আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হজ্ব কাহিনী

হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি হারামের ইমাম শায়খ শোরায়ম ফজর পড়ালেন। তাঁর মিষ্টি মোলায়েম তিলাওয়াত খুব ভালো লাগে। আল্লাহর কালামের শব্দগুলো তাঁর মুখ থেকে যেন বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার মত বর্ষিত হতে থাকে। সেই ফোঁটা ফোঁটা আসমানি বৃষ্টিতে সবাই যেন ভিজতে থাকে। কীভাবে বোঝাবো ‘শোরায়মি তিলাওয়াত’ -এর জান্নাতি জামাল! তারাবির জামাতে তাঁর তিলাওয়াত যখন শুনি, ইচ্ছে হয়, সারা রাত কিয়াম করি, আর শুনি, শুনতেই থাকি! ইমাম সোদায়সের ভরাট কণ্ঠের দরাজ গলার তিলাওয়াত অন্য রকম, যেন এক মরুঝড়! কখনো মৃদু, কখনো প্রবল; সব কিছু কাঁপিয়ে, সবকিছু দাপিয়ে দিলের আবর্জনা যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়! ভালো লাগে মসজিদুন্নবীতে ইমাম শাতেরীর মধুঝরা কণ্ঠের রিমঝিম সুরের তিলাওয়াত, যা মানুষকে শুধু আত্মহারাই করে না, আত্মসমাহিতও করে; যেন জান্নাতের নহরে লহর ওঠে।

আর ইমাম হোযায়ফী! যখন থেকে বাইতুল্লাহর সফর শুরু তখন থেকে তিনি আমার প্রিয় ইমাম। মদীনায় ফজরের জামাতে তাঁর তিলাওয়াত শুনে জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো, কে তিনি, যার কণ্ঠে এত ব্যথা, এত দরদ! এত অর্পণ, এত সমর্পণ! কণ্ঠ নয়, যেন ঝর্ণা, আর তাতে হৃদয়টা গলে গলে বয়ে চলেছে! জান্নাতে ভোরের আবহে হয়ত বাজবে এমনই মধুর কোন সঙ্গীত-সুর! ছালাতুল ফজর শেষ হলো। এর পর কী ঘোষণা আসবে, আমি জানি এবং আমার কলজে বিদীর্ণ করে সেই ঘোষণাটি এলো- الصلاة على الأموات يرحمكم الله (কয়েকজন মৃত ব্যক্তির জানাযা পড়ো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি রহম করুন। ) মাইয়েত নয়, আমওয়াত; একজন নয়, কয়েকজন! যতবার আল্লাহর ঘরে এসেছি, হারামাইনে প্রায় প্রতিওয়াক্তে জানাযা পড়েছি। কখনো একজন, কখনো কয়েকজন।

যেন নারী, পুরুষ ও শিশুদের জানাযার মিছিল! অনন্তকাল ধরে চলছে এবং চলতেই থাকবে। একদিন আমাকেও শামিল হতে হবে সেই মিছিলে। এক রামাযানে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দুই আরব মুছল্লী। জানাযার ঘোষণা শুনে তাদের একজন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, কেউ কি বলতে পারে যে, পরের ওয়াক্তে তার জানাযা পড়া হবে না?! প্রতিটি জানাযাই তো সতর্ক করছে যে, তুমি নিজের জানাযার জন্য প্রস্ত্তত হও। আরবের ঐ দুই মুসলিম ভাই এখন কোথায় জানি না।

এখনো কি তারা জানাযা পড়েন, না তাদেরই জানাযা পড়া হয়ে গেছে?! সেদিন জানাযার কাতারে দাঁড়িয়ে শোনা তাদের কথাগুলো আমার দিলে যেন গেঁথে আছে! মাঝে মধ্যে মনে পড়ে। এই সফরে আজ আল্লাহর ঘরে প্রথম জানাযার কাতারে দাঁড়িয়েও তাদের কথা মনে পড়লো। দুনিয়ার যিন্দেগিতে আল্লাহ যেন মউতকে ইয়াদ রেখে চলার তাওফীক দান করেন, আমীন। *** ফজরের পর সময়টুকু বড় নূরানিয়াতপূর্ণ। ইচ্ছে ছিলো, তখন একটি তাওয়াফ করবো, কিন্তু দুনিয়ার সব ক্লান্তি যেন একসঙ্গে জড়িয়ে ধরলো।

ক্লান্ত-শ্রান্ত পদক্ষেপে উম্মেহানির দিকে এগিয়ে গেলাম, যেখানে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. বসতেন। কিন্তু আশ্চর্য, খুঁজে পেলাম না! হারামের পরিচ্ছন্নতার সেবায় যারা নিয়োজিত তাদের একজন দেখিয়ে দিলেন। আমি তো অবাক! এতো পরিবর্তন! আগে মেঝেটি ছিলো দুই ধাপের। বাইতুল্লাহর দিকে কিছু দূর গিয়ে সিঁড়ির একটি ধাপের পরিমাণ নীচু হয়ে আরো কিছু দূর গিয়েছে। এখন পুরোটা সমতল।

সেই উঁচু স্থানটিও সমান করে ফেলা হয়েছে, মেরাজের রাত্রে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে শয়ন করেছেন বলে কথিত আছে। হারামের এ অংশটি তুর্কীদের তৈরী। দুই স্তম্ভের মাঝে ঐ স্থানটি তখন থেকে চৌকিমত উঁচু করে চিহ্নিত করা ছিলো। মানুষ যখন বাড়াবাড়ি শুরু করল তখন সেখানে কোরআন শরীফের তাক রেখে বিদ‘আত দমনের চেষ্টা করা হলো। তাতে অবশ্য কাজ হলো না।

