এই পাজেরো থেকে নামছি।

আমার বাবার হাত ধরে। ওফ... কি মজাই না হতো। আকরাম আমার চেয়ে ভাল ছাত্র ছিল। আমরা দুজনেই এস এস সি তে ভাল রেজাল্ট করি। এরপর আমি যখন দূরের একটি কলেজে ভর্তি হই, তখন থেকে ওর আর আমার মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়।

পড়াশুনার চাপে আর তেমন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। ও আমাদের এলাকারই একটি কলেজে ভর্তি হয়। পরে শুনেছিলাম কলেজে এক মেয়ের সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্পর্কটা ওদের আর বেশিদিন আগায়নি। মেয়েটি ওকে ছেড়ে চলে যায়।

আকরাম এমনিতেই তার জীবনকে ঘৃণা করতো। এরপর এই ঘৃণার মাত্রা অতিশয় বেড়ে যায়। নিজের জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয় সে। নেশা করে বাড়ি ফিরতো প্রতিদিন। নিজের শরীরে নিজেই ব্লেড দিয়ে আকাআকি করতো, জ্বলন্ত সিগারেট হাতের কব্জিতে চেপে ধরতো।

তার নাকি এতে কোন কষ্ট হতোনা। আর কষ্ট হতোনা বলেই একদিন তার সাধ জাগলো মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার। একদিন সকালে ওদের বাড়ির লোকজন ওকে সিলিং ফ্যানে ঝুলে থাকতে দেখলো। আকরাম নামক অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটল। আমি তার জন্য শুধু দুফোটা চোখের জল ফেলেছি... আর কিছুই করতে পারিনি।

পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছে, ও হয়তো যার সাথে প্রেম করতো... তার চেয়ে সুন্দরী কাউকে দেখলে বলে উঠতো “ এই মেয়েটি যদি আমার গার্লফ্রেন্ড হতো!!! আমার যদি ওর মত একটি বাইক থাকতো!!!!! আমার যদি এটা থাকতো!!!!! আমার যদি সেটা থাকতো!!!! ইত্যাদি ইত্যাদি। আকরাম একটু বেশিই পাগলামি করতো। কিন্তু আমরা যে করিনা, তা কিন্তু নয়। আকরাম হয়তো মুখ ফুটে বলে ফেলতো, কিন্তু আমরা হয়তো মনে মনে বলি। অনেককে দেখেছি সামান্য ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করছে।

এটা আমাদের সমাজে এখন একটি ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সুইসাইড করলো সে তো বেঁচে গেল, আর যাদেরকে রেখে গেল তাদের কথা আর নাই বা বললাম। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। কিন্তু পাওয়া যৎসামান্য। তাই বলে জীবনকে এতটা অনিশ্চিতের পথে ঠেলে দেওয়া ঠিক না।

সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনা। কারো জন্ম কোটিপতির ঘরে আবার কারো জন্ম দিনমজুরের ঘরে। কোটিপতির সন্তানেরা যে অনেক ভাল হয়, এমন না। আবার দিনমজুরের ছেলেও যে অনেক খারাপ হয়, এমনও না। আমরা দেখেছি অনেক কোটিপতির ছেলেরা চুরি করে ধরা পড়ে, জেল খাটে।

বাবা-মায়ের সম্মানকে তারা ধূলিসাৎ করে। সমাজের জন্য এরা আশীর্বাদ না। এরা সমাজ, দেশ, জাতি এমনকি বাবা-মার শত্রু। বাবা-মা কত চোখের জল ফেলেন এমন কুলাঙ্গার সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। আবার এমন অনেক দিনমজুরের ছেলেকে দেখেছি যারা নিরলস পরিশ্রম করে লেখাপড়া করে বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করেছে।

সমাজ,দেশ,জাতি এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা সুনাম কুড়িয়েছে। সবথেকে মজার ব্যাপার হল- যারা আজ সফল তাদের সিংহভাগই অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের সফলতায় কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। বড় বড় মনীষীদের জীবন কাহিনী পর্যালোচনা করলে এই চরম সত্যিটাই উপস্থাপিত হবে। আমাদের যা আছে তার জন্য যদি আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি এবং তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি, তাহলে আমার মনে হয় সুখী হওয়া অনেক সহজ।

তাই বলে এই না- আমরা কিছুই করবোনা। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করবো ভাল কিছু করার। সফল হলে সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানাবো। ব্যর্থ হলে ধৈর্য্যশীল হবো। কখনোই আরেকজনের সুখ দেখে ঈর্ষান্বিত হবোনা।

তবেই আমরা সুখী হতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।