আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি কি বিজয় দেখেছি...??

গেদু চাচার খোলা চিঠি। রাতে ঘুমাতে দেরি হবার ফল...সারারাতের পরিকল্পনা ভন্ডুল হবার পথে অর্থাৎ আমি দেরি করে ফেলেছি। ম্যারাথন রেস শুরু করে দিলাম নিজের সাথে...ব্রাশে পেষ্ট নিয়ে বাথরুমে ভোঁ দৌড়। মনে সুখে দাঁত ঘষে ট্যাপের পানি ছেড়ে মুখে দিতেই...পাকস্থলী থেকে যাবতীয় পাচক রস...আধা হজম খাবার বের হয়ে আসার উপক্রম...কারণ কিছুই না ওয়াসার পানিতে ‘গু’ এর গন্ধ। এবার ঘরে ফিরে আগের দিনের ধরা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললাম।

মনে মনে বাড়িওয়ালার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তার দরজা নক করে বললাম, ‘বাবাজি, কি অবস্থ্যা পানির বলতো ? এভাবে কি জীবন চলে? বাড়িওয়ালা অন্তত চামার না...সে বলল, ‘কাকা, সরি...ওয়াসার লাইন আর সেফটি ট্যাংকের লাইন এক করে দিয়ে গেছে রাস্তা খোড়ার সময়...আজকে ছুটির দিন তাই কাজ করাইতে পারি নাই...কালকে আসবে’। রুমে ফিরে আসলাম...বিদ্যুৎ আসছে। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসে...যায়না। কবে থেকে শুনছি পাবনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হচ্ছে...আমাদের দেশে আর বিদ্যুৎ যাবে না...আমরা মনের আনন্দে ঘরের পাখা আর লাইট জালায় রাখতে পারবো...ভাবতে ভাবতেই আবার আমাদের পরম অতিথী বিদ্যুৎ সাহেব চলে গেলেন। জানালা খুলে দিলাম...এবং বাইরে থেকে প্যারিসের সুগন্ধী হাওয়া আরেকবার আমার পাচক রস বের করার উপক্রম করলো...আমার জানালার একটু দুরেই সিটি কর্পোরেশনের ডাষ্টবিন...সেখানে কাক...কুকুর আর ময়লা টোকানি মানুষের বিজয় খুঁজে পাবার ব্যার্থ চেষ্টা।

ঢাকা কে দুই ভাগ কেনো...আশি ভাগ করলেও এই চিত্র পাল্টাবেনা...কারণ এই কথা ভেবে লেখার মাঝেই উপরের কোন এক ফ্লোর থেকে ঝপাস করে ময়লা আবর্জনার পলিথিন কুকুরের গা এর উপর এসে পরল। নেড়ি কুকুরের মনেও অপমান বোধ আছে...সে উপরের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে গালি দিয়ে যেন বলে দিলো, ‘ফেলাবি ফেলা...একটু দেখে শুনে ফেলতে পারিস না?’ ল্যাপ্টপে যা চার্য আছে তাই দিয়েই আমাকে একটা মেইল পাঠাতে হবে...দ্রুত। আমি মডেম সেট করে...ব্রাউজারে জিমেইল এড্ড্রেস লিখে ইন্টার দিলাম...শুরু হয়ে গেলো ডিজিটাল বাংলাদেশের সবুজ চাকা ঘোরার খেলা। এই চাকা একবার ঘোরা শুরু করলে আর থামতে চায়না। আমি মিনিট দুয়েক দেখে চা বানাতে চলে গেলাম রান্নাঘরে।

চা বানালাম...তিন নাম্বার আটা দিয়ে তৈরি বেকারী থেকে কেনা পাউরুটি সেঁকে পবিত্র করে ঘরে ফিরে দেখলাম জিমেইল পেজের অর্ধেকটা উকি দিয়েছে...আর বাকি অর্ধেকের নিচে লেখা, ‘ দ্যা পেজ ক্যান নট বি ডিসপ্লেইড’... ‘আলো আসবেই’। ‘আল্ হামদুলিল্লাহ্’ ক্লিক করার দশ মিনিট পরে অর্ধেক আলো তো আসছে...এটাই বা কম কি?। গুলিস্থান থেকে বাসে উঠব। শিকড়ের উঠে যাব আগারগাও। ধীর গতির বাসে হঠাৎ দুইজনের মাঝে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো...সেইখান থেকে হাতাহাতি...চৌদ্দগুষ্টি থেকে মা-খালা কেউ রেপ্ড হবার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না মুখেমুখে।

