আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনকে

সমাজকর্মী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর চলে গেলেন ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন। রাজধানীর পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে সকাল ১১টার দিকে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সংগ্রামী এই সৈনিকের প্রতি। শিল্পীর সংগ্রামী জীবনগাথাঃ ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর চাঁদপুরে। বাবা মজিদ বক্স (ধনু মিয়া)।

তিনি ছিলেন চাকুরিজীবী। চাঁদপুরে 'চিটাগাং জুট মিল'-এ কাজ করতেন। মা সাবেদুন নেসা ছিলেন গৃহিনী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ইমদাদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে চারদিকে প্রচন্ড অভাব-অনটন শুরু হয়ে যায়।

ইমদাদের বাবাও আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হন। ইমদাদ হোসেন তখন পরিবারের কথা বিবেচনা করে কিছুদিন পাটকলে ম্যাকানিক্যাল ওয়ার্কসপ-এ চাকুরি করেন। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর আরো একটু বেশি উপার্জনের আশায় ১৯৪৪ সালে তিনি কাশিপুর গান ও শেল ফ্যাক্টরিতে আর্টিসান হিসেবে চাকুরি নেন। ১৯৪৬ সালে সারা পূর্ববঙ্গ জুড়ে শুরু হয় প্রচন্ড দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এসময় তিনি রেডিও মেকানিজম শেখার জন্য দিল্লী চলে যান।

ইমদাদের মেজভাই তখন দিল্লীতে থাকতেন। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার মধ্যেই তিনি ১২ আগষ্ট দিল্লী থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৪ আগষ্ট দেশ স্বাধীন হয়। তার দু'সপ্তাহ পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথমদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দেশব্যাপী আনসার বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

এটি এখানকার আনসার বাহিনীর মতো ছিল না। ছিল স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের সংগঠন। ইমদাদ নিজে ছিলেন প্রচন্ড সাহসী। ফলে তিনি কেরাণীগঞ্জ আনসার বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি খুবই সফলভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন।

ফলে সেসময় তাঁকে সরকার থেকে একটি বন্দুকও দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালে ইমদাদ হোসেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আর্ট কলেজে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। প্রথম ব্যাচে ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র পনের জন। সেসময় তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রাহমান, শামসুল কাদির, মকসুদুস সালেহীন, খালেদ চৌধুরী, আবদুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে যে ড্রয়িং ক্লাসগুলি হতো তাতে অধিকাংশ ছাত্রেরই প্রাণ ভরতো না।

এর উপর প্রতিদিন এতো দূর থেকে যাওয়া-আসা ছিল কষ্টকর। ফলে ইমদাদ হোসেন একেবারেই ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তী বছর আগের অনেকের সঙ্গে তিনি আবার ভর্তি হলেন প্রথম বর্ষে। ফলে ইন্সটিটিউটে তিনি দুই ব্যাচেই বন্ধু পেয়েছিলেন। ততদিনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন করাচী থেকে এসে স্থায়ী অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

তাঁকে পেয়ে ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের প্রাণ ফিরে এল। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গার বিরুদ্ধে শান্তি ও পুনর্বসতি কমিটির উদ্যোগে "পূর্ববঙ্গ রুখিয়া দাঁড়াও" শীর্ষক একটি বিবৃতিতে ৩৭ জন বুদ্ধিজীবী স্বাক্ষর করেন। ইমদাদ হোসেন তখন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্ঘলা বজায় রাখায় জোর উদ্যোগ নেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন-এর ভাষা বিতর্কিত উক্তিতে ছাত্রসমাজ উত্তাল হয়ে উঠে।

এই সময়ই অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের জন্ম হয়। ইমদাদ হোসেন ছিলেন এর অন্যতম গায়ক-সংগঠক। অবশ্য গ্রুপ হিসেবে অগ্রণীর অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। ১৯৫০ সালেই এটি তৈরী হয়। কিন্তু তখন নামকরণ করা হয়নি।

১৯৫২ সালের শেষ সপ্তাহে সঙ্ঘটি 'অগ্রণী' নামে আত্মপ্রকাশ করে। অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের সাথে সেসময় আরো যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন, অজয় রাও বর্মণ, আনন্দ পাল, আব্দুল করিম, বিশ্বনাথ রায় মল্লিক, বদরুল হাসান (কামরুল হাসানের ভাই), মন্টু খান, মাসুদ আলী খান, নাসিম আলী, আব্দুর রাজ্জাক, আবদার রশিদ ও আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দিনসহ আরও অনেকে। এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ঢাকায় ছাত্রদের প্রতিটি মিছিলের সম্মুখ সারিতে ছিলেন ইমদাদ হোসেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ইমদাদ হোসেন ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। তিনি আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন।

