আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পার্বত্য ‘শান্তি’চুক্তি একটা ‘আত্মসমর্পণের দলিল’--- ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা

বৃষ্টি যেরকম আসতে আসতে ফিরে যায়..তেমনি বৃষ্টির মতো আমিও ফিরেছি বহুবার... ‘আজ থেকে ১৪ বছর আগে জনসংহতি এবং সরকারের মধ্যে যে চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। আসলে আমরা তখনই বলেছিলাম,পাহাড়ী জনগণ তেমন উপকৃত হবেনা। এই চুক্তি একটি কাগুজে চুক্তি,এই চুক্তি একটা ‘আত্মসমর্পণের দলিল’। এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রত্যাশা করেছিলো পাহাড়ে শান্তি আসবে,আমরা ভিটেমাটি ফিরে পাবো,সামরিক শাসন প্রত্যাহার হবে,রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যে লক্ষাধিক মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্মানজনক পূনর্বাসন করা হবে ,মানুষ যে প্রত্যাশা করেছিলো তার কিছুই হয়নি। ’ সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এইসব কথা বলেছেন রাঙামাটিতে ইউপিডিএফ এর মুখপাত্র এবং গনতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক মাইকেল চাকমা।

বুধবার রাঙামাটি শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের কুতুকছড়ি বাজারে পার্বত্য চুক্তি এবং পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এইসব কথা বলেন তিনি। এইসময় তিনি আরো বলেন- এই চুক্তির মাধ্যমে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা উপকৃত হয়েছে। তাদের সদস্যরা বিভিন্নভাবে পূনর্বাসিত হলেও,চাকুরীও ফিরে পাওয়া,আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে তাদের চাকুরী,বেতনভাতা সরকারী সুবিধা দেয়া হয়,এমনকি পুলিশেও তাদের নেয়া হয়। কিন্তু সাধারন মানুষ কোনভাবেই উপকৃত হয়নি। নিজেদেরে চুক্তিবিরোধী পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন-‘চুক্তিবিরোধী বলতে আমাদের অবস্থান খুবই পরিস্কার।

এটিকে আমরা একটি অসম্পূর্ণ চুক্তি মনে করি। আমরা পাহাড়ীদের যে অধিকারের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেছিলাম,সেই অধিকারের কোনকিছুই এই চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়নি। একটা আত্মসমর্পণের দলিল ছাড়া এটি আর কিছু না। সন্তু লারমার জনসংহতির সদস্যরা কিভাবে আতত্মসমপর্ণ করবে,কিভাবে তাদের পূনর্বাসন করা হবে, কি কি সুৃযোগ সুবিধা তারা পাবে তা স্পষ্টভাবে লেখা থাকলেও বিরাজমান ভূমি সমস্যা, সেনা শাসন কিভাবে প্রত্যাহার হবে সেই সম্পর্কে চুক্তিতে কিছুই লেখা হয়নি। পার্বত্য সমস্যার সমাধান কোন পথে’-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘সরকারের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট দাবীনামা আছে।

২০০৬ সালে ঢাকায় আমাদের পার্টির কংগ্রেসে আমরা সরকারের কাছে এই দাবীনামা এবং ইশতেহার পেশ করেছি,সেই প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আর চুক্তির বাইরে,সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে,হতে পারে সেটা আরেকটা চুক্তি,যেহেতু এই চুক্তি একটি অসম্পূর্ণ চুক্তি। আরেকটা চুক্তি অথবা সেইরকম আরেকটা কিছু এবং সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমেই পাহাড়ের রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘এটি অনেক পুরনো ইস্যু। এ বিষয়ে আমরা অনেক বক্তব্য দিয়েছি।

এটা শুরু হয় চুক্তির পর ১৯৯৮ সালে কুসুমপ্রিয়-প্রদীপলালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। সেই সময় খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লতিবান নামক এলাকায় সন্তু লারমার নির্দেশে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কুসুমপ্রিয় সেই সময় চেয়ারশ্যান ছিলেন। এবং তারা সন্তু লারমার সাথে সাক্ষাত শেষেই ফিরছিলেন। সেই সময় আমরা সরকারকে এইসব খুন খারাবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছিলাম।

