আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রকৃত আহলে সুন্নাত কারা?

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি। View this link মনসুরের সাথে মালিকের সাক্ষাৎকার উক্ত সাক্ষাৎকারকে মহান ঐতিহাসিক ইবনে কোতায়বাহ্ তার কিতাব ‘তারিখুল খোলাফা’-তে স্বয়ং মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন। সে জন্য আমরা পাঠক মন্ডলীর জন্য তার রচনারই অনুবাদ উপস্থাপন করছি। ইমাম মালিক বলেন, আমি মিনা থেকে ফেরৎ হয়ে তাবুগুলোর দিকে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি অনুমতি চাইলাম।

আমাকে অনুমতি দেয়া হল। অনুমতি দাতা আমাকে ভিতরে ডেকে পাঠালেন। আমি তাকে বললাম, “যখন সেই কুব্বাহ্ (গম্বুজ বা খিলান করা ছাদ) যেখানে আমীরুল মুমেনীন অবস্থান করছেন অল্প কিছু দূরে থাকে তখন আমাকে বলে দিও”। সে আমাকে এক তাবু থেকে আরেক তাবুতে এবং এক কুব্বাহ্ থেকে আরেক কুব্বাহ্তে নিয়ে গেল, যেখানে প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন ধরণের লোক হাতে নাংগা তরবারী নিয়ে বসা ছিল। দরবান আমাকে বললো, “ঐ যে কুব্বাহ্”, বলেই সে চলে গেল।

আমি নিজেই সেই কুব্বাহ্তে প্রবেশ করলাম যার মধ্যে আমীরুল মুমেনীন উপস্থিত ছিলেন। তিনি মজলিশ সমাপ্ত করে একা বসেছিলেন। তিনি এতো মোটা পোষাক পরে ছিলেন যার উদাহরণ মেলা ভার, আর এ সব কিছু আমার আগমনের খাতিরে ছিল। কুব্বাহ্তে কেবল একজন রক্ষি তরবারী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি নিকটবর্তী হলে তিনি স্বাগত জানালেন এবং নিজের কাছে ডেকে বললেন, “আমার কাছে আসুন”।

আমি তাকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলাম। কিন্তু তিনি আবারো নিজের কাছে আসতে অনুরোধ করলেন। এমন কি আমাকে তার এতো নিকটে বসালেন যে, আমার জানু তার জানুর সাথে মিশে গেল। অতঃপর তিনি কথা আরম্ভ করে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ! কসম সেই আল্লাহর যিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নাই। আমি না জাফর সোলায়মানকে কোড়া মারার নির্দেশ দিয়েছিলাম আর না আমার ঐ কথা জানা ছিল।

আর যখন আমি ঐ সংবাদ পেলাম তখন খুব মর্মাহত হলাম। মালিক বলেন, আমি আল্লাহর হাম্দ পাঠ করলাম এবং রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠালাম। তারপর তিনি নিজেকে এ ঘটনা থেকে মুক্ত ঘোষণা দিয়ে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ! যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি হারামাইনের মাঝে আছেন তারা (অর্থাৎ মক্কা ও মদীনাবাসীগণ) নিরাপদে আছে। আমি আপনাকে তাদের জন্য আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষাকারী জ্ঞান করি এবং আল্লাহ্ আপনার কারণে তাদেরকে এক বিরাট মুসিবাত থেকে সংরক্ষিত রেখেছেন। ফিতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমি তাদেরকে সবার চেয়ে অগ্রবর্তী এবং সেটিকে নিস্ক্রিয় করার বিষয়ে সবার চেয়ে দূর্বল জ্ঞান করি।

আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুক, এরা কোন দিকে স্খলিত হচ্ছে? আর আমি সেই শত্রুকে (জাফর বিন সোলায়মান বিন আব্বাস তার চাচাতো ভাই যে মদীনাতে তার গভর্নর ছিল) মদীনা থেকে উটের পিঠের উপর নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলাম এবং তার বসার জায়গাটিকে সংকুচিত করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম আর কঠোরতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছিলাম এবং তার চাইতেও অধিক শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম যা সে আপনাকে দিয়েছিল”। মালিক বলেন যে, আমি বললাম, “আল্লাহ আমীরুল মুমেনীনকে নিরাপদে রাখুক এবং মর্যাদা টিকিয়ে রাখুক, আমি তাকে (জাফর বিন সোলায়মানকে) রাসুল (সা.) এবং আপনার নৈকট্যের কারণে ক্ষমা করে দিলাম”। আবু জাফর মনসুর বললেন, “আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার আনুগত্যকারীগণকে ক্ষমা করুক”। মালিক বলেন, তারপর তিনি যখন আমার সাথে পূর্বপুরুষগণ ও ওলামাগণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন তখন আমি তাকে উক্ত বিষয়ে মহা জ্ঞানী রূপে পেলাম। অতঃপর তিনি যখন আমার সাথে ফিক্হ শাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করলেন তখন আমি তাকে ‘মুত্তাফিক আলাইহ্’ (ঐক্যমত) বিষয়াবলীতে সর্বোচ্চ জ্ঞানী মানুষ রূপে পেলাম এবং মতানৈক্য বিষয়াবলীতেও তাকে জ্ঞানী রূপে পেলাম আর দৃশ্যমান বিষয়বালীতে প্রখর স্মৃতি শক্তিধর ব্যক্তি এবং কথিত বিষয়াবলীতেও প্রখর শ্রবণ শক্তিধর ব্যক্তি রূপে পেলাম।

