আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালো কাপড়ে বেঁধে দিলাম কবিতার মুখ

কেবলই নিজেকে খুঁজছি বিচ্ছেদের প্রথম যাতনা, শীতল উত্তরে হাওয়া আমার ভেতরে বয়ে গিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়। বাবা যখন ঠাকুরগাঁও থেকে বদলি হয়ে রাজবাড়ী চলে এলো। তখন তার সাথে আমাদেরও চলে আসতে হয় গ্রামে। ঠাকুরগাঁও এর মানুষদের ছেড়ে আসতে হাহাকার জেগেছিল ছোট্ট মনের ভেতরে। ট্রেনের জানলায় বসে নীরবে কেঁদেছিলাম।

সেই স্মৃতি এখনও তাজা। এরপর গ্রামে ফিরে এসে নতুন ভাবে শুরু হয়েছে জীবন। অনেকের আদর-ভালবাসা পেয়েছি গ্রামে। হঠাৎ-ই ৯২ এর সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়। সেই হামলা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের গ্রাম স্পর্শ করেনি।

কিন্তু করেছে পরোক্ষে। একদিন রাতে শুনি এক প্রতিবেশি পরিবার ভারতে চলে যাবে। যাদের ভালবাসা পয়ে বড় হচ্ছিলাম তেমনই একটি পরিবার। চলে গেল। আবার যাতনার শীতল হাওয়া বইলো ভেতরে।

নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে মানুষ এভাবে চলে যায় এর আগে এমন ঘটনার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। সেই প্রথম। সেই শুরু। এরপর দেখি এ বাড়ি থেকে কেউ চলে যায়, ও বাড়ি কেউ থেকে চলে যায়। একটা জমজমাট ভরাট পাড়ায় এলাম।

আর অমনি পাড়া শূন্য হতে থাকলো। প্রতিবেশিদের শূন্য ভিটের দিকে তাকাই আর ভেতরে খোদাই হয় বেদনার কীলকলিপি। একদিন কুয়াশা জড়ানো ভোরবেলা মানুষের কোলাহল-আর কাঁন্নায় ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম জড়ানো চোখে বাইরে এসে দেখি এক প্রতিবেশী পরিবার চলে যাচ্ছে ভারতে। শেষ বিদায় নিতে এসেছে।

অন্যদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কদিন আগেও যার ছেলের সাথে মারমারি করে মুখ-নাক ফেঁড়ে ফেলেছি। সেই ক্ষত তখনও শুকোয়নি। সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কাকারে জন্মের মতো চলে গেলাম। ভাল থাকিস তোরা।

’ ছোট্ট বুকের ভেতর তখন কি হয়! কি খেলা চলে! ওরা চলে গেল গাট্টি-বোচকা নিয়ে। আমার কেবল বলতে ইচ্ছে হলো, মেরে আমার নাক-মুখ আরও ক্ষত-বিক্ষত করে দে। তবু তোরা এদেশেই থাক। চলে গেছে ওরা। আর দেখা হয়নি।

বিকাশ। আমার গোপন ব্যথার নাম। আমার ছেলেবেলার বন্ধুর নাম। চৈত্রের দাবদাহে ফেঁটে চৌচির হওয়া দুই কিলোমিটার মাঠ, বর্ষায় এক হাঁটু জল কাঁদা ভেঙে দুই কিলোমিটার মাঠ পেরিয়ে স্কুলে আসতো বিকাশ। ওদের গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামে আসার কোন রাস্তা ছিল না।

তাই এই কষ্ট স্বীকার করেই ওকে স্কুলে আসতে হতো। ছোট্ট বেটে শরীর। কিন্তু খুব মজবুত গঠন। অসাধারণ ফুটবল খেলতো। দূরন্ত গতিতে ছুটতো বল নিয়ে।

ক্লাস সিক্স এ উঠে আমরা স্কুলের ফুলবল দলে নির্বাচিত হয়ে ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না শারীরিক ক্ষুদ্রতার কারণে। নাইন-টেনের ছেলেরাই খেলতো। সেখানে আমাদের বন্ধু ক্লাস সিক্সেই দলের প্রধান খেলোয়ার। আমাদের গর্বের শেষ নেই! হঠাৎ একদিন বিকাশ স্কুলে এসে জানালো, 'আমারা ভারতে চলে যাব। ' শোক নেমে এলো আমাদের মধ্যে।