কিন্তু সরকার আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। এরপর থেকে সন্তু লারমারা একের পর এক আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের হত্যার রাজনীতি শুরু করলো। আমরা তাদের কাছে বারবার এই সংঘাত বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আমরা এটা(সংঘাত) চাইনি। সরকার এবং সন্তু লারমা এই সংঘাতের জন্য দায়ী।

সাধারন মানুষ সংঘাত চায়না,তারা গত ১১ ও ১৮ নভেম্বর গণবিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ,গনপ্রার্থণা করেছে। জনগণের যে ঐক্যর ডাক তার সাথে আমরা একাত্মতা ঘোষনা করেছি। জনসংহতি এবং ইউপিডিএফ এর বিরোধে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সাক্ষরের পর নিজেদের ২০৯ জন নেতাকর্মী নিহত এবং প্রায় ৫ শতাধিক অপহরণের শিকার হয়েছে বলে দাবী করে তিনি বলেন-এদের সবার নাম ঠিকানাসহ বিস্তারিত পরিচয় ও তথ্য আমাদের কাছে আছে। পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকহারে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে এই ইউপিডিএফ নেতা বলেন-‘পাহাড়ে যে চাঁদাবাজি হয়,এটা বিভিন্নভাবে বিভিন্নসময় অভিযোগ করা হয়। তবে এটা অপ্রমাণিত।

চাঁদাবাজির বিষয়টি বলা হয়,কিন্তু প্রমাণ কেউ দিতে পারেনা। তাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘অবৈধ অস্ত্র তো বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আছে। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে অনেকেই ঘুরাফেরা করে। এইসব ভিত্তিহীন অভিযোগ জনসংহতি করে বলে দাবী করে করে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন-‘সন্তু লারমাদের বিরুদ্ধে যদি আমরা একই অভিযোগ করি,তারা কি বলবে?’ পার্বত্য চুক্তি নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে তিনি বলেন- ‘সত্যিকার অর্থে আমাদের চুক্তিবিরোধী বলা ঠিক না। আসলে আমরা চুক্তির বিপক্ষে নই।

মিডিয়া শুরু থেকেই আমাদের চুক্তি বিরোধী দল বলে প্রচার করছে। আমরা চুক্তিকে সমালোচনা করি এবং এই চুক্তিকে আমরা প্রত্যাখ্যাান করেছি এটা ঠিক,কারণ এই চুক্তিতে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে,যেটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। এই চুক্তিকে আমরা প্রথ্যাখান করেছি কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা বাধা দেইনি। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা কোনসময় কোনদিন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আমরা দেবোনা,এমন কথাও বলিনি। সরকার যদি বাস্তবায়ন করতে চায়,জনসংহতি সমিতি যদি চুক্তি বাস্তবায়নে কর্মসূচী ঘোষণা করে তবে আমরা তাদের সহযোগিতা করব।

সংবিধানে ‘আদিবাসী’ না ‘জাতিসত্ত্বা’র স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘সংবিধানে আমাদের স্বীকৃতি না দিয়ে যে অবমাননা করা হয়েছে এর জন্য সন্তু লারমারা দায়ী। কারণ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির শুরুতেই নিজেকে ‘উপজাতি’ হিসেবে মেনে নিয়েই তিনি চুক্তিতে সাক্ষর করেছেন। এখন তিনি যে ‘আদিবাসী, দাবী করে সভা সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন,তা কেবলমাত্র লোক দেখানো। এই বিষয়ে জোরালো আন্দোলন করার নৈতিক ভিত্তি তার নেই। তথাপি আমাদের দাবী আমরা জাতিসত্তার স্বীকৃতি চাই।

জাতিসত্বার স্বীকৃতি দিলেই একজন চাকমা,একজন মারমা তার নিজ নিজ জাতিগত পরিচয় এবং অস্তিত্বের স্বীকৃতি পাবে। ‘আদিবাসী’নয় জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সন্তু লারমার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য সন্তু লারমা আমাদের দায়ী করেন। বিগত কয়েক বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে তিনি কোন কর্মসূচী দেননি। ঢাকা এবং বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য,বিবৃতি দেয়া ছাড়া তিনি কিছুই করেননি।