তারপর তিনি আমাকে বললেন: “হে আবু আব্দুল্লাহ! এই জ্ঞানকে সংগ্রহ কর এবং ইহাকে কিতাবের আকার দাও। আর আব্দুল্লাহ বিন উমরের কাঠিন্য, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস ও ইবনে মাসউদের নমনীয়তা ও সংবরণকে খারাব দৃষ্টিতে দেখবে এবং মধ্যপন্থা অবলম্ব করবে। আর সেই বিষয়কে গ্রহণ করবে যেটির উপর ইমামগণ এবং সাহাবাগণ ঐক্যমত আছেন, যাতে আমি মানুষকে আপনার জ্ঞান অনুসারে পরিচালিত করি এবং সকল শহরে আপনার কিতাবকে ছাপিয়ে প্রচার করি আর লোকজনকে বলে দেই যে, এই কিতাবের বিরোধিতা যেন না করে এবং এই কিতাব অনুসারেই যেন ফয়সালা করে”। আমি (মালিক) বললাম, “আল্লাহ আমীরের সংশোধন করুক। ইরাক, বাসীরা আমার জ্ঞানের প্রতি রাজী হবে না আর না আমার কথামত আমল করবে”।

আবু জাফর মনসুর বললেন, “আমি তাদেরকে ইহার উপর জোরপূর্বক চলতে বাধ্য করব এবং তাদের গর্দান উড়িয়ে দিব আর চাবুক দ্বারা তাদের কমর নীল করে দিব। এই কাজে তড়িঘড়ি কর। সত্বর আমার সন্তান আল-মাহদী তোমার নিকটে আসবে যাতে উক্ত কিতাবকে তোমার কাছে শোনে। নিশ্চিতরূপে আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত এই কাজ থেকে ফারেগ হয়ে যাবেন (অবকাশ পেয়ে যাবেন) ইনশা আল্লাহ”। মালিক বলেন, তখনও আমরা বসা অবস্থাতেই ছিলাম, কুব্বাহ্’র পেছন থেকে মনসুরের ছোট ছেলে প্রবেশ করল।

ছেলেটি আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেল এবং উল্টা পা ফেরত চলে গেল। আবু জাফর মনসুর বলল, “এসো, হে আমার প্রিয় এসো। ইনি হলেন হিজাজবাসীদের (মদীনাবাসীদের) ফকীহ্ আবু আব্দুল্লাহ”। তারপর আবু জাফর আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল: “হে আবু আব্দুল্লাহ! তুমি কি জানো, এই ছেলেটি কেন ঘাবড়ে গেল এবং কেন এলো না”? আমি বললাম, “আমার জানা নেই”। আবু জাফর মনসুর বলল, “আল্লাহর কসম সে আমাকে আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে দেখেছে বিধায় ফেরৎ চলে গেল এবং অন্তর্ভূক্তিকে সঠিক মনে করেনি”।

মালিক বলেন, তারপর মনসুর আমাকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের এক হাজার দীনার দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল আর পোষাক উপহার দিল এবং আমার পুত্রকেও এক হাজার দীনার দেয়ার নির্দেশ দিল। অতঃপর আমি অনুমতি চাইলাম, তিনি বিদায় জানালেন, আমিও খোদা হাফেজ বললাম, তিনিও বিদায় জানালেন। তারপর একজন হিজড়া আমার নিকট এলো আর একটি চাদর আমার ঘাড়ের উপর রেখে দিল। এমন ব্যবহার দরবারের এমন প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে করা হয়ে থাকে যাকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়। সে উক্ত চাদরটি নিয়ে মানুষের সম্মুখে আসে তারপর হিজড়াকে দেয়।

সুতরাং সে যখন উক্ত চাদর আমার ঘাড়ে রাখল তখন আমার ঘাড় উক্ত চাদরের ওজনে নত হয়ে গেল। আমি বললাম, “হে ভাই! আমার এতো শক্তি নাই”। আবু জাফর বলল, “ইহা মালিকের সোয়ারী (বাহন) পর্যন্ত পৌছে দাও”। [সূত্র: তারিখুল খোলাফা, খন্ড-৩, পৃ-১৫০] জরুরী হাশিয়া (নোট) ইমাম মালিক ও আবু জাফর মনসুরের উক্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের মাঝে হওয়া আলোচনা দ্বারা আমরা কিছু বিষয়াবলীর খোজ পাই। (১) আমরা দেখতে পাই যে, আব্বাসীয় খলিফা তার চাচাতো ভাইকে যে মদীনাতে তার পক্ষে গভর্নর ছিল, বরখাস্ত ও অপমানিত করে।

তার বিপরীত ইমাম মালিকের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় এবং কসম খেয়ে বলে যে, “যেমন কষ্টদায়ক ব্যবহার আপনার সাথে করা হয়েছে আমি তাতে শরীক নাই আর না আমি সে সম্পর্কে কিছু জানি। সে জন্য আমি যখন সংবাদ পেলাম তখন খুবই দুঃখ পেলাম”। এসমস্ত বিষয় উভয়ের মাঝে গভীর সম্পর্কের চিহ্ন বহন করে এবং আবু জাফর মনসুরের নিকট মালিকের যে কত সম্মান ও মর্যাদা ছিল তাই প্রকাশ করে। এমন কি খলিফা তার সাথে ব্যক্তিগত আর ঘরোয়া পোষাকে সাক্ষাৎ করেছিল এবং উক্ত সাক্ষাৎকারের সময় অন্য কেউ তাদের সঙ্গে থাকতে পারেনি। সাক্ষাৎকারের ধরণ দেখে খলিফার ছেলেটিও ঘাবড়ে গিয়েছিল।

