আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিবর্তনের হাওয়া

গৃহে থেকেও আমি যেন গৃহত্যাগী উৎসর্গ: দেশের সকল যাত্রা অভিনেতাদের এক যমুনার তীর ঘেঁসে সারি সারি দোকানপাট। এটা চন্দ্রা বাজার। এই বাজারকে চন্দ্রা ছাড়াও আশেপাশের গ্রামগুলোর রজধানি বলা চলে। চন্দ্রা হচ্ছে উন্মত্ত যমুনার মাঝে একটি চর, এই চরের মাঝে এমন একটা বাজার আছে বলেই গ্রামের মানুষজনের রক্ষা। তা না হলে নদী পার হয়ে আরও সাত মাইল হেটে যেতে হত বাজার করতে।

এই বাজারের বয়স কিন্তু বেশি না, মাত্র পাঁচ বছর। যুদ্ধের পাঁচ বছরের মধ্যেই শরিফ উদ্দিন মণ্ডল একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছে এই বাজার। বাজারের জমিটুকু পুরোটাই তার। ৬০ ভাগ দোকানের মালিকও তিনিই। এর মাঝে কিছু দোকান নিজে চালায় আর বাকি গুলো নাম মাত্র ভাড়ায় ভাড়া দেয়া হয়েছে।

বাজারটা করার কারনেই গ্রামের মানুষজন তাকে সন্মান করে চলে। শরিফ উদ্দিন অত্যন্ত ধুরন্ধর ও খারাপ লোক। ১৯৭১এ পাকসেনাদের এই চরে এনে হিন্দু পরিবারগুলোকে নিশ্চিহ্ন করিয়েছেন তৎকালীন শান্তি-কমিটির প্রধান শরিফ উদ্দিন। তার কিছুই ছিলনা তখন। আর এখন হিন্দুদের জায়গা জমি দখল করে জমিদার সেজেছে।

এই এলাকায় তার সামনে কেউ দাড়াতে পারে না। তবে ইদানীং রমিজ মির্জা ভালোই এগিয়ে যাচ্ছে। রমিজ স্থানীয় লোক না বগুড়া থেকে এখানে এসে ব্যবসাবাণিজ্য করে। তার একছেলে যুদ্ধের আগে থেকেই দেশের বাইরে থাকে। এই কয়েকবছর না পারলেও এখন টাকাপয়সা ভালোই পাঠাচ্ছে।

রমিজ সেই টাকা দিয়ে জায়গা জমি কিনছে আর কলার বাগান করছে। তন্দ্রা বাজারে তার কলার ব্যবসা। জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে পাইকাররা আসে কলা কিনতে। নৌকাভরে কলা কিনে নিয়ে যায়। গ্রামের কোন বিচার সালিশিতে আগে শুধু শরিফ উদ্দিন কেই ডাকা হত, আজকাল রমিজকেও ডাকা হচ্ছে।

যদিও শরিফ উদ্দিনই সভাপতিত্ব করছে তবুও রমিজকে ডাকা তার সহ্য হয় না। ভিন দেশ থেকে একজন এসে এখানে রাজত্ব করবে এটা সে কিছুতেই মানতে পারে না। তাই নিয়মিত চক্র আঁকতে থাকে রমিজকে ঘায়েল করার। রমিজ মির্জাও কম চালাক না, তিনি সব বুঝতে পারে কিন্তু চুপ করে সব সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভালো করেই জানে এখন শরিফের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সে টিকতে পারবে না কিন্তু সময় একদিন ঠিকই আসবে।

সেদিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনে যায়। দুই রমিজ মির্জার পাঁচ ছেলে অপর দিকে শরিফ উদ্দিনের মাত্র এক মেয়ে কোন ছেলে নেই। এ নিয়েও শরিফের দুঃখের কোন শেষ নেই। প্রথম স্ত্রী টা মেয়ে জন্মদিতে গিয়ে মারা গেল এরপর সে সন্তানের আশায় আরও তিনবার বিয়ে করেছে কিন্তু কাজ হয় নি কেউ তাকে সন্তান উপহার দিতে পারে নি। রমিজের সব থেকে ছোট ছেলের নাম সিরাজ।