আমরা আমজনতা দেখছি বিজয়ের দিনে দুই বাংলাদেশীর মাঝে কে জিতে সেই খেলা...বাইরে মাইকে সাবিনা ম্যাডামের ভুবন বিজয়ী গান ‘সব কটা জানালা খুলে দাওনা...আমি গাইবো গাইবো...বিজয়েরই গান’। সাবিনা ইয়াসমিন আগে জানলে এই গান বোধহয় গাইতেন না। বাস থেমে যায় কোন এক ষ্টপেজে...একদল গূড়াগাড়া বাচ্চার দল বাবা মা সহ বাসে উঠে পরে...মুখে তাদের বাংলাদেশের পতাকা আঁকা। আমি একজন কে জিজ্ঞাসা করি, ‘আম্মু বলতো আজকে কিসের দিন?’...বাংলাদেশের এই কান্ডারি আমার কথা বুঝতে না পেরে মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় থাকে। তার লাস্যময়ী মা আমাকে লাজুক মুখে বলেন, ‘চাচা,ইংলিশ মিডিয়াম তো...বাংলা বুঝে না...আপনি ইংলিশে বলেন ও এন্সার দেবে’।

অগত্য আমি তাকে ইংলিশেই প্রশ্ন করি...এবং সেই বাচ্চা উত্তর দেয়, ‘টু ডে ইজ ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’। আমি অবাক...আর তার মা লজ্জিত। সন্দেহ হলো...আজকে সেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জাতীয় পতাকা উঠেছে তো?’ আগারগাও নেমে হেটে হেটে আমার গন্তব্য জিয়া-চন্দ্রিমা উদ্দ্যান...(দুইটা নামই দিলাম...একটা দিলে আরেক পক্ষ নাখোশ হবে)। ঘুরে ঘুরে দেখতেছি সব... লেকের পাশে লাল সবুজ পাঞ্জাবী পরা ছেলে আর লাল সবুজ সেলোয়ার কামিজ বা বিভিন্ন বাহারী পোষাক পরা মেয়েদের অপার স্বাধীনতা ভোগ করার চিত্র...(বাংলাদেশ যে স্বাধীন তা এখানেই বোধহয় খানিকটা বুঝা যায়। কোন এক বছর খুব ভোর বেলাতে পৌছে গেছি জাতীয় স্মৃতিসৌধে...কাতারে কাতার বান্দা হাজারের মত পিল পিল করছে মানুষ...কিন্তু ঢুকতে পারছে না কেউ।

আমি আলগোছে নিজের জায়গা করে নিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে। প্রধাণমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতি আসবেন তাই কারো ঢোকার সাধ্য নাই...এমনকি যারা স্বাধীনতা যুধ্যে প্রাণ বাজি রেখে লড়ে হাত-পা খুইয়ে ফেলেছেন...তাদেরও। কনেকনে শীতে এক বৃদ্ধ্যের গায়ে ই পি আর এর সোয়েটার আর তার সামনে পশ্চাৎদেশ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এস এস এফের সদস্য। একটা প্রবাদ শুনেছিলাম... ‘হাসুয়ার থেকে আছাড়ি বড়’। আমাদের সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো পাক্কা দুই ঘন্টা।

পথের মাঝ থেকে একটা গাড়ি ঘ্যাচ করে আমার সামনে এসে ব্রেক করে...আমার কলিজা তখন গলার ভেতরে উঠে আসছে। গাড়ির ভেতর থেকে গলা বের করে মিটমিট করে হাসছে আমার বন্ধু। আমকে এক প্রকার চ্যাংদোলা করে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়...শহর দেখাবে। আমি ওকে বলি ঢাকা শহরের আবার কি দেখাবি...বন্ধু উত্তর দেয়, ‘চল, আজকের চিত্র দেখে আসি’। প্রথমে গেলাম আওয়ামিলীগ অফিসের সামনে...আশেপাশে কয়েক কোটি মাইকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ...বাজছে তো বাজছেই।

আজকে চোর বাটপার...হিন্দু-মুসলীম-বৌদ্ধ্য- খ্রীষ্টান সবাই যেন আওয়ামিলীগার...সবার গায়ে মুজিব কোট...সবাই আজ দেশপ্রেমিক। এরপরে যাত্রার স্থান বি এন পি অফিস...সেখানে চেয়ার পেতে বসে আছেন কিছু নেতা-নেত্রী...আজ তাদের স্বাধীনতা দিবস পালনের জোসে ভাটা পরেছে...মাইকে বাজছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাষণ...যা কিনা আশেপাশের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের আওয়াজে ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে। আজ এই দুই নেতা বেঁচে থাকলে নিশ্চিত এসব কান্ডকারখানা দেখে হাসাহাসি শুরু করে দিতেন...কাজের থেকে আওয়াজ বেশি...উন্নয়নের থেকে মাইক বেশি। বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়েই আমাকে গোপন কাজে যেতে হলো.. গন্তব্য গুলশানের ‘ম্যাঙ্গো’ নামক একটা বিশেষ স্থান। এই স্থানে প্রশাসনের আদরে চলতেছে ‘শিশা’ বাণিজ্য।