সুতরাং সে যখন মালিককে নিজের পিতার পাশে ঘনিষ্টভাবে বসা দেখল তখন উল্টা পা ফেরৎ চলে গেল। (২) আর মনসুর যে মালিকের সাথে কথাটি বলেছিল যে, “মক্কা আর মদীনাবাসীরা ততক্ষণ পর্যন্ত সংরক্ষিতি আছে যতক্ষণ আপনি তাদের মাঝে আছেন এবং আল্লাহ তাদেরকে বিরাট মুসিবাত থেকে রক্ষা করেছেন”। এসমস্ত কথা-বার্তা দ্বারা বুঝা যায় যে, মক্কা ও মদীনাবাসীরা খলিফা এবং জালিম শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চেয়েছিল। কিন্তু মালিক তাদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শণ করেছিলেন এবং নিজের ফতোয়ার মাধ্যমে উক্ত আন্দোলনকে নিস্ক্রিয় করে দিয়েছিলেন। মালিকের উক্ত ফতোয়ার মধ্যে এ ফতোয়াটিও ছিল যে, “আল্লাহ ও রাসুল এবং উলিল আমরের আনুগত্য ওয়াজিব”।

বিধায় লোকেরা ক্ষান্ত হয়ে গেল আর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে খালিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। অর্থ দিয়ে ক্রয় করা ফতোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে মানুষকে রক্ষা করা হল। (বায়াতে ইকরাহ হারাম এবং বাদশাহ’র আনুগত্য ওয়াজিব -এ দুই ফতোয়ার মধ্যে কত পার্থক্য আছে। এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের কাছে অনেক রেওয়াত আছে। নমুনা স্বরূপ সেগুলির মধ্য থেকে একটি উপস্থাপন করছি: “বাদশাহ’র অবাধ্য হয়ে যে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহেলিয়াতে মৃত্যুবরণ করবে।

বাদশাহ’র কথা শ্রবণ কর আর সেই মতে আমল কর, হয় সে তোমার ধন-সম্পদ গ্রাস করে নিক না কেন এবং তোমার পিঠে চাবুক মারুক না কেন”। সে জন্যই মনসুর ইমাম মালিককে বলেছিল যে, “মক্কা ও মদীনাবাসী ফেতনা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় আছে আর ফেতনা দমনের ক্ষেত্রে খুবই দূর্বল। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুক, এরা কোন্ দিকে বিচ্যুত হচ্ছে”। (৩) খলিফা মালিককে এই কথা বিশ্বাস করায় যে, সমগ্র ইসলামী বিশ্বে আমার নিকট আপনি হলেন সব চাইতে বড় আলেম। আবার মালিকের মাযহাবের উপর মানুষকে জোরপূর্বক চলতে বাধ্য করে এবং প্ররোচণা ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মালিকের আনুগত্য করতে বাধ্য করে।

প্ররোচনার বিষয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে এই যে: “আমি সকল শহরে এই ঘোষণা করিয়ে দিব যে, কেউ যেন আপনার (মালেকী) কিতাবের বিরোধিতা না করে এবং সেটা দিয়েই ফয়সালা করে আর হজ্জের মওসুমে তার (মালিকের) নিকট প্রতিনিধি পাঠায়”। ভয়-ভীতি প্রদর্শণের বিষয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে এই যে: “ইরাকবাসীকে আমি এই কিতাবের উপর আমল করতে বাধ্য করব। তারা যদি সেটির উপর আমল না করে তাহলে আমি তরবারি দিয়ে তাদের ধড় ও মাথার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিব এবং চাবুকের মাধ্যমে তাদের পৃষ্ঠদেশ নীল করে দিব”। উক্ত বাক্যাবলী দ্বারা এই অনুমান করা যেতে পারে যে, জালিম শাসকরা আহলে বাইতের অনুসারীদের সাথে কেমন ব্যবহার করত। তাঁদেরকে আহলে বাইতের ইমামগণ থেকে পৃথক করে ইমাম মালিকের অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

(৪) আমরা জানি যে ইমাম মালিক ও খলিফা মনসুর এমন ধরণেরই আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করতেন। বিশেষ করে ঐ সকল সাহাবা ও তাদের খলিফাদের ক্ষেত্রে তাদের আকীদা এমনটিই ছিল যারা জোরপূর্বক খেলাফতের মসনদে আসীন হয়েছিলেন। এই কথাটি স্বয়ং মালিক প্রকাশ করেছেন: “অতঃপর তিনি (মনসুর) ফিক্হ শাস্ত্র সম্পর্কে কথা-বার্তা আরম্ভ করলে আমি তাকে মানুষের মধ্যে মহাজ্ঞানী পেলাম”। এতে কোন সন্দেহ নাই যে আবু জাফর মনসুর মত-বিনিময় করেছিল এবং সেই বিষয়াবলীই বিশ্বাস করিয়েছে যেগুলি তার পছন্দনীয় ছিল। কেননা, ইহার পূর্বে ইমাম মালিকের সাথে একটি সাক্ষাৎকারের সময় সে বলেছিল যে, “আল্লাহর কসম! *আমীরুল মুমেনীনের পরেই আমি আপনাকে জ্ঞানী রূপে পেয়েছি”।

[তারিখুল খোলাফা, -ইবনে কোতায়বা, খন্ড-২, পৃ-১৪২] (*আমীরুল মুমেনীন বলতে মনসুর নিজেকে বুঝিয়েছিল। ) উপরন্তু ইবনে মালিক হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সেই আব্দুল্লাহ বিন উমরের মত নাসেবী ব্যক্তির প্রতি আস্থা রাখত, যে এই কথা বলেছে যে, “আমরা রাসুল (সা.)-এর যুগে আবু বকর ও উমর এবং উসমানকে পর্যায়ক্রমে সকলের চাইতে উত্তম জ্ঞান করতাম এবং তাদের পরে তো সকলেই সমান ছিলেন”। ইবনে মালিকের ‘মোয়াত্তা’ আর ফিক্হ শাস্ত্রের ক্ষেত্রে ‘আব্দুল্লাহ বিন উমর’-ই হল সবচাইতে বিখ্যাত রাবী। (৫) আমরা ইহাই লক্ষ্য করি যে, যে রাজনীতির ভিত্তি জুলুম ও বল প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল ছিল উহার উদ্দেশ্যই ছিল যেন মানুষকে এমন সব ফতোয়া দ্বারা রাজি করিয়ে নেয়া হোক যেগুলিকে তারা প্রিয় গণ্য করতো আর তাদেরকে সেই সকল বিষয়ে কোন কষ্ট যেন না দেয়া হয় যেগুলি কোরআন ও সুন্নাতের নির্দেশে আবশ্যিক আছে। মনসুর মালিককে বলেছিল যে, “এই জ্ঞানকে কিতাবের রূপ দান কর।