পাঁচ বছর আগে দেখেছি, কোন কোন হাজি সেখানে চুমু খায়, মাথা ঠেকায়। আগে এটা দেখিনি। শিরক ও বিদ‘আত এভাবে পর্যায়ক্রমেই আসে। শুরুতে এত নির্দোষ থাকে যে, মানুষ ভাবে, নেক কাজে বাধা দেয়া কেন? ধীরে ধীরে বিদ‘আত তার কদর্য চেহারা বের করে। তখন আর বাধা দেয়ার উপায় থাকে না।

কারণ স্রোত তখন ঢলের রূপ ধারণ করে ফেলে। এখানেও তাই হলো, মাথা ঠেকানোর চেয়ে জঘন্য বিদ‘আত আর কী হতে পারে! পুলিশ বাধা দেয়, তেড়ে আসে। মানুষ সরে যায়, আবার জড়ো হয়। শেষে সউদি হুকুমত স্থানটি সমান করে দিয়েছে। ভালোই করেছে।

জান্নাতুল মুআল্লা, জান্নাতুল বাকী ও অন্যান্য কবর-মাযার সম্পর্কে সউদি হুকুমত যে নীতি গ্রহণ করেছে, উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তার সমালোচনা করেছেন। মাওলানা দরয়াবাদী রহ. তো খুবই কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন। তবে সম্ভবত বিদ‘আত রোধ করার জন্য এছাড়া উপায়ও ছিলো না। বেশ কিছু বাড়াবাড়ি অবশ্য এদিক থেকেও হয়েছে। আসলে প্রান্তিকতা হচ্ছে মুসলিমসমাজের একটি বড় দুর্বলতা।

ভক্তি দেখাতে যায় তো সিজদা পর্যন্ত গিয়ে থামে, বিদ‘আত রোধ করতে নামে তো কবরের বেহুরমতি করে ছাড়ে। *** উম্মেহানি বরাবর হারামের ভূগর্ভস্থ অংশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। উঠলাম দশটার পরে। বাসায় গিয়ে দেখি, ইমাম ছাহেব আমার জন্য পেরেশান। আমি অবশ্য বলে গিয়েছিলাম, দশটা এগারটার দিকে ফেরার কথা।

ইমাম ছাহেব নাশ্তা এনে রেখেছেন। শুরু করতে যাবো, তখন তিনি ইনসুলিনের কথা মনে করিয়ে দিলেন। ইনসুলিন, আর ঔষধ নিতে ভুলে যাওয়া আমার ‘প্রিয়’ অভ্যাস। এমনও হয়েছে, মনে করিয়ে দেয়ার পরও ভুলে গেছি, আর তিনি ভুলে যাওয়াটাও নযরে রেখেছেন। ঘরে আমার খুব কমই যাওয়া হতো; তখন তিনি আমার জন্য হারামে খাবার নিয়ে যেতেন এবং জোর করে খাওয়াতেন।

এটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, এটা মমতা, যা তার কাছ থেকে আমি পেয়ে আসছি ছাত্র জীবন থেকে। সফরে, বিশেষ করে হজ্বের সফরে বড় বড় সম্পর্কেও ফাটল ধরে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমাদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। ঊনিশ বছরের ব্যবধানে দু’বার আমরা একসঙ্গে হজ্বের সফর করেছি, তারপর একাধারে কয়েক বছর চলছে বাইতুল্লাহর সফর, আমাদের সম্পর্ক রয়ে গেছে আমাদের মতই, যা সবার কাছে বিস্ময়ের বিষয়। ঊনিশ বছর আগের সফরে মাওলানা কাযী মু‘তাছিম বিল্লাহ ছাহেব বলেছিলেন, উর্দুতে বলে يار غار (গুহার বন্ধু), আপনাদের দেখে সেটা মনে পড়ে। এবারের এক সফরসঙ্গী বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হওয়ার রহস্য জানতে চাইলেন।

আমি বললাম, রহস্য এই যে, এ বন্ধুত্ব হলো দুই তালিবে ইলমের বন্ধুত্ব, যার ভিত্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এসব কথা হয়ত এখানে অপ্রাসঙ্গিক, তবু বলা যখন হলো তখন বিষয়টির সমাপ্তি টানছি হযরত আলী নদবী রহ.-এর একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু মাওলানা মসঊদ আলম নদবী-এর মৃত্যুর পর লিখেছিলেন আজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে, ‘যামানা যে দ্রুত গতিতে নীচের দিকে নেমে চলেছে তাতে মনে হয় না, এমন অন্তরঙ্গ ও নিবেদিত বন্ধু জীবনে আর কখনো পাবো। ...’ (পুরানে চেরাগ, ১ম খ-) আমি ও আমার বন্ধু, আমরা দু’জন অবশ্য এখনো বেঁচে আছি। আগে বা পরে মৃত্যু তো একদিন আসবেই।

সেই মৃত্যু প্রথমবার এসে যেন দেখতে পায়, আমাদের বন্ধুত্ব বেঁচে আছে সত্যের জন্য, মঙ্গলের জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। দ্বিতীয়বার এসে যেন দেখতে পায়, বন্ধু বেঁচে আছে তখনো বন্ধুর অন্তরে। *** ক্ষুধার কারণে নাশ্তাটা এমন আস্বাদন করছিলাম যে, শিকদার সাহেবের কথা মনেই পড়েনি। হঠাৎ দেখি, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। নাশ্তা শেষে কাছে গিয়ে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করলাম।

তিনি ‘ভালো আছি’র দিকে না গিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘আপনার কী মনে হয়, হাজী হয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবো?’ তারপর বললেন, ‘অবশ্য ফিরে যাওয়ার কী দরকার! হজ্বটা যদি কবুল হয়ে যায়, আর ডাক এসে যায় তাতে দুঃখ কিসের!’ তাই তো! দুঃখ কিসের!! মৃত্যু যখন কাছে এসে দাঁড়ায় তখন ভালো মানুষেরা হয়ত মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়ে যায়। মুখের কথাগুলো তখন যেন মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে! শিকদার সাহেবও হয়ত ঘনিয়ে আসা মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিলেন। আমার মন খুব কাতর হয়ে পড়লো তার কথা শুনে। কিছু সান্ত্বনার কথা বলতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু এটা আমার কখনো আসে না। হয় কিছু বলতে পারি না, না হয় যা বলি তাতে ব্যথা আরো উথলে ওঠে।