গ্রামের সব থেকে স্বপ্নবাজ মানুষ এই সিরাজ। কাজ কর্ম কিছু করে না আর পড়াশুনার তো বালাই ই নেই। সে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন নিয়েই বেচে থাকে। তার স্বপ্ন হচ্ছে একদিন সে অনেক বড় অভিনেতা হবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে আর যাত্রা করবে। যাত্রাপালায় রহিম বাদশা, সিরাজ-উদ-দৌলা, মজনু চরিত্র গুলো তার খুব পছন্দের সবগুলো পালার সংলাপ তার মুখস্থ।

প্রতি বছর পৌষ মাসে চন্দ্রা বাজারের দক্ষিণ পাশে নদীর ধারে মেলা বসে। মেলায় সাতদিন ধরে যাত্রাপালা হয়। যাত্রায় জামালপুরের মেলান্দ থেকে বড় বড় দল আসে। সিরাজ এই সময়টা দলের অধিকারীর পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে। ও কাজচোরা স্বভাবের মানুষ হলেও একটি চান্সের আশায় কাজটাজ ও করে দেয়।

এছাড়া দলের পেছন পেছন ঘুরঘুর করার আরও একটি কারন আছে। যাত্রা দলের একটি মেয়েকে ওর খুব ভাল লাগে। মেয়টির নাম শেফালি যদিও যাত্রায় তার নাম প্রিন্সেস লায়লা নামেই পরিচিত। মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ, ভাল নাচ গানও পারে। দেখতে শুনতে ভাল হলেও ময়নার(শরিফ উদ্দিনের মেয়ে) মত সুন্দরি না।

সিরাজ যে মেয়েকেই দেখে তাকেই ময়নার সাথে তুলনা করে কারন সে মনে মনে ময়নাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু ওর ইচ্ছে হল যাত্রার কাউকে বিয়ে করা যাতে বিয়ের পর দুইজন একসাথে ঘুরে বেড়াতে পারে, কোন পিছটান না থাকে। কিন্তু ময়না তো আর যাত্রা করে না, যাত্রাপালা পছন্দও করে না। যাত্রার সময় গ্রামের একজন মানুষই যাত্রা দেখতে আসে না-সেটা ময়না। তিন ময়না গঞ্জের স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে।

শরিফ উদ্দিন চায় না মেয়ে পড়াশুনা করুক তাই এখন পড়াশুনা বন্ধ। ময়না তার মা মারা যাবার পর থেকে মামার বাড়িতে বড় হয়েছে। তার বড় মামাই তাকে এতদিন পড়াশুনা করিয়েছেন। মৌলানা বলেছে মেয়ে মানুষকে পড়াশুনা করিয়ে বড়ই গুনাহের কাজ করছে তাই জোর করেই মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসেছে শরিফ। ময়নার একটা বিশেষ গুন আছে যেটা কেউ জানে না।

ও খুব ভালো পালা লেখতে পারে। ওর ট্রাঙ্কে চারটা মোটা খাতা ভর্তি শুধু পালা। যখন বাড়িতে কেউ থাকে না তখন ও ট্রাংক খুলে খাতাটা বের করে নিজের লেখা পালা গুলোই পড়ে। আনন্দের কাহিনী পড়ে আপন মনে হাসে, দুঃখের কাহিনী পড়তে পড়তে একসময় চোখ দুটো সিক্ত হয়ে উঠে। ও যে যাত্রাপালা পছন্দ করে না এই কথাটা ভুল।

ও যাত্রা দেখতে যায় না অন্য করনে। ও জানে যে সিরাজ ওকে দেখলেই সিরাজের মাথা আউলা হয়ে যায়। বেচারা অনেক মনোযোগ সহকারে যাত্রা দেখে, সংলাপ মুখস্থ করে। ও গেলেই সিরাজের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যায় না।