আর আব্দুল্লাহ বিন উমরের কাঠিন্ন, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের নমনীয়তা এবং ইবনে মাসউদের সংক্ষিপ্তকরণকে দৃষ্টির মধ্যে রাখো এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন কর আর সেই বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ কর যেটির প্রতি সাহাবাদের ইজমা (ঐক্যমত) আছে। যাতে আমি আপনার কিতাব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে লোকজনকে পাবন্দ বানাতে পারি”। মনসুরের উক্ত বক্তব্য দ্বারা এই কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‘মাযহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ হল আব্দুল্লাহ বিন উমরের কাঠিন্ন, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের নমনীয়তা এবং ইবনে মাসউদের সংক্ষিপ্ত করণের সংমিশ্রিত একটি মাযহাব। যেটাকে মালিক মধ্যপন্থা মনে করেছেন, যার প্রতি সাহাবা অর্থাৎ হযরত আবু বকর, উমর ও উসমানের ইজমা ছিল এবং খলিফা মনসুরও সেটির প্রতি রাজি ছিল। মোয়াত্তা ইবনে মালিকে এমন কোন হাদীস নাই যা পবিত্র ইমামগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে।

অথচ কিছু ইমাম তো মালিক ও মনসুরের যুগেই ছিলেন। ইহার বিপরীত খলিফা আবু জাফর মনসুর তাঁদের জীবন-জীবিকাকে সংকুচিত করে রেখেছিল এবং তাঁদেরকে সকল বিষয় থেকেই পৃথক করে রেখেছিল। সবার প্রথম মোয়াত্তা ইবনে মালিকে সাহাবা এবং তাবেয়ীনগণের বয়ানকৃত হাদীসসমূহ জমা করার হুকুম খলিফা দিয়েছিল যাতে সেগুলির উপর মানুষকে চলতে বাধ্য করা যায়। সুতরাং নির্দিষ্টভাবে উক্ত হাদীসগুলো উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের কর্তৃক রচিত হওয়া চাই, যা তাদের মুসলেহাত অনুসারে এবং তাদের সরকারকে শক্তিশালী করার কারণ হয়। আর সেই সকল ইসলামী বাস্তবতা থেকে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণ হয় যেগুলি সম্পর্কে নবী (সা.) অবগত করিয়েছিলেন।

(৭) ইমাম মালিক কেবল ইরাকবাসীর ব্যাপারেই ভীত ছিলেন। কেননা তারা ছিল আলী ইবনে আবি তালিবের অনুসারী এবং তাঁরই জ্ঞান ও ফিক্হ’র প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁর সন্তানগণেরই মধ্যেকার পবিত্র ইমামগণের তাকলীদ করতেন আর মালিকের মত লোকজনকে মোটেই গুরুত্ব দিতেন না। কেননা তারা জানতেন যে, এরা সকলেই ‘নাসেবী’ আর শাসকদের চাটুকারিতা করে থাকে এবং দেরহাম ও দীনারের বিনিময়ে নিজিদের দ্বীনকে বিক্রয় করে ফেলেছে। সে জন্যই তো মালিক খলিফাকে বলেছিল: “আল্লাহ যেন আমীরের সংশোধন করুক! ইরাকবাসীরা আমার জ্ঞানের প্রতি রাজি হবে না আর না আমার কথার উপর আমল করবে”। সুতরাং মনসুর খুবই অহংকার ও গর্বসহকারে বলেছিল, “আমি বলপূর্বক তোমার কথা মানতে বাধ্য করব এবং তরবারী দ্বারা তাদের দেহ ও মাথার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবো আর চাবুক দ্বারা তাদের কোমর সোজা করে ফেলব”।

এর দ্বারা আমাদের কাছে এই কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শাসকগণের আবিস্কৃত মাযহাবসমূহ যেগুলিকে ‘আহলে সুন্নাত’ নাম দেয়া হয়েছে, সেগুলি কিভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। আর তাজ্জবের কথা তো এই যে, আবু হানিফা মালিকের বিরোধিতা করতেন এবং মালিক তার বিরুদ্ধে ছিলেন, আবার উভয়েই শাফেয়ী ও হাম্বলীর শত্রু ছিলেন এবং এরা উভয়েই তাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। সম্ভবতঃ এমন কোন মাসয়ালা হবে না যে উক্ত চারজনই সেটির প্রতি ঐক্যমত আছেন। তা সত্বেও এরা সকলেই হলেন ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ -এ আবার কোন জামায়াত?! মালেকী অথবা হানাফি অথবা শাফেয়ী অথবা হাম্বলী? না এটা না ওটা, বরং ইহা হলো মোয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ানের জামায়াত, আর এই লোকগুলি হলো সেই সকল ব্যক্তিত্ব যারা হযরত আলীর প্রতি লা’নত করায় মোয়াবিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে এবং ৮০ বছর পর্যন্ত লানত করতে থাকে। কোন একটি বিষয়ে মহা বিরোধ, মত-পার্থক্য এবং বিভিন্ন ফতোয়া থাকা সত্বেও এই বিরোধটি হল রহমত স্বরূপ।