তাই আমি চেষ্টা করি, কিছু না বলে মাথায়, কাঁধে হাত বুলিয়ে বুকের ব্যথাগুলো শুষে নিতে। *** আজ যিলহজ্বের সাত তারিখ। সফরসঙ্গীরা সবাই সকালে তাওয়াফে কুদূম করে নিয়েছেন। আগামীকাল ভোরে মুআল্লিমের বাস মিসফালার চত্বর থেকে মিনার উদ্দেশ্যে আমাদের নিয়ে যাবে। আট তারিখের যোহর, আছর, মাগরিব এশা এবং নয় তারিখের ফজর মিনায় আদায় করা সুন্নত।

কিন্তু বহুকাল থেকেই মুআল্লিমদের প্রতি হাজী ছাহেবানের শেকায়েত যে, নিজেদের সুবিধার জন্য তারা সুন্নতের কোন পরোয়া করে না। মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরয়াবাদী ১৯২৯ সনে হজ্ব করেছেন। তখন ছিলো উটের শেষ এবং বাসের শুরুর যুগ। তিনি তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এভাবে, ‘হাযার হাযার মানুষ মিনায় রওয়ানা হয়েছে। সবার মুখে একই আওয়ায, লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক... আমাদের মুখেও তখন এ আওয়াযই ধ্বনিত হওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের মুখে ছিলো মুআল্লিমের নামে লা-হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা... আল্লাহ মুআল্লিম মিয়াঁর ভালো করুন, তার কৃপায় যোহর দূরে থাক, আছরও যায় যায় হলো।

তার শরীয়তে মিনায় অবস্থান করা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা বোধহয় অর্থহীন কাজ। তাই তো তিনি নিজে মক্কায় রয়ে গেছেন, আর আমাদের হেলা-ফেলা করে মিনায় রওয়ানা করিয়েছেন। তাকে নাগালে পেলে হয়ত যবানের গোনাহ আমাদের আরো বেশী করে পেয়ে বসতো। ... মধ্যরাতেই তাড়া দেয়া শুরু হলো শেষ রাতে রওয়ানা হওয়ার জন্য, কিন্তু আমরা অটল যে, সুন্নত সময়ের আগে কিছুতেই না। (মুআল্লিম) সিকিন্দার আব্দুল কাদির হলে হয়ত কথা বাড়তো, কিন্তু তার নিযুক্ত লোকদের মধ্যে কিছুটা হলেও ইনসানিয়াত ছিলো।

তারা পীড়াপীড়ি করলেও বাড়াবাড়ি করেনি। ’ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেকেই তাদের সফরনামায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, তবে আল্লাহর শোকর আমাদের অভিজ্ঞতা মধুর না হলেও এমন তিক্ত হয়নি। শুধু আরাফা থেকে ফেরার পথে বাসচালকের অজ্ঞতায় কিছু ভোগ, আর কিছু ভোগান্তি হয়েছে; অর্থাৎ ক্ষুধার্ত ভেবে কয়েকজন ভালো মানুষ আমাদের রুটি-কলা খাইয়েছেন, আর মুযদালিফায় পৌঁছতে রাত তিনটা বেজেছে। ফিরে আসি আগের কথায়। যোহরের জন্য হারামের উদ্দেশ্যে বের হলাম, তবে ভুল করে একটু দেরীতে।

প্রধান সড়কে এসে যাকে বলে একেবারে কিংকর্তব্য বিমূঢ়! জনসমুদ্র কথাটা তখন শাব্দিক অর্থেই যেন সত্য, তবে স্রোত নেই। কারণ সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আগে বাড়ার সুযোগ নেই, পিছিয়ে আসার উপায় নেই। পিপড়ের গতিতে একটু এগিয়ে আবার থেমে যায়। শেষে আশঙ্কা হলো, হয়ত রাস্তায়ও নামায পড়া সম্ভব হবে না।

তখন গায়ব থেকে মদদ হলো। অনেক কসরত করে কীভাবে যেন ফাঁক না থাকা ফাঁক দিয়ে কিছু দূর এগুলাম এবং হারামের চত্বরে দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলাম। না, পেয়ে গেলাম, কথাটা ঠিক নয়, দু‘পাশের কয়েকজন যথাসাধ্য নিজ নিজ শরীরের আয়তন কমিয়ে আমাকে কোনরকম দাঁড়াবার জায়গা করে দিলেন। নামাযের পর যথারীতি জানাযা। তারপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম একপাশে সরে।

ফিরতি স্রোত যখন কিছুটা শিথিল হলো তখন হারাম শরীফে প্রবেশ করলাম। যারা আল্লাহর ঘরে আসেন বারবার, এমনকি প্রতিবার তাদের কাছেও বাইতুল্লাহ যেন চিরনতুন! প্রতিবারই যেন তাদের প্রথমবার! সেই যে কবি বলেছেন-এ কোন শরাব পেয়ালায় ঢাললে তুমি সাকী!/যেন প্রথম পান, পয়লা নেশা, নতুন পিপাসা!/ তুমিও কি নতুন হে সাকী মদের জলসায়?/চুমুক দিলাম পেয়াস মেটাতে নয়, যেন আরো জাগাতে! আমার চোখের, আমার দিলের, আমার রূহের পেয়াস তো বহু দিনের, দীর্ঘ পাঁচ বছরের! তাই দৃষ্টিতে ছিলো ব্যাকুলতা, আবেগে ছিলো উচ্ছ্বাস এবং ...! আছর পর্যন্ত আল্লাহর ঘর শুধু অবলোকন করলাম, করেই গেলাম। মনে হলো আগে কখনো দেখিনি, এই প্রথম দেখা! প্রথম মিলন!! এই প্রথম পাওয়া! প্রথম নিবেদন!! এখন কত লক্ষ দৃষ্টি অবলোকন করছে বাইতুল্লাহর সৌন্দর্য! কত লক্ষ চোখের তারায় এখন প্রতিফলিত কা‘বাতুল্লাহর ছবি!! চোখের দৃষ্টি যেমন বিভিন্ন, ছবির প্রতিফলনও বিভিন্ন। কোন কোন দৃষ্টি এত স্বচ্ছ, শুভ্র ও পবিত্র যে, চোখের তারাকে অতিক্রম করে অন্তরের পর্দায় গিয়ে প্রতিফলিত হয় কা‘বার ছবি। আমার স্মৃতিতে আজো অম্লান পঁচিশ বছর আগের প্রথম সফরের সেই অপার্থিব দৃশ্য! ‘তিনি’ তাকিয়ে আছেন আল্লাহর ঘরের দিকে; তাকিয়ে আছে আমার গোনাহগার চোখদু’টিও।