সিরাজের জন্য ওর অনেক মায়া লাগে- বেচারা যদি একবার চান্স পেত! চার চান্স অবশ্য সিরাজ একটা পেয়ে যায়। আসছে পৌষ মাসে সে মঞ্চে উঠবে। চরিত্র যদিও ছোট জমিদারের লাঠিয়াল, তিন বার মঞ্চে উঠবে সংলাপ আছে দুইটা। এতেও সিরাজের দুঃখ নাই, চান্স পেয়েছে তাতেই খুশি। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা শুধু সংলাপ দুইটা আওড়াতে থাকে।

এক বছরে কত লক্ষবার যে সে সংলাপ গুলো মানুষজন কে শুনাল তার কোন হিসেব নেই! গ্রামের মানুষজন বলাবলি করতে লাগল আধপাগল ছেলেটি যাত্রায় চান্স পেয়ে পুরাই পাগল হয়ে গেছে। ময়নার কাছে কিন্তু এই পাগলামিটাই অনেক ভালো লাগে। ওর মনের দৃঢ় বিশ্বাস সিরাজ এবার ভালো অভিনয় করে সামনের বার অনেক বড় চরিত্র পাবে, এভাবেই একদিন অনেক বড় অভিনেতা হয়ে উঠবে। ময়না উলের মাফলার বোনে আর সিরাজের কথা ভাবে। ও ঠিক করেছে এবার ও যাত্রা দেখতে যাবে।

মাফলার টা ও সিরাজের জন্যই বানাচ্ছে। সিরাজকে মাফলার টা দিয়ে মনের কথা খুলে বলবে- দুই জনে মিলে একটা যাত্রার দল বানাবে। সেই যাত্রাপালা নিয়ে ওরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে। পাঁচ অবশেষে আসে সেইদিন। যাত্রার পেন্ডেল ভর্তি মানুষ মানুষ।

নিজেদের গ্রামের ছেলে অভিনয় করবে সেটা না দেখলে কি চলে! এত মানুষজন দেখে শরিফ উদ্দিনের মেজাজ গরম হয়ে উঠে। কি এক লাঠিয়ালের অভিনয় করবে সেটা দেখতে এত মানুষ! তবে শরিফের মনে মনে একটু ভয় ভয়ও লাগতে থাকে- সিরাজ যদি ভালো অভিনয় করে তাহলে তো গ্রামের মধ্যে ওর সন্মান বেঁড়ে যাবে। সিরাজের সন্মান বাড়া মানে রইসের সন্মান বাড়া। পৌষের হাড়কাপা শীতের মাঝেও শরিফ উদ্দিন চিন্তায় ঘামতে থাকে। প্রথমে বন্দনা করি আল্লাহ-নবীর নাম এরপরে বন্দনা করি মা ও বাবার নাম পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা শরীফের উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত পুবেতে বন্দনা করি সূর্য মহারাজা দক্ষিণে বন্দনা করি বঙ্গোপসাগর বন্দনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়ে যায়।

সবাই অপেক্ষা করতে থাকে কখন সিরাজ মঞ্চে উঠবে! একসময় সিরাজ উঠে আসে। সবাই জয়ধ্বনি দেয়। এই দৃশ্যে সিরাজের কোন সংলাপ নেই। সিরাজ জমিদারের পেছনে দারিয়ে থেকে জমিদারের সাথে বেরিয়ে যায়। একটু পর সিরাজ আবার মঞ্চে আসে।

এই দৃশেই সিরাজের সংলাপ আছে। প্রজাদের কষ্ট দেখে জমিদারের সাথে তার কথা কাটাকাটি হবে। শরিফ উদ্দিনের শরীর ঘামতে থাকে। সিরাজ কে সেখে মানুষজনের প্রতিক্রিয়া কি হয় সেটা দেখার জন্য আশেপাশে তাকায়। তার নজর পড়ে ময়নার উপর।

ময়না মুগ্ধ নয়নে সিরাজের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে রাগে তার শরীর কাঁপতে থাকে। মনে মনে বলে-“ হারামজাদী, আর মানুষ পাসনাই। কুত্তার বাচ্চারে দেখতে আইছস”। সিরাজ ময়নার ঐ মুগ্ধ দৃষ্টি দেখেছিল কিনা জানি না।