কিন্তু ইহা কেবল উক্ত চার মাযহাবের ক্ষেত্রেই রহমত আছে। তবে হ্যাঁ কোন অন্য মুজতাহিদ যদি তাদের বিরোধিতা করে তাহলে সে তাদের দৃষ্টিতে কাফির হয়ে যায় এবং ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আহলে বাইতের অনুসারীদের ওজর যথেষ্ট নয় কেননা তারা আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীর উপরে কাউকেই প্রাধান্য দেন না, আর এই বিরোধকেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত সহ্য করতে পারেন না। অথচ চারটি মাযহাবই হযরত আলীকে খেলাফত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং তাঁর ফজীলাতসমূহকে লুকিয়ে রাখার বিষয়ে ঐক্যমত আছে। ৮) যে শাসকরা বলপূর্বক মুসলমানদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, আমরা তাদেরকে দেখতে পাই যে তারা চাটুকার ওলামাদের মাঝে মনখুলে দান খয়রাত করতো, আর এভাবেই তারা তাদের দ্বীন ও বিবেককে খরিদ করে নেয়।

মালিক বলেন: “অতঃপর আমাকে এক হাজার স্বর্ণ ও রৌপ্যের দীনার দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং আমার পুত্রকেও এক হাজার দীনার দেয়ার হুকুম দিলেন”। মালিক একথা স্বীকার করেন যে, উপহারাদি কখনো কখনো উহার চেয়েও অধিক হতো, কিন্তু সেগুলি বয়ান করা হয়নি। কেননা মালিক এ কথাকে ভাল করেই জানতন যে, সমস্ত উপহারকে প্রকাশ করে দিলে ক্ষতি হবে। সেজন্য তিনি চেয়েছিলেন যেন লোকেরা উক্ত উপহারগুলোকে দেখতে না পায়। যেমনটি তিনি বলেন যে, “হিজড়াটা যখন উক্ত দীনার ভরা বোচকা আমার ঘাড়ে রাখলো তখন উহার ভারে আমি নত হয়ে গেলাম এবং বললাম যে, এটিকে নামিয়ে দাও।

মনসুর যখন অনুভব করলো যে আমি ইহা বহন করতে পারব না তখন সে হিজড়াকে নির্দেশ দিল যেন লোকজনার দৃষ্টি আড়াল করে সেটিকে আমার বাহন পর্যন্ত পৌছে দেয়”। আব্বাসীয় খলিফা নিজের যুগের ওলামাদের পরীক্ষা নিয়েছিল আব্বুসীয় খলিফা আবু জাফর মনসুর খুবই চালাক-চতুর ছিল। সে মানুষের বিবেক-বুদ্ধির উপর আধিপত্য স্থাপন করা এবং তাদের বিবেক ক্রয় করার কৌশল জানতো। সে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর নিজের রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য লোভ প্রদর্শন ও আতংকবাদকে ব্যবহার করতো। আবু জাফর বলেন: “আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আপনাকে আমি সেই ঘরে বসা দেখতে পেলাম তখন আপনি আল্লাহর ঘরের নির্মাতা হয়ে গেলেন এবং আমি লোকজনকে আপনার জ্ঞান মত পরিচালনা করছি আর অন্যান্য শহরবাসীদের পক্ষ থেকে আপনার নিকট দূত পাঠানোর হুকুম দিচ্ছি এবং হজ্জের মৌসুমে আমি আপনার কাছে আমার প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য বলছি যাতে তারা আপনার দ্বীনি বিষয়াবলীকে সরল পথে নিয়ে আসে।

এতে কোন সন্দেহ নাই যে, মদীনাবাসীদের জ্ঞানই হল আসল জ্ঞান। কিন্তু আপনি হলেন তাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ আলেম। [তারিখুল খোলাফা, -ইবনে কোতায়বা, খন্ড-২, পৃ-১৪৩] ইবনে কোতায়বাহ্ বলেন যে, আবু জাফর মনসুর যখন খেলাফতের মসনদে আসীন হল তখন সে মালিক ইবনে আনাস, ইবনে আবি যোওয়ায়ব আর ইবনে সাময়ানকে একই সময়ে ডেকে জিজ্ঞাসা করল যে, “তোমাদের কাছে আমি কেমন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে গণ্য হই? ন্যায় বিচারক ইমামগণের মধ্যে না অত্যাচারী ইমামগণের মধ্যে? মালিক বললেন: “হে আমীরুল মুমেনীন! আমি আল্লাহর কাছে তোমার উসিলা দিয়ে থাকি এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তোমার নৈকট্যের দৃষ্টিকোণ থেকে শাফায়াতের প্রত্যাশী। এ বিষয়ে আরো কিছু বলার ক্ষেত্রে আমাকে ক্ষমা করুন”। মনসুর বলল: “আমীরুল মুমেনীন তোমাকে ক্ষমা করলেন”।

ইবনে সাময়ান বললেন, “হে আমীরুল মুমেনীন! আপনি হলেন সব চাইতে ভাল। আল্লাহর ঘরের হজ্জ সম্পন্ন করে থাকেন, শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করেন, পথ-ঘাটকে মজবুত করেন। আপনার কারণে শক্তিশালী দূর্বলকে হজম করতে পারে না। আপনার মাধ্যমেই দ্বীন টিকে আছে। অতএব, মানুষের মধ্যে আপনি হলেন সব চেয়ে উপযুক্ত আর ন্যায় বিচারক ইমাম”।