ইচ্ছে জাগে, একবার অবলোকন করি তাঁর চোখের দৃষ্টি যাতে শিখতে পারি দৃষ্টিপাত ও ছায়াপাতের সৌন্দর্য রহস্য! এবং আমার মনে হয়, খুব সামান্য হলেও সেদিন শিখতে পেরেছিলাম পবিত্র মানুষের পবিত্র দৃষ্টি থেকে, কীভাবে হয় স্বচ্ছ-শুভ্র দৃষ্টিপাত এবং কীভাবে হয় চোখের তারায় কালো গিলাফের সজীব সৌন্দর্যের ছায়াপাত! সেই দৃষ্টিতে প্রেম ছিলো, ছিলো প্রেমের নিবেদন; আর ছিলো আত্মার আকুতি ও সমর্পণ! হয়ত আরো কিছু ছিলো, যা বুঝতে পারে শুধু সেই, যার আছে অন্তর্দৃষ্টি ও অন্তর্জ্ঞান। সেই প্রেম ও প্রেমনিবেদন, সেই আকুতি ও সমর্পণ হায় কিছুটা হলেও যদি পেতাম! কিন্তু চোখ যার ‘পাপদুষ্ট’, দৃষ্টি যার ‘কলঙ্ক-কলুষিত’ সে কোথায় পাবে সেই দৃষ্টিপাত এবং সেই ছায়াপাত! সুন্দর চোখের শুভ্র দৃষ্টির অধিকারী যারা তাদের পবিত্র সান্নিধ্যে বাইতুল্লাহর দিদার এবং কালো গিলাফের সৌন্দর্য অবলোকন, আমাদের মত দুর্ভাগাদের জন্য তো এটাই বড় সৌভাগ্য। এর মধ্যে যমযম পান করলাম কয়েকবার এবং আকণ্ঠ, যেভাবে পান করে বহুদিনের পিপাসার্ত। হারামের সর্বত্র যমযম-পানের ব্যবস্থা। এখানে সেখানে সর্বত্র যেন ‘শারাবানতাহূরার নহর’! তুমি শুধু ইচ্ছা করো এবং হাত বাড়াও, তোমার শুকনো ঠোঁট পেয়ে যাবে আবে যমযমের শীতলতা ও মিষ্টতা, নতুন স্বাদে, নতুন অনুভবে! আছরের পর মাতাফে নেমে এলাম, কিছুক্ষণ বসে থাকলাম, মেযবানের ঘরের আঙ্গিনায় বসে থাকার মত।

যেন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াবার আগে কিছু দ্বিধা, কিছু কুণ্ঠা; তারপর দয়া ও করুণার অবলম্বে এগিয়ে যাওয়ার একটু প্রস্তুতি। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর এগিয়ে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। দীনতা ও নিঃস্বতার শরম-সঙ্কোচ অতিক্রম করে অন্তরে আশা ও আশ্বাসের আশ্চর্য এক পুলক শিহরণ জাগে। উঠে দাঁড়ালাম। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম।

শুভ্র-শীতল প্রস্তরের উপর হজরে আসওয়াদের সমান্তরালে এই যে লাল-কালোর মাখামাখি সরল রেখা! তার উপর দাঁড়িয়ে হজরে আসওয়াদের অভিমুখি হলাম এবং হাতের তালু দিয়ে ইশারা করে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করলাম। এই তাওয়াফে সুখকর একটি ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। বাইতুল্লাহর ঠিক উপরে চৌথা আসমানে রয়েছে বাইতুল মা‘মূর। আল্লাহর হুকুমে সেখানে চলছে নূরের তৈরী মাসুম ফিরেশতাদের তাওয়াফ, আর এখানে যমীনে চলছে মাটির তৈরী ‘গোনার পুতলা’ ইনসানের তাওয়াফ। এখানে এসে ফিরেশতা-ইনসান যেন এক হয়ে যায়! মাটির মানুষ যেন নূরের ফিরেশতাদের কাতারে শামিল হয়ে যায়! তাওয়াফের মাধ্যমে মাওলা যেন তাঁর গোনাহগার বান্দাদের জন্য খোশকিসমতের দুয়ার খুলে দিয়েছেন, যাতে ফিরেশতাদের আমলের সঙ্গে সাদৃশ্য দ্বারা তাদের নূরানিয়াত হাছিল করা যায়।