নাকমুখ চেপে ভেতরে ঢুকলাম। ওয়েটার বেটা আমাকে দেখে মুচকি হাসি দিলো...এই বয়সেও??? যাই হোক স্বচোখে দেখলাম এই শিশার বাণিজ্য। সব কিছুর পুনর্জাগরণ হতে নাই...আমার বাপ দাদা যেই হুক্কা টানতেন সেই হুক্কা দিয়ে বিষ খাচ্ছে আমার বয়সের তিনভাগের একভাগ বয়সের ছেলেমেয়ে। এত লেখালেখি...তবুও কোন ফায়দা নেই। অদ্ভুত সব গোলমেলে পোষাকের এয়ারন্ডিশন্ড আবহাওয়ায় মানুষ হওয়া বড়লোকের আদিম সন্তানেরা টানছেন শিশা।

একজন তার বন্ধুকে মোবাইলে জানাচ্ছে, ‘আর বলিস না ডুড, মম কে বলেছি স্মৃতিসৌধে যাব...মম খুশি হয়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছে...সকাল থেকে টানতেছি...উমম!!!’...তার বগল দাবা করা আরেক লাস্যময়ী যুবতী। বিকাল পার হয়ে সাঁঝের দেখা দিচ্ছে...আমি দাঁড়িয়ে আছি ফার্মগেটে...বাস ধরতে হবে। ট্রাফিক সার্জেন্ট হাত ইশারায় আট নম্বর বাস দাড় করায়... বাস চালাচ্ছে এক চেঙরা বালক। ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতে কিছু মাসোহারা গুজে দিয়ে চালক ছুটে যায় একপাল হাস-মুরগী সমতুল্য মানুষ নিয়ে...জীবনের মুল্য যেখানে ‘বিশ হাজার টাকা’...!!!!। বাসে যেতে যেতে একটা আধা ছেড়া পত্রিকা পেয়ে হাতে তুলে নেই...সেখানে আশরাফুলের শরীর আছে মাথা নেই...সাকিবের ব্যাট আছে হাত নেই...তামিমের মাথার পাশে অশ্রাব্য গালি।

মনে মনে ভাবি এত সময় এই চলতি পথে মানুষ কিভাবে পায়? একজন লিখেছে...রাজাকারদের সাথে এদেরও বিচার হওয়া দরকার...বিজয়ের মাসে পাকিস্থানের লগে ক্যামনে হারলি? আমার খুব ক্রিকেটার হয়ে যেতে মন চাইলো...যেন মাঠে নেমে ব্যাট চালিয়ে গোটা চারেক চারশ মারতাম...তবুও যদি এই বাচ্চারা একটু রেহাই পেত। যে ঘরের বাবা মাতাল...সে ঘরের সন্তান বেপরোয়া...আমাদের কে এই সত্যটা জানতে হবে আগে। রাত যা হয়ে গেলো তাতে বাজারে ভেজাল কিছুও পাব কিনা জানিনা। আপনাদের চাচি আমাকে কেটে রান্না করবে যদি বাজার থেকে কিছু না নিয়ে যাই। অর্ধাঙ্গীর ডরে অগত্য বাজারে গমন।

সকালের বেগুন বাঁকা হয়ে গেছে কারো বাজারের ব্যাগে ঢুকতে পারেনাই এই অভিমাণে... শাবনুরের মত চিকন মরিচ আরো বাসী হয়ে হয়েছে পেনোলপি ক্রজের মত...দাম কিন্তু টম ক্রুজের পাতের একবেলা খাবারের সমান মুল্যেরই। কিনে ফেলি তাড়াতাড়ি। মাংস কিনবো না আজকে...মাছ নিতে হবে। মাছওয়ালার কাছে যেতেই ব্যাটা একটা জব্বর হাসি দিয়ে বলল, ‘লন চাচা, এক্কেরে ফেরেশ’। আমি বললাম, ‘বাজান, একটা সত্যি কথা আজকে বলবা? আজ তো বিশেষ দিন’।

তার ‘বলেন’ কথা শুনে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ ফরমালিন দিছো মাছে?’। মাছওয়ালা বাজার কাঁপানো হাসি দিয়ে বলল, ‘কাকা যে কি কন আর না কন...এই ঢাকা টাউনে যত লোক তার চাহিদা কি রোজ রোজ মেটানো সম্ভব?...আমগো পরধান মন্তিরিও ফরমালিন দেয়া মাছ খায়...হেই বেডি যদি বাইচ্চা দেশটারে বেইচ্চা খায়... তো আপনে পারবেন না ক্যান?’ আমি বলি, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী না... আমি গেদু মিয়া...আমার দেশ বেইচা খাওয়ার ইচ্ছা নাই...লাগব না তোমার মাছ’। আমি হাটা শুরু করি...পেছনে এতক্ষণ ভদ্র সেঁজে থাকা মাছওয়ালার রাগি কন্ঠের হুংকার, ‘...পুলা, আবার যদি আইছোশ...তরে জুতা দিয়া বাইরামু’। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরীক আমি মান ইজ্জতের ভয়ে হাঁটার গতি বাড়ায় দেই। আমি কি বিজয় দেখেছি...?? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.