কিন্তু আবি যোওয়ায়ব বললেন: “আল্লাহর কসম! আমার কাছে তুমি হলে সবচাইতে বেশি অনিষ্টকারী। আল্লাহ, রাসুল, যুল কোরবা, মিসকীন ও ইয়াতীমগণের মাল খাচ্ছ। দূর্বলদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছ এবং শক্তিশালীদের বিরক্ত করে রেখেছ। তাদের ধন-সম্পদকে আত্মসাৎ করেছ। অতএব, আল্লাহর সম্মুখে কি জবাব দিবে”? আবু জাফর বলল, “আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুক, এসব তুমি কি বলছ? বুঝে-শুনে বলছ তো? নিজের সম্মুখে দেখ! কি আছে? ইবনে যোওয়ায়ব বললেন: “জ্বী হ্যাঁ, আমি আমার সম্মুখে তরবারী সমূহ দেখতে পাচ্ছি, যা সাক্ষাৎ মৃত্যু।

আর মৃত্যু থেকে কারোর রক্ষা নেই। সুতরাং দেরীর চাইতে দ্রুত মরাটাই ভাল”। উক্ত আলোচনার পর মনসুর, ইবনে আবি যোওয়ায়ব ও ইবনে সাময়ানকে বিদায় করে দিল এবং মালিককে একান্তে আলাপকালে বলল, “হে আবু আব্দুল্লাহ! আপনি শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের শহরে ফেরৎ চলে যান, আর যদি চান তো আমার কাছেই থাকুন। আমি কাউকেই আপনার উপরে প্রাধান্য দিব না আর না সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে আপনার উপর আমীর বলে জ্ঞান করব”। ইহার পর ইবনে কোতায়বাহ্ লিখেছেন যে, পরের দিন আবু জাফর মনসুর প্রত্যেকের কাছে (ইমাম মালিক, ইবনে যোওয়ায়ব ও সাময়ান) নিজের পুলিশ অফিসারের হাতে পাঁচ হাজার করে দীনারের থলি পাঠিয়ে তাকে বলে দিল, “প্রত্যেককে একটি করে থলে দিও, যদি মালিক গ্রহণ করেন তাহলে সেটি হবে তার অধিকার, যদি ফেরৎ করে দেন তাহলে তার কোন অপরাধ নেই।

কিন্তু আবি যোওয়ায়ব যদি গ্রহণ করে তাহলে তার মাথা কর্তন করে আমার কাছে নিয়ে এসো। আর যদি নিতে অস্বীকার করে তাহলে ইহাই হবে তার নীতি এবং কোন অপরাধ নেই। আর যদি সাময়ান ফেরৎ করে দেয় তাহলে তার মাথা কর্তন করে নিয়ে আসবে, আর যদি গ্রহণ করে নেয় তাহলে তাতেই তার রক্ষা আছে”। মালিক বলেন, “পুলিশ অফিসারটি প্রত্যেকের কাছে পৌঁছাল। ইবনে সাময়ান থলে গ্রহণ করে নিল বিধায় রক্ষা পেল।

কিন্তু আবি যোওয়ায়ব ফেরৎ করে দিল এবং সেও রক্ষা পেয়ে গেল। থাকল আমার ব্যাপার, তো আল্লাহর কসম! আমি উহার মুখাপেক্ষী ছিলাম সেজন্যই গ্রহণ করে নিলাম”। [তারিখুল খোলাফা, -ইবনে কোতায়বাহ্, খন্ড-৩, পৃ-১৪৪] উক্ত ঘটনা দ্বারা এই কথা স্পষ্ট হয় যায় যে ইমাম মালিক খলিফার জুলুম ও অত্যাচারের কথা জানতেন। কিন্তু নিজের ও খলিফার সম্পর্কের ভিত্তিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম উচ্চারণ করেন এবং তাঁর সাথে মনসুরের নৈকট্যের আলোচনা করেন। ইহা তো স্পষ্ট যে, আব্বাসীয় শাসকরা এ বিষয়টি খুবই পছন্দ করত এবং তারা এই কথাকে খুবই গুরুত্ব দিত যে, মানুষ তাদের সম্মান করুক, সে জন্যই তাকে অধিক কথা-বার্তা বলার কষ্ট দেন নি।

ইবনে সাময়ানও সেই পথ অবলম্বন করল যেখানে মৃত্যুর ভয় ছিল না, কেননা তরবারীসমূহ কোষ মুক্ত ছিল আর খলিফার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ইবনে আবি যোওয়ায়ব বীর ছিলেন। আল্লাহর বিষয়ে তিনি কারোর নিন্দাকে পরওয়া করতেন না। তিনি ছিলেন মুখলেছ মুমিন, একমাত্র আল্লাহ ও রাসুল এবং মুমিনদের জন্য উৎসর্গ ছিলেন। সেজন্যেই তিনি বাস্তবতাকে বয়ান করে দিলেন এবং তার প্রলোভন ও উপঢৌকনকে প্রত্যাখ্যান করলেন।

আর যখন মনসুর হত্যার ভয় প্রদর্শন করল তখন তিনি সেটিকে ললাট ভাজ না করেই কবুল করে নিলেন। কিন্তু তাকে ভয় পেলেন না। আমরা খলিফাকে দুজন লোকের পরীক্ষা নিতে এবং মালিককে উক্ত পরীক্ষা থেকে মুক্ত দেখতে পাই। সুতরাং ইমাম মালিককে সেটি থেকে দূরে রাখা হল, তিনি যদি মাল কবুল করে নেন তখনও আর যদি ফেরৎ করে দেন তখনও তিনি সংরক্ষিত থাকবেন। কিন্তু ইবনে যোওয়ায়ব যদি মাল গ্রহণ করে নিতেন তাহলে তার মাথা ছিন্ন করা হতো আর ইবনে সাময়ান যদি ফেরৎ করে দিতেন তাহলে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হতো।