তাওয়াফের এ তাৎপর্য আগে কখনো উদ্ভাসিত হয়নি। এ নতুন ভাবনা তাওয়াফের মধ্যে আমাকে নতুন স্বাদ ও তৃপ্তি এবং নতুন আনন্দ ও প্রশান্তি দান করলো। মনে হলো, জীবনে পাপের কদর্যতা ও ক্লেদাক্ততা যতই থাক, এই তাওয়াফ আমাকে সবকিছু থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য, এই তাওয়াফ আমার অতীতের সব অন্ধকার মুছে দেয়ার জন্য, এই তাওয়াফ আমাকে যুলমানিয়াত থেকে নূরানিয়াতে উত্তীর্ণ করার জন্য। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর! মাকামে ইবরাহীমের সামনে দাঁড়াবার, দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার এবং কিছু উপলব্ধি করার সুযোগ কল্পনাও করা যায় না, কিন্তু হঠাৎ একটি স্রোত যেন আমাকে কাঁচের বেষ্টনের কাছে নিয়ে গেলো। পাথরের উপর হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পাক কদমের চিহ্ন শুধু স্পষ্ট নয়, বরং আলোকিত এবং উজ্জ্বল! দু’চোখ ভরে দেখলাম সেই পাক কদমের নূর-নিশান! দেখলাম আর রোমাঞ্চিত হলাম।

পৃথিবীর কত মহাপ্রতাপান্বিত রাজা-বাদশাহের শুধু পদচিহ্ন নয়, অস্তিত্বই মুছে গেছে পৃথিবী থেকে, যেন কোনদিন তারা ছিলো না এখানে, এই পৃথিবীতে। কিন্তু আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম! তাঁর পবিত্র পদচিহ্ন এখনো পর্যন্ত অক্ষয় রয়েছে, মাকামে ইবরাহীম নামে, থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। ইবরাহীম আলাইহিস্সালামের পদচিহ্ন যারা অনুসরণ করবে তারাও হবে অক্ষয় সৌভাগ্যের অধিকারী। হঠাৎ মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দিলো, হযরত ইবরাহীম আ.-এর পাক কদমের চিহ্ন এই যে কাচের দেয়ালে আবদ্ধ করে রেখেছি, হয়ত হিফাযত ও সংরক্ষণের জন্য এর প্রয়োজন আছে, কিন্তু আমাদের জীবনের চলার পথে! সেখানে আছে তো এই পদচিহ্নের অনুসরণ?! এশা পর্যন্ত উম্মেহানীতে বসে তিলাওয়াত করলাম। চোখের সামনে আল্লাহর ঘর এবং আল্লাহর কালাম।

দৃষ্টি কখনো আল্লাহর কালামের দিকে, কখনো আল্লাহর ঘরের দিকে। আমার অন্তর তখন অনাস্বাদিতপূর্ব এক ভাবে ও অনুভবে উদ্বেলিত। এমন স্বাদ আগে কখনো না তিলাওয়াতে পেয়েছি, না বাইতুল্লাহর দীদারে। মেহমানকে মেযবান যেন নতুন স্বাদে আপ্যায়িত করছেন। হঠাৎ কানে এলো আমার পাশে বসা উর্দূভাষী এক হাজীর আকুতি, ‘আয় কাশ, ওয় আভী বোলা লেতা!’ (হায়, তিনি যদি এখনি ডেকে নিতেন।

) তার সঙ্গী হয়ত কথাটার মর্ম বুঝতে পারেননি। বললেন, ‘কী বলছো, তিনি ডেকেছেন বলেই তো আমরা আসতে পেরেছি!’ প্রথমজন একথার কোন উত্তর দিলেন না। তার তন্ময় দৃষ্টি তখন বাইতুল্লাহর দিকে। চোখ থেকে নেমে এসেছে অশ্রুর ধারা। হয়ত বাইতের দীদার তার অন্তরে সৃষ্টি করেছে রাববুল বাইতের দীদার লাভের অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা।

কিতাবে পড়েছি পূর্বযুগের বহু আশিকীনের এধরনের বিভিন্ন ঘটনা। বাইতুল্লাহর দীদারে ব্যাকুল বে-কারার হয়ে এক চিৎকার দিয়েছেন, আর বেহুশ হয়ে পড়ে গেছেন। তিনি পড়ে গেছেন, আর তার রূহ ‘পরওয়ায’ করে গেছে আসমানে আরশের মালিকের সান্নিধ্যে। কেউ বলেছেন, হে আল্লাহ, তোমার ঘরের দীদার লাভের পর যিন্দেগির আর কোন তামান্না আমার বাকি নেই, এখন আছে শুধু তোমার দীদার লাভের তামান্না। এই বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন হাতীমের ভিতরে, আর দেখা গেলো আল্লাহ তাঁর আশিক বান্দার আখেরি তামান্নাও পূর্ণ করে দিয়েছেন।

আমার পাশে আল্লাহর যে বান্দা বসে আছেন, মনে হলো তিনি পূর্বযুগের সেই আশিকীনেরই উত্তরসূরী। প্রত্যেক যুগেই তারা ছিলেন, এখনো আছেন। আগামী যুগেও তারা থাকবেন। আল্লাহর ঘরের সামনে তাদের কারো দেখা পাওয়া সৌভাগ্যেরই বিষয়। এশার পর আমীর ছাহেবের সঙ্গে ঘরে ফিরে এলাম।

কামরায় ভাই কামরুল ছিলো এবং আব্দুল বাকী ছিলেন। শিকদার সাহেব শুধু আফসোস করছেন নামায ও তাওয়াফের জন্য হারামে যেতে পারছেন না বলে, আর তারা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে শিকদার সাহেব উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, এই যে আমার ‘সান্ত্বনা’ এসে গেছেন! শুনতে ভালো লাগলো; কারণ তাতে রয়েছে মুহববতের ছোঁয়া। আমি বললাম, ভাই, আপনার ভাগ্য তো আমাদের চেয়ে ভালো। কারণ আমরা সবাই আপনার হয়ে হারামে নামায পড়ছি, তাওয়াফ করছি।

আপনি তো আমাদের সবার নামায-তাওয়াফের ভাগিদার। তিনি খুশী হলেন, জাযাকাল্লাহ বললেন। আগামীকাল সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে গাড়ী আসবে মিসফালার চত্বরে। মুআল্লিম- নম্বর ছিয়াশীসম্বলিত গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে মিনায় ৮৬ নম্বর তাঁবুতে। বস্ত্তত মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রার মধ্য দিয়েই শুরু হবে হজ্বের আমল।