২০ ফেব্রুয়ারি সারা রাত তিনি সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়ে পোষ্টার-ব্যানার লেখার কাজ করেন। পরদিন যথারীতি তিনি সমাবেশে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে ২২-২৪ আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। এ অনুষ্ঠানে ইমদাদ হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকা আর্ট গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। ১৯৫৩ সাল থেকে ছাত্রাবস্থাতেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে নানান বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অন্যান্য কাজ করে ইমদাদ হোসেন স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ইমদাদ হোসেন সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল কেরাণীগঞ্জ-ঢাকা ও সাভার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার কাজ চালানো। এসময় তিনি অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের মহড়া, আর্ট ইন্সটিটিউটে লেখাপড়া সব একসঙ্গে চালাতেন। ১৯৫৪ সালে ইমদাদ হোসেন আর্ট ইন্সটিটিউট থেকে পাস করেন। এবং এ বছরই তিনি তাঁরই মামাত বোন মনোয়ারা বেগম বকুলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

এই দম্পতির দুই মেয়ে ও চার ছেলে। ১৯৫৫ সালে কামরুল হাসান তাঁকে Silver Band H. Co. of Newyork নামে একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু চার মাস পর কোম্পানিটি ওঠে যাওয়ায় তিনি বেকার হয়ে পড়েন। এরপর তিনি Usic-এ চাকুরি নেন এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই কাজ করেন। ১৯৬০ সালে EPSIC-এর তদারকিতে এবং ASIA Foundation-এর অর্থায়নে গঠিত East Pakistan Design Centre--এ চাকুরি নেন।

এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। কাইয়ুম চৌধুরী ও ইমদাদ হোসেন হলেন ডিজাইনার। এবং সেখানে পাঁচজন ছিল এসিস্ট্যান্ট। এসময় ইমদাদ হোসেনEPSIC-এর মনোগ্রাম ডিজাইন করেন। এক বছরের মাথায় ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে দিয়ে তিনি USAID Communication & Media Centre-এ আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন।

১৯৬৩ সালে তিনি ইউএস এইড-এর কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এ (Institute Of Education Research) সিনিয়র লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৯-এ উত্তাল গণজোয়ার। ইমদাদ তখন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পূর্ণ নিয়োজিত। তিনি গড়ে তোলেন শিল্পীদের সর্বপ্রথম সংগঠন চারু শিল্পী সংস্থা । ১৯৭০ সালে তিনি শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

একই বছর পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রগতিশীল দল ও সংগঠন মহাসমারোহে পালন করে লেনিন জন্মশতবার্ষিকী। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে ইমদাদ হোসেনর প্রাণের যোগ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী নেতারা তাঁর গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতেন প্রায় সময়ই। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সভা হত তাঁর বাড়িতে। তিনি বুক আগলে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের রক্ষা করতেন, কখনো ঢাকার ভাড়া করা বাড়িতে আবার কখনো বা নিজের গ্রামের বাড়িতে।

কমিউনিস্ট পার্টির গোপন 'সেল'-এর বৈঠকে আমন্ত্রিত হতেন তিনি। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমানে ব্যবহৃত লোগোটি ইমদাদ হোসেনের করা। আর এতে 'বাংলাদেশ টেলিভিশন' লেখাটি মুস্তাফা মনোয়ারের। ১৯৭৪ সালে সারাদেশে জাঁকজমকের সাথে মহান একুশে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সে সময় প্রথম শহীদ মিনারের পেছনে লাল সূর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন করে শহীদ মিনার বিনির্মাণ এবং স্থাপনের পূর্ণ কৃতিত্ব শিল্পী ইমদাদ হোসেন ও সহশিল্পীদের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবুন্ধ হত্যাকান্ডের পর বহু সুবিধাবাদী মানুষের রূপ পাল্টে যায়। প্রচন্ড ব্যাথাহত ইমদাদ হোসেন এতে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন।

১৯৭৬-এ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিটিভির একজন কর্মকর্তা রসিকতা করলে ইমদাদ হোসেন তৎক্ষণাৎ ক্ষোভে-দুঃখে টেলিভিশনের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন। EPSIC ততদিনে BSIC হয়ে গেছে। ইমদাদ হোসেন পুনরায় BSIC-এর ডিজাইন সেন্টারে যোগ দেন। এবং এখান থেকেই ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর থেকে ইমদাদ হোসেন অনুজশিল্পী ফরিদ আহমদের প্রতিষ্ঠান 'কালার স্ক্যান লিমিটেড'-এর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

২০১০ সালে ইমদাদ হোসেনকে শিল্পকলায় একুশে পদক দেওয়া হয়। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।