আবু জাফর মনসুর খুবই প্রতারক ছিল। সেজন্যই সে মালিকের সম্মান বৃদ্ধি করল। তার মাযহাব কবুল করাকে ওয়াজিব ঘোষণা দিল যা ইবনে যোওয়ায়বের বিরুদ্ধে চলে গেল যিনি ইমাম মালিকের তুলনায় অধিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যেমন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ইহা স্বীকার করেছেন। অনুরূপভাবে লায়স বিন সা’দ-এর মাযহাবকে দাবিয়ে দেয়া হল।

অথচ শাফেয়ীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি আহমদ বিন হাম্বলের চেয়ও বড় ফকীহ্ ছিলেন। বাস্তবতা তো ইহাই যে উক্ত যুগে নবী বংশের ৬ষ্ট পুরুষ ইমাম জাফর সাদিক ইলম ও ফিক্হ শাস্ত্রে সর্বোত্তম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং সকলেই এই কথা স্বীকারও করতেন। এমতাবস্থায় উম্মতের মাঝে কার সাহস হতে পারে যে সে ইলম ও আমলে ইমাম জাফর সাদিকের মোকাবেলা করবে। অথচ তাঁর দাদা হলেন আলী ইবনে আবি তালিব, যিনি রাসুল (সা.)-এর পরেই সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম ও ফকীহ্ ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির দাবী হলো, উহা একটি দলের উত্থান ঘটায় আর অন্য দলকে দাবিয়ে রাখে।

অনুরূপভাবে ধন-সম্পদ একজনকে উপরে তোলে আর একজনকে নীচে নামিয়ে আনে। এই আলোচনাতে আমি যে বিষয়টি স্পষ্ট মাধ্যম আর পোক্ত দলিলের মাধ্যমে প্রমান করতে চাই তা হলো এই যে “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত”-এর চার মাযহাবই হচ্ছে রাজনৈতিক কলা-কৌশলের ফলাফল। যা লোভ ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আর মানুষ তো নিজেদের বাদশাহ’র দ্বীনেরই আনুগত্য করে থাকে। এ বিষয় সংক্রান্তে যে সকল ব্যক্তিবর্গ অনুসন্ধান করতে ইচ্ছুক তারা যেন শেখ আসাদ হায়দার রহমাতুল্লাহি আলাইহের “আল-ইমাম আস-সাদিক ওয়াল মাযাহিবুল আরবায়া” কিতাবটি অধ্যয়ন করবেন। এর দ্বারা জানা যাবে যে বাদশাহ’র নিকট ইমাম মালিকের কেমন সম্মান ও মর্যাদা ছিল।

এমনকি ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক পর্যন্ত পৌছানোর জন্য মদীনার গভর্নরের উসিলা ধরেছিলেন। আর শাফেয়ীকে গভর্নর বলেছিল যে, “মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে সফরকারী ব্যক্তি আমার নিকট সেই মানুষ থেকে উত্তম যে মানুষ মালিকের দরজার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। কেননা আমি মালিকের দরজার উপর দাঁড়িয়ে থাকাকে সবচেয়ে বড় অপমান মনে করি”। “যোহরুল ইসলাম” নামক বইতে আহমদ আমীন মিসরী লিখেছেন যে: “মাযহাবে আহলে সুন্নাতের উন্নতি ও বিজয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর বিরাট ভূমিকা ছিল। আর যখন হুকুমাত মজবুত ও শক্তিশালী হয় এবং উহা যখন কোন মাযহাবের সাহায্য করে তখন মানুষ সেটারই তাকলীদ করে।

অতঃপর একটির পর আরেকটি হুকুমাত উক্ত মাযহাবগুলোর সহায়ক হয়ে আসছে”। আমি বলতে চাই যে, মাযহাবে ইমাম জাফর সাদিক হচ্ছে ‘মাযহাব-এ-আহলে বাইত’। মুসলমানদের স্বভাব অনুপাতে আমি ইহাকে মাযহাব বলছি। অন্যথায় বাস্তবে ইহাই হচ্ছে সঠিক ইসলাম যা রাসুল (সা.) নিয়ে এসেছিলেন, যেটিকে না কোন শাসক সাহায্য করেছে আর না কোন শাসক গ্রহণ করেছে। বরং সকল শাসক উহাকে নাস্তা-নাবুদ করার চেষ্টা করেছে এবং বিভিন্ন পন্থায় মানুষকে উহার প্রতি ঘৃনা সৃষ্টি করানোর কাজে ব্যতি-ব্যস্ত ছিল।

অতঃপর সেই জমাট অন্ধকার ছিটকে পড়ল আর আল্লাহর মেহেরবানীতে প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক জালিম শতাব্দীতে উহার আনুগত্যকারী লোকেরা উপস্থিত ছিল। কেননা ‘আল্লাহর নূরকে ফুৎকার দিয়ে নিভানো যাবে না’ আর না তরবারি দিয়ে উহাকে নিঃশ্চিহ্ন করা যাবে। অনুরূপভাবে মিথ্যা প্রপাগান্ডা (গুজব) দ্বারাও উহার কোন ক্ষতি সাধন করা সম্ভবপর নয় যে, যার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় অথবা তারা এই কথা বলতে লাগে যে আমরা উহা থেকে বেখবর ছিলাম। নিশ্চয়ই কোরায়েশরা নবুয়াত ঘোষণার প্রারম্ভেই মুহাম্মদ (সা.)-এর কাহিনী সমাপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে ছিল। আর যখন কোরায়েশরা আল্লাহর মেহেরবানী আর আবু তালিব ও হযরত আলীর সহযোগিতার কারণে নিজেদের উদ্দেশ্যে সফলকাম হতে পারেনি তখন মুহাম্মদ (সা.)-কে তারা ‘আব্তার’ বলে নিজেদের মনকে শান্তনা দিতে থাকে।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.)-কে ‘কাউসার’ দান করলেন আর মুহাম্মদ (সা.) ‘হাসনায়েন’-এর নানা হয়ে গেলেন এবং লোকজনকে বাশারাত/সুসংবাদ দিলেন যে হাসান ও হুসাইন উভয়ই হলেন ইমাম, হয় তারা সন্ধি স্থাপন করেন অথবা যুদ্ধ করেন। তারপর সকল ইমামই হুসাইনের নসল্ থেকে হবেন। এ সকল কথা-বার্তা কোরায়েশদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। কোরায়েশরা ইহা কখনোই সহ্য করতে পারতো না। বিধায় নবী (সা.)-এর পরে তারা সুযোগ পেয়ে গেল এবং পবিত্র বংশধরদের শেষ করে ফেলার জন্য অক্লান্ত চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