যাত্রার শুধু আলোচনা থেকেই ভিতরে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভূত হলো। দীর্ঘ ঊনিশ বছরের প্রতীক্ষার পর আবার ডাক এসেছে পিতা-পুত্রের কোরবানির ময়দানে হাজির হওয়ার। মিনার কোরবানি ছিলো মা হাজেরারও, তবে পর্দার আড়ালে বলে কারো মনে থাকে না কথাটা। মেয়েদের, মায়েদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ চিরকাল পর্দার আড়ালেই থাকে, অথচ এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রতিটি সংসার, প্রতিটি পরিবার। কথা হলো, ফজরের পর কেউ তাওয়াফ করবো না, সোজা ঘরে চলে আসবো, যাতে একজনের বিলম্বের কারণে সবার কষ্ট না হয়।

তাছাড়া চালক একটু মেজাযী হলে একদু’জনের জন্য অপেক্ষা করে না, বাস ছেড়ে দেয়। তখন পেরেশানির শেষ থাকে না। আমি হারাম শরীফে রাত্রিযাপনের জন্য রওয়ানা হলাম। আমীর ছাহেব কানে কানে বললেন, শক্ত করে না বললে কেউ কেউ বিলম্ব করে বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়, তুমি চাইলে ফজরের পর তাওয়াফ করে আসতে পারো, তবে তাড়াতাড়ি। বুঝলাম, যারা পরিচালনা করে তাদের অনেক ‘সমঝদার’ হতে হয়।

আমি মৃদু হেসে জাযাকাল্লাহ বলে চলে এলাম। আরেকটি মধুর ও পবিত্র রাত্রি যাপিত হলো হারামের নূরানি পরিবেশে। ফজরের পর আমীর ছাহেবের ‘কানপড়া’ অনুসরণ করে তাওয়াফ শুরু করলাম, কিন্তু সময় লেগে গেলো বেশী। ফিরে এসে দেখি, আমি ছাড়া সবাই উপস্থিত। আমীর ছাহেবকে মনে হলো ভিতরে ভিতরে পেরেশান।

কেননা বুদ্ধিটা তো ছিলো তার। আমাকে দেখে চেহারা থেকে উৎকণ্ঠার ছায়াটা দূর হলো, তবে আস্তে করে বললেন, ‘না বাবা, সামনে আর কখনো গোপন বুদ্ধি দেবো না। আর একটু দেরী হলে তো সবার সামনে আমাকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। কেন! বিলম্ব করবো আমি, আসামী হবে তুমি, কেন?! তিনি বললেন, ঐ তো! এটাকেই তো বলে বন্ধুত্বের মাশুল! দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর এই মানুষটি আমার মনের ভিতরে বাস করে, আমি ঠিক ভিতরে না হলেও তার মনের দুয়ারেই থাকি। এরূপ অন্তরঙ্গ একজন বন্ধু দান করার জন্য আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

উত্তম বন্ধু সত্যি অতিবড় নেয়ামত। উত্তম বন্ধুকে হাদীছ শরীফে আতরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ সে তোমাকে আতরের মত সুবাস দান করে। আমার এ বন্ধু আমার জীবনে অনেক সুবাস এনেছেন। তারই উছিলায় জীবনে দ্বিতীয়বার আমি হিজাযের, হারামের এবং বাইতুল্লাহর সুবাস পেয়েছিলাম।

বন্ধুকে বন্ধু এর চেয়ে উত্তম সুবাস আর কী দিতে পারে?! আজ ঊনিশ বছর পর সেই প্রিয় বন্ধু আমার হজ্বের সফরের আমীর। মিছফালার কবুতর চত্বরে এসে দেখি .. দেখি আশ্চর্য এক দৃশ্য! খোলা মাথায় কালো চুল, আর গায়ে সাদা লেবাস, কালো-সাদার যেন এক সমুদ্র! দু’পাশে বাসের দীর্ঘ সারি। নড়া-চড়া নেই কথাটা এখানে খাটে না। কারণ প্রতিটি বাসে চড়া ছিলো, বাসের ভিতরে এবং ছাদে, কিন্তু নড়া ছিলো না। হাজী ছাহেবান যে যেভাবে পারছেন বাসের উপরে ভিতরে চড়ছেন, কিন্তু বাস নড়ছে না, মানে নড়তে পারছে না! আমাদের বলা হলো, ৮৬ নম্বর বাস মিসফালার শেষ মাথায় অবস্থান করছে, এখানে আসতেই দুপুর হয়ে যাবে।

আমরা যদি পায়ে হেঁটে ওখানে চলে যাই তাহলে মিনায় তাড়াতাড়ি পৌঁছা যাবে। বুদ্ধিটা পুরুষদের জন্য ছিলো সুখকর, আর মহিলাদের জন্য কষ্টকর, তবে এছাড়া কোন উপায় ছিলো না। তাই পায়ে হাঁটা শুরু হলো। শুধু আমরা নই, আমাদের সামনে এবং পিছনে আরো হাজারো মানুষ। হাঁটা চলছে, আর চলছে।

বাইরে মানুষের ঢেউ, ভিতরে অন্য কিছুর মউজ। বাইরে লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের সুমধুর ধ্বনি, ভিতরে আসমান থেকে নেমে আসা আশ্বাসের বাণী। ভিতরের প্রাপ্তি-পুলকের কাছে বাইরের কষ্টক্লেশ তুচ্ছই মনে হলো। এমনকি মহিলারাও জানালো, হাঁটতে তাদের কষ্ট হচ্ছে না। দেখো হে আল্লাহ! কষ্ট হলেও তোমার দুর্বল বান্দীরা বলছে কষ্ট না হওয়ার কথা! আসলে তারা তোমাকে সন্তুষ্ট করতে চায়।