কিন্তু ও কোনও সংলাপ দিতে পারল না, হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করল। মঞ্চের পেছন থেকে অধিকারী সংলাপ বলে দিল, সিরাজ সেটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। এক দৌড়ে মঞ্চ থকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। যে মানুষজন একটু আগে সিরাজের নামে জয়ধ্বনি করেছিল তারাই এবার সিরাজের নামে তামাশা করতে লাগল। পাগল পাগল বলে দুয়োধ্বনি দিতেই ভুলল না।

কেউ কেউ আবার সিরাজের পাশাপাশি রমিজকে নিয়েও তামাশা করতে ছাড়ল না। শরিফ উদ্দিনের বুক থকে পাথর নেমে গেল, মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই ময়নার কথা মনে পড়তেই মেজাজ আবার গরম হয়ে গেল। মেয়েকে এবার বিয়ে দিতেই হবে, লক্ষণ ভাল না। ছয় একবছর আর সিরাজের কোন খোজ পাওয়া গেল না।

পরের বছর পৌষ মাসে গ্রামে ফিরে এলো। আবার আগের মতই যাত্রা দেখা শুরু করল যেন কিছুই হয় নি। এদিকে ময়নারও বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। আসছে বৈশাখ মাসে বিয়ে। ছেলের বাড়ি জগন্নাথ গঞ্জ ঘাট।

স্টিমার ঘাতে ছেলের দোকান আছে, এছাড়াও বাপের অনেক সয় সম্পত্তি আছে। ময়নাকে আর ঘর থেকে বের হতে দেয়া হয় না। বন্ধী জীবন আর কাটতে চায় না। আগে পালা লিখে বা পড়ে সময় কাটাত কিন্তু শরিফ সব খাতা পুড়ে ছাই করে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। রমিজ ভুঁইয়া তার ব্যবসা আরও বৃদ্ধি করে চলে।

কলাবাগানের পাশাপাশি এখন গরুর খামার দিছে ২০ টা গাভী প্রতিদিন দুধ দেয়। সাত এভাবেই চলতে থাকে চন্দ্রার মানুষদের জীবন। সময় গড়িয়ে যায়। পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায় দেশ জুড়ে। মুজিব মারা যায়, জিয়া আসে।

জিয়া মারা যায় এরশাদ আসে। এরশাদ যায় খালেদা আসে। খালেদা যায় হাসিনা আসে। খালেদার হাত ঘুরে আবার হাসিনার কাছে আসে ক্ষমতা। সেই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে চন্দ্রা গ্রামেও।

শরিফ উদ্দিন ও রমিজ ভূঁইয়ার দৌরাত্ব আর নেই। পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে মালিকানার পরিবর্তন ঘটে শরিফ উদ্দিনের জমির। রমিজের ছেলেদের মাঝে ঐক্যের অভাবে ব্যবসায় ধ্বস নামে। আজ তারা সর্বশান্ত। চন্দ্রা আজ আর চর নয় ব্রিজ তৈরি হয়েছে নদীর উপর দিয়ে।

চন্দ্রায় পাটকল, চিনিকল, ইটভাটা গড়ে উঠেছে। পৌষ মাসে আর মেলা বসে না- মদ আর জুয়া খেলার আসর বসে। কেউ আর যাত্রা দেখে না- স্যাটালাইট টিভিতে হিন্দি ছিনেমা দেখে। ময়না আর সিরাজ এখন কই আছে তা কেউ জানে না। তারা গ্রাম থকে পালিয়ে যায় এরপর যাত্রার দল নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়।

১৯৮১ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সেরা যাত্রার দল হিসেবে স্বর্ণের মেডেল জিতে তাদের দল। এখন দেশে যাত্রা নিষিদ্ধ। ওরা কোথায় আছে, কি করছে, কেমন আছে? সে খবর আর কেউ রাখে না। আমরা এখন স্মার্ট হয়েছি হিন্দি সিরিয়াল দেখি এসব যাত্রাফাত্রার লোকের খোজ আমরা নেই না। ময়না ও সিরাজ যেখানেই থাকুক না কেন ভালো থাকুক এই কামনা।

আর আপনারা যদি কেউ ময়নার ও সিরাজের খোজ জানেন তো আমাকে বলে দিয়েন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।