এমনকি হযরত মা ফাতেমার গৃহে আগুন ও কাঠ নিয়ে জড় হল। হযরত আলী যদি নিরবতা অবলম্বন না করতেন আর খেলাফতের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে না নিতেন এবং সন্ধি ও ধৈর্যের আশ্রয় না নিতেন তাহলে তখনই পবিত্র বংশধরগণের ইতি ঘটে যেত আর সে দিনই ইসলামের কাম তামাম হয়ে যেত। অতঃপর কোরায়েশরা হুকুমাত কেড়ে নেয়ার পর ততক্ষণ পর্যন্ত নিরব ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.)-এর নস্লের কোন ব্যক্তি তাদের ফায়দার পথে চ্যালেঞ্জ হয়ে না দাঁড়িয়েছে। আর যেই না খেলাফত হযরত আলীর করায়ত্বে এলো ওমনি কোরায়েশরা ফেৎনা ফ্যাসাদের আগুন ছড়িয়ে দিল, আর ততক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হল না যতক্ষণ না খেলাফতকে সব চাইতে খবীসতম মানুষের হাতে সোপর্দ করে দেয়নি। সুতরাং আবারো খেলাফত, বাদশাহী ও রাজতন্ত্রে পরিনত হলো, যা পিতা থেকে পুত্রের কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে থাকে।

আবার ইমাম হুসাইন যখন ইয়াজীদের বায়াত করতে অস্বীকৃতি জানালেন তখন কোরায়শদের অহংকারের আগুন ভড়কে উঠলো এবং তারা পবিত্র বংশধরদের কাহিনীই সমাপ্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বরং সেই সমস্ত প্রত্যেক জিনিষকে নাস্তা-নাবুদ করে দেয়ার ইরাদা করল যেগুলির উপর মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহর (সা.) বংশধরগণের চিহ্ন নির্ভর করছিল। অতঃএব কারবালার হত্যাযজ্ঞের স্থানে তারা নবী (সা.)-এর বংশধরগণকে জবাই করে ফেলল। এমন কি অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং দুগ্ধপানকারী শিশুকেও শহীদ করে ফেলল। তাদের ইচ্ছা ছিল যেন নবুয়াতের প্রত্যেকটি শাখাকে কর্তন করে ফেলে।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন সেটিকে পূরণ করলেন এবং আলী ইবনে আবিল হুসাইনকে (জয়নুল আবেদীকে) বাঁচিয়ে নিলেন এবং পরবর্তী ইমামগণ তাঁরই নসল্ থেকে এসেছেন আর জমীনকে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আওলাদ দিয়ে ভরে দিলেন। ইহাই হল সেই ‘কাউসার’ যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী (সা.)-কে দান করেছিলেন। এখন প্রত্যেক শহর ও গ্রাম এবং জমীনের প্রতিটি খন্ডে রাসুল (সা.)-এর নসল্ উপস্থিত আছে আর মানুষের মাঝে তারা প্রিয় ও সম্মানিত হয়ে আছেন। শত্রুদের সকল বিফল প্রচেষ্টার পরও আজ সমগ্র পৃথিবীতে আহলে বাইতের অনুসারীদেও সংখ্যা ২৫০ মিলিওন আর সকলেই ‘ইসনা আশারী’ ইমামগণের তাকলীদ করে থাকেন এবং তাঁদেরই মোয়াদ্দাত ও মুহাব্বতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকেন এবং তাঁদের নানাজানের শাফায়াত প্রত্যাশা করেন। অন্যান্য মাযহাবগুলোর মধ্যে কোন একটি মাযহাবও এতো অধিক সংখ্যায় কখনোই আপনার দৃষ্টি গোচর হবে না।

যদিও প্রত্যেকটি মাযহাবকে প্রত্যেক সময়ের শাসকরা সাহায্য করেছে। তারা প্রতারণা করে থাকে। “আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম”। [সূরা আনফাল, আয়াত-৩০] ফেরআউন সে সময় কি সকল নবযাত শিশুকে হত্যা করার নির্দেশ দেইনি যখন তার জ্যোতির্বিদরা তাকে বলেছিল যে, বনী ইসরাইলের মাঝে একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করবে যে তোমার রাজত্বকে ধ্বংস করে ফেলবে? কিন্তু উত্তম অভিসন্ধিকারী আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)-কে ফিরআউনের অভিসন্ধি থেকে রক্ষা করে তার ঘরেই পাঠিয়ে দিলেন আর স্বয়ং ফিরআউনের কোলেই তার লালন-পালন করালেন এবং তাঁর মাধ্যমেই তার রাজত্বকে ধ্বংস করালেন এবং ফিরআউনের দলবলকে হালাক করে দিলেন।

আর আল্লাহর হুকুম অবশ্যই পূর্ণ হয়ে থাকে। (যুগের ফিরআউন) মোয়াবিয়া কি হযরত আলী।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।