অবশেষে ৮৬ নম্বর বাসের দেখা পাওয়া গেলো এবং তাতে চড়া হলো, কিন্তু বাসের নড়া আর হয় না। নড়লো অনেক পরে এবং পিঁপড়ার গতিতে; মাঝে মধ্যে কচ্ছপের গতিতে, কিন্তু খরগোশের গতিতে একবারও নয়। বাসের ভিতরে যাত্রীদের, বিশেষ করে আমার অবস্থা তখন গুরুতর। এসি চলে না, অথচ দরজা-জানালা বন্ধ! সে এক দমবন্ধ হওয়া অবস্থা! দরজা-জানালা খুলে দেয়ার জন্য অনেক চেঁচামেচি হলো, কিন্তু বাসের মিসরীয় চালক যেন অন্য কোন জগতে! গুনগুনিয়ে গাইছে, আর সামনের নিশ্চল বাসের দিকে তাকিয়ে আছে! আমার তখন মাথা ঘুরছে, আর গা গুলিয়ে আসছে; হয়ত এখনি ... একটু পরে বাস অবশ্য গতি লাভ করলো এবং খরগোশের চেয়েও দ্রুত। বাসের ছাদে দু’টি ঢাকনা মত ছিলো, যাত্রীরা বুদ্ধি করে তা খুলে দিলো।

ভিতরে বাতাস ঢুকলো, ফলে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলো। তবু আমি ঝিম মেরে বসে থাকলাম। জানালা দিয়ে যে বাইরে তাকাবো; পাহাড় দেখবো, মরুভূমি দেখবো, ভিতর থেকে তেমন কোন সাড়াই পেলাম না। ইবাদতের জন্য এবং ইবাদতকে অনুভব করার জন্য সুস্থতার প্রয়োজন। হজ্বের শুরুতেই সামান্য এই ‘তকলীফ’ দ্বারা আল্লাহ যেন বুঝিয়ে দিলেন, দেখো বান্দা, তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে কীভাবে আদায় করবে হজ্ব? এত কষ্ট করে, এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে একেবারে হজ্বের দুয়ারে এসেও তুমি মাহরূম হতে পারো যদি আমার সাহায্য ও মদদ তোমার সঙ্গে না থাকে।

সুতরাং আমার ইয়াদ থেকে কখনো গাফেল হয়ো না; বরং আমার তাওফীক ও মদদ চাইতে থাকো; আবদিয়াতের আজেযি ও দাসত্বের কাতরতা প্রকাশ করতে থাকো; তাহলে আমি সাহায্য করবো, আর তুমি লাভ করবে হজ্বে মাবরূর। তাঁবুর রাজ্য মিনা শুরু হলো। ‘তাঁবুর রাজ্য’ কথাটা শব্দে শব্দে বাস্তব। উঁচুতে, নীচুতে, যেদিকে তাকাও, সারি সারি তাঁবু আর তাঁবু! অপূর্ব! অপূর্ব! সমস্ত তাঁবুর একই রঙ, সাদা! যেন ইহরামের শুভ্র লেবাসের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেছে! আমাদের ৮৬ নম্বর মুআল্লিমের তাঁবু-ইউনিট যে কোন্ মুলুকে তা মনে হয় জানা নেই বাসের চালকের। এপথ থেকে সেপথ, সেপথ থেকে ওপথ শুধু চালিয়েই যাচ্ছে।

আবার একই পথে বারবার চক্কর দিচ্ছে। হজ্বের আগে যদি এদের কিছুটা প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, যাতে ঠিক জায়গাটি সহজে খুঁজে পায় তাহলে... হজ্বের সফরে কষ্ট তো হবেই; এটা তো কষ্টেরই সফর, জানের কষ্ট, মালের কষ্ট এবং অন্যান্য কষ্ট। সব কষ্ট হাসিমুখে বরণ করার জন্যই তো আল্লাহর আশিক বান্দারা এসেছে। যত কষ্ট তত আজর, তত মরতবা ও কবুলিয়াত। সুতরাং কষ্টের কোন পরোয়া নেই, তবে যে দেশ, যে হুকুমত হারামাইনের খিদমত এবং হজ্বের ইনতিযামে নিয়োজিত তাদের তো কর্তব্য হলো আল্লাহর মেহমানদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করা।

এক্ষেত্রে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন দক্ষতা ও বিচক্ষণতার। এটার কিন্তু যথেষ্ট অভাব রয়েছে সউদি রাজপুরুষদের মধ্যে। হজ্বের মৌসুম সামনে রেখে মিসর, ইয়ামেন, সুদান ও অন্যান্য দেশ থেকে বহু চালক আমদানি করা হয়, সাময়িক চুক্তির ভিত্তিতে। পথঘাট সম্পর্কে তারা এমনই বেখবর থাকে যে, অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত তাঁবুর পাশ দিয়ে চলে যায়, কিন্তু বলতে পারে না। এভাবে প্রতিবছর মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় হাজীদের হতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার।

অথচ খুব সহজেই এর নিরসন হতে পারে যদি চালকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং মিনা, আরাফা ও মুযদালিফার পথের মানচিত্র বুঝিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু কারো মাথায় বিষয়টি যেন ঢুকেই না। আল্লাহ মাফ করুন; ইশক ও মুহববত এবং ত্যাগ ও কোরবানির পবিত্র ভূমি মিনায় এসে এ আমি কিসের প্রলাপ জুড়ে দিলাম! এখন তো আমার কলবে থাকবে শুধু ইশক ও মুহববতের জোশ ও জোয়ার! এখন তো আমি ডুবে থাকবো শুধু ত্যাগ ও কোরবানির সেই পাক জযবায়, যা এই পবিত্র মিনা-ভূমি প্রত্যক্ষ করেছে আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে, যার অনুকরণ চলছে এখানে যুগে যুগে। আমি তাঁদের মত হতে না পারি, তাদের কথা ভাবতে তো পারি! তাদের পিছনে পিছনে চলতে তো পারি!! অনেক পথ ঘুরে অবশেষে বাস এসে থামলো সঠিক ঠিকানায়। বাসের যাত্রীদের একজন ৮৬ নম্বর দেখতে পেয়ে বলে উঠলো, এই তো! এই তো! ‘এই তো, এই তো’-এর মধ্যেও বাস চলে গেলো বেশ কিছু দূর। তারপর চালক বাস থামালেন এবং হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘খালাছ’! বাস থেকে সবাই তাঁবুতে এসে পৌঁছলো ‘আধমরা’ অবস্থায়।