আর চুক্তির মধ্যে যদি ভালো কিছু থেকে থাকলে সন্তু লারমা এবং সরকারের উচিত চুক্তি বাস্তবায়ন করে দেখানো। জনসংগতি সমিতি এবং ইউপিডিএফ এর ঐক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘ঐক্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সন্তু লারমাদের সাথে ২০০০ সালে,২০০৬ সালে এবং এর মাঝে একবার ঐক্যের ব্যাপারে আমরা বৈঠক করেছি। এই ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছিলো। গনতান্ত্রিকভাবে যে যার মতো আন্দোলন করে যাবে,এমন সিদ্ধান্তই ছিলো চুক্তিতে।

কিন্তু সন্তু লারমারাই সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তবুও আমরা এখনো ঐক্য চাই। জাতির বৃহত্তর সাথে মতপার্থক্যকে পেছনে ফেলে আামাদেরকে আলোচনার মাধ্যমে একটা চুক্তিতে উপনীত হওয়ার দরকার,আমরা ঐক্যের আহ্বান জানাই। এটা বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি,মানবাধিকারকর্মী, সমাজের বিশিষ্টজনরা অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসেই আমরা সমস্যাটির নিরসন চাই। চাকমা সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায় ঐক্য প্রক্রিয়া উদ্যোগ নিলে সাড়া দিবেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-‘ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।

রাজা দেবাশীষ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নয়,তবে সামগ্রিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তাই কেবল দেবাশীষ রায় নয়,যে কেউ এগিয়ে এসে উদ্যোগ নিতে পারে। সেটা দেবাশীষ রায় হোক,গৌতম দেওয়ান হোক আর মানিকলাল দেওয়ান হোক আমরা স্বাগত জানাই। একজন সাধারন মানুষও যদি আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলেও আমরা তাকে এবং তার উদ্যোগকে স্বাগত জানাবো। পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন-‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টি।

এরা সবাই পার্বত্য ইস্যূতে নীতি ও কৌশল একই দৃষ্টিভঙ্গীতেই নীতি নির্ধ্রান করে থাকে। পাহাড়ের প্রতিবাদ,প্রতিরোধ যারা করছে,যারা ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার, যারা প্রতিবাদী হয়ে কথা বলে তাদের দুর্বল করে দিয়ে,কিছু লোক নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়া। কিছু সংখ্যক লোক ভাগিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলানো। সব সরকারের আমলে কিছু পাহাড়ী বিএনপিঅলা,আওয়ামী লীগ অলাকে দেখা যায়,যারা সরকারী নীতির পক্ষের কথা বলে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক স্বায়ত্ত্বাশাসিত অঞ্চল হিসেবে নিজেদের দাবী প্রসঙ্গে এই নেতা বলেন-পূর্ণূ স্বায়ত্তশাসন হচ্ছে অর্থ,পররাষ্ট্র,ভারিশিল্প ছাড়া বাকী সবগুলো বিষয় স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে থাকবে,যা চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত সরকার ব্যবস্থা এবং যেটি স্বায়ত্তশাসিত হবে।

এর জন্য সংবিধানকে সংশোধন করে নিতে হবে। সরকার আন্তরিক হলে সরকার সংবিধান সংশোধন করে সমস্যার সমাধান করতে পারে কারণ বর্তমান সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন পদ্ধতিটি নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন নজির আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ভেতরে থেকেই রাজনৈতিক স্বশাসনের অধিকার পেতে চান মন্তব্য করে তিনি বলেন- ‘আমাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ বিচ্চিন্নভাবে কেউ কেউ বললেও কেউ এই অভিযোগ সামনে আনার সাহস পায়নি। আমরা গনতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন করছি।

সরকার আমাদের বাধ্য করছে ভিন্ন কিছু চিন্তা করতে। আমাদের অফিস বা কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। শত বাধার মুখেও আমরা গনতান্ত্রিকভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। জনসংহতি সমিতির কোন নেতাকর্মী হত্যার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে তিনি বলেন-তারা (জনসংহতি) কিসের ভিত্তিতে অভিযোগ করে জানিনা। তারা কল্পনা প্রসূত অভিযোগ করে ।

এইসব তাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ । তারা জনগণের উপর নানাভাবে নিপীড়ন করায়,জনগণের পাল্টা প্রতিরোধে তাদের ক্ষতি বা কেউ মারাও যেতে পারে। এর জন্য আমরা সাংগঠনিকভাবে দায়ী নই। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.