ওদের গ্রামে মাত্র দুটো হিন্দু পরিবার। কেন ওরা ভারতে চলে যাবে তা আমাদের বলতো। আমরা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। রাগও হতো কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না। ক’দিন পরই দেখি বিকাশ আর স্কুলে আসছে না।

বাজারে গিয়ে দেখি ওর কাকার দোকানে অন্য লোক বসে পণ্য বিক্রি করছে। ছোট্ট বুকটা হাহাকার করে উঠলো। অভিমানও হলো বিকাশের উপর। যাবার বেলায় একবার শেষ বিদায় নিয়ে যাবি না! ভেতরে হাহাকার নিয়েই বাজার থেকে ফিরলাম নীরবে কাঁদতে কাঁদতে। এরপর চলে গেছে বছরের পর বছর।

কিন্তু বিকাশকে হারানোর বেদনা মুছে যায়নি। বরং ভেতরের কোন গোপন কুঠিরে লালিত হয়েছে। সেই অনুভূতি নিয়েই ২০০৮ সালে বিকাশকে নিয়ে লিখি কবিতা- ‘এখন কি সুখে আছিস, বিকাশ?’ একটি মুসলমান পাড়ায় তোদের বাড়ি ছিল এক প্রভাবশালী ধর্মান্ধ মুসলমান পরিবারের লোকেরা রাতের বেলা তোদের বাড়ির টিনের চালে ঢিল ছুঁড়তো তাদের কাছে বাড়ি বিক্রি করার জন্য হুমকি দিত তোর বাবাকে। তোদের বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠে গরু জবাই করতো কারণে-অকারণে তোদেরকে ভয়-ভীতি দেখাতো। তোরা অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাগে-ক্ষোভে, কষ্টে-অভিমানে আপন ভিটে-মাটি, তুলসীতলা, পূর্বপুরুষের স্মৃতি- দেশ ছেড়ে সপরিবারে চলে গেলি ভারতে।

একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার আশায় একটু সুখের আশায়! এখন কি সুখে আছিস, বিকাশ? এখন তো বোধহয় তোদের বাড়িতে কেউ ঢিল ছোঁড়ে না তোদের বাড়ির সামনে গরু জবাই করে না এখন তো কেউ তোকে মালাউন বলে গালি দেয় না ধর্ম-বিদ্বেষী ওয়াজ শুনতে হয় না। এখন উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে অভ্যস্ত তোরা তোদের বাতাসে ভাসে ধুপের গন্ধ পূঁজা-পার্বণে মেতে থাকিস সারাবছর। এখন কি ওখানে কেবলই সুখের বন্যা! কোন কষ্ট নেই? ক্ষুধা, দারিদ্র, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ এই শব্দগুলো কি নিজস্ব ধর্ম-পরিচয় ভুলে আছে ওখানে! গোটা পৃথিবীটাই যখন এই শব্দগুলোর সামনে অসহায়ভাবে মাথা নত করে আছে তখন সত্যিই জানতে ইচ্ছে হয় এখন কি সুখে আছিস, বিকাশ? আজ ২০১৩ সালে এসে এই কবিতাটির মুখে কালো কাপড় বেঁধে, বিকাশের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লিখতে হচ্ছে নতুন কবিতা-‘তোরা সুখেই আছিস বিকাশ’ ‘তোরা সুখেই আছিস বিকাশ দেবতার বদ্ধভুমিতে এখনও এখানে চোখের জল ফেলতে হয়। গয়ায় পিন্ডি দেবে বলে রেখে দেওয়া পিতার দেহভষ্ম দ্বিতীয়বার পুড়ে রাশি রাশি ভষ্মে মিশে যায় এখানে। এখানে রক্তের স্রোতে ভেসে যায় সিঁথির সিঁদূর।

তোরা সুখেই আছিস। সুখেই থাক বিশ্বাস। ’ এই রাষ্ট্র এখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সেই চেষ্টাও করেনি। এখনও করছে না।

দিনে দিনে সাম্প্রদায়িক শক্তি পৌঁছে যাচ্ছে তাদের অভীষ্ট লক্ষে। হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। তাদের সেই ‘হিন্দু মুক্ত বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন কি খুব বেশি দূরে? আর কয়েকটি নির্বাচন-আর কয়েকবার জামায়াত-বি,এন,পি’র সরকার গঠন। তারপর আদমশুমারী-ই দেবে এই প্রশ্নের উত্তর। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.