আসলে আধমরাদের জন্যই যত দুর্গতি! এখানে যারা মরতে পারে পুরোপুরি এবং জবাই হতে পারে ইশক ও মুহববতের ছুরিতে তারাই হলো কামিয়াব! যোহর পড়া হলো, খাবারও কিছু জুটলো; কিন্তু জুটলো না বিশ্রাম। কারণ সেজন্য চিত হয়ে বা কাত হয়ে শোয়া দরকার! কিন্তু এখানে হলো ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ব্যবস্থা! সুতরাং যারা পরে এলো তারা কেউ শোয়ার জায়গা পেলো না। কেউ কেউ বসার জায়গা পেলো, অনেকে তাও পেলো না। আগে থেকে যারা ‘আরাম’ করে শুয়ে ছিলেন তারা নিজেদের একটু গুটিয়ে অন্যদের একটু জায়গা দিতে পারতেন, দিলেন না; আল্লাহর শোকর, তাতেও কোন বিবাদ হলো না। আছরের পর ইমাম ছাহেব বের হলেন পথের নিশানা চিনে রাখতে।

কারণ আগামীকাল ফজরের পর রওয়ানা হবো আরাফার উদ্দেশ্যে এবং সূর্যাস্তের পর ফিরে আসবো মুযদালিফায়। আগে বুঝতে পারিনি, এখন জানা গেলো, আমাদের তাঁবু পড়েছে মিনার বাইরে, মুযদালিফার অনেক ভিতরে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মিনায় কি বহুতল, অন্তত দ্বিতল তাঁবুর ব্যবস্থা করা যায় না?! এখন তো করার কিছু নেই! আল্লাহ অবশ্যই আমাদের মজবুরি কবুল করবেন এবং মিনায় অবস্থানের ফযীলত দান করবেন। ইমাম ছাহেবের সৌভাগ্য, তিনি প্রতিবছর আসেন, সবকিছু তার মোটামুটি চেনা।

কিন্তু সব চেনা এখানে বারবার অচেনা হয়ে যায়। একটু অসতর্ক হলেই পথ হারিয়ে যায়। তারপর সব তাঁবু সাদা! যেদিকে তাকাও মনে হবে, এটাই আমার ফেলে যাওয়া তাঁবু, কিন্তু ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখো, সব অচেনা মুখ। এরপর শুধু ঘুরে ঘুরে পেরেশান হওয়া। অবশ্য সবার হাতে বেঁধে দেয়া হয়েছে ফিতা এবং গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে মালা।

তাতে লেখা আছে মুআল্লিমের নাম ও তাঁবু-নম্বর, যাতে হারিয়ে যাওয়া হাজীকে পুলিশ ও সেচ্ছ্বাসেবক সাহায্য করতে পারে। ইমাম ছাহেবের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর গেলাম। এরপর আর তাঁবু নেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটি প্রশস্ত পথ চলে গেছে আরাফায়, যারা পায়দল যেতে চায় তাদের জন্য। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় একটি ভবন, যেন বাচ্চাদের খেলনাঘর! সেখানে বহু উঁচু একটি টাওয়ার।

তার মাথায় জ্বলছে লালবাতি। এটা কি বিপদসঙ্কেত! কিসের! লালবাতিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি হারিয়ে গেলাম দূর অতীতে। সেখানে তাঁবু ছিলো না, ‘খিমা’ ছিলো। পিচঢালা পথ ছিলো না, উটের খাড়া-ঢালু রাস্তা ছিলো। সেখানে কোলাহল ছিলো না, গভীর গম্ভীরতা ছিলো, শান্তি ছিলো, প্রশান্তি ছিলো।

সেখানে যারা ছিলো তাদের চেহারায় নূর ছিলো, আর চলাফেরায় ছিলো আশ্চর্য এক নূরানিয়াত! হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি আমার বর্তমানে ফিরে এলাম। ইমাম ছাহেব বললেন, ‘মাগরিব হয়ে আসছে, চলো তাঁবুতে ফিরে যাই। ’ তখন ঝিরঝির বাতাস বইছিলো। তাতে দেহ-মন জুড়িয়ে ফিরে এলাম তাঁবুতে। সন্ধ্যা হলো, রাত ভোর হলো।

সেই রাত ছিলো কুণ্ঠা ও উৎকণ্ঠার মাঝে অতিবাহিত অন্যরকম এক রাত। গোনাহগার বান্দার কুণ্ঠা ও উৎকণ্ঠা; রাত পোহাবে তো! ভোরের আলো দেখতে পাবো তো!! আরাফার পবিত্র ভূমিতে, জাবালে রহমতের পাদদেশে পৌঁছতে পারবো তো!! সন্ধ্যারাতে রাস্তার অন্যদিকে নাইজেরিয়ানদের তাঁবুতে এক হাজী ছাহেব ইনতিকাল করেছেন। নাইজেরীয় হজ্বমিশনের এ্যাম্বুলেন্স তার মৃতদেহ নিয়ে গেছে আমাদের সামনে দিয়ে। তিনিও আরাফার যাত্রী ছিলেন। আরাফায় অকূফের নিয়তে তিনিও ইহরামের লিবাস ধারণ করেছিলেন।

কিন্তু না, রাত ভোর হওয়ার আগেই তার ইহরামের লিবাস হয়ে গেলো কাফনের লিবাস। (চলবে ইনশাআল্লাহ) মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ এর বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১৯, আলকাউসার জানুয়ারি ২০১২ সংখ্যা থেকে http://www.alkawsar.com/article/526 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.